Table of Contents
Toggleলর্ডসভার কার্যপদ্ধতি Procedure of the House of Lords
লর্ডসভার কার্যপদ্ধতি
Procedure of the House of Lords
ক. অধিবেশন : রাজা বা রানী লর্ডসভার অধিবেশন আহ্বান করেন এবং সমাপ্তি ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাজা বা রানী একই সঙ্গে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অধিবেশন শুরু করেন ও শেষ করেন। কিন্তু একই সঙ্গে লর্ডসভার অধিবেশন মূলতবি ঘোষিত হয় না। সাধারণত সোম থেকে বৃহস্পতি সপ্তাহের এই চারদিন পর্ডসভার অধিবেশন বসে। তবে প্রয়োজনবোধে শুক্রবারও অধিবেশন বসতে পারে। ওয়েস্ট মিনস্টারে নিজেদের একটি কক্ষে লর্ডসভার অধিবেশন বসে ।
খ. কোরাম : ৩ জন সদস্য উপস্থিত থাকলে লর্ডসভার কার্য চলতে পারে। তবে কোনো বিল পাসের সময় অন্তত ৩০ জন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন । ১৯৫৮ সালে লর্ডসভা যে স্থায়ী নির্দেশ জারি করেছে সেই নির্দেশ অনুযায়ী পার্লামেন্টের প্রত্যেক অধিবেশনের শুরুতে লর্ডসভার সদস্যদের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই নির্দেশে উপস্থিত থাকতে অনিচ্ছুক সদস্যকে অনুপস্থিত সময়ের জন্য ছুটির আবেদন করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে লর্ড চ্যান্সেলরকে লিখিতভাবে কোনো সদস্য কিছু না জানালে ধরে নেওয়া হয় যে, সংশ্লিষ্ট সদস্য অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে আগ্রহী নন।
গ. লর্ড চ্যান্সেলর : লর্ডসভার সভাপতিত্ব করেন লর্ড চ্যান্সেলর। তিনি কেবিনেটের সদস্য। রাজা বা রানী তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নিয়োগ করেন। সাধারণত পিয়ারদের মধ্যে থেকেই লর্ড চ্যান্সেলরকে নিয়োগ করা হয়। পিয়ার নন এমন ব্যক্তিকে লর্ড চ্যান্সেলর রূপে নিয়োগ করা হলে নিয়োগের পরেই তাকে পিয়ারেজ প্রদান করা হয়। লর্ড চ্যান্সেলরের আসনটি উলস্যাক (Woolsack) নামে পরিচিত। লর্ডসভার সভাপতি হিসেবে লর্ড চ্যান্সেলরের পদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সভাপতিত্ব করা এবং প্রস্তাবসমূহকে ভোট গ্রহণের জন্য সভার নিকট উপস্থিত করা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা তাঁর হাতে অর্পিত হয়নি। লর্ডসভার কার্যপদ্ধতি সভা নিজেই ঠিক করে। সভার নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে তিনি কোনো সদস্যকে শাস্তি দিতে পারেন না ।
লর্ডসভার সভাপতি হিসেবে লর্ড চ্যান্সেলর কমন্সসভার স্পিকারের মতো নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন না। পিয়ার হিসেবে তিনি সভায় বক্তৃতা করতে পারেন বা বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে এ সময় তিনি তার আসন ত্যাগ করেন। সভার অন্যান্য সদস্যদের মতো তিনি নিজ দলের পক্ষে ভোট দিতে পারেন। তবে কমন্সসভার স্পিকারের মতো তার কোনো নির্ণায়ক ভোট (Casting vote) নেই। লর্ডসভার সদস্যগণ বক্তৃতা করার সময় লর্ড চ্যান্সেলরকে সম্বোধন না করে My Lords’ বলে সম্বোধন করেন । লর্ড চ্যান্সেলরের অনুপস্থিতিতে সহ-সভাপতি সভার কার্য সম্পাদন করেন ।
ঘ. কমিটিসমূহের লর্ড চেয়ারম্যান : লর্ড চ্যান্সেলরের অনুপস্থিতিতে সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য রাজা বা রানী পিয়ারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন এবং সহ-সভাপতি হিসেবে সভার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। এদের মধ্যে যিনি প্রথম সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি হলেন লর্ডসভার কমিটিগুলোর লর্ড চেয়ারম্যান ( Lord Chariman of Committees)। সভার প্রত্যেক অধিবেশনের জন্য তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। তিনি সকল কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ঙ. কমিটি ব্যবস্থা : লর্ডসভায় কমিটি ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু কাজ সম্পাদন করা হয়। এই সভার অনেক কাজ সমগ্ৰ কক্ষ কমিটি (Committee of the Whole House) -এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সভায় উপস্থিত সকল সদস্যই এই কমিটির সদস্য। সমগ্র কক্ষ কমিটিতে সভাপতিত্ব করেন সভার কমিটিসমূহের লর্ড চেয়ারম্যান ( Lord Chairman of Committees ) । তিনি সকল কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া লর্ডসভার অধিবেশনকালীন কমিটি এবং সিলেক্ট কমিটি আছে। অধিবেশকালীন কমিটির সদস্যসংখ্যা লর্ডসভাই নির্ধারণ করে। বিশেষ ধরনের কিছু বিল বিবেচনা বা কোনো বিশেষ বিল সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের জন্য সিলেক্ট কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্য সংখ্যাও লর্ডসভা স্থির করে।
খ. উত্তরাধিকার সূত্রে পিয়ার রাজা উত্তরাধিকারী সূত্রে পিয়ার পদ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বানের সময় রাজা একাই পিয়ারদের অধিবেশনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানাতেন। কোনো পিয়ারের মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে পিয়ার আখ্যা দিয়ে লর্ডসভায় যোগদানের জন্য আহ্বান করা হতো। এভাবে পিয়ারের পদটি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রদান করার রীতি চালু হয়। পূর্বে একমাত্র পুরুষেরাই পিতার মৃত্যুর পর লর্ডসভার সদস্যপদ অর্জনের অধিকারী ছিল। এখন মহিলারাও লর্ডসভার সদস্য হতে পারেন। উত্তরাধিকার সূত্রে উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের লর্ডসভার অধিবেশনে যোগাদানের অধিকার আছে। তবে তার বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হতে হবে।
গ. উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ড উপাধি পরিত্যাগ ও কম সভার সদস্যপদ গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয় ১৯৬৩ সালের পিয়ারেজ আইন (‘The Pearage Act 1963) এর আগে লর্ড উপাধির উত্তরাধিকার অস্বীকার করা যেত না এবং কোনো লর্ড তাঁর উপাধি পরিত্যাগ করে কমপসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না। স্বেচ্ছায় লর্ড উপাধি বর্জনের বিষয় নিয়ে ১৯৬০ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। মি. অ্যান্টনি ওয়েজ উডবেন (Mr. Anthony Wedge Woodbenn) পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ড উপাধি লাভ করেন। কিন্তু তিনি লর্ডসভার সদস্যপদ ত্যাগ করে কমপসভার নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়ী হন। বিষয়টির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন বিচার-বিবেচনার জন্য বিষয়টিকে নির্বাচনি আদালত ( Election Court ) -এ পাঠানো হয়। নির্বাচনি আদালত রায় দেয় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত লর্ড উপাধি পরিত্যাগ করা যায় না এবং লর্ড উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি কমন্সসভার সদস্য হতে পারেন না ।
ঘ. ১৯৬৩ সালের লর্ড উপাধি সংক্রান্ত আইন (The Pearge Act, 1963) : এ সমস্যা নিরসনের জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ কর্তৃক লর্ডসভার সংস্কার সংক্রান্ত যুগ্ম কমিটি (Joint Committee on House of Lords Reforms ) গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯৬৩ সালে লর্ড উপাধি সংক্রান্ত আইন (The Pearge Act 1963) প্রণীত হয়। এই আইনে বলা হয় যে, উত্তরাধিকারসূত্রে লর্ড উপাধি প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় লর্ডসভার সদস্যপদ ত্যাগ করে কমন্সসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে উত্তরাধিকারসূত্রে লর্ড উপাধি অর্জনের একবছরের মধ্যে ঐ উপাধি পরিত্যাগ করতে হবে। ১৯৭৪ সালের তথ্য অনুযায়ী লর্ডসভায় উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ড এর সংখ্যা ৮৬৫ জন ।
ঙ. স্কটল্যান্ডের লর্ড : ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের একত্রীকরণ আইন (Act of Union, 1707) অনুযায়ী প্রতিটি নতুন পার্লামেন্ট গঠনের সময় স্কটল্যান্ডের লর্ডগণ তাঁদের নিজেদের মধ্য থেকে ১৬ জনকে নির্বাচন করে লর্ডসভায় পাঠাতেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের লর্ড উপাধি সংক্রান্ত আইন (The Pearage Act) প্রণীত হবার পর থেকে স্কটল্যান্ডের সব লর্ডই লর্ডসভার সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারেন ।
চ. আয়ারল্যান্ডের লর্ড : ১৯০১ সালে আয়ারল্যান্ডের সাথে একত্রীকরণ আইন (Act of Union 1901) অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে, আইরিশ পিয়ারগণ নিজেদের মধ্য থেকে ২৮ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করে লর্ডসভায় পাঠাতে পারবেন। আইরিশ লর্ডগণ আজীবন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতেন। কিন্তু ১৯২২ সালে স্বাধীন আইরিশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর কোনো নতুন আইরিশ লর্ড ব্রিটিশ লর্ডসভায় নির্বাচিত হতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে আয়ারল্যান্ডের শেষ লর্ড মৃত্যুবরণ করায় লর্ডসভায় আয়ারল্যান্ডের আর কোনো লর্ড নেই ।
ছ. ধর্মীয় লর্ড বা যাজকীয় লর্ড : বর্তমানে লর্ডসভায় ধর্মীয় লর্ডদের সংখ্যা ২৬। আইন প্রণয়ন করে এই সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ক্যান্টারবেরী ও ইয়র্কের আর্চবিশপ, লন্ডন, ডারহাম ও উইনচেস্টারের বিশপগণ পদাধিকার বলে লর্ডসভার সদস্য হন। তাছাড়া চার্চ অব ইংল্যান্ড ২১ জন প্রবীণ বিশপ লর্ডসভার সদস্যপদ লাভ করেন। কোনো বিশপের মৃত্যু হলে তাঁর পরবর্তী প্রবীণ বিশপ লর্ডসভার সদস্যপদ লাভ করেন। এরা বিশপ হিসেবে যতদিন কার্য সম্পাদন করেন ততদিনই কেবল লর্ডসভার সদস্য থাকতে পারেন।
জ. আপীল লর্ড : ১৮৭৬ সালে প্রণীত আপীল সংক্রান্ত এখতিয়ার আইন (Appellate Jurisdiction Act, 1876) অনুযায়ী লর্ডসভায় ব্যারন উপাধি প্রাপ্ত দু’জন আপীল লর্ড নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে আপীল লর্ডের সংখ্যা ৯ জন। ১৮৮৭ সালে প্রণীত একটি আইনের মাধ্যমে আপীল লর্ডগণ লর্ডসভার আজীবন সদস্য হন। তাঁদের দায়িত্ব হলো লর্ডসভাকে বিচারসংক্রান্ত কাজে সাহায্য করা। এই শ্রেণির লর্ডগণ নিয়মিতভাবে বেতন পান ।
ধনিক-বণিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতিভূ বলা হয়। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “The House of Lords is the common fortress of wealth the house is dominated by vested interests.” সাধারণত সম্পত্তির মালিকরা রাজার পরামর্শদাতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে লর্ড উপাধিতে ভূষিত হন। আর লর্ডগণকে নিয়ে যে সভা গঠিত হয়েছিল তা লর্ডসভা নামে পরিচিত হলো ।
লর্ডসভার গঠন Composition of the House of Lords
ব্রিটেনের লর্ডসভা প্রধানত উত্তরাধিকার সূত্রে গঠিত হয়। এ কক্ষের কোনো সদস্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন না । তবে লর্ডসভা যে কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে গঠিত হয় তা নয় এ ছাড়াও এখানে অন্যান্য সদস্যবৃন্দ রয়েছেন। লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। ১৯৭৪ সালের তথ্য অনুযায়ী লর্ডসভার সর্বমোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১১০০ জন। ১৯৮৫ সালে লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ১১৮৮ জন। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাউস অব লর্ডস-এর সদস্যসংখ্যা ৭৯৯ জন। লর্ডসভা দু’ধরনের লর্ড নিয়ে গঠিত। যথা— অযাজকীয় লর্ড (Temporal Lord) এবং যাজকীয় লর্ড (Sprirtual Lord)। অযাজকীয় লর্ডগণের মধ্যে অধিকাংশ উত্তরাধিকার সূত্রে মনোনীত হন। লর্ডসভার সদস্যপদ নির্দিষ্ট নয়। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৯ জন অযাজকীয় (Temporal Lord) এবং যাজকীয় লর্ডকে (Spiritual Lord) লর্ডসভায় আসন গ্রহণ এবং ভোটদানের অধিকার দেয়া হয়েছে।
তবে লর্ডসভার সদস্যগণকে নিম্নোক্ত কয়েকভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায় :
ক. বিভিন্ন ধরনের পিয়ার : সামন্ত যুগে ব্রিটেনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনেই পিয়ার (Pears) বা উত্তরাধিকার সূত্রে সদস্যপদ অর্জনকারীদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আইনগত দৃষ্টিতে ‘পিয়ার’ (Pears) বলতে সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বোঝায়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ইংল্যান্ডে পিয়ার বলতে রাজার অধীনস্থ সামন্তদের বোঝাত। চতুর্দশ শতাব্দিতে পার্লামেন্ট দুটি কক্ষে বিভক্ত হবার পর যে সব ব্যারনকে ব্যক্তিগতভাবে লর্ডসভায় যোগদানের জন্য রাজা আহ্বান জানাতেন, তাদেরই পিয়ার বলা হতো। পাঁচ প্রকার উপাধিকারী ব্যক্তি লর্ডসভার সদস্য হতে পারেন। যথা— ক. ডিউক (Duke), খ. মার্কোয়েস (Marquess), গ. আর্ল (Earl), ঘ. ভাইকাউন্ট (Viscount) এবং ঙ. ব্যারন (Baron)। উত্তরাধিকারসূত্রে এবং রাজানুগ্রহে এসব উপাধি লাভ করা যায় ।
খ. ত্রুটিমুক্ত আইন প্রণয়নে ভূমিকা : অনেক সময় লর্ডসভা বিলের পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করে। লর্ডসভার সদস্যদের হাতে প্রচুর সময় থাকে এবং নির্বাচকমণ্ডলীর চাপ থাকে না। তাই কমথসভা কর্তৃক গৃহীত কোনো বিল লর্ডসভা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে পারে। লর্ডসভা ১৯৭২ সালের স্থানীয় সরকার বিলে প্রায় ৬০০ শব্দের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এভাবে লর্ডসভা ত্রুটিমুক্ত ও উত্তম আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখে।
গ. বেসরকারি বিল ও অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: বেসরকারি বিল এবং ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লর্ডসভা সমান দায়িত্ব পালন করে এবং কমথসভার দায়িত্বভার লাঘব করে। লর্ডসভার কাজের চাপ কম এবং অভিজ্ঞ আইনবিদদের উপস্থিতি শাসন বিভাগের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ঘ. গ্রাজ্ঞ পরিষদের ভূমিকা : লর্ডসভার সদস্যপদ স্থায়ী। তাই তারা বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। তাঁদের আলোচনা ও সমালোচনার গুণগতমান উন্নত। লর্ডসভার সদস্যগণ দীর্ঘকাল যাবৎ আইনসভার সদস্যপদে অধিষ্ঠিত থাকেন। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকেন না। তাই তারা অভিজ্ঞতার আলোকে যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে পারেন। এই সভাকে তাই প্রধানদের প্রাজ্ঞ পরিষদ বলা হয়।
২. শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা (Executive Powers ) : লর্ডসভা সরকারের বিভিন্ন নীতি নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারে। এই সভা সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তাছাড়া লর্ডসভা শাসন বিভাগীয় নীতি অনুমোদন ও পরীক্ষা করে দেখতে পারে। সর্বোপরি, বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষেত্রে লর্ডসভার ভূমিকা কমন্সসভার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে উভয়কক্ষ যৌথভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় লর্ডসভা থেকেও সদস্য গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৭ সালের কমন্সসভা অযোগ্যতা আইন (The Commons Disqualification Act) এবং ১৯৬৪ সালের সংশোধিত রাজকীয় মন্ত্রী আইন (Minister’s of the Crown Act) অনুযায়ী কমন্সসভা থেকে মন্ত্রীদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাই লর্ডসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে মন্ত্রী করা হয়। সাধারণত দুই থেকে চারজন কেবিনেট মন্ত্রী লর্ডসভার সদস্যদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়। লর্ড চ্যান্সেলর কেবিনেটের সদস্য ।
৩. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা (Powers to control the executive organ) : লর্ডসভা অনেক ক্ষেত্রে সরকারের কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লর্ডসভার সদস্যগণ মন্ত্রীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আলোচনার প্রস্তাব ও কার্যবিবরণী উত্থাপন করে, সরকারি নীতির প্রশংসা ও সমালোচনা করে। এমন কি লর্ডসভা সরকারি সংবিধি বা দলিল প্রত্যাখ্যান করতে পারে, উদাহরণস্বরূপ ১৯৬৮ সালে লর্ডসভা শ্রমিক দলের প্রধানমন্ত্রী উইলসন (Harold Wilson) কর্তৃক উত্থাপিত সপরিষদের রাজাদেশ (Order in council) প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ব্রিটেনে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। এই আদেশে উইলসন সরকার রোডেশিয়ার অবৈধ হোয়াইট গভর্নমেন্ট (White Government) এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন লর্ডসভা শ্রমিক সরকারের রোডেশিয়া নীতির বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত লর্ডসভার অনুমোদন ছাড়া বিলটি গৃহীত ও আইনে পরিণত হয়।
৪. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা (Judicial Powers ) : লর্ডসভার হাতে কিছু কিছু বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে। এটি গ্রেট ব্রিটেনে ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। লর্ডসভার মূল ও আপীল উভয় এলাকাই আছে। বর্তমানে মূল এখতিয়ারের গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এখন কেবল খেতাবের দাবি সম্পর্কিত মামলার বিচার মূল এলাকায় হয়। তবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে লর্ডসভার কাছে আবেদন করা যায়। হার্ভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেছেন, in appeal matters, however, it remains the supreme and final court in the United Kingdom, both for criminal and civil jurisdiction. তাছাড়া লর্ডসভা লর্ড উপাধি সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা করে। লর্ডসভার প্রতিনিধি নির্বাচনেরও ক্ষমতা আছে। আবার সভার অধিকার ভঙ্গের জন্য লর্ডসভা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা করতে পারে বা জেলে পাঠাতে পারে। তবে আপীল বিচারের সময় কেবল আইনজ্ঞ লর্ডরাই উপস্থিত থাকেন ।
৪. অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা (Financial Powers ) : লর্ডসভার অর্থসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা রয়েছে। অর্থ বিল এবং বাজেট কমন্সসভায় উত্থাপিত হয়। কমন্সসভা কর্তৃক অর্থবিল গৃহীত হওয়ার পর লর্ডসভার সুপারিশের জন্য পেশ করা হয়। লর্ডসভা অর্থবিল সম্পর্কে আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে পারে। তবে ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে বা কমাতে পারে না। ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইন অনুযায়ী অর্থ সংক্রান্ত কোনো বিল কমথসভায় গৃহীত হওয়ার পর থেকে এক মাসের মধ্যে লর্ডসভা সেই বিয়ে সম্মতি প্রদান না করলে তার অনুমোদন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট বিলটিকে রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হবে। কোনো বিল অর্থবিল কি-না সে বিষয়ে কমগসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। স্থানীয় বা বিশেষ অর্থ সংক্রান্ত বিল বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য পার্লামেন্টে কমিটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আইভর জেনিংস ( Ivor Jennings) বলেন কর্মব্য কমলসভার সদস্যদের তুলনায় লগণই অধিক উদ্যোগী এবং উপযোগী ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাই পার্লামেন্টের কমিটির কাজ-কর্মের প্রায় অর্ধেক লর্ডসভায় সম্পন্ন হয়।
৪. সরকার ও জনমত প্রভাবিত করার ক্ষমতা (Powers to influence Government and Public opinion) : ও জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে লর্ডসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । লর্ডসভা আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে সরকার এবং জনমতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এ সভার আলোচনা ও বিতর্ক উচ্চমানের হয়ে থাকে। এর কারণ হলো প্রবীণ রাষ্ট্রনেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী, গভর্নর জেনারেল এবং লর্ডসভার আজীবন সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ। হা মরিসন (Herbert Morrison) তাই বলেছেন, “The debates in the Lords have a characters and importance of their own and not without their influence on public opinion and government policy.”
৭. নীতি নির্ধারণে সহায়তা (Assists to determine policy) : লর্ডসভার আলোচনা ও বিতর্ক সরকারি নীতি নির্ধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। কখনো কখনো লর্ডসভার আলোচনা কমন্সসভার আলোচনার পুনারাবৃত্তি ঘটায়। কি কমন্সসভার চেয়ে লর্ডসভার কার্যাবলি কম থাকায় এ কক্ষের সদস্যগণ কোনো বিষয় সম্পর্কে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা করতে পারেন । তাই নীতি প্রণয়ন বা নীতির পরিবর্তনে লর্ডসভার বিজ্ঞ সদস্যগণ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে থাকেন।
৮. কেবিনেট ও মন্ত্রিসভায় ভূমিকা (Role in the cabinet and the minitstry) : বিংশ শতাব্দির পূর্ব পর্যন্ত লর্ডসভা বা কমন্সসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে অন্যতম সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথাগত বিধান হলো যে প্রধানমন্ত্রীকে কমন্সসভার সদস্য হতে হবে। বর্তমানে লর্ডসভা হতে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত না হলেও কেবিনেট ও মন্ত্রিসভায় লর্ডসভার সদস্যদের নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে লর্ডসভা হতে ২-৪ জন কেবিনেট মন্ত্রী হন এবং কিছু কিছু লর্ড অন্যান্য মন্ত্রী হন। লর্ডসভার সদস্যদেরকে অনেক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৯. পিয়ারদের বৈধতা যাচাই (Determine the legitimacy of pears) : লর্ডসভা আইরিশ পিয়ারদের বৈধতা যাচাই করে। লর্ডসভা পিয়ারদের বসবার ও ভোটদানের অধিকার আছে কিনা তা যাচাই করে দেখে। এটি ব্রিটেনের পিয়ারদের বৈধতাও যাচাই করতে পারে।
১০. পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ক্ষমতা (Powers related to Foreign affaris ) : পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সাধারণত জনপ্রিয় কক্ষেই পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত আলোচনা ও বিতর্ক চলে। এদিক থেকে কমন্সসভা লর্ডসভার তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। তবে লর্ডসভা কেবল নীরব দর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করে না। লর্ডসভায় আজীবন লর্ড ছাড়াও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীগণ আজীবন লর্ড হিসেবে মনোনীত হন। এ সব অভিজ্ঞ লর্ড পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১১. অন্যান্য ক্ষমতা (Other Powers) : উপরিউক্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি ছাড়াও লর্ডসভা অন্যান্য কয়েকটি কার্য সম্পাদন করে।
- লর্ডসভা প্রাইভেট বিল ও বিতর্কহীন বিল বিচার-বিবেচনা করে ।
- অনেক সময় পার্লামেন্টের সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে লর্ড উপাধি প্রদান করে মন্ত্রিসভায় স্থান দিতে পারে।
iii. লর্ডগণ বিচারকদের অপসারণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।
- প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়ে কমন্সসভাকে পরামর্শ প্রদান
উপরিউক্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলির জন্য ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় লর্ডসভার অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে গণ্য হয়। তবে ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্টের আইন প্রণীত হওয়ার পর লর্ডসভার এখন আর তেমন কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। এখনও এই কক্ষের হাতে যেসব ক্ষমতা আছে তার গুরুত্ব কম নয়। হারম্যান ফাইনার (Herman Finer)-এর মতে, লর্ডসভার হাতে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল এবং এখনও তা অবশিষ্ট আছে। লর্ডসভা আইন, নীতি ও প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। সরকারি নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে লর্ডসভা হলো বিশ্বের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ কক্ষ। সিডনী লো (Sidny Low) তাঁর The Government of England গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, লর্ডসভার সদস্যগণের মর্যাদা উন্নত না হলেও অন্য যেকোনো দেশের দ্বিতীয় কক্ষের তুলনায় এই কক্ষের সদস্যদের বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতা অনেক বেশি। (In spite of the dead of weight of the mere titled nobodies, there is probably more intellect and ability in the House of Lords than in any other second chamber that could be named.)
লর্ডসভার উপযোগিতা বা পক্ষে যুক্তি
Utility or Argument in farvour of the House of Lords
ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় লর্ডসভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই রক্ষণশীল দলের সমর্থকগণ লর্ডসভাকে বিলুপ্ত করার পক্ষপাতি নন। লর্ডসভার সপক্ষে তারা যেসব যুক্তির অবতারণা করেন সেগুলো নিম্নরূপ :
ক. নিরপেক্ষভাবে আইন প্রণয়ন : কমন্সসভা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বলে তাকে সব সময়ই জনমতকে সন্তুষ্ট করার কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। তাই জনকল্যাণ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় আইন রচনা করার সময় বা সামর্থ্য সব সময় তার থাকে না। কিন্তু লর্ডসভা জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থেকে কার্যসম্পাদন করে না বলে সে নিরপেক্ষভাবে সবকিছুই বিচার- বিশ্লেষণ করতে পারে। অবিতর্কমূলক (non-controversial) বিষয় নিয়ে লর্ডসভা ধীরস্থিরভাবে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
খ. আইনের ত্রুটি সংশোধন করে : এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে আবেগের বশবর্তী হয়ে আকস্মিক ও অবিবেচনাপ্রসূত আইন প্রণীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইনসভার দুটি কক্ষ থাকলে উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ কর্তৃক গৃহীত বিলটিকে ধীরস্থিরভাবে পুনর্বিবেচনা এবং ত্রুটিমুক্ত করতে পারে। লর্ডসভা আইনের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যতা থাকলে তা দূরীভূত করে। কার্টার, রেনী ও হার্জ (Carter, Renney and Herz) এর মতে, “Particularly at a time when the amount of technical ligeslation prevents the House of Commons from giving adequate consideration to the bills it passes, the House of Lords has proved extremely useful as a chamber of revision.
গ. জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটে : লর্ডসভা জ্ঞানী, গুণী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়। ফলে তাদের আলোচনা বা সমালোচনার উৎকর্ষ বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। লর্ডসভার সদস্যগণ প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন। দীর্ঘকাল ধরে তারা আইনসভার সদস্য হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকেন। ফলে তারা অভিজ্ঞপ্রসূত জ্ঞানের সাহায্যে যথাযোগ্য আইন প্রণয়ন করতে পারেন। কিন্তু আইন প্রণয়নের জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন অধিকাংশক্ষেত্রেই কমন্সসভার সদস্যদের তা থাকে না।
ঘ. অবিবেচনাপ্রসূত আইন প্রণয়নে বাধাদান : লর্ডসভা কমন্সসভার অবিবেচনাপ্রসূত ও ভাবাবেগ তাড়িত আইন প্রণয়নে বাধাদান করে দেশের কল্যাণ সাধন করে। কমন্সসভা জনপ্রিয় কক্ষ হওয়ার ফলে অনেক সময় জনমতের চাপে কিংবা ভাবাবেগ তাড়িত হয়ে অবিবেচনাপ্রসূত আইন প্রণয়ন করতে পারে। লর্ডসভা সেই সব আইনকে আটকে দিয়ে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেয় এবং দ্বিতীয়বার ধীরস্থির মস্তিষ্কে তা বিচার-বিবেচনা করার জন্য কমন্সসভাকে বাধ্য করে।
ঙ. কমন্সসভার কাজের চাপ হ্রাস করে : বর্তমানে কমন্সসভার কাজের চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কমন্সসভা কমিটির কাজে অধিক সময় ব্যয় করতে পারে না। কিন্তু লর্ডসভার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকায় সদস্যগণ কমিটিসমূহের কার্যাবলি সম্পাদনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। ফলে কমন্সসভার উপর কাজের চাপও কমে যায়। তাই আইভর জেনিস (Sir Ivor Jennings) বলেন, “কমিটিসমূহের কার্যাবলি সম্পাদনে লর্ডসভার সদস্যগণ কমন্সসভার সদস্যগণ অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।” (There is too a good deal of committee work to be done on private bills and
orders and it is often done better in the Lords than in the Commons).
চ. স্বৈরাচারিতা রোধ করে : লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) -এর মতে, অসংযম, স্বৈরাচারিতা ও দুর্নীতিপরায়ণতা হলো প্রতিটি আইনসভার অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তি। লর্ডসভার অস্তিত্বের জন্যই কমন্সসভা খেয়ালখুশী মতো আইন প্রণয়ন করে স্বৈরাচারী হয়ে
জ. দায়িত্বহীন : লর্ডসভা হলো একটি দায়িত্বহীন কক্ষ। নিজেদের কাছে ছাড়া লর্ডসভার সদস্যদের অন্য কারও কাছে কোনো ধরনের দায়-দায়িত্ব নেই। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অবজ্ঞা করে লর্ডসভা নিজের ইচ্ছেমতো আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে সদস্যপদ লাভের কারণে এই কক্ষে অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটে। এই ধরনের একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কক্ষকে টিকিয়ে রাখা গণতন্ত্রসম্মত নয় ।
ঞ. প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র : লর্ডসভা একটি প্রতিক্রিয়াশীল কক্ষ। এটি রক্ষণশীল দলের ও বিত্তবানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। এজন্য অধ্যাপক জেনিংস (Jennings) বলেছেন, “The House of Lords for all practical purposes is an outpost of the conservative party.” কারণ সামন্ততান্ত্রিক যুগে লর্ডসভা সামন্তশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আবির্ভাবের ফলে লর্ডসভা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। এ সময় সামন্তশ্রেণির প্রতিনিধিদের সাথে সাথে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিদের লর্ডসভায় সমাবেশ ঘটে। বর্তমানে ব্রিটেনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণি ও ও ধনিক-বণিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা লর্ডসভার সদস্যপদ পেয়ে থাকেন ।
ট. অস্তিত্ব অর্থহীন : দ্বিতীয় কক্ষ হিসেবে লর্ডসভার অস্তিত্ব অর্থহীন। কমন্সসভায় গৃহীত বিল দ্বিতীয়বার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ত্রুটিমুক্ত করাই হলো দ্বিতীয় কক্ষের কাজ। কিন্তু লর্ডসভা এই কাজও যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারে না। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “The House of Lords is only a revising and delaying body and not very effective even for that purpose.” আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লর্ডসভা নিরপেক্ষ সমালোচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না ।
ঠ. আপীল আদালতের ধারণা উপযোগী নয় : সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবেও লর্ডসভার অস্তিত্ব যুগোপযোগী নয়। পার্লামেন্টের সংস্কার আইনের মাধ্যমে নতুন আদালত গঠন করা যায়। সেই আদালত সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে অনেকের বিশ্বাস ।
লর্ডসভার সংস্কার Reforms of House of Lords
লর্ডসভার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ দুটি যথা— এর সদস্যগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন, উত্তরাধিকার সূত্রে সভার সদস্যপদ লাভ করেন এবং বাস্তব পরিস্থিতির সাথে পরিচিত নন। এই দুই ধরনের ত্রুটির জন্য লর্ডসভার বিলোপসাধন অথবা সংস্কার সাধনের কথা বলা হয়েছে। বামপন্থী দলগুলো লর্ডসভার বিলোপ সাধনের পক্ষপাতি। ১৯৩৪ সালে শ্রমিক দল তাদের নির্বাচনি ইশতিহারে লর্ডসভার বিলোপসাধনের কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক দলও লর্ডসভার সংস্কার সাধনের পক্ষে। মধ্যপন্থীরা সংস্কারের দ্বারা এটাকে কার্যকরী দ্বিতীয় কক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী। রক্ষণশীল দল এটাকে অপরিবর্তিত রক্ষার পক্ষপাতি। বহু বিশেষজ্ঞ লর্ডসভার সমালোচনা করলেও এটাকে বিলোপ করার পক্ষে মত দেন নি। তাঁরা মনে করে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থার জন্য আইনসভার দুটি কক্ষ অপরিহার্য। ওয়াল্টার বেজহট (Walter Bagehot ) বলেছেন, “There used to be a singular idea that two chambers a revising chamber and a suggesting chamber was
essential to a free government.”
বিভিন্ন সময়ে লর্ডসভার সংস্কার সাধনের প্রস্তাব
Proposal for the Reformation of the House of Lords in several times
বিভিন্ন সময়ে লর্ডসভার সংস্কার সাধনের যেসব প্রস্তাব করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ :
১. লর্ড রাসেল, লর্ড রোজবেরি ও লর্ড সলসবেরির সংস্কার প্রস্তাব : ১৮৬৯ সালে লর্ড রাসেল ( Lord Russell) লর্ডসভার সংস্কার সাধনের জন্য একটি বিল উত্থাপন করেন। এই বিলের উদ্দেশ্য ছিল রানীর হাতে বছরে ৪ জন আজীবন পিয়ার ( Life Peer) নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা। কিন্তু সেই বিল সভায় গৃহীত হয়নি। তারপর ১৮৭৪ সালে লর্ড রোজবেরী (Lord Rosebury) এবং ১৮৮৮ সালে লর্ড সলসবেরি ( Lord Salsbury) কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো বাতিল হয়ে যায়। এরপর ১৯০৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত লর্ডসভার সংস্কার নিয়ে আর কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হয়নি।
- উঠতে পারে না। এভাবে গর্ডরা ব্রিটিশ গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখে। লর্ডসভা জনস্বার্থের পরিপন্থী যেকোনো আইনকে আটকে দিয়ে অসংযমী কমণসভাকে সংযত করতে পারে। তাই অনেকে লর্ডসভাকে গণতন্ত্র রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে গণ্য করেন।
ছ. বেসরকারি বিলের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ : সাধারণত অধিকাংশ বেসরকারি বিল লর্ডসভায় উত্থাপিত হয়। লর্ডসভার বিভিন্ন কমিটি এসব বিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে। আধা-বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিতে লর্ডসভা এসব বিল পরীক্ষা করে। লর্ডসভার অস্তিত্ব না থাকলে এসব দায়িত্ব কমন্সসভাকে গ্রহণ করতে হতো। কমন্সসভার মূল্যবান সময়ের একটা অংশ এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট রাখার প্রয়োজন হতো।
জ. প্রশাসনিক ভূমিকা : লর্ডসভা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লর্ডসভা থেকেও বিভিন্ন স্তরের মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়ে থাকে। কখনো কখনো লর্ডসভায় ক্ষমতাসীন দলের অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কোনো সদস্য থাকলে এরকম লর্ডতে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্গারেট থ্যাচারের মন্ত্রিসভায় লর্ড কারিংটাকে পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
ঝ. বিচার বিভাগীয় ভূমিকা : লর্ডসভা আইন প্রণয়ন ছাড়া বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করে। এদেশের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হলো লর্ডসভা। লর্ডসভাকে বিলুপ্ত করলে ঐ দায়িত্ব অন্য আদালতের হাতে অর্পণ করতে হবে ।
ঞ. অ-বিতর্কিত আইন আলোচনা : আধুনিক বিশ্বে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমন্সসভার পক্ষে এককভাবে সকল বিলের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। লর্ডসভা এই বিষয়ে কমন্সসভাকে সহায়তা প্রদান করে। যেসব বিল নিয়ে বিতর্কের সম্ভাবনা সেসব বিল লর্ডসভায় উত্থাপিত হয়। লর্ডসভা ঐ সব আলোচনা করে কমন্সসভার কাছে সুচিন্তিত মতামত পেশ করে ।
ট. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীলতা : লর্ডসভার অস্তিত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইংরেজ জাতির রক্ষণশীলতা। সরকারি দল, বিরোধী দল, সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সকলে লর্ডসভার বিলোপসাধনের বিরোধী। লর্ডসভা তাদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, কাজেই তারা তাদের এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি চায় না। ডিজরেলি (Benjamin Disraeli ) বলেছেন, “ইংল্যান্ডের রাজা লর্ড তৈরি করতে পারেন কিন্তু লর্ডসভা গঠন করতে পারেন না।”
ঠ. গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন : লর্ডসভা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে যেগুলো কমন্সসভার পরিপূরক। তাই ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় লর্ডসভার অস্তিত্ব অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) তাঁর The Queens Government গ্রন্থে বলেছেন, “আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষের অবস্থিতি সম্পর্কে পুরানো বিতর্কের অবসান ঘটেছে। লর্ডসভার সপক্ষে ও বিপক্ষে যত কথা বলা হোক না কেন এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্রিটেনের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় লর্ডসভা বহু প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে।” (The old debate over the principle of a second chamber has almost disappeared. Whatever theoritical arguments may be advanced for and against the fact its that the House of Lords does useful work.
লর্ডসভার সমালোচনা বা বিপক্ষে যুক্তি
Criticism or Arguments against the House of Lord’s
হ্যারম্যান ফাইনার (Herman Finer), অধ্যাপক লাস্কি (Laski) রামজে ম্যুর ( Rumsay Muir) প্রমুখ লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লর্ডসভার সমালোচনা করেছেন। সাধারণত লর্ডসভার গঠন, প্রকৃতি, কার্যকারিতা ও গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এসব সমালোচনা করা হয়েছে। যারা লর্ডসভার সংস্কার অথবা অবলুপ্তির দাবি জনান, তাদের মতামত নিম্নরূপ
ক. লর্ডসভার গঠন অগণতান্ত্রিক : লর্ডসভার গঠন প্রকৃতি অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক। কেননা, লর্ডসভার সকল সদস্যই উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা উপাধির ভিত্তিতে সদস্যপদ লাভ করেন। লর্ডসভায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি স্থান পায় না। তাই আইনসভার এই কক্ষটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই সহানুভূতিশীল হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে সিডনি ওয়েব এবং বিয়াট্রিস ওয়েব (Sidney Webb and Beatrice Webb) বলেছেন, “লর্ডসভার সকল সিদ্ধান্ত তার গঠনের জন্যই ত্রুটিপূর্ণ হয়। এ ধরনের নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভা আর কখনও গঠিত হয়নি।” (Its decisions are vitiated by its composition. It is the worst representative assembly ever created).
২. সিলেক্ট কমিটি গঠন : লর্ডসভা সম্পর্কে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং সভার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য একটি সিলেক্ট কমিটি (Select Committee) গঠিত হয়। এ কমিটির সুপারিশে বলা হয় যে, লর্ডসভা গঠিত হবে কয়েকজন রাজবংশোদ্ভূত পিয়ার (Peers of the Royal blood) । সাধারণ আপীল লর্ড, বংশানুক্রমিক পিয়ারদের দ্বারা নির্বাচিত ২০০ জন প্রতিনিধি, বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন উত্তরাধিকার সূত্রে উপাধিপ্রাপ্ত কতিপয় পিয়ার, আজীবন পিয়ার (Life Pear) এবং ধর্মীয় পিয়ারদের নিয়ে। কিন্তু এ সংস্কার প্রস্তাব ও লর্ডসভা ও কমন্সসভার মধ্যে বিরোধের কারণে চাপা পড়ে যায় ।
৩. ল্যান্সডাউন পরিকল্পনা : ১৯০৯ সালে ল্যান্সডাউন পরিকল্পনায় (The Lansdown Plan) লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা ৩৩০ করার সুপারিশ করা হয়। এই পরিকল্পনায় বলা হয় যে লর্ডসভার মোট সদস্যদের মধ্যে ১০০ জন রাজা বা রানী কর্তৃক মনোনীত হবেন, ১০০ জন হবেন পিয়ারদের প্রতিনিধি, ১২৩ জনকে নির্বাচিত করবে কমন্সসভা এবং অবশিষ্ট সদস্য হবেন গির্জাসমূহের প্রতিনিধি । কিন্তু এই পরিকল্পনার প্রস্তাবও বাতিল হয়ে যায় ।
৪. ব্রাইস কমিটির সংস্কার প্রস্তাব : লর্ডসভার সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে ১৯১৭ সালে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) ছিলেন এই কমিটির সভাপতি। তাই এই কমিটি ব্রাইস কমিটি (Bryce commitee) নামে পরিচিত। ১৯১৮ সালে ব্রাইস কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে । এই রিপোর্টে বলা হয় যে, লর্ডসভার সর্বমোট সদস্য সংখ্যা হবে ৩২৭ জন। এঁদের মধ্যে ২৪৬ জন সদস্য কমন্সসভার সদস্য নিয়ে গঠিত ২৩টি নির্বাচনি সংস্থার (electroal college) কর্তৃক সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন, অবশিষ্ট ৮১ জন সদস্য লর্ডসভা ও কমন্সসভার একটি স্থায়ী যৌথ কমিটির দ্বারা লর্ডদের মধ্যে থেকে মনোনীত হবেন। সদস্যদের কার্যকাল হবে ১২ বছর। প্রতি চার বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করবেন এবং নতুন সদস্যরা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এ কমিটি লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে সুপারিশ করে। সুপারিশে বলা হয় যে, লর্ডসভার হাতে নিম্নলিখিত ক্ষমতা অর্পিত থাকবে :
ক. কমন্সসভা কর্তৃক প্রেরিত বিলগুলো পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনবোধে সংশোধন করবে;
খ. তুলনামূলকভাবে অবিতর্কিত বিল উত্থাপন করবে;
গ. সমগ্রজাতির মতামত যাতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিলকে বিলম্বিত করবে এবং ঘ. গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক ও স্বাধীনভাবে আলোচনা করবে।
৪. লর্ড ক্লারেনডন এর প্রস্তাব : ১৯২৮ সালে লর্ড ক্লারেনডন (Lord Clarandon) লর্ডসভার সংস্কারের একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয় যে, লর্ডসভার মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৩০০ জন। তার মধ্য অর্ধেক সদস্য পিয়ারদের দ্বারা পিয়ারদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি অর্ধেক সদস্য রাজা বা রানী কর্তৃক মনোনীত হবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।
৬. ১৯৩২ সালে লর্ড সলসবেরীর প্রস্তাব : ১৯৩২ সালে লর্ড সলসবেরী (Lord Salsbury) লর্ডসভার সংস্কারের লক্ষ্যে লর্ড ক্লারেনডনের প্রস্তাবের অনুরূপ একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা হবে ৩২০ জন। তার মধ্যে ১৫০ জন বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডদের দ্বারা ১২ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অন্য ১৫০ জনকে একটি সময়ের জন্য সরকার মনোনীত করবেন। বাকি ২০ জন লর্ড রাজ পরিবারের রক্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত পরিবার, বিশপ ও আপীল লর্ড থেকে নিযুক্ত হবেন। এ প্রস্তাবে অর্থ বিলের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষমতা স্পিকারের হাতে প্রদান করার পরিবর্তে উভয় কক্ষের একটি যৌথ কমিটির হাতে প্রদান করার কথা বলা হয়। কিন্তু সলসবেরী রক্ষণশীল দলের একজন প্রভাবশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও রক্ষণশীল দলের বিরোধিতার জন্য এই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি।
৭. ১৯৪৮ সালে শ্রমিক দল কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব : ১৯৪৮ সালে শ্রমিক দলের সরকারের প্রধানমন্ত্রী এটলির (Atlee)-র সভাপতিত্বে একটি ত্রি-দলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে লর্ডসভার সংস্কার সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলো নিম্নরূপ :
ক. লর্ডসভা কমন্সসভার প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে; এর মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৩০০ জন। খ. লর্ডসভাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে যাতে এই কক্ষে কোনো একটি মাত্র দল স্থায়ীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে না পারে;
গ. উত্তরাধিকার সূত্রে সদস্যপদ ও ভোটাধিকার পদ্ধতির পরিবর্তন করা হবে।
ঘ. লর্ডসভার সদস্যগণকে পার্লামেন্টের গর্ড (Land of Parliament) নামে অভিহিত করা হলে। তাদের নিয়োগের তিনি হবে ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং জনসেবামূলক কাজ। বংশানুক্রমিক শর্ত অথবা সাধারণ নাগরিককে আজীবন লর্ড নিয়োগ করা যাবে।
৩. নারীরাও পার্লামেন্টের গর্ত পদে নিযুক্ত হতে পারবেন।
চ. লর্ডসত্যায় কয়েকজন রাজ পরিবারের লোক, ধর্মীয় গর্ত এবং আপীল নগণ যাতে সদস্যপদ লাভ করতে পারেন তার
ব্যবস্থা থাকবে।
২. হাতে নিম্ন আয়ের লোকেরা সদস্যপদ থেকে বর্তিত না হন, সেজন্য লর্ডসভার সদস্যপদ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। না. যেসব গিয়ার লর্ডসভায় স্থান পাবেন না, তারা কমনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিংবা ভোটদান করতে পারবেন এবং অ. লর্ডসভার যেসব সদস্য নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তনা যথাযথভাবে সম্পাদন করবেন না তাদের সদস্যপদ বাতিল হবে। লর্ডসভার গঠন সম্পর্কে ত্রি-দলীয় সম্মেলনে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্বন্ধে মতবিরো দেয়। ফলে এ সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯৬৮ সালে শ্রমিক দলের সরকার লর্ডসভার সংস্কারের জন্য শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে একটি পার্লামেন্ট বিলের প্রস্তাব করে। ঐ বিলে লর্ডসভাকে দুটি স্তরে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়। প্রথমস্তনের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের ভোটাধিকার থাকবে। এসব সদস্যের মোট সংখ্যা ২৩০ করার প্রস্তাব করা হয়। এই পিয়ারগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী কর্তৃক সারাজীবনের জন্য নিযুক্ত হবেন বলে বলা হয়। ভোটাধিকার প্রাপ্ত এসব পিয়ারের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ যাতে লর্ডসভার অধিবেশনে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন, সেজন্য তাদের বেতন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় ।
এরপর ১৯৭৭ সালের শ্রমিক দলের সম্মেলনের আজীবন পিয়ার পদের পরিবর্তন এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প উপাধিধারীদের অধিকার সংকোচনের প্রস্তাব গৃহীত হয় ৷
১৯৭৯ ও ১৯৮৩ সালে শ্রমিক দল তাদের নির্বাচনি ইশতিহারে ঘোষণা করে যে, নির্বাচন জয়লাভ করলে তারা লর্ডসভার বিলোপসাধন করবে। অপরদিকে রক্ষণশীল দল মার্কিন সিনেটের অনুকরণে উচ্চকক্ষ সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করে। যাই হোক, সাম্প্রতিককালে কোনো দলই লর্ডসভার সংস্কারের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেনি।
পরিশেষে বলা যায়, ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইনে লর্ডসভার ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই এর সংস্কারের জন্য কোনো দলই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। লর্ডসভার সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে এর ক্ষমতা ও মর্যাদা কমলসভার সমান হবে। তাই ওয়েড ও ফিলিপস (Wade and Philips ) বলেছেন, “A reformed House of Lords, it based upon the elective principle, would inevitably come into conflict with the House of Commons, while it based on any other principle. Its composition would in all probability incline to be conservative.”
হার্ভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেছেন, লর্ডসভার সংস্কার করতে হলে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য আনা দরকার। কিন্তু এটা আদৌ সম্ভব নয়, তাই লর্ডসভার সং বহু প্রস্তাব কাগুজে প্রস্তাব হিসেবে রয়ে গেছে ।