Table of Contents
Toggleসুপরিবর্তনীয় সংবিধান : অর্থ, সংজ্ঞা, ধারণা Flexible Constitution: Meaning, Definition, Concepts
পদ্ধতিগত সংবিধানের একটি বিশেষ রূপ হচ্ছে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান। এটি সংশোধন পদ্ধতি অনুসারে বিন্যস্ত। লর্ড ব্রাইস এই সংবিধানের অন্যতম সমর্থক ।
সাধারণত যে সংবিধান সংশোধনে আইনসভা সাধারণ আইন প্রণয়ন-পদ্ধতি অনুসরণ করে সংশোধন বা পরিবর্তন সাধন করতে পারে তাকে সুপরিবর্তনীয় বা নমনীয় সংবিধান বলে। অর্থাৎ, বিশেষ কোনো পদ্ধতি ছাড়াই সাধারণ আইন পাসের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করে যে সংবিধান সংশোধিত হয় তাই সুপরিবর্তনীয় সংবিধান ।
অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettel)-এর ভাষায়, “If a constitution may be easily amended by the ordinary law making body and procedure, it may be classed as flexible.”
লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতে, সুপরিবর্তনীয় সংবিধান সংশোধনে কোনো জটিল বা পৃথক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় না। আইনসভার সদস্যদের ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব। এ সংবিধানে সাধারণ ও শাসনতান্ত্রিক আইন অনেকটা সমপর্যায়ভুক্ত। যুক্তরাজ্য ও নিউজিল্যান্ডের সংবিধান সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণ বা সুবিধাসমূহ Qualities/ Merits of Flexible Constitution
সহজ সংশোধন পদ্ধতির ভিত্তিতে প্রণীত বিশেষ সংবিধানই সুপরিবর্তনীয় সংবিধান। এর বিধি-বিধানসমূহ প্রায়শই বিবর্তিত হয় ও লিখিত থাকে । একই সাথে তা সহজে পরিবর্তনীয়। সুপরিবর্তনীয় সংবিধান যে সমস্ত গুণ বা সুবিধার অধিকারী সেগুলো হলো :
১. সময়োপযোগী ও গতিশীল : সময়োপযোগিতা ও গতিশীলতা সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের বিশেষ গুণ। সময়, সমাজ, চাহিদা
ও বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখেই এটি প্রণীত ও পরিবর্তিত হয়। তাই এ সংবিধান বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী ।
২. প্রগতিশীল : প্রগতিশীলতা ও প্রগতির সহায়তা সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের বিশেষ গুণ। এটি রক্ষণশীলতা ত্রুটি থেকে মুক্ত। এ সংবিধান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। প্রগতির সাথে সাথে সংবিধান পরিবর্তিত হয়। তাই এটি আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতি ও প্রগতির সহায়ক।
৩. নমনীয়তা : নমনীয়তা সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের বিশেষ গুণ। এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সহজে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে। যে কারণে প্রয়োজন অনুসারে এতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা যায়। তাই এটি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। আর. সি. আগরওয়াল (R. C. Agarwal)-এর ভাষায়, “A flexible constitution is very useful for a developing country because it is a great expression of its development.”
৪. সংস্কারপন্থী : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান দেশের চাহিদা ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সহজে সংস্কার করা যায়।
সহজে পরিবর্তনীয় তাই এ সংবিধান সংস্কার উপযোগী। সুতরাং এটি একটি ক্রিয়াশীল সংবিধান ।
জরুরি অবস্থা মোকাবেলা : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “Flexible constitution may be stretched or bent so as to meet emergencies without breaking the framework.”
৬. জনমতের প্রতিফলন : এ সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিবিম্ব রূপে এটি জনকল্যাণে কাজ করে।
৭. বিপ্লব হ্রাস : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এতে বিপ্লবের আশঙ্কা কম এবং সহজে পরিবর্তনের ফলে বিপ্লবের সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। মনীষী ফ্রিম্যান (Freeman)-এর ভাষায়, ÔIn a flexible constitution the nation is protected against internal revolt and revolution.”
৮. সহজবোধ্য : সহজবোধ্যতা সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের বিশেষ গুণ। এ সংবিধানে বিশেষ বিধানাবলি সহজ-সরল ভাষায় লিখিত থাকে। পাশাপাশি কিছু দিক অলিখিতও থাকে। যে কারণে জনগণের নিকট তা সহজবোধ্য হয় ।
৯. উন্নতির সহায়ক : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক। উন্নয়নশীল সমাজের জন্য এটি অত্যন্ত সুবিধাজনক ।
১০. অন্যান্য সুবিধা : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের আরো যেসব গুণ বা সুবিধা রয়েছে সেগুলো হলো :
শাসন-ব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি অপসারণ;
গণবিক্ষোভ প্রশমনে সহায়তা;
- জনস্বার্থ সংরক্ষণ ।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের দোষ বা অসুবিধাসমূহ Disqualities or Demerits of Flexible Constitution
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের যেসকল দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারা অলিখিত থাকে বিধায় এটি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট হিসেবে প্রতীয়মান হয় ।
২. স্থায়িত্বের অভাব : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অস্থায়ী। কেননা, এটি সহজে সংশোধনীয় ও পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন জনমতের জোয়ারের কারণে-অকারণে অনবরত একে পরিবর্তন করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
৩. মৌলিক অধিকারের অনিশ্চয়তা : সুপরিবর্তনীয় সর্ববধানে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ফলে নাগরিক চেতনাবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া শাসন বিভাগও স্বেচ্ছাচারি হতে পারে।
৪. বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা থাকে। কেননা, সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হওয়ায় বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর প্রাধান্য ও স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। কারণ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার স্পষ্ট বিধান অনুপস্থিত।
৫. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অনুপযোগী : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার জন্য অনুপযোগী। কেননা, এরূপ সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়া সম্ভব হয় না।
৬. দুর্বল: স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ, জনতার সাময়িক উন্মাদনা ও কল্যাণমূলক বিধির অকাম্য পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে এ সংবিধান দুর্বল হয়ে পড়ে। নমনীয় প্রকৃতির জন্য মৌলিক সাংবিধানিক বিধানের সাথে সাধারণ আইনের পার্থক্য থাকে না । ফলে এটি তার মর্যাদা হারায়। তাই সুপরিবর্তনীয় সংবিধান উত্তম সংবিধান হতে পারে না ।
৭. জনস্বার্থ উপেক্ষিত : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান ক্ষমতাসীনদের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়। যে কারণে এ সংবিধানে জনগণের দাবি ও স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
৮. অস্থিতিশীলতা : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের যে কোনো ধারা সহজে পরিবর্তন করা যায়। ফলে যে কোনো রাজনৈতিক সংকটে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে ক্ষমতাসীন দল নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারে বিধায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়।
অগ্রগতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ফলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয় ।
১০. অন্যান্য ত্রুটি : এছাড়া সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের আরো যেসকল ত্রুটি বা অসুবিধা রয়েছে সেগুলো হলো :
- জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যাহত করে;
সংবিধান সম্পর্কে উঁচু ধারণা বিনষ্ট করে;
- বিভাগীয় হস্তক্ষেপ ও দায়িত্বহীনতার জন্ম দেয়;
- সংখ্যালঘুদের অধিকার বিপর্যস্ত ও আইন অমান্যের উস্কানি বোধ জাগ্রত করে;
- বিচার বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ প্রদান করে প্রভৃতি ।
সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে দোষ-গুণ উভয়ই বিদ্যমান। তবে ত্রুটি অনেক বেশি থাকায় এ সংবিধান তেমন একটা গৃহীত হয়নি। তবে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের কিছু গুণ অনস্বীকার্য। লর্ড ব্রাইস বলেন, “সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বাঁকে, কিন্তু ভেঙ্গে যায় না।”