সংসদীয় শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ

সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইনসভা কর্তৃক শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ

Parliamentary/Legislative Control over the Executive in case of Parliamentary Government

সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। এ সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা চর্চা হচ্ছে শাসন বিভাগের উপর আইনসভার নিয়ন্ত্রণ। এতে আইনসভার কাছে মন্ত্রিসভা একক ও যৌথভাবে দায়ী। আইনসভা বিভিন্নভাবে শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। যেমন-

১. আইন প্রণয়ন : আইনসভার অন্যতম প্রধান কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। আইনসভা নতুন আইন তৈরি এবং পুরাতন আইনের সংশোধনের মাধ্যমে শাসন বিভাগের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আইন লঙ্ঘনের ভয়ে শাসন বিভাগ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে ।

২. প্রশ্ন জিজ্ঞাসা : শাসন বিভাগকে আইন বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের একটি মোক্ষম অস্ত্র হলো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা। আইনসভার সদস্যগণ সরকারের মন্ত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। প্রত্যেক মন্ত্রী এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য থাকেন। কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। যে কারণে শাসন বিভাগ সর্বদাই আইন সভার সদস্যদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে চেষ্টা করে। এভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

৩. মূলতবী প্রস্তাব : পার্লামেন্টের চলমান সকল কার্য মূলতবী রেখে জনগুরুত্বসম্পন্ন কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য আইনসভার সদস্যরা মূলতবী প্রস্তাব (Adjournment motion) উত্থাপন করতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে আলোচনায় অংশ নিয়ে আইন পরিষদের সদস্যগণ সরকারের দোষ-ত্রুটি ও ব্যর্থতা উত্থাপন ও প্রতিকার দাবি করেন। এক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার সদস্যদের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

৪. নিন্দা প্রস্তাব : আইনসভার সদস্যগণ নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমেও শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শাসন বিভাগের কোনো কাজ আইনসভার সদস্যদের মনঃপুত না হলে তারা আইনসভায় এ প্রস্তাব উত্থাপন করে শাসন বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারেন। শাসন বিভাগ এজন্য সতর্কতামূলকভাবে কার্য সম্পাদন করেন।

৫. ছাঁটাই প্রস্তাব : ছাঁটাই প্রস্তাবের মাধ্যমেও আইন বিভাগ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আইনসভায় উত্থাপিত কোনো বিলের উপর আলোচনাকালে বিরোধীদলের সদস্যগণ বিলটিকে গণমুখি আইনে পরিণত করার জন্য আইনের খসড়া বিলটিকে সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন। এটা পাস হলে প্রস্তাবকৃত মূল আইন পরিবর্তিত হয়ে যায়। এজন্য আইন প্রণয়নের পূর্বে শাসন বিভাগ খসড়া আইনের বিলকে অনেক যাচাই বাছাই করে পেশ করেন । ৬. অনাস্থা প্রস্তাব : শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন বিভাগীয় পদক্ষেপ হলো অনাস্থা প্রস্তাব (No Confidence motion) আনয়ন। আইনসভা শাসন বিভাগের বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব পাস করলে শাসন বিভাগ পদত্যাগে বাধ্য হয়। অনাস্থা প্রস্তাবের ভয়ে শাসন বিভাগ সর্বদাই তটস্থ থাকে ।

৭. বিতর্ক আলোচনা : আইনসভায় যে কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে পারে। এসব আলাপ- আলোচনা ও বিতর্ক থেকে শাসন বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রম ও ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। আর এক্ষেত্রে শাসন বিভাগীয় বিভিন্ন অনিয়মের জন্য বিভাগটি সমালোচিত হয়। এতে করে শাসন বিভাগের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার আশংকায় শাসন বিভাগ নিজেকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে দূরোসরিয়ে রাখে ।

  1. অভিযোগ উত্থাপন : এ ব্যবস্থায় আইন বিভাগীয় সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে অভিযোগ উত্থাপন ও তার প্রতিকার দাবি করতে পারে। এভাবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাজ-কর্মের সমালোচনা ও ব্যাখ্যা দাবি করা হয়। আইন বিভাগীয় সদস্যদের উত্থাপিত অভিযোগ ও সমালোচনাকে মন্ত্রিরা উপেক্ষা করতে পারেন না ।

৯. বাজেট : বাজেট হলো সরকারের আয়-ব্যয়ের খতিয়ান। আইনসভায় বাজেট পাস না হলে সরকার একটি পয়সাও ব্যয় করতে পারে না। প্রত্যেক অর্থ বছরের শেষে আইনসভায় বাজেট উত্থাপন করা হয়। আইনসভার সদস্যগণ বাজেটের উপর আলোচনা সমালোচনার পর তা পাস করেন। আর এই প্রক্রিয়ায় বাজেটের মাধ্যমে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ১০. তদন্ত কমিটি গঠন : শাসন বিভাগের অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনসভা সংসদীয় কমিটি গঠন করতে পারে। এ তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন আইনসভায় উত্থাপন করে তা প্রতিকারের জন্য সুপারিশ করেন। অনিয়ম প্রমাণিত হলে শাসন বিভাগের সুনাম নষ্ট হয় এবং তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। যে কোনো বিষয়ে তদন্ত হতে পারে এ ভয়ে শাসন বিভাগ কোনো প্রকার অনিয়ম করা থেকে বিরত থাকে।

১১. নিয়োগ : সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনসভার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। শাসনবিভাগের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। শাসন বিভাগের পেছনে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন অবশ্যই থাকতে হবে, অন্যথায় এ বিভাগ কাজ করতে পারবে না ।

১২. অপসারণ : সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও মন্ত্রিসভা আইনসভার কাছে দায়ী থাকে। মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব আইনসভার আস্থা-অনাস্থার উপর নির্ভরশীল। এমনকি মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রপতি আইনসভা কর্তৃক মনোনীত হয়ে পরবর্তী সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে তাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

১৩. মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা : মন্ত্রিসভা আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা নিজ নিজ দপ্তর সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত আইনসভায় উপস্থাপন করেন। তাঁরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে একক ও যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন।

১৪. রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও অপসারণ : প্রজাতান্ত্রিক সংসদীয় রাষ্ট্রে আইনপরিষদ কর্তৃক একজন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। তিনি আইনসভার সদস্যদের অনাস্থার মুখে পদচ্যুত হতে পারেন বিধায় তিনি আইনসভার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন ।

সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংসদীয় সরকারের আইনসভা কর্তৃক শাসন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় ৷ কিন্তু কার্যত আইন বিভাগের এসকল পদ্ধতি অকার্যকর। কারণ এ ব্যবস্থায় সরকারি দল দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সকল বাধাকে উপেক্ষা করতে পারেন। তথাপি সংসদীয় ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতিতে এসকল পদ্ধতি অনেকটাই কার্যকর।

Leave a Reply