সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম

সংসদীয় / মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার অন্য যে কোনো সরকার ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম

Parliamentary Government is better than any other Government

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্য যে কোনো প্রকার শাসনব্যবস্থার তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এ্যাপলবি বলেন, “Parliamentary Government is decidedly better than any other government.” অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner), ওয়াল্টার বেজহট (W. Bagehot), জেনিংস (Jennings), লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) এ উক্তির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। যে সকল যুক্তিতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অপরাপর সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম তা নিম্নে তুলে

ধরা হলো :

১. আইন শাসন বিভাগের মধ্যে সংযোগ সাধন : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগ একে অপরের সহযোগী ও পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে আইন বিভাগের একাংশ নিয়ে শাসন বিভাগ গঠিত হয়। আবার শাসন বিভাগকে তার কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য আইন বিভাগের সমর্থন লাভ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটেনের আইনসভাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ওয়াল্টার বেজহট (W. Bagehot ) ব্রিটেনের ক্যাবিনেটকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “The Cabinet is a hyphen that joins buckle that binds the executive and legislative departments together.”

২. সুপরিবর্তনীয় শাসনব্যবস্থা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি মূলত সুপরিবর্তনীয় শাসনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যায়। কেননা, আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার উপর সরকার ক্ষমতাসীন থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। অর্থাৎ, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সুপরিবর্তনীয় বিধায় এই ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বেশি।

৩. প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। শাসকবৃন্দ বা জনপ্রতিনিধিগণ তাদের কার্যাবলির জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। এ প্রসঙ্গে জেনিংস (Jennings), “Government with us, is government by opinion and that is the only kind of self government that is possible.”

৪. দায়িত্বশীল সরকার : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অপরাপর যে কোনো সরকার ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম হওয়ার কারণ হলো এ সরকারের মন্ত্রিসভা তাদের যাবতীয় কার্যের জন্য ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকে। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

৫. বহুদলীয় ব্যবস্থা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ফলে জাতীয় নির্বাচনে একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীগণ প্রতিংন্দ্বিতা করে। জনগণ তাদের কর্মসূচির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সঠিক প্রার্থীকে রায় প্রদান করে। এতে জনগণের স্বাধীন মতামতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

৬. বিরোধীদলের মর্যাদা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার কার্যকারিতার জন্য শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতি অপরিহার্য। সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়। কেননা, এই ব্যবস্থায় বিরোধী দল আইনসভা এবং এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বিকল্প সরকার হিসেবে অবতীর্ণ হতে পারে। অধ্যাপক জেনিংস (Jenning) ব্রিটেনের সংবিধানের আলোকে বলেন, “The leader of the opposition is the alternative primeminister. Only a slight shift in the public opinion is necessary to give the majesty’s opposition a majority in the mouse and so convert them into his majesty’s government.”.

৭. গঠনমূলক সমালোচনা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জনগণের গঠনমূলক সমালোচনার মূল্যায়ন করা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কিত বিষয়গুলোতে সরকার জনমত বিরোধী কোনো কাজ করে না। আবার বিরোধী দলের গৃহীত প্রস্তাবের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় ।

অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের শাসন : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটিই সরকার গঠন করে থাকে। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চৌকস রাজনীতিবিদদেরকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এর ফলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় গতিশীলতা আসে এবং জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়।

রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। কেননা, এ ব্যবস্থায় আইনসভায় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক জনগণের অভাব-অভিযোগ উত্থাপিত হয়। উত্থাপিত অভিযোগের উপর আলাপ-আলোচনা ও তর্ক- বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিতর্ক থেকে জনগণ দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে ।

১০. আইনের প্রাধান্য : সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনের প্রাধান্য অর্থাৎ আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। যা সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে ।

১১. কল্যাণকর আইন প্রণীত হয় : সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইনসভায় যে সকল আইন প্রণীত হয় সেগুলো জনগণের কল্যাণ সাধনে বদ্ধপরিকর। কেননা, আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি বিধায় তাঁরা জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে আইন, প্রণয়নে উদ্যোগী হন ।

১২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়। এই ব্যবস্থায় দেশের প্রচার মাধ্যম তথা সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ইত্যাদি স্বাধীনভাবে মতামত পেশ করতে পারে। এতে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। ফলে একদিকে সরকারের কার্যের স্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন  করা সম্ভব হয় ।

১৩. নমনীয় প্রকৃতির শাসনব্যবস্থা : সংসদীয় ব্যবস্থা যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে পারে । আবার জরুরি অবস্থায় নির্বাচন ছাড়াও মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনয়ন করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য যে কোনো প্রকার সংকটকালীন বিপর্যয়কে এই ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে পারে।

১৪. বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। ফলে কোনো শ্রেণি  বা গোষ্ঠী সরকারের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে না। অধিকন্তু এই ব্যবস্থা নমনীয় প্রকৃতির বিধায় এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের সম্ভাবনাও থাকে না।

১৫. প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশেষ ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রী আইনসভাকে ভেঙে দিতে পারেন। ফলে আইনসভাও শাসন বিভাগের সাথে সমন্বয় সাধন করে কাজ করে যায় ।

১৬. জনমতের প্রতি সংবেদনশীল : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা জনমতের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে থাকে। কারণ ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে যে সকল প্রতিশ্রুতি প্রদান করে বিজয়ী হয়ে এসে সেগুলো ক্ষমতায় থেকে বাস্তবায়ন করতে না পারলে পরবর্তী নির্বাচনে জনমতকে তাদের অনুকূলে প্রবাহিত করতে পারে না ।

১৭. প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রমুখি করা সম্ভব : সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রমুখী করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্রসমূহে ক্রমান্বয়ে অধিকতর গণতন্ত্র প্রয়োগ করা হয়। আর তা সম্ভব হয় নির্বাচনের মাধ্যমে বা জনমতের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে ।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অন্যান্য সরকার ব্যবস্থার তুলনায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা উত্তম। এই ব্যবস্থায় একাধারে জনমতের প্রতিফলন ঘটে, জনপ্রতিনিধিগণ জনকল্যাণ সাধনে তৎপর হয় এবং জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। তবে মূল কথা হলো সরকারের ভালোমন্দ নির্ভর করে পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং জনগণের গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডের উপর। তাই বলা যায় যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অপরাপর সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম। যে কারণে বর্তমান বিশ্বে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি অত্যধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত।

Leave a Reply