Table of Contents
Toggleরাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না
রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না
রাজার মৃত্যু নেই এবং রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন
রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না
The King Can do no Wrong
ব্রিটেনে একটি প্রচলিত উক্তি হলো “রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না”-এ উক্তিটি আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কারণ কোনো মানুষই ন্যায় অন্যায়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারেন না। মানুষ মাত্রেরই ভুল বা অন্যায় হতে পারে। রাজা যেহেতু রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ সেহেতু তাঁর পক্ষে যে কোনো সময় অন্যায় আচরণ করা সম্ভব। কিন্তু উক্তিটি ব্যক্তি রাজার সম্বন্ধে নয়; প্রাতিষ্ঠানিক রাজার সম্বন্ধে করা হয়েছে। বর্তমানে ব্রিটেনের রাজার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। নিজ দায়িত্বে তিনি কিছুই করেন না। তাই তিনি কোনো অন্যায়ও করতে পারেন না। রাজা নিজে কোনো প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করেন না। এই কারণে কোনো সরকারি কাজের জন্য রাজাকে দায়ী করা যায় না কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ আনয়ন করা যায় না। যে কোনো সরকারি কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীকেই দায়ী থাকতে হয়। তাই যে কোনো দলিল বা নির্দেশনামায় রাজার স্বাক্ষরের সাথে কোনো-না-কোনো মন্ত্রীকে অবশ্যই প্রতিস্বাক্ষর করতে হয়। বর্তমানে ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। তাই রাজার নামে যাবতীয় কার্য মন্ত্রিসভা কর্তৃক সম্পাদিত হয়। এই কারণে সিডনি পো (Sedney Low) বলেছেন, “বাস্ত বিক পক্ষে রাজশক্তি হলো কাজের সুবিধার জন্য একটি অনুমান” (The crown may indeed be a convenient working hypothesis) ।
রাজা তৃতীয় হেনরি নাবালক থাককালীন ‘রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না’ (The king can do no wrong ) ব্রিটেনে শাসন সংক্রান্ত এই মূলনীতিটির সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্য ছিল যারা রাজার হয়ে কার্য চালাচ্ছিলেন তারা যাতে রাজা দায়ী এই অজুহাতে নিজের দোষ এড়িয়ে যেতে না পারেন। সুতরাং কোনো অন্যায় কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে দায়ী করা হয়। ১৯৪৭ সালের রাজকীয় কার্যবাহ আইন (The crown proceedings Act, 1947) প্রবর্তিত হবার পর বে-আইনি কাজের জন্য রাজশক্তির অঙ্গ হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে আইনত দায়ী করা যায়। তত্ত্বগতভাবে অদ্যাবধি রাজা ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃত। বাস্তবে তিনি কোনো কাজ করেন না বলে অন্যায়ও করেন না ।
রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না
রাজার মৃত্যু নেই এবং রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন
The King never Dies and The King is Dead, Long Live the King
রাজার মৃত্যু নেই। রাজার মৃত্যু হয়েছে; রাজা দীর্ঘজীবী হোন— উক্তি দুটি আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত বিচারে ব্রিটেনে এ দুটি প্রবচনের বিশেষ অর্থ এবং তাৎপর্য রয়েছে। মানুষ মাত্রই মরণশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির যেমন মৃত্যু আছে তেমনি ব্যক্তি রাজার মৃত্যু অবধারিত। ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজাই অমর নয়। একদিন না একদিন প্রত্যেক রাজাই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ব্যক্তি রাজার মৃত্যু হলেও প্রাতিষ্ঠনিক রাজার বা রাজতন্ত্রের কোনো মৃত্যু নেই। একজন রাজার মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী রাজপদে আসীন হন। পরে জাঁকজমক সহকারে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যু হতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পর অষ্টম এডওয়ার্ড রাজা হতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তি রাজার এই পরিবর্তনের ফলে রাজতন্ত্রের কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না। তাই মুনরো বলেছেন, “রাজপদ হলো একটি কৃত্রিম অথবা আইনগত ব্যক্তি বিশেষ; এর কখনো মৃত্যু হয় না; (The crown is an artificial or juristic person, it is not incarnate and it never dies). সুতরাং রাজার মৃত্যু নেই (The king never dies) বলতে ব্যক্তি রাজার মৃত্যু নেই বোঝায় না; এর দ্বারা বোঝায় যে কোনো রাজা বা রানীর মৃত্যু হলে রাজশক্তির অবসান হয় না এবং রাজসিংহাসন শূন্য থাকে না। একজন ব্যক্তি রাজার মৃত্যুর সাথে সাথে অন্যজন রাজা উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাই বলা হয় রাজা অমর ।
ব্লাকস্টোন (Blackstone) বলেছেন, একজন হেনরি, একজন জর্জ বা একজন এডওয়ার্ড মারা যেতে পারেন ; কিন্তু রাজতন্ত্র কখনো মারা যায় না। (Henry, Edward or George may die, but the king survive them all) রাজার মৃত্যু হয়েছে বলতে কোনো ব্যক্তি রাজার মৃত্যুকে বোঝায়। অন্যদিকে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন কথাটির দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক রাজার ধারাবাহিকতা বোঝানো হয়েছে। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র অমর, এর কোনো মৃত্যু নেই। রাজপদের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে ১৯১০ সালে রাজমৃত্যু আইন (Demise of the Crown Act, 1910) প্রণীত হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী ব্যক্তি রাজার মৃত্যুর ফলে পার্লামেন্টের স্বাভাবিক মেয়াদ ক্ষুণ্ণ হয় না এবং রাজকর্মচারীদের চাকরির কোনো পরিবর্তন হয় না। উল্লেখ্য যে, ১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লসকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬০ সালে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ঐ বছরটিকে তাঁর রাজত্বের ১১ বছর হিসেবে গণনা করা হয়।
রাজা রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেন না।
The King Reigns, but does not Rule
তত্ত্বগতভাবে রাজা বা রানী সকল ক্ষমতার উৎস। তিনি হলেন শাসন বিভাগীয় প্রধান। পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, বিচার বিভাগের প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং ব্রিটেনের গির্জার প্রধান প্রশাসক। সমগ্র শাসনকার্য রাজা বা রানীর নামে পরিচালিত হয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে রাজা বা রানী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না। কার্যক্ষেত্রে রাজা বা রানীর নামে সব ক্ষমতাই পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে। রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার সমর্থন ছাড়া কোনো কাজই করেন না। বর্তমানে ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় এক সময়ের সর্বশক্তিমান রাজা নিয়মতান্ত্রিক শাসকে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে রাজা বা রানীর ভূমিকা আনুষ্ঠানিক মাত্র। তিনি রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না। তাঁর নামে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য তাঁকে দায়িত্বশীল থাকতে হয় না। ঐসব কাজের দায় দায়িত্ব মন্ত্রীদেরই বহন করতে হয়। দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে ১৬৭৯ সালে আর্ল ড্যানবি (Earl Danby)-কে কয়েকটি গুরুতর অপরাধের জন্য পার্লামেন্টে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি সকল দায়-দায়িত্ব রাজার উপর চাপিয়ে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিচারের রায়ে ড্যানবিকে ঐসব অপরাধের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হয়।
১৬৮৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক অধিকারের বিল (Bill of Rights) প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে আইনগতভাবে রাজাই হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত আছে। জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রাজা বা রানী বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান। তবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজা বা রানীর মর্যাদা ও জাঁকজমক একেবারে কম নয়। তিনি বিপুল বৈভব, বিলাসিতা ও জাঁকজমকের মধ্যে জীবন যাপন করেন। এই কারণে কে.সি. হোয়ার (K.C. Wheare) তাকে জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষী গোপাল (a magnificient cipher) বলে আখ্যায়িত করেন। এ প্রসঙ্গে কে . সি. হোয়ার (K.C. Wheare), “It would be quite incorrect to suppose that because the Queen occupies a strictly constitutional role, she is therefore a puppet monarch.” এখনও ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্ট বলতে রাজা বা রানীসহ পার্লামেন্ট (King or Queen in Parliament) বোঝায়। বর্তমানে যেমন সরকারি দল বলতে মহামান্য রানীর সরকার (ler Majesty’s Government) বোঝায় তেমনি বিরোধী দল বলতে মহামান্য রানীর বিরোধী দল (Her Majesty’s Opposition) বোঝানো হয়। ব্রিটেনের আদালতগুলো মহামান্য রানীর আদালত (Her Majesty’s Courts) এবং বিচারকগণ মহামান্য রানীর বিচারক (Her Majesty’s Judges) নামে অভিহিত। ব্রিটেনে রাজশক্তি হলো ন্যায়বিচারের উৎস (Fountain of justice)। রাজার হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলেও তিনি নিজে কোনো ক্ষমতাই প্রয়োগ করেন না । প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা। এজন্য বলা হয়, রাজা রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না ।
রাজশক্তির ক্ষমতার উৎস
Sources of Power of the Crown
ব্রিটেনের রাজা বা রানী তত্ত্বগতভাবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যাবতীয় সরকারি কাজ রাজশক্তির নামে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ব্রিটেনের রাজা বা রানীর এই বিপুল ও বহুমুখি ক্ষমতার প্রধান উৎস হলো দুটি, যথা— (ক) পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন এবং (খ) রাজশক্তির বিশেষাধিকার।
ক. পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন (Parliamentary Enactments) : রাজশক্তির ক্ষমতার একটি প্রধান উৎস হলো পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন৷ বর্তমানে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাজাকে যেসব ক্ষমতা প্রদান করে, সেই সব ক্ষমতার ভিত্তিতেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলি সম্পাদিত হয়। তাছাড়া অর্পিত ক্ষমতার ভিত্তিতে মন্ত্রীরা প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন প্রণয়ন করে প্রশাসনিক কার্যাদি লিনা করেন। এগুলো সপরিষদ রাজাজ্ঞা ( orders in council) নামে পরিচিত। পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের বিরোধী না হলে এগুলো আইনের মতোই কার্যকর হয়। ব্রিটেনে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় সেখানে আইন বিভাগ ও প্রশাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে। এই কারণে ব্রিটেনে সপরিষদ রাজাজ্ঞার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্য সম্পাদিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল অনুযায়ী কোনো রাজা বা রানী রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত হবেন না বা রোমান ক্যাথলিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন না। ১৭০১ সালের উত্তরাধিকার আইন ( Act of settlement) নির্ধারণ করে দেয় যে, রাজা বা রানী হবেন উত্তরাধিকার সূত্রে হ্যানোভারের প্রিন্সেস সোফিয়া (Princes Sophia )-র বংশধর। রাজতন্ত্র হবে উত্তরাধিকর সূত্রে প্রাপ্ত বিষয় এবং রাজা বা রানী হবেন একজন প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant) খ্রিস্টান। ১৮৬৭ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে নির্ধারণ করা হয় যে, রাজার মৃত্যুর উপর পার্লামেন্টের কার্যকালের মেয়াদ নির্ভরশীল নয়।
১৯১৭ সালের “রাজ মৃত্যু আইন” স্থির করে দেয় যে, রাজার মৃত্যু সত্ত্বেও রাজার অধীনে নিযুক্ত কর্মচারীদের কার্যকাল ব্যাহত হবে না। ১৯৩৬ সালের সিংহাসন ত্যাগ নির্ধারণ করে দেয় যে, রাজা যে কোনো সময় পদত্যাগ করে রাজকীয় পাত্র- দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন। ১৯৫৩ সালের রাজপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী প্রথম সম্ভ্যব্য রাজপ্রতিনিধি হবেন ডিউट অব এডেনবরা। তারপর প্রিন্সেস মার্গারেট, তারপর বয়স্ক অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যারা রাজপদের উত্তরাধিকারী হবেন। তাছাড়া পার্লামেন্ট নির্ধারণ করে দেয় যে, সিংহাসনে আরোহণ করতে হলে বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে।
খ. রাজকীয় বিশেষাধিকার (Royal Prerogatives) : ব্রিটেনে রাজশক্তির ক্ষমতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো রাজকীয় বিশেষাধিকার। ব্রিটেনে চিরাচরিত প্রথার মাধমে গড়ে উঠা ক্ষমতাসমূহকে রাজকীয় বিশেষাধিকার বলে। এগুলো প্রাচীন রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে রাজার যেসব ক্ষমতা বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা নির্ধারিত হয় সেগুলোকে ঠিক রাজার বিশেষাধিকার বলা যায় না। হুড ফিলিপস (O’ Hood Phillips) এর মতে, বিশেষাধিকার কোনো প্রায়োগিক বিদ্যা (technical) ধারণা নয়। কখনো কখনো রাজার সকল ক্ষমতা বোঝানোর জন্য বিশেষাধিকার কথাটি ব্যবহার করা হয়। অথবা কখনো বা রাজকীয় বিশেষাধিকার বলতে সেই সকল ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে যে ক্ষমতা প্রয়োগে শাসিতের বা প্রজার কোনো অধিকার থাকবে না ।
রাজার বিশেষাধিকারের সংজ্ঞা
Definition of Royal Prerogatives
বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজার বিশেষাধিকারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
আইনবিদ ব্লাকস্টোন (Blackstone)-এর মতে, “রাজার বিশেষাধিকার বলতে সেই সব ক্ষমতাকে বোঝানো হয় যেগুলোর ভিত্তিতে রাজাকীয় মর্যাদা অনুযায়ী অন্য সকলের উপর রাজার বিশেষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত এবং যেগুলো প্রথাগত আইনের বহির্ভূত।” (“By the word prerogative, we usually understand that special pre-eminence which the king have, over and above all persons, and out of the ordinary course of common law, in right of his royal dignity”)
এ. ভি. ডাইসি (A.V. Diecy) এর মতে, “কোনো নির্দিষ্ট সময়ে স্ব-বিবেচনা অনুযায়ী বা স্বেচ্ছাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতার যে অবশিষ্টাংশ রাজশক্তির হাতে আইনগতভাবে ন্যস্ত থাকে, তাকেই বিশেষাধিকার বলে।” (The prerogatives appears to be historical, and as a matter of actual practise nothing less than the residue of discretionary or arbitrary authority, which at any time is legally left in the hands of the crown.”
এডওয়ার্ড কোক (Edward Coke)-এর মতে, “রাজকীয় বিশেষাধিকার বলতে আইন কর্তৃক রাজশক্তিকে প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা, প্রাধান্য এবং সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায় ।” (Prerogatives are those powers, pre-eminence and privileges which
law gives to the crown.)”
হুড ফিলিপস (Hood Phillips)-এর মতে, “রাজকীয় বিশেষাধিকার বলতে সার্বভৌম রাজশক্তির সেই সকল ক্ষমতাকে বোঝানো হয়, যা তিনি বিধিবদ্ধ আইনের পরিবর্তে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন।”
সুতরাং রাজার বিশেষাধিকার বলতে রাজশক্তির ক্ষমতার সেই অবশিষ্টাংশকে বোঝায় যা প্রথাগত আইন এবং পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের মাধ্যমে সংশোধন ও প্রত্যাহার করা হয়নি।
বিশেষাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রবচন : ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় রাজকীয় বিশেষাধিকারকে কেন্দ্র করে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রবচন বা মৌলিক নীতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল প্রবচনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজার মৃত্যু রাজা দীর্ঘজীবী হোন (The king is dead, long live the king) । রাজার মৃত্যু নেই (The king never dies)। রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না (The king can do no wrong) । রাজা রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না (The king reigns but does not rule) প্রভৃতি। এই প্রবচনগুলো ব্যক্তিগত রাজা (individual king) এবং প্রতিষ্ঠানগত রাজা (institutional king)-এর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে।
রাজকীয় বিশেষাধিকারসমূহ
Royal Prerogatives
বর্তমানে ব্রিটেনের রাজা বা রানীর যেসব বিশেষাধিকার রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :
ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ : বিভিন্ন দেশে সরকারের প্রধান নিয়োগের বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশ, ভারত ও জার্মানিতে রাষ্ট্রপতি এ কাজ সম্পাদন করেন। ব্রিটেনে এই দায়িত্ব পালন করেন রাজা বা রানী। তবে ব্রিটেনের প্রথা অনুযায়ী কোনো একটি রাজনৈতিক দল কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে রাজা বা রানী সেই দলের নেতা বা নেত্রীকে সরকার গঠনের জন্য আহবান করেন ।
খ. মন্ত্রীদের নিয়োগ : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভার সদস্যদের তালিকা রাজা বা রানীর অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হয়। মন্ত্রিসভায় কারা থাকবেন বা থাকবেন না সে ব্যাপারে অদ্যাবধি রাজা বা রানী বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন। যেমন রানী ভিক্টোরিয়া চার্লস ডিউক ও লোবেচরকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করতে আপত্তি জানান ।
গ. সরকারকে বরখাস্ত করা : সরকারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা হলো রাজা বা রানীর অন্যতম বিশেষাধিকার। সরকারকে বরখাস্ত করা বলতে কার্যক্ষেত্রে কেবল প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা বোঝায়। কারণ ব্রিটেনে মন্ত্রিসভার যৌথ দায়িত্বশীলতার নীতি বিদ্যমান থাকায় প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হলে মন্ত্রিসভার সব সদস্যকেই পদত্যাগ করতে হয়। তবে ১৭৮৩ সালের পর থেকে অদ্যাবধি কোনো মন্ত্রিসভা বরখাস্ত হয়নি।
.
ঘ. পার্লামেন্টের অধিবেশন আহবান, স্থগিত ও বাতিল করা : ব্রিটেনে রাজশক্তির আর একটি বিশেষাধিকার হলো পার্লামেন্টের অধিবেশন আহবান, স্থগিত ও বাতিল করা। তবে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাজা বা রানী পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন না। তাছাড়া লর্ড সভাপতি কর্তৃক আহূত প্রিভি কাউন্সিলের সভায় গৃহীত স-পরিষদ রাজাজ্ঞা (Order in council) এবং লর্ড চ্যান্সেলরের ঘোষণা ছাড়া পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া যায় না ।
ঙ. রাজা সকল ন্যায়বিচারের উৎস : ব্রিটেনে রাজশক্তিকে সকল ন্যায় বিচারের উৎস হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিচারকগণ রাজশক্তি কর্তৃক নিযুক্ত হন। সকল ফৌজদারি মামলা রাজশক্তির নামে আনয়ন করা হয় । তিনি কোনো ব্যক্তিকে প্রিভি কাউন্সিলের নিকট আপিলের সুযোগ দিতে পারেন। তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবের (Home secretary) পরামর্শ অনুযায়ী কোনো অপরাধীর দণ্ড হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন ।
চ. রাজা বা রানী সকল সম্মানের উৎস : রাজা বা রানী হলেন সকল সম্মানের উৎস। রাজা বা রানী অধিকাংশ সময় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী উপাধি ও সম্মান বিতরণ করেন। রাজা বা রানী কত সংখ্যক পিয়ার ( Peer) সৃষ্টি করতে পারেন তার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। তবে তিনি যথেচ্ছভাবে ঐ পদ সৃষ্টি করতে পারেন না ।
ছ. সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক : রাজা বা রানী হলেন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। রাজকীয় বিশেষাধিকারের ভিত্তিতে নৌবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করা হয়। প্রতি বছর পার্লামেন্টে আইন পাসের মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে বৈধ করা হয়। রাজা বা রানী সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অফিসারদের কমিশন প্রদান করেন। তিনি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দান করেন।
জ. রাজা বা রানী নাবালক নন: রাজা বা রানী কখনো নাবালক বলে বিবেচিত হন না। তিনি সাবালক। রাজা নাবালক হলেও ধরে নেওয়া হয় যে, তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনার উপযুক্ত। সুতরাং কোনো নাবালক রাজা যদি পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত বিলে স্বাক্ষর করেন তবে তা বৈধ বলে গণ্য হবে।
ঝ. রাজা বিদেশে ব্রিটিশ জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন : রাজা বা রানী বিদেশে ব্রিটিশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি- বিদেশের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন। এজন্য পার্লামেন্টের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজন নেই ।
ঞ. রাজা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের গ্রহণ করেন : রাজা তার নিজ দেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন। তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন এবং তাদের সংবর্ধনা দেন। তিনি অন্য দেশে ব্রিটেনের কূটনীতিকদের নিয়োগ দান করেন, প্রয়োজনে তাদের ডেকে পাঠান।
ট. রাজার জরুরি বিশেষাধিকার : জরুরি অবস্থায় বা সংকটকালীন সময়ে রাজা বা রানী কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেন। জাতীয় প্রয়োজনে তিনি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ব্রিটিশ জাহাজগুলো অধিকার করতে পারেন। এগুলো করা হয় বিদেশি আক্রমণ ও আসন্ন অবরোধ হতে দেশকে রক্ষা করার জন্য।
ঠ. দেশত্যাগে বাধা প্রদান : কোনো ব্যক্তি বিচারের ভয়ে দেশত্যাগ করতে চাইলে রাজা তাকে আটক করতে পারেন। একজন পলাতক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করেন। রাজা বা রানী যুদ্ধের সময় কোনো ব্রিটিশ নাগরিককে দেশত্যাগে বাধা দিতে পারেন। তিনি বিদেশ থেকে কোনো ব্রিটিশ নাগরিককে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে রাজশক্তির বিশেষাধিকারগুলো মন্ত্রীদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রযুক্ত হয়। রাজা বা রানী ব্যক্তিগতভাবে এগুলো প্রয়োগ করেন না। উপরিউক্ত বিশেষাধিকার ছাড়া রাজা পরামর্শদান, উৎসাহ দান এবং সতর্কীকরণের মতো বিশেষাধিকার ভোগ করে থাকেন। কোনটি রাজার বিশেষাধিকারের বিষয় তা আদালত নির্ধারণ করতে পারে।