সংবিধান প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিসমূহ Methods of Establishing Constitution
সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি অবস্থা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ তাদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রায় অভিন্ন নিয়ম পালন করে থাকেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশের পূর্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেসব দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধান গড়ে উঠেছে।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী র্যামজে গেটেল (Gettell) তাঁর ” Political Science” গ্রন্থে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলোবী (WF. Willoughby) তাঁর “The Government of Modern State” গ্রন্থে সংবিধান প্রতিষ্ঠা বা প্রণয়নের চারটি পদ্ধতির কথা বলেছেন। যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১.রাজাদেশ বা অনুমোদন ( By Grants) : রাজার আদেশ বা শাসকের অনুমোদনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সংবিধান। তবে এ পদ্ধতি অত্যন্ত পুরনো। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা (১৭৭৬) ইত্যাদির পূর্বে ও পরে পৃথিবীর দেশে দেশে স্বৈরশাসন পরিলক্ষিত হয়। এসব শাসক তাদের ইচ্ছেমাফিক দেশ পরিচালনা করতেন। ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ইত্যাদি মানব জীবনের মৌলিক বিষয়গুলো ছিল একেবারে উপেক্ষিত। ফলে সময়ের পরিবর্তন এবং জনগণের জীবনের প্রয়োজন ইত্যাদি কারণে প্রতিবাদী ও সংগ্রামি জনগণ স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ও দমননীতি উপেক্ষা করে সুগঠিত হয়ে রাজা বা শাসকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এসব চুক্তিতে রাজা বা শাসকের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, জনগণের প্রতি তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে জনগণের অধিকার ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। এসব চুক্তিতে রাজা বাধ্য হয়ে অনুমোদন দিয়ে থাকেন। সুতরাং বলা যায়, রাজা বা শাসকের আদেশ বা অনুমোদনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সংবিধান। এভাবে ১২১৫ সালে টেমস নদীর রানিমিড দ্বীপে রাজা জন কর্তৃক স্বাক্ষরিত ম্যাগনাকার্টা, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের ঘোষণা (১৭৯৯), জাপানের মেইজী সম্রাটের ঘোষণা (১৮৮৯), রুশ সম্রাট দ্বিতীয় জার নিকোলাসের অনুমোদন (১৯০৫) ইত্যাদির মাধ্যমে সেসব দেশে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়।
গণপরিষদে আলাপ-আলোচনা বা সুপরিকল্পিত রচনা (By Deliberate Creation) : যখন কোনো দেশের সংবিধান সুপরিকল্পিতভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে তখন তাকে সুপরিকল্পিত রচনা বলে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান হলো গণপরিষদ। গণপরিষদের সদস্যরা সাধারণত জনগণের ভোটে প্রথমে আইন পরিষদের সদস্য হন। এ আইন পরিষদ সংবিধান প্রণয়ন করলে তখন তার নাম হয় গণপরিষদ। অবশ্য জনগণের ভোট ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনোনয়নের মাধ্যমে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচন করা হয়। এসব গণপরিষদের প্রথমে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এরপর উক্ত খসড়া সংবিধানের উপর উন্মুক্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় এর বিভিন্ন ধারা এবং উপধারায় পরিবর্তন বা সংযোজন করা হয়। প্রয়োজনে একে গণভোটেও দেয়া হয়। সবশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এক পাস করিয়ে সরকার প্রধানের অনুমোদন নেয়া হয়। এভাবে ১৭৮৯ সালে মার্কিন সংবিধান, ১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধান এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।
৩. ক্রমবিবর্তনের মাধ্যম (By Gradual Evolution) : ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমেও সংবিধান গড়ে ওঠে। এ অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট শাসক বা প্রতিষ্ঠান সংবিধান প্রণয়ন করে না। মূলত অত্যাচারী শাসকদের থেকে জনগণ এ ধরনের সংবিধান আদায় করে নেয়। শাসকগণের অত্যাচার যখন চরমে পৌঁছে তখন জনগণের মধ্যে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের স্পৃহা জাগরিত হয়। জনগণ তখন ঐক্যবদ্ধভাবে শাসকের নিকট থেকে কতিপয় দাবি আদায় করে থাকে, যা বিধিবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। এছাড়া শাসকরাও অনেক সময় তাদের উৎকর্ষ প্রমাণ করতে গিয়ে জনগণকে কতিপয় বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুনের আওতায় নিয়ে আসে। এভাবে জনগণ ও শাসকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বা শাসনকার্যের নীতিমালা প্রণয়ন করতে গিয়ে ধীরে ধীরে কতিপয় বিধান রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এভাবেই ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সংবিধান। এসব সংবিধান মূলত অলিখিত হয়। ব্রিটিশ সংবিধান ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সংবিধানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ । ৪. বিপ্লবের মাধ্যমে (By Revolution) : লেনিন এবং মাও সে তুং-এর মতে, বিপ্লব হলো প্রচলিত শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নতুন ধ্যান-ধারণা চালু করা। বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার পূর্ববর্তী সরকারের সকল কিছুতেই পরিবর্তন আনেন। ফলে সরকারকে সংবিধানও নতুনভাবে রচনা করতে হয়। বিপ্লবী সরকার অবশ্য তার নতুন সংবিধান প্রণয়নে জনগণের মতামত গ্রহণ বা তাদের অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপ্লবোত্তর সরকারের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার নজির রয়েছে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব এবং ১৯৪৯ সালের চীনা বিপ্লবের মাধ্যমে সেসকল দেশে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ধারণার সুপ্রচারণার ফলে সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিই তার জঠর থেকে সংবিধানকে জন্ম দেয়, একে লালিত পালিত করে এবং আইনগত ক্ষমতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। সংবিধান থেকেই উৎসারিত হয় অন্য সকল আইন ।