Table of Contents
Toggleসর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার Universal Adult Suffrage
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদানের নীতিকে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার বলে। এ নীতি অনুসারে ভোটাধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে একটি মাত্র যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। তা হলো ভোটাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমে উপনীত হতে হবে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত প্রত্যেক ব্যক্তির ভোটদানের অধিকার থাকে। বাংলাদেশে এ বয়সসীমা ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, রুমানিয়া, পূর্ব জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ১৮ বছরের বয়সের নাগরিকদের ভোটাধিকারের যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে উন্মাদ, দেউলিয়া, গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি, বিদেশি প্রভৃতি ব্যক্তিদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয় না। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার সম্পর্কে কয়েক জনের মতামত প্রদান করা হলো :
১. সিজউইক (Sidgwick)-এর মতে, “ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সুস্থ ও সবল প্রতিটি নাগরিকের ভোটযোগ্য ভোটাধিকারই প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকার।”
- Dictionary of Social Science-এর সংজ্ঞানুযায়ী, “সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের অর্থ হচ্ছে শর্ত ও যোগ্যতা সাপেক্ষে ভোটাধিকার।”
৩. অধ্যাপক লেকি (Leckey ) বলেন, “Universal adult suffrage implies all are equal to take part in politics in the eye of law because everybody is equally by the laws and policies of the state.”
সুতরাং সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার হচ্ছে সকল সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোট দেয়ার অধিকার। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও মানসিক প্রতিবন্ধী, দেউলিয়া, রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমুখের ভোটাধিকার থাকবে না ।
সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের পক্ষে যুক্তিসমূহ
Arguments in favour of the Universal Adult Suffrage
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহ তুলে ধরা যায় :
১. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। কারণ পৃথিবীতে সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জনুগ্রহণ করে। যে কারণে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করে তাকে ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত করা যায় না।
২. ব্যক্তি যদি জন্মগতভাবে প্রাপ্য সমানাধিকার হতে বঞ্চিত হয় তবে গণতন্ত্রকে বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব নয়। কারণ গণতন্ত্র প্রত্যেক ব্যক্তির সমান অধিকার ও সুযোগের নীতিতে বিশ্বাসী। রাষ্ট্র জনগণের প্রতিষ্ঠান বিধায় এর পরিচালনা ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকাই বাঞ্ছনীয়। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তন করে গণতন্ত্রের মৌল আদর্শকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
৩. ব্যক্তিত্রে পূর্ণ বিকাশ তথা ব্যক্তি জীবনের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োজন। কারণ ভোটাধিকার না থাকলে ব্যক্তি রাজনৈতিক ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের জন্য সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক । লর্ড ব্রাইসের মতে, “ভোটাধিকার নাগরিকের ব্যক্তিত্বকে মর্যাদাসম্পন্ন করে ।” ৪. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ তাদের এই সার্বভৌম ক্ষমতাকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই কার্যকর করতে পারে বিধায় সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার জরুরি। মনীষী Appadorai-এর ভাষায়, “The primary means by which the people exercise their sovereignty is the vote.”
৫. প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালা দ্বারা সমানভাবে পরিচালিত হয়। যে কারণে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার থাকতে হবে।
৬. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার ব্যবস্থা সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দেয়। যে কারণে তাদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রয়োজন নেই ।
৭. জনগণের সাম্য ও সমানাধিকার- এ দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের ইমারত নির্মিত। যে কারণে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ রাজনৈতিক অধিকার তথা ভোটাধিকারকে স্বীকার করে নিলে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। তা না করা হলে সাম্যের অধিকার অস্বীকৃত বা উপেক্ষিত হয় ।
৮. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি থাকলে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী হতে সাহস পায় না। কারণ জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করলে নির্বাচনকালীন সময়ে সমস্ত জনসাধারণ উক্ত গোষ্ঠী বা দলের পরিবর্তে অন্য গোষ্ঠী বা দলকে ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।
৯. কোনো ব্যক্তিকে ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত করা হলে তার স্বার্থ রক্ষায় সরকার উদাসীন হয়ে পড়বে। যাদের ভোটাধিকার আছে সরকারের স্থায়িত্ব তাদের মতামতের উপর নির্ভর করে বিধায় সরকার সর্বদা তাদের স্বার্থ পূরণ করবে।
১০. কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত করা হলে বঞ্চিত জনসাধারণের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ মনোভাব কখনো বিক্ষোভ এমনকি বিদ্রোহের আকার ধারণ করতে পারে। ফলে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকার করে নেয়া প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য।
১১. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করে এবং নির্বাচিত সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করে। ফলে দেশের কল্যাণ সাধিত হয়।
১২. সরকার সকলের কল্যাণ সাধনের জন্য। তাই সরকার সকলের দ্বারাই নির্বাচিত হওয়া উচিত। জে. এস. মিল (JS. Mill)- এর মতে, “What touches all, must be decided by all.”
১৩. প্রতিনিধিত্বকে সহজ, সুন্দর ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এতে প্রতিনিধিত্ব সীমিত হয় না ।
১৪. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার নীতিতে জনগণ দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। দেশের প্রতিরক্ষার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করার মনোভাব পোষণ করে। এভাবে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় ।
১৫. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার ব্যবস্থা নাগরিক ও বিদেশিদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সর্বোত্তম পন্থা ।
সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ
Arguments Againts the Universal Adult Suffrage
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের বিপক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহ তুলে ধরা যায় :
১. কোনো মানুষই ভোটাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা মূলত রাষ্ট্র প্রদত্ত অধিকার ।
২. জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষা না থাকলে জনগণ রাষ্ট্রের জটিল সমস্যা উপলব্ধি করে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। যে কারণে শিক্ষা ভোটাধিকারের একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে ৷
.
৩. অনেকেই ভোটাধিকারের যোগ্যতা হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উল্লেখ করেছেন। যাদের সম্পত্তি নেই তারা রাষ্ট্রকে কর প্রদান করে না বিধায় তাদের ভোটাধিকার থাকা সমীচীন নয়। অর্থাৎ, কর প্রদানের দায়িত্ব পালন না করলে সরকারি কার্যে অংশগ্রহণেরও অধিকার থাকা সঙ্গত নয় ।
৪. সর্বজনীন ভোটাধিকার নীতি গ্রহণ করা হলে মূর্খ ব্যক্তিগণ কোনো যোগ্যতার মাপকাঠি পরিমাপ ব্যতীতই আবেগের তাড়নায় মূর্খ অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন করবে। ফলে মূর্খদের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে ।
৫. নারী ভোটাধিকার লাভ সাম্প্রতিককালের ঘটনা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে ভোটাধিকার প্রদানের পরও নারীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা একটি সাধারণ নিয়ম ছিল। কিন্তু বাস্তবতায় ভোটাধিকারের বিষয়টি আলোচনা করলে স্ত্রী- পুরুষগত যোগ্যতায় ভিন্নতা লক্ষ করা যায় ।
৬. সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের নীতি তুলনামূলকভাবে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কারণ শুধুমাত্র বয়সের উপর ভিত্তি করে ভোটাধিকার নীতি প্রণয়ন করার ফলে ভোটারদের অযোগ্যতার জন্য অযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। মেকলে (Mackley), লেকী (Leckey) এবং হেনরি মেইন (Henry Main) মনে করেন যে, অশিক্ষিত জনগণকে ভোটাধিকার প্রদান করা অবিবেচনাপ্রসূত এবং বিপজ্জনক। এদের মতে, ভোটাধিকার কখনো সহজাত বা জন্মগত অধিকার বলে গণ্য করা যায় না। পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত কেউই ভোটাধিকার দাবি করতে পারে না। তাই বলা যায়, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রগতির পরিপন্থী।.
৭. জন স্টুয়ার্ট মিলের (JS. Mill) মতে, শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করে নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদান করা উচিত। কারণ শিক্ষা না থাকলে সমকালীন জটিল সমস্যাবলির প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা এবং সেগুলোর সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থা করা জনগণের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই সার্বিক প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার প্রদানের পূর্বে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন ।
৮. সর্বস্তরের মানুষকে ভোটাধিকার প্রদান করা হলে রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হবে, অনেকের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হবে। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে ভোটাধিকার প্রদান করলে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হবে না।