একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Dictatorship
একনায়কতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা হতে পারে এক ব্যক্তির, এক দলের বা এক শ্রেণির অথবা তাদের সমর্থিত শাসনব্যবস্থা। একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা, স্বরূপ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে ।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফাইনার একনায়কতন্ত্রের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন । যথা :
১. প্রচারণার ব্যাপক প্রয়োগ;
২. একদলীয় ব্যবস্থা;
৩. নামমাত্র ও নিয়ন্ত্রিত আইনসভা; এবং ৪. ক্ষমতার ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ ।
(Source: Theory and Practice of Modern Government)
অটো স্ট্যামার একনায়কতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা : স্বৈরাচারি ও একচেটিয়া ক্ষমতার প্রয়োগ, সাংবিধানিক ব্যবস্থার অবলুপ্তি, নাগরিকদের পৌর ও অন্যান্য অধিকারের অবলুপ্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভাবাবেগতাড়িত ও অন্যান্য মনোভাবের প্রাধান্য এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে স্বৈরাচারি পদ্ধতি।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রেক্ষিতে একনায়কতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. একদলীয় শাসন : একনায়কতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একদলীয় শাসনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের প্রাধান্য থাকে এবং দেশের সার্বিক ক্ষমতা এককভাবে করায়ত্ত করে। এ ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল অন্য কোনো দলের অস্তি ত্ব স্বীকার করতে চায় না। জার্মানিতে হিটলারের Nazist party এবং ইতালির মুসোলিনীর Facist party একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২. এক ব্যক্তির শাসন : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মূল ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হয়। তিনি অপরিসীম ক্ষমতার মালিক। তাঁর সম্পাদিত কাজের জন্য তিনি কারো নিকট দায়ী থাকেন না। তাঁর আদেশ ও নির্দেশই হলো সার্বভৌম নির্দেশ। তাকে কেন্দ্র করে পুরো শাসনব্যবস্থা আবর্তিত হয়।
৩. একদলীয় ব্যবস্থা : আধুনিক একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুষ্টিমেয় লোকের সমন্বয়ে একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। এরা অন্য কোনো পক্ষ, দল, বিরোধী দল, মত, পথ নির্মূল করে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে । কেন্দ্রীয় কতিপয় নেতার মাধ্যমে এ দল পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, “Dictatorship is the one party government।” জার্মানিতে হিটলারের Nazist party ও ইটালির মুসোলিনীর Facist party একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৪. সর্বাত্মকবাদ : সর্বাত্মকবাদ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র হলো সর্বশক্তিধর ও সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রই নাগরিক জীবনের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করে। ইতালিয় একনায়ক মুসোলিনীর (Mussolini) ভাষায়, “All within the state none outside the state ।” হেগেলীয় দর্শন মতে, “রাষ্ট্র হলো সর্বাত্মক ও সর্বশক্তিমান, কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।”
৫. রাষ্ট্র ও সরকার অভিন্ন : একনায়কতন্ত্রের বিশেষ দিক হচ্ছে যে, এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সরকার এক ও অভিন্ন। বিশ্বের সেরা একনায়করা নিজেদের সাথে রাষ্ট্রকে অভিন্ন ও একাত্ম করে দেখতেন। যেমন— ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই, হিটলার, মুসোলিনি প্রমুখ। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই (Lui) বলতেন, “I am the state। “
৬. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ : ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। এ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ স্বীকৃত। সকল ক্ষমতা এক ব্যক্তি ও কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশ মোতাবেক সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। ফলে কেন্দ্র একক আধিপত্য বিস্তৃত হয়। যদিও বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আদৌ কাম্য নয়।
৭. . ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম দিক হলো এধরনের ব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। কেননা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারকে এখানে রাষ্ট্রের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ফলে ব্যক্তি জীবনের সকল দিকই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সংবিধান, সংসদ ও অন্যান্য সংস্থার অস্তিত্ব থাকলেও এগুলো মেকীরূপ ধারণ করে। প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেল (Hegell)-এর ভাষায়, “A man is what he is because of the state and he is no what he is without the state.”
৮. দায়িত্বহীনতা : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা, একনায়কতন্ত্রে সরকার জনগণের উপর কর্তৃত্ব খাটায় এবং তারা জনগণের নিকট কোনোভাবেই জবাবদিহিতা করতে চায় না। এমনকি বলপ্রয়োগের মাধ্যমেও একনায়কতান্ত্রিক সরকার জনগণের উপর প্রভাব খাটায়। এক্ষেত্রে সংবিধানের বিধি-নিষেধকেও পুরোপুরি অনুসরণ করা হয় না। ফলে এটি মূলত একটি দায়িত্বহীন শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয় ।
৯. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ : একনায়কতন্ত্রে সব কিছুতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন : কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামরিক অস্ত্রের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব, প্রচারযন্ত্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, সংগঠন ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের প্রধান প্রধান দিক ।
১০. বিরোধী মতামত উপেক্ষা : একনায়কতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক হলো বিরোধী মতামত উপেক্ষা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সকল প্রকার বিরোধিতার অবসানকল্পে ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। শাসকদল মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিরোধী সমালোচনাকে প্রতিহত করে। প্রয়োজনে বিরোধী ও বিদ্রোহী নেতাদেরকে কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় ।
১১. প্রচারযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ : প্রচারযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ একনায়তন্ত্রের অন্যতম দিক। কেননা, এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর সরকারের একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র একনায়কদের গুণকীর্তন ও সফলতা প্রচারে ব্যস্ত থাকে। এসব মাধ্যম সরকার বিরোধী কোনো তথ্য ও মতামত প্রচার করতে চায় না। সংবাদপত্রের কোনো বাকস্বাধীনতা থাকে না ।
১২. দুর্বল আইন ও বিচার বিভাগ : একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, এ ধরনের শাসনব্যবস্থা আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানই হলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর নির্দেশই হলো আইন। এ প্রসঙ্গে অস্টিন (Austin) বলেছেন, “Law is the command of soveriegn।” অর্থাৎ, এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয় বিধায় রাষ্ট্রের এ দুটি বিভাগ দুর্বল হয়ে থাকে। ১৩. বল ও শক্তি প্রয়োগ : একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র বল ও শক্তি প্রয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব রাষ্ট্র শান্তি ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাস করে না। সুযোগ পেলে তারা প্রতিবেশী ও দুর্বল রাষ্ট্রের ভূখণ্ড জোর করে দখল করে নেয়। হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়া, – অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখল করেছিল। মুসোলিনিও ইথিওপিয়া দখল করেছিল।
১৪. নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য : একনায়কতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য। এ ব্যবস্থার নেতার মাহাত্মা জোর গলায় প্রচার করা হয় এবং নেতাকে সর্বশক্তিমান বলে গণ্য করা হয়। নেতাকে বিভিন্ন টাইটেল ও গুণে ভূষিত করা হয়। নেতার যে কোনো প্রকার বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা বলে গণ্য করা হয়।
১৫. উগ্র জাতীয়তাবাদ : একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। একনায়কগণ জ্বালাময়ী ভাষার নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করে জনগণকে অন্য জাতির উপর আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের ফসল হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৬. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের অনুপস্থিতি : একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় অপরিসীম ক্ষমতাধর শাসন বিভাগ একক দলের নেতাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফলে বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ অকেজো হয়ে পড়ে। লোক দেখানো ও ক্ষমতাহীন আইনসভা থাকলেও সেখানে শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণীত হয়। ১৭. গুপ্তচর বাহিনী : ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য একনায়কতন্ত্রে গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর কাজ হচ্ছে জনগণ ও দলের মধ্যে বিরোধিতা ও চক্রান্তের খবর সংগ্রহ এবং হিংসাত্মক পন্থায় তা রোধ করা। যেমন : হিটলারের গেস্টাপো, মুসোলিনীর কালো কোর্তা ইত্যাদি।
১৮. মিথ্যা প্রচারণা : একনায়ক নিজের মত ও পথ চাপিয়ে দিয়ে এবং নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে ব্যাপক মিথ্যা প্রচার চালায়। বিরোধী ভাবমূর্তি নষ্টের জন্যও এরূপ প্রচারণা চালানো হয়। যেমন : হিটলার আইনসভায় অগ্নিসংযোগ করে কমিউনিস্টদের দোষ দেয় ।
১৯. আন্তর্জাতিকতা পরিপন্থী : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলো আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী একটি শাসনব্যবস্থা । একনায়কতন্ত্রে আন্তর্জাতিকতাকে স্বীকার করা হয় না। এই শাসনব্যবস্থায় আন্তর্জাতিকতার সহযোগী কোনো কার্যক্রমকে সহজে অনুমোদন দেয়া হয় না। Dictionary of Political Science-এর ভাষায়, “The dictator do not care for the international opinion and they give priority to their own selfish motives.”
২০. অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আরও যেসকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলোর মধ্যে হয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবিরোধিতা, অতি মানবীয় নেতৃত্ব, নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠোরতা এবং ইউটোপিয়ানিজম ইত্যাদি ।
পরিশেষে বলা যায় যে, একনায়কতন্ত্রের মূল সূর হলো, “One man, one state and to believe, to obey and to fight।” এ শাসনব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে বিশ্বের কোথাও একনায়কতন্ত্র তেমন নিয়ন্ত্রণ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ।
1 Comment.