সংবিধান হচ্ছেন রাষ্ট্র পরিচালনার মনিষ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে “Constitution”, যা ল্যাটিন শব্দ “Constiture” থেকে এসেছে। এই “Constiture” শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, সংবিধান হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সর্বোত কর্তৃপক্ষের আদেশ।
সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান : সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান করতে লিখিত মৌলিক নিয়মকানুনকে বুঝায়, যেগুলোর ভিত্তিতে সরকারের নান, সরকারের বিগসমূহের সংগঠন, ক্ষমতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়
সাত আইভর জেনিংস-এর মতে, “সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান বলতে এমন একটি দলিলকে বোঝায় যে দক্ষিণ সরকারের মুখ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের গঠন, ক্ষমতা এবং কাজ পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কিত নিয়মাবলি এবং নাগরিকদের সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পর্কে সাধারণ নীতি স্থির করে।”
কে. সি. হোয়ার-এর মতে, “সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান হলো কোনো একটি অথবা কয়েকটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট দলিলে সংক্ষেপিত আইনসিদ্ধ নিয়মাবলির সমষ্টি।”
ব্যাপক অর্থে সংবিধান : ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে বুঝায় দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী লিখিত ও অলিখিত স প্রকার নিয়মকানুনকে যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত।
স্যার আইভর জেনিংস-এর মতে, “লিখিত নিয়মাবলি এবং প্রথা, সাংবিধানিক রীতি-নীতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মাবলির সমষ্টিকে ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলে।”
কে.সি. হোয়ার-এর মতে, “ব্যাপক অর্থে সংবিধান হলো কোনো দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা, সরকার গঠন, নিয়ন্ত্রণকারী বা পরিচালনাকারী নিয়মাবলির সমষ্টি। আইন এবং আদালতের দ্বারা স্বীকৃত নিয়মাবলি ও রীতিনীতি, প্রথা এবং আচার-আচরণের উপর প্রতিষ্ঠিত নিয়ামবলির সমষ্টি।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সংবিধান বলতে আমরা এমন কিছু নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান বা অনুশাসনকে বুঝি যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এসকল সাংবিধানিক নিয়মকানুনকে অনুসরণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে ।
১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল (Aristotle) সংবিধানের সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন, “Constitution is the way of life the state has chosen for itself.” অর্থাৎ, সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এমন এক জীবন পদ্ধতি, যা রাষ্ট্র স্বয়ং নিজের জন্য বেছে নিয়েছে।
২. সি.এফ. স্ট্রং (C.F. Strong ) তাঁর “Modern Political Constitution” গ্রন্থে বলেন যে, “Constitution is a collection of principles according to which the powers of the government, the rights of the governed and the relation between two are adjusted.” অর্থাৎ, সংবিধান হচ্ছে সেই সকল নিয়ম-কানুনের সমষ্টি যা দ্বারা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং এ দুয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ধা ি হয়ে থাকে ।
৩. অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare) তার “Modern Constitution” গ্রন্থে সংবিধানের সংজ্ঞায় বলেন যে, “সংবিধান হচ্ছে সে সমস্ত নিয়মের সমষ্টি যা কী উদ্দেশ্যে এবং কোন বিভাগের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা পরিচালিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।”
৪. মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞ লেসলি লিপসন তাঁর গ্রন্থে সংবিধানের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন যে, “সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নিয়ম-প্রণালী ও তার সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক সংবলিত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। বলা বাহুল্য এই প্রকল্পের মূল কাঠানো হলো লিখিত সংবিধান। ”
৫. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) সংবিধানের সংজ্ঞায় বলেন, “Constitutron is the aggregate of laws and customs hunker which the life of the state goes on; or the complex totally of laws embodying the principles and rules whereby the community is organized, governed and held together.” অর্থাৎ, সংবিধান হচ্ছে এমন কতগুলো আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়, অথবা এমন কতিপয় আইনের সমন্বয় ঘটে যাতে সম্প্রদায়তে সংগঠিত, এমন ও একরাকরণের নীতিমালা এবং নিয়মাবলি সংযোজিত হয়েছে।
৬. অস্টিন রেনী (Austin Ranney)-এর মতানুসারে, “A constitution is the whole body of the fundamental rules, written and unwritten, legal, extra legal and according to which a particular government operates.” অর্থাৎ, লিখিত বা অলিখিত বিধিসম্মত বা বিধি বহির্ভূত সকল মৌলিক নিয়মকানুন যা দেশের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাই হলো সংবিধান ।
সুতরাং, চূড়ান্তভাবে বলা যায় যে, সংবিধান হলো কতিপ্যা নিয়ম-কানুনের সমষ্টি, যা সরকার গঠন, দেশ পরিচালনা, সরকার ও জনগণের অবস্থান নির্ণয় এবং সর্বোপরি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয় ।
সংবিধানের উৎসসমূহ Sources of Constitution
সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দলিল। এটি সৃষ্টি বা প্রণয়নে বিভিন্ন উপাদান বা বিষয় সহায়তা করে। অর্থাৎ, বিভিন্ন উৎস হতে সংবিধানের উৎপত্তি হয়। সংবিধান প্রণয়নে ইংল্যান্ড বা বর্তমান যুক্তরাজ্য আদর্শস্থানীয়। সংবিধানের বিভিন্ন উৎস- সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. ঐতিহাসিক সনদ : সংবিধান রচনায় ঐতিহাসিক সনদ বা মহাসনদ অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে। এসকল সনদ বিশ্বস্বীকৃত। এরূপ সনদ গ্রহণের সূত্রপাত ঘটে ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক গৃহীত ঐতিহাসিক সনদ গ্রহণের মাধ্যমে। যেমন— ১২১৫ সালে প্রবর্তিত “মহাসনদ” (Magna Charter ), যা সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এছাড়াও ১৬২৮ সালের অধিকারের আবেদনপত্র, ১৬৮৯ সালের অধিকার বিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসবের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার মেনে নেওয়া হয় ।
২. লোকাচার ও রীতিনীতি : সমাজ জীবনে অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত বিভিন্ন লোকাচার (Customs) বা আচার-প্রথা, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি। সনাতন এসব বিষয় বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ও স্বীকৃত হয়। এভাবে সেগুলো সংবিধানে স্থান পায়। ব্রিটেনের সংবিধানের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এরূপ প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি।
৩. মৌলিক দলিল : মৌলিক দলিলও সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যেমন, ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সভাপতিত্বে ফিলাডেলফিয়ায় সংবিধান প্রণয়নে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের কিছু ধারা দলিলরূপে লিখিত হয় ।
৪. বিধিবদ্ধ আইন : বিধিবদ্ধ আইন, যা আইনসভা কর্তৃক প্রণীত ও আইনসভাই এর পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে, তা সংবিধান রচনার উৎস রূপে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসরূপে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইনের উল্লেখ করা যায়। যেমন— ১৮৩২, ১৮৬৭ ও ১৮৮৪-৮৫ সালের “সংস্কার আইন”(ভোটাধিকার সম্প্রসারণ), ১৬৭৯ সালের স্বাধীনতা সম্পর্কিত (Habeas Corpus Act) প্রভৃতি ।
৫. সাধারণ আইন : সাধারণ বা প্রথাগত আইনও সংবিধান রচনার পথ প্রশস্ত করে। দীর্ঘদিনের প্রথা, লোকাচার, বিবিধ স্তর ও যুগ পেরিয়ে এক সময় আইনে পরিণত হয়, যা পরবর্তীতে সংবিধানের উৎসরূপে কাজ করে। ৬. সন্ধি ও চুক্তি : বিভিন্ন সময়ে বহু দেশের সাথে সন্ধি ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এগুলো রাজনৈতিক সংকট সমাধানে যেমন অবদান রাখে, তেমনি সংবিধান প্রণয়নের উৎসরূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন- “দ্য পিটিশন অব রাইট্স” ১৬২৮, “দ্য বিল অব রাইটস” ১৬৮৯; “দ্য এ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট”, ১৭০০; স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি, ১৮০০; যা গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধানের অন্যতম উৎস।
৭. শাসনতান্ত্রিক রীতি-নীতি : সংবিধানের অন্যতম উৎস হলো শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি (Conventions)। অর্থাৎ, শাসনতন্ত্র বা সংবিধান সম্পর্কিত আইন-কানুনসমূহ। এর দ্বারা শাসনক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধানের বড় একটি অংশ হলো এরূপ রীতিনীতি। মনীষী Ogg-এর ভাষায়, “Conventions refers understanding practices and habits which alone regulate a large portion of the actual relations and operations of the public authorities.”
৮. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত : বিচার বিভাগ জটিল কোনো মামলার নিষ্পত্তিতে সুচিন্তিত রায় প্রদান করে। যা পরবর্তীতে
সংবিধানে সংযোজিত হয়। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি হিউজেস (Justice Heiughes) মন্তব্য করেন, “
তাই, বিচারকরা একে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন।”
সংবিধান হচ্ছে
অধ্যাপক ডাইসিও ব্রিটিশ সংবিধানকে ‘Judge-made’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “The English constitution for being the result of the legislation in the ordinary sense of the term. is the fruit of contests carried on in the courts on behalf of the rights of the individual.”
৯. আইনসভা ও গণপরিষদ : দেশের আইনসভা ও গণপরিষদ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এ
সংস্থা আইন ও সংবিধান চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকে। এছাড়া গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করা হয় ।
১০. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি ও সংশোধন : সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গৃহীত বিভিন্ন সংশোধনও সংবিধানের অংশ রূপে
পরিগণিত হয়। যেমন— বাংলাদেশের সংবিধানে বর্তমান পর্যন্ত ১৪টি সংশোধনী সংযোজিত হয়েছে।
১১. প্রামাণ্য পুস্তক : শাসনতন্ত্র বিষয়ক প্রামাণ্য রচনা বা বই-পুস্তক সংবিধানের বিশেষ উৎস। বিশ্বের বহু জ্ঞানী, পণ্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে সংবিধান তৈরিতে অবদান রেখেছে। শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত নিম্নোক্ত রচনাসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
• The English Constitution – Walter Bagehot
Law and Customs of The Constitution
• The Law and The Constitution -Ivor Jenings
• Parliamentary Government in English – Laski
Law of The Constitution – Diecy
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলো সংবিধান রচনার মূল উৎস। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এসব উৎসের ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হয়। এগুলোর মধ্যে আইন, প্রথাগত বিধান ও আইনসভা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। কেননা, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সংবিধান রচনায় এগুলো মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তবে অন্যান্য উৎসের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই ।