Table of Contents
Toggleসাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকার : ধারণা ও সংজ্ঞা Constitutional Government: The Concept & Definition
বর্তমান বিশ্বের শাসনতান্ত্রিক আলোচনায় সাংবিধানিক সরকার বা নিয়মতান্ত্রিক সরকার বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেেছ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সাংবিধানিক সরকার। যে সরকার সংবিধানের অধীনে বা সংবিধানের বিধি-বিধানের আলোকে পরিচালিত হয় তাকে সাংবিধানিক সরকার বলে। তবে সব সরকারই সাংবিধানিক সরকার নয়। সাংবিধানিক সরকার কতিপয় বৈশিষ্ট্য বা শর্তাবলি বহন করে।
সাধারণত সাংবিধানিক সরকার বলতে সংবিধানসম্মত সরকারকেই বুঝায়। অর্থাৎ, যে সরকার সংবিধান অনুসারে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সংবিধানের প্রতি অনুগত থেকে আইন প্রণয়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে তাকে সাংবিধানিক সরকার বলে।
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ( Woodrow Wilson ) বলেন “A constitutional government is one whose powers have been adapted to the interests of the people and to the maintenance of individual liberty.” (অর্থাৎ, সাংবিধানিক সরকার বলতে বোঝায় যার ক্ষমতা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তির স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ)।
২. কে.সি. মুইয়ার (K. C. Wheare)-এর মতে, “শুধু সংবিধানকে অনুসরণ করলেই সাংবিধানিক সরকার হয় না। এটি এক প্রকার আইনানুগ সরকার যা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। “
৩. অধ্যাপক উইলোবী ( F. W. Willoughby)-এর মতে, “আইনের অনুগত ও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ সরকারকে সাংবিধানিক সরকার বলে।”
৪. অধ্যাপক ডাইসি ( Prof. Diecy)-এর মতে, “Constitutional government is a government refers the govemment in which the powers of the government is distributed according to the constitution also responsible to the people.”
৫. ম্যাকইলওয়েন (H. Mellwain)-এর মতে, “Constitutionalism is a legal limitation on government, it is antithesis of arbitrary rule, it is opposite to despotic government of will instead of law.”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটলের মতে, সাংবিধানিক সরকারের ৩টি দিক আছে। এগুলো হলো :
১. এ শাসন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয় না;
২. এটি এক বৈধ শাসন;
৩. এটি ইচ্ছুক প্রজাবৃন্দের শাসন এবং এতে বলপ্রয়োগের কোনো অবকাশ নেই ।
সুতরাং বলা যায়, সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকার সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ সরকার। এ সরকার ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছাধীন নয়, সংবিধানের বিধান, আইন, জনগণের ইচ্ছা ও ক্ষমতার বলে পরিচালিত হয়। তাই একে বলা হয় ‘নিয়মতন্ত্র’ বা ‘সংবিধানতন্ত্র’।
সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Constitutional Government
সংবিধান ও আইন অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত সরকারই সাংবিধানিক সরকার। এর কিছু স্বকীয়তা বিদ্যমান। সংজ্ঞা ও প্রকৃতি অনুযায়ী সাংবিধানিক সরকারের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১. আইনানুগ সরকার : সাংবিধানিক সরকার অবশ্যই সংবিধানসম্মতভাবে প্রণীত আইনের দ্বারা পরিচালিত সরকার। অর্থাৎ, এটি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ শাসিত সরকার নয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে এই সরকার পরিচালিত হয়। অন্য কথায় এই সরকার অবশ্যই গণতান্ত্রিক (Democratic)।
২. ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা : সাংবিধানিক সরকারকে বলা হয় সীমাবদ্ধ সরকার। অর্থাৎ, এটি সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। সাংবিধানিক বিধান বা সীমানার বাইরে এ জাতীয় সরকার কিছুই করতে পারে না। তাই সাংবিধানিক আইন, সাধারণ আইন, জনতার ইচ্ছা ও ক্ষমতা অনুযায়ী সাংবিধানিক সরকার নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত।
৩. স্থিতিশীলতা : শাসন পদ্ধতির স্থিতিশীলতা সাংবিধানিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সংবিধান অনুসারে সরকার পরিচালিত হয়। যে কারণে খেয়াল-খুশিমতো তা পরিবর্তন করা যায় না। ফলে সাংবিধানিক সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
৪. সুনির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতি : সাংবিধানিক সরকার দেশের সংবিধানে বিধিবদ্ধ আইন, শাসনতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে । অর্থাৎ, এ সরকার সংবিধানসম্মত পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হয়।
৫. সংবিধানের প্রাধান্য : সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সাংবিধানিক সরকারের সংবিধানকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব সম্পন্ন মনে করা হয়। অর্থাৎ, সকল ব্যক্তি, সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের উপর সংবিধান প্রাধান্য পাবে এবং সংবিধানের সাথে অসামগ্রস্যপূর্ণ কোনো কিছু বাতিল বলে গণ্য হবে।
১৯. ব্যক্তির প্রাধান্য লোপ : সাংবিধানিক সরকারে ব্যক্তি বা দল বিশেষের ক্ষমতা নিরোধ করা হয়। এটি আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
২০.স্বাভাবিক ক্ষমতা হস্তান্তর : স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষমতা হস্তান্তর সাংবিধানিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে সরকার নির্বাচিত পক্ষ বা দলকে সাংবিধানিক নিয়মের আওতায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এমনকি সরকার যদি আস্থা ভোটে হেরে যায়, তখনও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারে না ।
সাংবিধানিক সরকার উত্তম ও শ্রেষ্ঠ সরকার। সাংবিধানিক সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করে চলে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি সাংবিধানিক সরকারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের সীমাবদ্ধতা Limitations of Constitutional Government
সাংবিধানিক সরকারের বিভিন্ন গুণ থাকায় সকলেরই লক্ষ থাকে এরূপ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্বব্যাপী সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নে কয়েকটি বাধা বা সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হলো :
১. যুদ্ধ : যুদ্ধ বা যুদ্ধের আশঙ্কা সাংবিধানিক সরকারের জন্য গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ এরূপ সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দাবি করে। সরকার তখন সংবিধানের বিধি নিষেধের মধ্যে থেকে কাজ করতে চায় না। বস্তুত যুদ্ধ বা যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রত্যেক দেশের সংবিধানেই সরকারকে জরুরি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এরূপ অবস্থায় সংবিধান ও সংবিধানের অনেক বিধান স্থগিত রাখা হয়। এতে সাংবিধানিক সরকারও স্থগিত হয়ে যায় ।
২.. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : সাংবিধানিক সরকারের অন্যতম সমস্যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। নিয়ম-কানুন, আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি প্রশাসনিক কাজে সমস্যার সৃষ্টি করে ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দেখা দেয়। সরকারও আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।
৩. অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্যোগ : অর্থনৈতিক সংকট (ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা, স্টক এক্সচেঞ্জ পতন, বৈদেশিক বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ) সাংবিধানিক সরকারকে দুর্বল করে দেয়। এ সকল সংকটকালীন সময়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। তখন সরকারের উপর আরোপিত বিধি-নিষেধ অনেকাংশে স্থগিত রাখতে হয়। যেসব দেশে এরূপ সংকট ও দুর্যোগ অধিক পরিমাণে দেখা দেয় সেসব দেশের সাংবিধানিক সরকার সমস্যায় পড়ে।
৪. স্বৈরশাসন : স্বৈরশাসন সাংবিধানিক সরকারের অন্যতম একটি সীমাবদ্ধতা। সাংবিধানিক সরকার কখনো কখনো স্বৈরশাসনে রূপ নেয়। বিশেষ করে রাজতান্ত্রিক, ফ্যাসীবাদী ও মাওবাদী সরকার অপ্রতিহতভাবে শাসন ক্ষমতা ভোগ করে। তারা সংবিধানকে অধিকতর প্রাধান্য দেয়। ফলে সাংবিধানিক সরকার স্বৈরাচারে পরিণত হয়।
৫. বিপ্লবের সম্ভাবনা : জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অসন্তোষ, দাবি-দাওয়ার অপূর্ণতা প্রভৃতি কারণে বিপ্লবের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সহজে তা সংশোধন করা যায় না, যা সাংবিধানিক সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সাংবিধানিক সরকারের জন্য বিরাট বাধা। কোনো কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে তা সমাধানে সংবিধানের আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু এরূপ অস্থিরতা সমাধানে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। সুতরাং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতা, অসন্তোষ সাংবিধানিক সরকারের বিরাট সমস্যা।
৭. বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ : সাংবিধানিক সরকারে সংবিধানের প্রাধান্য দেয়া হয়। যে কারণে সর্বত্র রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। ফলে বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সাংবিধানিক সরকার উল্লিখিত সমস্যাসমূহের সম্মুখীন হয়। এসব সমস্যা সাংবিধানিক সরকারকে সীমিত করছে। এসব প্রতিবন্ধকতার অবসান হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সাংবিধানিক সরকার সর্বদা সাংবিধানিক উপায়ে কাজ করতে পারে না। তবুও এ সরকারের সাংবিধানিকভাবে জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত। তবেই সাংবিধানিক সরকার একটি উত্তম ও জনপ্রিয় সরকার বলে পরিগণিত হবে।