Merits or Advantages of Dictatorship

একনায়কতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাসমূহ Merits or Advantages of Dictatorship

একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্র ও মানবিকতা বিরোধী স্বৈরশাসন হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু গুণ বা উপযোগিতা রয়েছে। নিম্নে একনায়কতন্ত্রের সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা : একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ গুণ হলো এর মাধ্যমে শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। কেননা, এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সাধারণত একটি মাত্র দল থাকায় এবং বিশেষ কোনো দলীয় কোন্দল না থাকায় সকলের সহযোগিতায় শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যে সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষমতায় আসীন থাকতে পারে। কেননা, কঠোর শাসনের মাধ্যমে একনায়ক প্রাদেশিকতা, আঞ্চলিকতা দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। Dictionary of Political Science-এর ভাষায়, “The dictatorship remains in power for a long time with the help of his party and military, with the result that the government becomes stable.” ২. সরকারের স্থায়িত্ব : একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অপর আর একটি বিশেষ গুণ হলো সরকারের স্থায়িত্বের বিধান গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তন, দল ত্যাগ ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং অনেক সময় সরকারের পতন ঘটে থাকে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একটি মাত্র দল থাকায় সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় না। ফলে সরকার সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা করতে পারে। তাছাড়া একনায়কের লৌহ কঠোর শাসনও একনায়কতন্ত্রের স্থায়িত্ব বিধান করে।

 ৩. দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা : একনায়ককে ক্ষমতা চর্চার জন্য কারও নিকট জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে দীর্ঘদিন  থাকার সুযোগে তার দলীয় ও পছন্দের লোকের সাহায্যে সে দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আর এতে করে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের প্রশাসন হয় দক্ষ এবং সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। ফলে জনগণের ভোগান্তি হ্রাস পায় ।

৪. দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন : একনায়কতন্ত্র যেহেতু একটি স্থায়ী শাসনব্যবস্থা, সেহেতু এতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। কিন্তু ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হলে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা  অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।

৫. বলিষ্ঠ নেতৃত্ব : একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব হয় না। কেননা, এ ব্যবস্থায় দক্ষ নেতার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। যারা জীবনের বিনিময়ে হলেও আদর্শকে বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকেন। হিটলার বলতেন, “আমি যদি সামনে অগ্রসর হই, তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ করবে, যদি পিছনে ফিরি, তাহলে হত্যা করবে এবং যদি মৃত্যুবরণ করি, তাহলে প্রতিশোধ নেবে।” (If I go forward follow me, if I come back kill me and if I die revenge me)। এ বক্তব্য বলিষ্ঠ নেতৃত্রে পরিচায়ক।

৬. জরুরি অবস্থার মোকাবিলা : দেশের সংকটকালীন সময়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন বিশেষ উপযোগী। কেননা, একনায়কের হাতে রাষ্ট্রীয় সর্বময় ক্ষমতা থাকে বিধায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা যুদ্ধ ও অন্য যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে একনায়ক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। স্ট্যালিন (Stalin) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে দৃঢ়ভাবে জার্মানির মোকাবিলা করে এবং হিটলারকে পরাজিত করে রাশিয়াকে রক্ষা করেন। অধ্যাপক ফাইনার বলেন, “এ শাসন দেশের আমূল পরিবর্তনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দ্রুতগতিতে পরিবর্তন সাধন করে।

৭. জাতীয় সংহতি ও ঐক্য : একনায়কতন্ত্রে একটিমাত্র দল ব্যতীত অন্য কোনো দল থাকে না বিধায় এ ব্যবস্থায় দলাদলি, দলীয় অন্তঃকলহ ও দ্বন্দ্ব বিরোধ থাকে না। তাছাড়া একনেতা, একদল, একদেশ— এ প্রচারণা জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করে। জাতীয় সংহতি রক্ষায় একনায়ক “Blood and Iron Policy” অবলম্বন করেন। ফলে আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দানা বেঁধে উঠতে পারে না। ইতালির একনায়ক মুসোলিনী (Mussolini) বলতেন, “আমার উদ্দেশ্য খুব সামান্য— আমি ইতালিকে বড়, সম্মানী ও শক্তিশালী করতে চাই।” (My objective is simple. I want to make Italy great. respected and fearful) 1

৮. দলীয় ত্রুটিমুক্ত : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বহুদলীয় ব্যবস্থা স্বীকৃত থাকে বিধায় দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ লেগেই থাকে। এতে করে সরকারের দৃঢ়তা ও গতিশীলতা হ্রাস পায়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায় সেখানে কোনো দলীয় কোন্দল দেখা দেয় না। ফলে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালিত হয়।

৯. জাতীয়তাবাদ : একনায়কতন্ত্রে জনগণ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। দেশ, জাতি ও একনায়কের দক্ষতার ভিত্তিতে জনগণ দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ হয়। জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হলে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায় । ঐতিহ্যগত জাতীয়তাবাদ ও জাতিতত্ত্বের কারণে জার্মানিতে নাৎসিবাদের ( Nazism) জন্ম হয়। হিটলার জার্মান জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

১০. ব্যয় সংকোচন নীতি : গণতন্ত্র একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। কেননা, গণতন্ত্রে জনগণের সম্পদ ও জীবন রক্ষায় সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে বিধায় সরকার পরিচালনায় বেশি অর্থ ব্যয় হয় না। তাছাড়া এক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় ।

১১. সামাজিক সংস্কার : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একটি সামাজিক সংস্কারমূলক শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থায় শাসকের নির্দেশে সমাজে পরিবর্তন সূচিত হয়। একনায়ক দেশকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার লক্ষ্যে বহুবিধ পরিবর্তন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Gettell-এর ভাষায়, “Dictatorship bring about social reforms in order to make the country strong and to eradicate social the evils through laws and propaganda.”

 

১২. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : একনায়ক কর্তৃক গৃহীত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সঠিক সময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় নিশ্বাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। ফলে দেশের অর্থনীতি হয় সমৃদ্ধ। স্ট্যালিন (Stalin) অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়াকে একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত করেন। হিটলার ও মুসোলিনি শক্তি প্রয়োগ করে কল-কারখানায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পূর্বক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেন। কালোবাজারি, চোরাচালানি ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং সম্পদ বণ্টন নীতিমালা নির্ধারণ করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন ।

৩. শিক্ষা ও যোগ্যতার কদর : একনায়কতন্ত্রে শিক্ষিত, যোগ্য, জ্ঞানী-গুণী ও মেধাবীদের সমাবেশ ঘটে। প্রশাসকরা পেশাদার রাজনীতিবিদদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারেন। জাতীয় পর্যায়ে যোগ্যতার সন্নিবেশ ও বিকাশ সাধিত হয় এবং দক্ষতার সাথে শাসন পরিচালিত হয়। ফলে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

১৪. শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি : একনায়কতন্ত্রে সুফল হলো এখানে জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ ঘটে বিধায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা,

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির প্রসার ও উন্নতি ঘটে। এতে করে শিল্প সাহিত্য চর্চা বৃদ্ধি পায়।

১৫. সহজ-সরল ব্যবস্থা : একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সহজ-সরল ব্যবস্থা। কারণ এ ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ন্যায় কোনো প্রকার জটিল প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় না। এ ধরনের ব্যবস্থায় নির্বাচন, প্রচারণা, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতি অনেকাংশে একদলীয়।

১৬. নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা : একনায়কতন্ত্রের কঠোর শাসনের ফলে জনগণ নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি নিয়মানুবর্তী হয়ে ওঠে। কেননা, এ ব্যবস্থায় অনেক সময় ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সবাইকে সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়। এর ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। জনগণও নির্বিঘ্নে জীবন ধারণ করতে পারে।

১৭. সভ্যতার বিকাশ : অনেক সময় এটা মনে করা হয় যে, একনায়কতন্ত্র অসভ্য জনগোষ্ঠীকে সভ্য সমাজে রূপান্তর করতে পারে। জে. এস. মিলও (J. S. Mill) তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, “অসভ্য লোকদের সভ্য করার জন্য একনায়কতন্ত্র একটি বৈধ সরকার— তবে তাদের মনোভাব হতে হবে তাদের সভ্যকরণ।” লুসিয়ান ডব্লিউ পাই. (Lucian W. Pye ) বলেন, “ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অত্যন্ত অসভ্য জনপদের জন্য এরকম সরকারের অভ্যুদয় ঘটে।”

পরিশেষে একথা বলা যায় যে, একনায়কতন্ত্রের যত গুণের কথাই বলা হোক না কেন বাস্তবে একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী একটি শাসনব্যবস্থা। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় একনায়কতন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে বিশ্ব মানবতাকে মুক্তি প্রদান করলেও আজও কোনো কোনো দেশ এধরনের অপশাসন থেকে মুক্ত হয়নি। তবে বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান মেরুকরণ গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছে।

Leave a Reply