সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের দোষাবলি বা অসুবিধা Demerits/ Disqualities of Parliamentary Government
নিম্নে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের অসুবিধা বা দোষসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. দলীয় শাসন : দলীয় শাসন সংসদীয় সরকারের অন্যতম ত্রুটি। নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় সেই সরকারে সঙ্গত কারণেই দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য দেয়া হয়। দলীয় শাসনের ফলে অন্যান্য দলের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়। তাছাড়া ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে কোনো প্রকার হীন ব্যবস্থা যেমন গ্রহণ করতে পারে, তেমনি বিরোধীরা ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করে। ফলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। যদিও সংসদীয় গণতন্ত্রে এ ধরনের অভিযোগ বা ত্রুটি কাম্য নয়।
২. দলীয় স্বৈরাচার : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। এতে দলের স্বার্থ, মতামত ও সিদ্ধান্ত বড় করে দেখা হয় এবং আইন, বিচার ও শাসন কার্য সেভাবেই পরিচালিত হয়। এমনকি ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সিদ্ধান্ত বা মত যতই ভ্রান্ত হোক না কেন তাই গ্রহণ করে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু বা বিরোধীদের যুক্তিপূর্ণ মত ও সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে। এতে করে তাদের মধ্যে অবাধ স্বেচ্ছাচার জন্ম নেয় ।
৩. জরুরি অবস্থায় অনুপযোগী : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার জরুরি অবস্থায় তেমন উপযোগী নয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় অনেক আলাপ-আলোচনা ও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, যা অনেকটা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু জরুরি অবস্থায় এমন দীর্ঘসূত্রিতা কাম্য নয়। যে কারণে বলা যায়, এ ধরনের সরকার ব্যবস্থা জরুরি পরিস্থিতিতে অনুপযুক্ত ।
৪. দুর্বল সরকার : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার এক ধরনের দুর্বল সরকার। আইনসভার নির্বাচনে কখনো কখনো একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে নাও পারে। এরূপ অবস্থায় ছোট ছোট দল নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। কিন্তু ছোট ছোট দলসমূহ যে কোনো সময় সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে। ফলে শাসনতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে ।
৫. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্যরা একই সাথে আইনসভারও সদস্য। তারা শাসনকার্য ছাড়াও আইন প্রণয়ন কার্যে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এরূপ অবস্থায় শাসন ও আইন বিভাগের মধ্যে যোগসূত্র থেকেই যায় ৷ যে কারণে এ ব্যবস্থায় ক্ষমতার পৃথকীকরণ সম্ভব নয়।
৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত না হওয়ায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বর্তমান থাকে । ফলে এই দুই বিভাগের মধ্যে এক প্রকার “অশুভ আঁতাত”-এর আশঙ্কা থাকে। যে কারণে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ।
৭. অস্থায়ী : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা অনেকটাই অস্থায়ী। কেননা, এ ব্যবস্থায় আইনসভার আস্থা- অনাস্থার উপর মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব নির্ভর করে। আইনসভা যে কোনো সময় সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করতে পারে। আর এতে করে মন্ত্রিসভার পতন অনিবার্য। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মেয়াদের পর নির্বাচন, মধ্যবর্তী নির্বাচন, উপ-নির্বাচন, সরকারের প্রতি আইনসভার অনাস্থা, জনগণের খেয়ালখুশি মতো কোনো দলের সমর্থন দান ইত্যাদি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারকে সফল হতে দেয় না।
৮. জাতীয় অগ্রগতির অন্তরায় : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার মাঝে মাঝে জাতীয় অগ্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । ঘন ঘন মন্ত্রিসভার রদবদলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেমন সফল হয় না, তেমনি বিরোধী দলের সমালোচনা, কাজে- অকাজে সর্বদাই বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা, ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদল নামক দুটি শিবিরে বিভক্তি প্রভৃতি অকল্যাণকর ও উন্নয়নের পরিপন্থী।
৯. দুর্নীতি : দুর্নীতির উপস্থিতি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি। কেননা, শাসনব্যবস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, নির্বাচকমণ্ডলী, আইন প্রণেতা, নীতি নির্ধারক, মন্ত্রী, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি জনগণ বা ভোটদাতাগণ সহজেই দুর্নীতির কবলে পড়ে। সংসদীয় সরকার দলীয় সরকার বিধায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রিগণ দলীয় নেতা- কর্মীদের প্রাধান্য দেন। আর এভাবে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির পথ ধরে সরকার দুর্নীতির দিকে ধাবিত হয়। দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ফলে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বিকৃত বা অবমূল্যায়িত হয় ।
১০. ধনতান্ত্রিক প্রভাব ও বৈষম্য : এটি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের অন্যতম দুর্বলতা। পুঁজিবাদের অসম প্রভাব ও অর্থনৈতিক অসাম্য রাজনৈতিক সাম্যকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে এর সাথে যেমন ধনতন্ত্রের কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তেমনি এটি ধনিকদের রক্ষাকবচে পরিণত হয়। ফলে সামষ্টিক কল্যাণ তিরোহিত হয়।
১১. অদক্ষ প্রশাসন : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তির শাসন লক্ষ করা যায়। পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা গুণগত ভিত্তিতে নির্বাচিত না হওয়ায় সর্বদা যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হন না। অধিকন্তু বর্তমান সময়ে জনগণকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে, অপপ্রচার ও পেশি শক্তির মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হন। এভাবে আইনসভায় বহু অযোগ্য ব্যক্তি স্থান লাভ করে বিধায় সার্বিকভাবে প্রশাসনে অদক্ষতা দেখা দেয়।
১২. আমলাতান্ত্রিক প্রভাব : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার মূলত একটি আমলাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। কারণ জনগণ, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রিগণ প্রায়ক্ষেত্রেই প্রশাসন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। যে কারণে তাদেরকে আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে শাসনের কেন্দ্রস্থলে বসে আমলারা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তাই এ ব্যবস্থাকে “অপেশাদার” বা “সৌখিন সরকার” (Government by Amaterers) বলা হয়। Ramsay Muir – এর ভাষায়, “The influence of bureaucracy of parliamentary government by the office also is all round is England. Bureaucracy not only rules but it also prepares the outlines of the laws.”
১৩. ব্যয়বহুলতা : সংসদীয় পরিচালনা ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ অ
নির্বাচন পরিচালনা, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে নেতাদের বেহিসাবী খরচ, রাষ্ট্র পরিচালনা, সেনাবাহিনী পরিচালনা প্রভৃতি কাজে ব্যাপক হায় হয়ে থাকে। ফলে সরকারি তহবিলের অতিরিক্ত খরচ বা অপচয়ে জনস্বার্থ ও জনকল্যাণ উপেক্ষিত হয়।
১৪. রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সংসদীয় ব্যবস্থার অনেক সময় রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের মধ্যে নীতিগত প্রশ্নে মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এখন পরিস্থিতিতে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে এবং সেই সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং-এর সঙ্গে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর দ্বন্দ্ব-বিরোধ ভারতীয় রাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।
১৫. অস্থিতিশীলতা। সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা নয়। কারণ এই সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট মেয়াদি জীবন নেই। যে কোনো মুহূর্তে আইনসভার অনাস্থা দ্বারা সরকারের পতন ঘটতে পারে। ফলে গোটা শাসনব্যবস্থা অনিশ্চয়তার ধূম্রজালে আবদ্ধ থাকে। তাছাড়া ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে বিধায় এ ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
উপরিউক্ত সমালোচনা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিনিধিত্বশীল সরকারগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সরকার। এ জাতীয় সরকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। যে কারণে বলা হয়ে থাকে, “Parliamentary government is better than any other system of government.”