যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের শর্তাবলি Pre-requisites to Success of Federal Government
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের একটি জনপ্রিয় ও উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এই সরকারের সাফল্য খুবই কঠিন এক বিষয়। কেননা, এ ধরনের সরকারব্যবস্থার সফলতার জন্য অনেক পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কে. সি. হুইয়ার (K.C. Wheare)-এর ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিরল, কেননা এর পূর্বশর্ত অনেক।” নিম্নে এ সরকারের সাফল্যের কতিপয় শর্তাবলি আলোচনা করা হলো :
১. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সফলতার জন্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকতে হবে। তা না হলে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র গঠন ও একে স্থায়ী করা যায় না। স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হলে প্রদেশগুলো প্রথমে স্বাধিকার ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দেলনের মাধ্যমে পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্বায়ত্তশাসনের পূর্ণ সুযোগ না থাকার কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যুক্ত পাকিস্তানের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সফলতার জন্য অঞ্চলসমূহের স্বাধীন সত্তা থাকতেই হবে। এখানে প্রাদেশিক সরকারের আইনসভা কেন্দ্রের অনুরূপ আইন প্রণয়ন করতে পারবে। কে. সি. হুইয়ার (K.C. Wheare) বলেন, “…. যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে টিকে থাকতে হলে নিজ নিজ এলাকার অঞ্চলসমূহের স্বাধীন সত্তা অপরিহার্য।”
২. অঙ্গরাজ্যসমূহের সমমর্যাদা : ছোট বড় নির্বিশেষে সকল অঙ্গরাজ্যের সমমর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সফলতার জন্য অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চ কক্ষে ছোট বড় সকল অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায়। মার্কিন সিনেট এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যেখানে ছোট বড় নির্বিশেষে সকল অঙ্গরাজ্য থেকে দু’জন করে সদস্য নিয়ে মোট ১০০ জন সদস্যের সমন্বয়ে সিনেট গঠিত। সিনেটে সমপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম কারণ । জে. এস. মিলের (J. S. Mill) মতে, “There should not be any one state so much more powerful than the rest as to be capable of lying is strength with many of them”, সমপ্রতিনিধিত্ব ছাড়াও আয়তন, জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সম্পদ প্রভৃতি দিক থেকেও প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যসমূহের মধ্যে সাদৃশ্য থাকা প্রয়োজন। অঙ্গীভূত অঞ্চলগুলোকে একই নজরে দেখতে হবে এবং সম্পদের সমবণ্টন করতে হবে। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার মূল কারণ ব্যাপক বৈসাদৃশ্যতা ।
ভৌগোলিক নৈকট্য : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র গঠনে ইচ্ছুক রাজ্যগুলোর ভৌগোলিক সান্নিধ্য। ভূখণ্ডগত সংলগ্নতার ভিত্তিতে জাতিগুলো একে অপরের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করে এবং সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর পরস্পরের নিকট থেকে দূরত্ব ভৌগোলিক সংহতির জন্য সহায়ক নয়, বরং প্রতিবন্ধক। ভৌগোলিক সংহতি ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সাফল্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব। যত রকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে না। জনগণের মাঝে যদি মিলনের ইচ্ছাই না থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হবে না। তবে এক্ষেত্রে মিলন হবে কিন্তু মিশে যাবে না (Desire for union not for unity)। মিশে গেলে তা হবে এককেন্দ্রিক সরকার। এদিক থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে জনগণের মধ্যে গড়ে উঠা একীভূত হবার মনোভাবকে অধ্যাপক ডাইসী যুক্তরাষ্ট্রের সফলতার প্রথম শর্ত বলে অভিহিত করেছেন। কে. সি. হুইয়ারের মতে, “যুক্তরাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসম্প্রদায়ের মধ্যে মিলিত হবার প্রবল বাসনা থাকতে হবে, তবে তা এক হয়ে যাবে না।”
৫. জাতীয়তাবোধ : যুক্তরাষ্ট্র গঠনকারী অঞ্চলসমূহের জনগণ যদি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ না হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সাফল্যমণ্ডিত করা সম্ভব হবে না। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত অভিন্নতা একটি শক্তিশালী সমাজ ও যুক্তরাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশগুলোতে কমবেশি ভাষাগত বৈষম্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী জাতীয়তাবাদের উপস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কার্যকর হয়। সুতরাং বলা যায়, জাতীয়তাবোধের অভাব যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ ।
৬. ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐক্য : অনেকের মতে, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত ঐক্য গড়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে। এটি জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা এনে দেয়। তা না হলে জনগণের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সফলতার অন্তরায় হবে। মনীষী স্ট্যালিন (Stalin)-এর মতে, “A nation of historical evolved stable community of language, territory, economic life and psychological makeup manifested in a community of culture.”
৭. লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সফলতার জন্য সংবিধানের প্রাধান্য থাকা একান্ত প্রয়োজন । সংবিধানের প্রাধান্য রক্ষার জন্য সংবিধানকে অবশ্যই লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হতে হবে। সংবিধান লিখিত না হলে কেন্দ্রিয় ও আঞ্চলিক সরকারসমূহ তাদের নিজস্ব স্বার্থের দৃষ্টিতে সংবিধানের ব্যাখ্যা করতে পারে। আবার সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়া প্রয়োজন এই কারণে যে, তা না হলে সরকারদ্বয় নিজেদের প্রয়োজনে সামান্য বিষয়ে সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
৮. উত্তম সংবিধান: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সফলতার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো একটি উত্তম সংবিধানের উপস্থিতি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতা বণ্টন, প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গ, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সংগঠন ও দল, বিভিন্ন এককের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা এবং নাগরিক চেতনার বিকাশ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকবে। তবে উত্তম সংবিধানের লিখিতরূপ থাকলেই হবে না। এই জাতীয় সংবিধানকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৯. সংবিধানের প্রাধান্য : কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব-বিরোধ হলে সেক্ষেত্রে সংবিধানকে সর্বোচ্চ দিতে হবে। অর্থাৎ, সংবিধানের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই উভয় সরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-বিরোধের সমাধান করতে হবে। ডাইসি (Diccy)-এর মতে, “যুক্তরাষ্ট্র বলতে বুঝায় কেউ কারো অধীন নয়, এমন কতগুলো অঙ্গের মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতার বণ্টনব্যবস্থা, যাতে প্রত্যেক ক্ষমতার উৎস ও নিয়ন্ত্রক হলো সংবিধান।” অর্থাৎ, কেন্দ্র বা প্রদেশে কারো প্রাধানা থাকবে না, বরং প্রাধান্য থাকবে সংবিধানের। আব্রাহাম লিংকনের মতে, “যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার অধীন প্রদেশ এবং কেন্দ্রের ক্ষমতা পাশাপাশি চলে এবং দুটি সরকারই সংবিধানের অধীন। “
১০. আইনের অনুশাসন : আইনের অনুশাসন ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থাকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয়। অর্থাৎ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র সফল হবে। এজন্য আইনকে তাঁর নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। আইন অনুযায়ী বিচারকার্য সমাধা করতে হবে। সেজন্য জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বিচারালয়ের আদেশ মেনে চলতে হবে। আইন মান্য করার মনোভাব গড়ে না উঠলে যুক্তরাষ্ট্র কায়েম হতে পারে না। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকদের এরূপ আনুগত্যবোধ থাকার ফলে এবং জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার ফলেই তাঁরা একটি শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
১১. নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সফলতার জন্য প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। এরূপ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত সাংবিধানিক বিধি-নিষেধ, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা প্রদান, কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যকার বিরোধের সুষ্ঠু নিষ্পত্তি এবং সামঞ্জস্য বিধান করবে। সংবিধানের আলোকে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে বণ্টনকৃত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে কোনো বিরোধ দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত তা নিষ্পত্তি করবে। যে কারণে বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার উপর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সাফল্য সর্বোতভাবে নির্ভরশীল।
১২. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা এবং এর সমপ্রতিনিধিত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত। এর মধ্যে নিম্ন কক্ষ গঠিত হবে অঙ্গরাজ্যগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। অর্থাৎ, কেন্দ্রিয় আইনসভার উচ্চ কক্ষে সকল অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকা আবশ্যক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার নিম্ন কক্ষ তথা প্রতিনিধিসভার সদস্যগণ জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। আর উচ্চ কক্ষের সদস্যগণ সকল অঙ্গরাজ্যের সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয় ।
১৩. কেন্দ্রিয়করণ প্রবণতা রোধ : আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। এ কেন্দ্রিয়করণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সফলতার জন্য কেন্দ্রিয়করণ প্রবণতা রোধ করতে হবে। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অন্ধকার ।
১৪. শাসনব্যবস্থার সাম্য : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য শাসনব্যবস্থার সাম্য থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অনেক অঙ্গরাজ্য থাকে। এসব অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রে একই প্রকার শাসনব্যবস্থা থাকতে হবে। কেন্দ্রে গণতন্ত্র, আর প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যে স্বৈরতন্ত্র— এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সফল হতে পারে না। কেননা, ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।
১৫. দ্বি-নাগরিকত্ব : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সফলতার জন্য রাষ্ট্রের জনগণের দ্বৈত নাগরিকতা আবশ্যক। এক্ষেত্রে একজন নাগরিক একাধারে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও তাঁর নিজের অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। এ দ্বৈত নাগরিকত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই বিধায় ভারত পূর্ণাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্র নয়।
১৬. যোগ্য নেতৃত্ব : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কোনো একটি দেশকে পরিচালনা করার জন্য পরিপূর্ণ যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। কেননা, যোগ্য নেতৃত্বের বলে বিভিন্ন প্রকার সংকীর্ণতা ও মতানৈক্য দূরীভূত হয় এবং জনগণের মধ্যে একত্রিত হবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। ওয়াশিংটন, অ্যাডামস, হ্যামিলটন ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-এর মতো যোগ্য নেতৃত্বই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। কে. সি. হুইয়ার (K.C Wheare)-এর মতে, “যোগ্য নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।”
১৭. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ : গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের চর্চার উপর যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করে। স্বায়ত্তশাসন, মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রভৃতির অবাধ চর্চা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সফল করে তোলে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যের নাগরিকগণ নিজেদের অধিকার রক্ষার সুযোগ পায়। অনেকেই মনে করেন, স্বৈরাচারী শাসন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
সুষ্ঠু দল ব্যবস্থা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সাফল্যের জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলের শক্তিশালী অবস্থান থাকা অপরিহার্য। এরূপ দল ব্যবস্থা বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার সমন্বয় সাধনসহ জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ সুরক্ষা করে। স্যার আইভর জেনিংস (Ivor Jennings ) বলেন, “The opposition is at once the alternative to the government and a focus to the discount of the people.”
১৯. আর্থিক সচ্ছলতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা বিধায় যেসব জাতি যুক্তরাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা করতে চায় তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকতে হবে। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। বিশেষত আঞ্চলিক সরকার আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল না হলে নিজেদের ও কিছু পরিমাণ কেন্দ্রিয় সরকারের ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম হয় না। এ প্রসঙ্গে হুইয়ার (Wheare) বলেন, “উভয় সরকার যেন আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল ও স্বাধীন থেকে নিজ নিজ কাজ সম্পন্ন করতে পারে সেজন্য উভয় সরকারের আর্থিক সচ্ছলতা থাকা প্রয়োজন।”
২০. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য : যুক্তরাষ্ট্র গঠনের জন্য সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন । রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে না। আর জাতীয় ঐক্য না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী হয় না। অধিকন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও সাদৃশ্য থাকা প্রয়োজন। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পূর্বে রাজনৈতিক সাদৃশ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সময়ও রাজনৈতিক সাদৃশ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল প্রায় এক ও অভিন্ন হওয়ায় তা একে অপরের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে ।
২১. প্রাতিষ্ঠানিক অভিন্নতা : একই ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র গঠনকারী অঙ্গরাজ্যগুলোর জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতা সৃষ্টিতে সহায়ক। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠাগণ এ সরকারের সংবিধান প্রণয়নের সময় সকল অঙ্গরাজ্যের জন্য একই ধরনের সরকারব্যবস্থা সমর্থন করেন।
২২. ধর্মীয় ঐক্য : ধর্মীয় ঐক্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনকে সুসংহত করে। সৃষ্টিকর্তার একই ধরনের আরাধনা জনগণকে সমধর্ম ও বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করে। ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়। যে কারণে ধর্মীয় ঐক্যানুভূতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে বলেন, “The possession of common religion has been extremely important in creating nation-state”.
পরিশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি উপরে আলোচিত ও নির্দেশিত শর্তাবলি পালন সাপেক্ষে সফলতা লাভ করে বলে প্রত্যাশা করা যায়। আর এদের মধ্যে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব না হলে পুরো সরকার পদ্ধতিই ভেঙে পড়ার আশংকা থাকে। যদিও এসব শর্ত পালন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। যে কারণে সফল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সহজে দৃষ্ট হয় না। তবুও আন্তর্জাতিক শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফল করা আবশ্যক ।