লিখিত সংবিধান : অর্থ, সংজ্ঞা, ধারণা Written Constitution:
Written Constitution: Meaning, Definition, Concepts
সাধারণত যে সংবিধান লিখিত অবস্থায় থাকে তাকে লিখিত সংবিধান বলে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ যে আইনগত দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে তাই লিখিত সংবিধান।
১. অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettell)-এর মতে, “যখন কোনো দলিলে সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার সকল মৌলিক নীতি অন্তর্ভুক্ত থাকে, তখন তাকে লিখিত সংবিধান বলে।”
২. কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare)-এর মতে, “লিখিত সংবিধান সেসব লিখিত নিয়মের সমষ্টি যা কি উদ্দেশ্যে ও সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে কীভাবে ক্ষমতা পরিচালিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।”
৩. ড. গার্নার (Prof. Garner)-এর মতে, “লিখিত সংবিধান সাধারণত এমন এক বিশেষ কৌশল যা উচ্চতর আইনগত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত ও যা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনযোগ্য।”
সুতরাং লিখিত সংবিধান বলতে এমন এক লিখিত দলিলকে বুঝায়, যাতে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত মৌলিক নিয়ম বা বিধি- বিধানসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে। যেমন— বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া প্রভৃতিসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংবিধানই লিখিত ৷ এরূপ সংবিধান রচিত হয় দেশের বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুণী ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে এবং তা কোনো গণপরিষদ (Assembly) বা সম্মেলন (Convention) কর্তৃক প্রণীত, ঘোষিত ও স্বীকৃত হয় ।
লিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of written constitution) : লিখিত সংবিধানের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন :
১. এতে রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যক মূলনীতিসমূহ সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকে ।
২. শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় মৌলিক নীতিসমূহ একটি বা কয়েকটি দলিলে লিপিবদ্ধ থাকতে পারে ।
৩.পূর্ব পরিকল্পনা এবং আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত সংবিধান প্রণীত হয়ে থাকে ।
৪. লিখিত সংবিধান সাধারণত কোনো গণপরিষদ বা আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রণীত হয় ।
৫. লিখিত সংবিধানের রচনাকাল সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যায় ।
৬. লিখিত সংবিধান সহজে সংশোধন করা যায় না।
লিখিত সংবিধানের গুণাবলি/ সুবিধাসমূহ Qualites/ Merits of Written Constitution
লিখিত সংবিধান কতিপয় যেসব গুণ বা সুবিধার অধিকারী সেগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত গুণ বা সুবিধাসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
১. লিখিত রূপ : লিখিত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যক মূলনীতিসমূহ কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ থাকে। যে কারণে লিখিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত বিষয় সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় না। লিখিত সংবিধান পাঠের মাধ্যমে জনগণ তাদের অধিকার ও কর্তব্য, সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে যেমন জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তেমনি প্রয়োজনে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামও করতে পারে।
২. সুস্পষ্টতা : স্পষ্টতা ও সুনির্দিষ্টতা লিখিত সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ সংবিধানের ধারাসমূহ সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত থাকে বিধায় সহজে বোধগম্য হয়। সরকার এবং জনগণ উভয়ে নিজস্ব অধিকার এবং কর্তব্য বিষয়ে জ্ঞাত থাকতে পারে।
৩. স্থায়িত্ব : স্থায়িত্ব লিখিত সংবিধানের একটি গুণবাচক দিক। কেননা, খেয়াল খুশিমতো এই সংবিধানের বিধিবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না। যার দরুন যে কোনো প্রকার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশেও লিখিত সংবিধান তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
- দুষ্পরিবর্তনীয় : লিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না। পরিবর্তনের জন্য বিশেষ পন্থা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। যে কারণে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নিজেদের সুবিধামতো লিখিত সংবিধানকে পরিবর্তন করতে পারে না। অর্থাৎ, লিখিত সংবিধান স্থায়িত্বের প্রতীক— যা উত্তম সংবিধানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
৫. জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি : লিখিত সংবিধানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। কারণ লিখিত সংবিধান সাধারণত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কোনো গণপরিষদ বা কমিশন কর্তৃক রচিত হয়। এভাবে জনপ্রতিনিধিদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে সংবিধান প্রণীত হয় তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে।
৬. মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণ : লিখিত সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচসমূহের উল্লেখ থাকে। যে কারণে সরকার সহজে এসব মৌলিক অধিকার হতে জনগণকে বঞ্চিত করতে পারে না বা এসব অধিকারে হস্ত ক্ষেপ করতে পারে না। লর্ড বাইস (Lord Bryce)-এর মতে, “There is a mention of fundamental rights in a written costitution the rights and freedom of the people are protect against absolute rule.” ৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উপযোগী : বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একটি উত্তর শাসনব্যবস্থা। আর লিখিত সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার সাথে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, এ ধরনের সংবিধানে কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত থাকে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার একক প্রাধান্যের মাধ্যমে এককেন্দ্রিক শাসন কায়েম করতে পারে না।
৮.হস্তক্ষেপমুক্ত : লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়া হয়। যে কারণে এক বিভাগ তার সীমা অতিক্রম করে অপর বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
৯. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : বিচার বিভাগীয় প্রাধান্য লিখিত সংবিধানের একটি মৌলিক দিক। এ সংবিধানের মাধ্যমে আদালতের পক্ষে সুষ্ঠু বিচার কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হয়। বিচার বিভাগ লিখিত সংবিধানের অভিভাবক হিসেবেও গণ্য। আইনসভা বা শাসন বিভাগ সংবিধান লঙ্ঘন করে কোনো কাজ করলে বিচার বিভাগ সেই কাজকে অবৈধ বা বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারে।
১০. ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষক : লিখিত সংবিধানে ব্যক্তির অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে বিধায় তা ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করে । কেননা, ব্যক্তি এসব অধিকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভোগ করার সুযোগ পায়। ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার সুসংহত হয় ।
- J. Laski. A Grammar of Politics (London; George Allen & Urwin Ltd., 1960), p-104
১১. বিপ্লব প্রতিরোধ : লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিরোধ করা সহজ হয়। কেননা, সামাজিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে এ সংবিধান প্রণয়ন করা হয় বিধায় বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে। বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকলে সামাজিক গতিশীলতাও আসে।
১২. শাসক-শাসিতের সম্পর্ক নির্ণয় : লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে শাসক ও শাসিত তথা জনগণের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণীত হয়। লিখিত বিধি-বিধানের আলোকে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক স্পষ্ট থাকে। কোনো পক্ষ এ সংবিধানকে উপেক্ষা করতে পারে না। ১৩. রাজনৈতিক চেতনাবোধ : লিখিত সংবিধানে জনগণের সকল প্রকার অধিকার ও কর্তব্য লিখিত থাকে বিধায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাবোধ জাগ্রত হয়।
লিখিত সংবিধানের দোষ বা অসুবিধাসমূহ Disqualities/ Demerits of Written Constitution
লিখিত সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বহুমুখী সুবিধার পাশাপাশি এর কতিপয় ত্রুটি বা অসুবিধাও পরিলক্ষিত হয়। এ সব ত্রুটি লিখিত সংবিধানকে এক প্রকার সীমাবদ্ধতা দান করে। লিখিত সংবিধানের দোষ বা ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাসমূহ নিম্নরূপ :
১. রক্ষণশীলতা : রক্ষণশীলতা লিখিত সংবিধানের প্রধান সমস্যা। কেননা, লিখিত বিধানের পরিবর্তন করতে সরকার সহজে আগ্রহ দেখায় না, অথচ পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার কারণে সংবিধানের ধারা বা উপধারার পরিবর্তন আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
২. অসামঞ্জস্যপূর্ণ : লিখিত সংবিধানের অন্যতম সমস্যা হলো এই সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না। যে কারণে এই
সংবিধান পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামোর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়। ফলে শাসন প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দেয়। ৩. সংশোধন জটিলতা : লিখিত সংবিধান সংশোধনে জটিলতার সৃষ্টি হয়। কেননা, অলিখিত সংবিধানের ন্যায় কিংবা সাধারণ আইন পাসের ন্যায় লিখিত সংবিধানকে সহজে পরিবর্তন করা যায় না। লিখিত সংবিধান সংশোধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন হয় বিধায় তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. সংস্কার পরিপন্থী : লিখিত সংবিধান অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু লিখিত সংবিধান জটিল প্রকৃতির, সেহেতু এটি পরিবর্তনে ব্যাপক সময় ও পরিবেশ দরকার হয় স্বল্প সময়ে এ সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না। ফলে এটি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করে ।
৫. অগ্রগতির অন্তরায় : লিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না বিধায় এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। অর্থাৎ অলিখিত সংবিধান সময় ও বাস্তবের সাথে সঙ্গতিহীন বিধায় এটি অগ্রগতির পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে ড: গার্নার (Dr. Garner) বলেছেন, “Written constitution is often rigid and the progress of the country is retarded.”
৬. বিচার বিভাগের প্রভাব : লিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগকে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি এক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে সংবিধানের অভিভাবক বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, যে কোনো প্রকার সাংবিধানিক জটিলতার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। মার্কিন বিচারপতি Huges-এর ভাষায়, “We are under constitution but the constitution is what the judges say it is.”
৭. বিদ্রোহ-বিপ্লবের আশঙ্কা : লিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয় বিধায় পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে সঙ্কটকালে সংবিধান লঙ্ঘিত হয় ও জনমনে অসন্তোষ থেকে বিদ্রোহ-বিপ্লবের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
৮. রাজনৈতিক অস্থিরতা : লিখিত সংবিধান অনেক সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী। প্রায়ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংবিধানের বিভন্ন ধারা ও উপধারার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা পরিবর্তন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। যেমন— বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় ২০০৬ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে বিতর্ক দেখা দেয় ।
৯. স্বাধীনতার যথার্থ রক্ষাকবচ নয় : লিখিত সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার ভোগের ব্যাপারে নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে, এমন ধারণাও পুরোপুরি ঠিক নয়। দেশের জনগণ ও বিচারব্যবস্থার উপর নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। ইংল্যান্ডের সংবিধান অলিখিত হলেও ইংরেজরা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের অধিবাসীদের তুলনায় কম স্বাধীনতা ভোগ করে না। আবার জার্মানির পূর্বের সংবিধান লিখিত হলেও জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সেই সংবিধান যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
১০. সংকীর্ণতা : লিখিত সংবিধানে লিপিবদ্ধ বিধানাবলিকেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতিকে উপেক্ষা করা হয়। অথচ, যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থায় এসব রীতিনীতির সাংবিধানিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যে কারণে লিখিত সংবিধানের ধারণাকে সংকীর্ণ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লিখিত সংবিধানের বিভিন্ন গুণ বা সুবিধার পাশাপাশি কিছু দোষ-ত্রুটিও বিদ্যমান। কিন্তু বলাবাহুল্য যে, কোনো সংবিধানই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। কাজেই এক্ষেত্রে লিখিত সংবিধানেরও কিছু দোষ- ত্রুটি থাকতে পারে এটাই স্বাভাবিক। তবে দোষ অপেক্ষা লিখিত সংবিধানের গুণ বা সুবিধাই অধিক। যে কারণে বিশ্বব্যাপী লিখিত সংবিধান প্রশংসিত হচ্ছে। লিখিত সংবিধানের সপক্ষে মনীষী গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য; তিনি বলেন, “Written constitution considered as a sacred document and it is apt to command the confidence of the people.”