রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা কর । Discuss the role of oposition party in modern democratic state.

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই সরকার গঠন করে। আর যে দল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সেই দল বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত হয়। মূলত সরকারি দলের বাইরে যে সব রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্ব করে তাদেরকেই বিরোধী দল হিসেবে অভিহিত করা হয়।

১. পেঙ্গুইন অভিধানের মতে, বিরোধী দল বলতে এমন এক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলকে বোঝায়, যারা সরকারের নীতি ও আদর্শকে পরিবর্তন করতে চায়। (Dictionary of Politics p. 243 )

২. মাইকেল কার্টিস (Michael Curtis)-এর মতে, বিরোধী দল বলতে যে দল সরকার গঠন করে না কিন্তু সরকার পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জড়িত থাকে, তাদেরকে বোঝায় ৷

৩. ফাইনার (Finer), লাস্কি (Laski), জেনিংস (Jennings) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তব্য করেন যে, বিরোধী দল হলো ছায়া সরকার (Shadow government )। ব্রুমহেড (Broomhead) সহ অনেকে একে বিকল্প সরকার (Alternative government) বলেছেন। সুতরাং একটি রাষ্ট্রে সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ই জনগণের ভোটে নির্বাচিত। কাজেই সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই ।

৪. আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেছেন, “If there is no opposition, there is no democracy.’ এইচ. আগার (H. Agar) বলেছেন, “প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বিরোধী দল ছাড়া চলতে পারে না।” (The representative government cannot exist without the opposition).

নিম্নে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :

১. সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা : দেশের সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে বিরোধী দলের বিকল্প কিছু নেই। সরকার যদি তার ঘোষিত নীতি বাস্তবায়ন করতে অনীহা প্রকাশ করে তাহলে বিরোধী দল সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে পারে। বিরোধী দলের চাপের মুখে সরকার বাঁকা পথে চলতে সাহসী হয় না। মাইকেল কার্টিস (Michael Curtis)-এর মতে, বিরোধী দল সরকারকে সংশোধন করে।

২. জনগণের অধিকার রক্ষা : বিরোধী দল জনগণের অধিকার রক্ষায় তৎপর থাকে। জনগণের অধিকার যাতে সরকার খর্ব করতে না পারে, সেদিকে বিরোধী দল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। অধিকার সংরক্ষণে বিরোধী দল কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে । তবে একথাও ঠিক সরকারি দল জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে সাধারণত কোনো গণবিরোধী কাজ করে না।

৩. রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার : জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে বিরোধী দল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । বিরোধী দল আইনসভায় সরকারি নীতি ও কর্মসূচির সমালোচনা করে থাকে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সেমিনারের মাধ্যমে জনগণ সরকারি কাজ-কর্ম সম্পর্কে জানতে পারে। জনগণ দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে । জনগণ সরকারি নীতির ও কাজ-কর্মের যৌক্তিকতা সম্পর্কে মতামত গঠন করতে পারে।

৪. জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রয়োজন। বিরোধী দল জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। সকল সংকীর্ণ স্বার্থ; যেমন— ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত স্বার্থ পরিহার করে দলীয় নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধী দল জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে তৎপর হয়।

 সরকারের সমালোচনা করা বিরোধী দল সুপরিকল্পিতভাবে সরকারের সমালোচনা করে এবং বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি উদ্ঘাটন করে। বিরোধী দল সরকারের দোষ-ত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরে। কখনো কখনো বিরোধী দলের বিরূপ সমালোচনার মুখে সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

সমস্যা নির্ধারণ প্রতিকার নির্দেশ। বিরোধী দল দেশে বিরাজমান প্রধান প্রধান সমস্যা নির্ধারণ করে। সমস্যাগুলোকে তালিকাভুক্ত করে সেগুলো সরকার ও জনগণের সামনে তুলে ধরে। বিরোধী দল এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক পন্থা নির্দেশ করে।

৩. বিকল্প সরকার : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলকে বিকল্প সরকার বলা হয়ে থাকে। কেননা কোনো কারণে ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটলে বিরোধী দল সরকার গঠন করতে পারে। তাছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দল জয়ী হলে সরকার গঠন করতে পারে। অনেক রাষ্ট্রে বিরোধী দলকে খুব সম্মান করা হয়। যেমন- যুক্তরাজ্যে বিরোধী দলকে His or her Majesty’s opposition হিসেবে সম্মানিত করা হয়।

৮. বিকল্প কর্মসূচি দেশ : সরকারি দলের কর্মসূচির বিকল্প কর্মসূচি পেশ করা বিরোধী দলের কাজ। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাকালে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এ ধরনের বিকল্প কর্মসূচি জনগণের সামনে পেশ করা হয়। ফলে জনগণ দুই বা ততোধিক কর্মসূচির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ পায় ।

*. সু জনমত গঠন : বিরোধী দল সুষ্ঠু জনমত গঠনে সহায়তা করে। ভবিষ্যতে ক্ষমতা লাভের আশায় বিরোধী দল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে। বিরোধী দল তাদের নীতি ও কর্মসূচি উপস্থাপনের সাহায্যে এবং জনসেবার মহান আদর্শ প্রচার করে জনমতকে তাদের অনুকূলে আনতে সচেষ্ট থাকে।

১০. জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা : সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রিসভা তাদের নীতি ও কাজের জন্য একক ও যৌথভাবে আইনসভার কাছে দায়ী থাকে। মন্ত্রিসভার যে কোনো নীতি ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিরোধী দলের সদস্যগণ প্রশ্ন-জিজ্ঞেস করতে পারে। মন্ত্রিগণ বিরোধী দলের প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য থাকেন ।

১১. সরকারি নীতি সংশোধনে সহায়তা : বিরোধী দল শুধু সরকারের দোষ-ত্রুটি উদ্ঘাটন করে না বরং এসব দোষ-ত্রুটি সংশোধনের জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। অনেক সময় বিরোধী দল সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নীতির দুর্বল দিকগুলো জনসম্মুখে এমনভাবে তুলে ধরে যে, সরকার তা বাতিল বা সংশোধন করতে বাধ্য হয় ।

১২. সরকারি দলকে সহায়তা প্রদান : বিরোধী দলের সহযোগিতায় আইনসভার কাজ-কর্ম সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে পরিচালিত হয়। আইন প্রণয়নে ও সরকারি নীতি বাস্তবায়নে বিরোধী দল সরকারি দলকে সহযোগিতা করে। সরকারি দল এবং বিরোধী দলের পারস্পরিক সহযোগিতায় আইনসভার বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়।

১৩. স্বৈরাচারিতা রোধ : গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকারি দলের স্বৈরাচাধিতা রোধ করে। বিরোধী দল সরকারি দলের নীতি ও সিদ্ধান্তের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে এবং সমালোচনার মাধ্যমে জনমতকে তাদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করে। ফলে বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না ।

১৪. গণতন্ত্র সুরক্ষায় : গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার জন্য বিরোধী দল অপরিহার্য। বিরোধী দলবিহীন সরকার স্বৈরাচারী হতে বাধ্য। এ কারণে জেনিংস (Jennings ) বলেছেন, যেখানে বিরোধী দল নেই সেখানে গণতন্ত্র নেই (If there is no opposition, there is no democracy.) অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দল একটি নিয়মিত অংশ। ১৫. স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা : বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও ভাবধারায় বিশ্বাসী বিরোধী দল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে এবং যথাসময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা আনয়নে সাহায্য করে।

১৬. জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ : আধুনিককালে প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বিরোধী দল বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। শীতবস্ত্র বিতরণ, ত্রাণ বিতরণ, কৃষি উপকরণ বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে।

১৭. আইন প্রণয়নে সহায়তা : আইন প্রণয়নের জন্য দক্ষতা, যোগ্যতা ও কলাকৌশলগত জ্ঞানের প্রয়োজন। সরকারি দল কোনো নতুন আইন প্রণয়নে উদ্যত হলে বিরোধী দল সুচিন্তিত মতামত প্রদান করে থাকে। তাছাড়া আইন প্রণয়নে বা সংবিধান সংশোধনে বিরোধী দল প্রয়োজনীয় সহায়তা দান করে থাকে।

১৮. স্বদেশপ্রেম জাগ্রতকরণ : বিরোধী দল সংকীর্ণ স্বার্থ পরিহার করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য পোষণ করে । তারা জনগণকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা বলে তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করে ।

পরিশেষে বলা যায়, বিরোধী দল সরকারি দলের বিরোধিতা করা ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। সাধারণত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা আবশ্যক। তাই অধ্যাপক জেনিংস (Jennings) বলেছেন, “একটি দেশের জনগোষ্ঠী কতটুকু স্বাধীন তা সে দেশের বিরোধী দলের সক্রিয় ভূমিকার উপর নির্ভরশীল।” (To find out whether a people is free it is necessary only to ask if there is an opposition.)

Leave a Reply