Table of Contents
Toggleরাজকীয় বিশেষাধিকারের গুরুত্ব ও উপযোগিতা আলোচনা কর ।
রাজকীয় বিশেষাধিকারের গুরুত্ব ও উপযোগিতা আলোচনা কর ।
Importance and Utility of Royal Prerogatives
রাজকীয় বিশেষাধিকারগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই এগুলো অদ্যাবধি টিকে আছে। ব্রিটিশ জনগণ বিশেষাধিকারগুলো বিলোপ সাধন করতে চায় না। নিম্নে বিশেষাধিকারগুলোর গুরুত্ব ও সেগুলো টিকে থাকার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
ক. সংবিধানকে নমনীয় এবং পরিবর্তনশীল করে : রাজকীয় বিশেষাধিকারসমূহ সংবিধানকে নমনীয় এবং পরিবর্তনশীল করে তুলে। হার্ভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেন, “ব্রিটিশ সংবিধানকে নমনীয় করে তুলতে হলে বিশেষাধিকার যথেষ্ট প্রয়োজন। আইন বা সংবিধি অনমনীয়, তাই পরিবর্তিত আবস্থার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে বিশেষাধিকার সহায়তা করে থাকে।”
খ. প্রয়োজন মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় : বিশেষ জনের তাগিদে একাধিক রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা দরকার হয়। তখন রাজকীয় বিশেষাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তা করা যায়। বিশেষাধিকার থাকার ফলে শাসন বিভাগের পক্ষে ইচ্ছেমতো কাজ করার অনেক সুবিধা হয় ।
গ. স্ব-বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ : রাজকীয় বিশেষাধিকার স্ব-বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়। বাঁধাধরা আইনের মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিশেষাধিকারটি আইন ও আদালতের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে একটি নির্দিষ্ট মামলায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিচার-বিবেচনা করতে আমাদের সহায়তা করে ।
ঘ. পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া এই ক্ষমতা প্রয়োগ : পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া রাজকীয় বিশেষাধিকার প্রয়োগ করা যায়। যেমন— পার্লামেন্টকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে পারে না। আবার ক্ষেত্র বিশেষে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হতে পারে। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনুমোদন না নিয়ে প্রশাসনিক উদ্দেশ্য সাধন করা যায়।
ঙ. রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় রাখে : ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রানীর ভূমিকা অনানুষ্ঠানিক বা নিয়মতান্ত্রিক। তার উপর রাজকীয় বিশেষাধিকারগুলো বাদ দিলে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্র টিকে থাকার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। তাই বলা যায়, রাজতন্ত্রের অস্তিত্বকে বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষাধিকারগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
গ. বিলে স্বাক্ষর প্রদান : পার্লামেন্ট কর্তৃক কোনো বিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হওয়ার পর এ বিল রাজা বা রানীর নিকট সম্মাতির জন্য পাঠানো হয়। তাঁর স্বাক্ষর ছাড়া কোনো বিল আইনে পরিণত হতে পারে না ।
ঘ. স-পরিষদ রাজাদেশ : স-পরিষদ রাজা বলতে প্রিভি কাউন্সিলসহ রাজাকে বোঝায়। রাজা বা রানী কোনো উপনিবেশের জন্য প্রিভি কাউন্সিলের নির্দেশনার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করতে পারেন ।
৩. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা (Judicial Powers) : ব্রিটেনের রাজা বা রানীর বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা কয়েকভাবে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যথা-
ক. ন্যায় বিচারের উৎস : তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনের রাজা বা রানী এখনও ন্যায়বিচারের উৎস (Fountain of Justice) হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর নামে সকল বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। অগ এবং জিংক (Ogg and Zink) বলেন, “The crown remains the historic ‘fountain of Justice’ and technically the courts are still the king’s courts.”
খ. বিচারকদের নিয়োগ করেন : দেশের সর্বস্তরের বিচারকদের রাজা বা রানী নিয়োগ করেন। তবে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ আবেদন ছাড়া তাঁদের পদচ্যুত করা যায় না। বিচারকদের কার্যকাল, বেতন, পদচ্যুতি প্রভৃতি পার্লামেন্টের আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়।
গ. ফৌজদারি মামলা দায়ের : সব ফৌজদারি মামলার ফরিয়াদী পক্ষ হলেন রাজা বা রানী স্বয়ং । কিন্তু রাজা বা রানীর বিরুদ্ধে আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যায় না ।
ঘ. তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত কার্য : সকল বিচারালয়ের তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ রাজা বা রানীর নামে লর্ড চ্যান্সেলর সম্পাদন করেন।
ঙ. দণ্ডাদেশ হ্রাস বা মওকুফ : রাজা বা রানী যে কোনো আদালতের দণ্ডাদেশ হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে তিনি সাধারণত স্বরাষ্ট্র সচিব (Home secretary)-এর পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাজশক্তির ক্ষমা প্রদর্শন ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- Mercy is not the subject of legal rights. It begins where legal rights end. ব্রিটেনে ১৭০১ সালে নিষ্পত্তি আইন (The act of settlement) এর দ্বারা বিচারকের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। তার ফলে বিচার বিভাগের কাজে রাজা বা মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণে সংকুচিত হয়েছে।
৪. সম্মান বিতরণ সংক্রান্ত ক্ষমতা (Powers relating to the conforment of honours) : ব্রিটেনে রাজশক্তিকে ‘সম্মানের উৎস’ (Fountain of honours) বলা হয়। যারা দেশে প্রশংসনীয় কাজ করেন তাদের তিনি খেতাব ও পদবি বিতরণ করেন। সাধারণত রাজ্যাভিষেক, রাজা বা রানীর জন্মদিন, নববর্ষ প্রভৃতি উপলক্ষে রাজশক্তি বিভিন্ন সম্মানসূচক খেতাব বা উপাধি বিতরণ করেন। বর্তমানে রাজা বা রানীর মন্ত্রিসভাও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী এই সকল সম্মান বিতরণ করেন। এ বিষয়ে ১৯২৩ সালে ‘সম্মান আইন’ নামে একটি আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বর্তমানে সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণকারীদের যোগ্যতা বিচারের দায়িত্ব প্রিভি কাউন্সিলের হাতে অর্পণ করা হয়েছে।
৫. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ক্ষমতা (Ecclesiastical Powers) : খ্রিস্ট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হলেন রাজা বা রানী । তিনি ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের চার্চের প্রধান। অ্যাংলিকান চার্চের প্রধান হিসেবে তিনি বিশপ ও আর্চ বিশপদের নিয়োগ করেন। ক্ষেত্র বিশেষে ডীনদের (Deans ) এবং কেননদেরও (Canons) তিনি নিয়োগ করেন। এই চার্চের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার কেনটারবেরি ও ইয়র্কের ধর্ম সমাবেশ রাজার আদেশেই আহূত হয়। চার্চের আইনও রাজা বা রানীর সম্মতি সাপেক্ষ। তবে আংলিকান চার্চ এবং স্কটল্যান্ডের প্রেসবিটারিয়ান চার্চ ছাড়া অন্য কোনো চার্চের সাথে রাজশক্তির কোনো সম্পর্ক নেই ।
রাজকীয় বিশেষাধিকারের গুরুত্ব ও উপযোগিতা
তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাজা বা রানী লর্ডসভার আজীবন সদস্য নিয়োগ করতে পারেন। রাজা বা রানী কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
ব্রিটেনের রাজা বা রানী হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসক প্রধান। তার এই সকল ক্ষমতা ও কার্যাবলি আনুষ্ঠানিক মাত্ৰ ৷ বাস্তবে রাজা বা রানীর এসব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কেবিনেটই চর্চা করে। রাজা বা রানী হলেন জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষী গোপাল । এই কারণে লর্ড ঈশার ( Lord Esher) বলেছেন, “If the constitutional doctrine of ministerial responsibility means
anything at all, the king would have to sign his own death warrant, if it is presented to him for signature by a minister commanding majority in parliament. ” সিডনি লো ( Sidney Low) বলেছেন—“রাজশক্তি হলো’ শাসনকার্যের সুবিধার জন্য একটি কল্পনা মাত্র।” (The crown indeed be a convenient working hypothesis.)
রাজশক্তির ভূমিকা ও পদমর্যাদা
Role and Position of the Crown
ব্রিটেনে রাজশক্তির ভূমিকা ও পদমর্যাদাকে কেন্দ্র করে দুটি পরস্পর বিরোধী মতামত প্রচলিত আছে ।
প্রথম মতামত, রাজা বা রানী প্রকৃত শাসক : প্রথম মতের সমর্থকরা রাজশক্তির বিপুল ক্ষমতার উল্লেখ করে রাজা বা রানীকে ব্রিটেনের প্রকৃত শাসক (real ruler) বলে বর্ণনা করেন। তাঁদের মতে, রাজা বা রানী আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, খ্রিস্ট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির প্রধান হিসেবে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে রাজার বিশেষাধিকার তাঁকে প্রকৃত শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে বলে তারা মনে করেন।
দ্বিতীয় মতামত, নিয়মতান্ত্রিক শাসক : দ্বিতীয় না.তর সমর্থকরা বলেন যে, তত্ত্বগতভাবে রাজা বা রানী ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করলেও বাস্তবে তিনি এসব ক্ষমতা কেবিনেটের পরামর্শ ছাড়া প্রয়োগ করতে পারেন না। বর্তমানে ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে এক সময়ের সর্বশক্তিমান রাজা নিয়মতান্ত্রিক শাসকে পরিণত হয়েছেন। রাজা কেবল রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না। রাজা বা রানীর নিয়মতান্ত্রিক প্রকৃতি লক্ষ করে সিডনি লো (Sideny Low) বলেছেন, রাজশক্তি হলো শাসনকার্যের সুবিধার জন্য একটি কল্পনা মাত্র। (The crown indeed be a convenient working hypothesis) । কে. সি. হোয়ার (K.C. Wheare) তাকে জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষী গোপাল (a magnificent cipher) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
উপরিউক্ত দুটি মতামতের কোনোটিকেই এককভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা যায় না। রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করলেও তাকে একেবারে জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষী গোপাল ভাবা ঠিক নয়। বর্তমানে রাজা বা রানীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকাকে মোটেই উপেক্ষা করা যায় না।
ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে রাজার ভূমিকা : প্রথাগত বিধান অনুযায়ী কমপসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। জেনিংস ( Jennings ) বলেছেন, The Queen has one and only one function of primary 113) কিন্তু কমপসভায় কোনো দলের importance. It is appoint a Prime Minister. (The British Constitution p নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে কিংবা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাজা বা রানীর পক্ষে নিজস্ব বিচার বিবেচনা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। যেমন ১৯৪০ সালে প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন কমন্সসভার ৮ মের বিতর্কের পর পদত্যাগ করেন। তখন রক্ষণশীল দলের উইনস্টন চার্চিল ও লর্ড হ্যালিফাক্সের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। রাজা ষষ্ঠ জর্জ চার্চিলকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
খ. মন্ত্রীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা : মন্ত্রীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজা বা রানীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথাগত বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। কিন্তু মন্ত্রীদের মনোনীত করার ব্যাপারে অদ্যাবধি রাজা বা রানীর মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ ১৯৪৫ সালে প্রধানমন্ত্রী এটলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগের জন্য হিউগ ডালটন এর নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু রাজা ষষ্ঠ জর্জ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আরনেস্ট বেভিনকে নিয়োগ করার জন্য পরামর্শ দেন। ফলে এটলি বেভিনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেন ।
গ. শাসনকার্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা : ব্রিটেনে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একটি মন্ত্রিসভার প্রস্থান এবং নতুন একটি মন্ত্রিসভার আগমনের অন্তর্বর্তী সময়ে শাসনকার্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য একজন রাষ্ট্রপ্রধানের প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থার আশংকা থাকে। ব্রিটেনের রাজা বা রানী অন্তর্বর্তীকালীন এ গুরুদায়িত্ব পালন করে শাসনকার্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন ।
ঘ. কমন্সসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা : রাজা বা রানী সাধারণত মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে কমন্সসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে তিনটি ক্ষেত্রে তিনি এই পরামর্শ নাও মানতে পারেন। যথা : ক. কমন্সসভা যদি সক্রিয় এবং দায়িত্ব পালনে সমর্থ থাকে; খ. সেই সময় সাধারণ নির্বাচন দেশের অর্থনীতির পক্ষে অকাম্য বিবেচিত হলে এবং গ. কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট কোনো ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করার সুযোগ থাকলে ।
ঙ. বিরোধের সন্তোষজনক নিষ্পত্তি : বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কোনো কারণে বিরোধ কিংবা সংঘর্ষ বাধলে নিরপেক্ষ চরিত্র বিশিষ্ট রাজা বা রানীর মধ্যস্থতায় বিরোধের সন্তোষজনক নিষ্পত্তি সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ আইরিশ স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে কিংবা লর্ড সভা ও কমন্সসভার মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে রাজা পঞ্চম জর্জের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় ।
চ. শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা : ব্রিটেনে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রবর্তিত না হলেও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করা একান্ত প্রয়োজন। এই সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় না হলে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। রাজা বা রানী বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করে শাসনকার্যে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বার্কার (Barker)-এর মতে, ব্রিটেনে রাজশক্তি সরকার বিরোধী দলসহ সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
ছ. পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত ভূমিকা : পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও পরিচালনায় রাজা বা রানীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রাজা বা রানী কমনওয়েলথের এবং ডোমিনিয়নসমূহের প্রধান। তাই তিনি বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। আইভর জেনিংস ( Ivor Jennings ) বলেছেন, “In some respects notable on foreign affairs and on matters dealing with the commonwealth, he may be better informed than the Prime Minister.”
জ. জনজীবনে বৈচিত্র্য আনে : রাজা বা রানী ব্রিটিশ জনগণের ক্লান্তিকর, বৈচিত্র্যহীন ও নিরানন্দময় জীবনে বৈচিত্র আনয়ন করে। বেশির ভাগ জনগণ রাজ পরিবারের আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদি অনুসরণ করে। এইচ. জি. ওয়েলস (H. G. Wales) বলেছেন, তার মা রানী ভিক্টোরিয়ার মধ্যে সকল অভাব পূরণকারী ব্যক্তিত্বের (compansating personality) সন্ধান পেয়েছেন। স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) এর মতে, গণতান্ত্রিক সরকার কেবল নীরস যুক্তি এবং একঘেয়ে নীতির সমন্বয় নয়, সেখানে বৈচিত্র্য প্রয়োজন, রাজকীয় পোশাকের বাহারী রঙের মতো কোনো কিছুই পরিপূর্ণভাবে দৃশ্যমান নয় । (… democratic government is not merely a matter of cold reason and prosaic policies. There must be some display of colour and there is nothing more vivid than royal purple and imperial scarlet. ( Jeanings. The British Constitution. pp 120-121]
ঝ. ঐক্য ও সংহতির প্রতীক : ব্রিটেনের জনগণের কাছে রাজা বা রানী ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে গণ্য। অনেকের ধারণা ব্রিটেন আজ একটি সুসংহত রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে রাজশক্তির ভূমিকার জন্য। কার্টার, রেনী ও হার্জ (Carter. Ranney and Herz)-এর মতে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভীতি ও যুদ্ধ মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তারা কোনো ব্যক্তির মধ্যে নিরাপত্তার বা আশ্বাসের সন্ধান করে। ব্রিটেনের রাজা বা রানী সেই নিরাপত্তার প্রতীক ।
ঞ. সামরিক ক্ষমতা : রাজা বা রানী ব্রিটেনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করেন। তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণ, সংগঠন ও পরিচালনা করেন। তাঁর নামেই যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপন করা হয়।
ট. পদ ও সম্মান বিতরণ : ব্রিটেনে রাজা বা রানী হলেন সকল সম্মানের উৎস। তিনি পিয়ার পদ সৃষ্টি করতে পারেন । তিনি নাগরিকদের মধ্যে সম্মান, পদ, খেতাব ও পুরস্কার বিতরণ করেন।
ঠ. লাস্কি ও বার্কারের মতামত : অধ্যাপক লাস্কির মতে, রাজা বা রানী কর্মদক্ষ হলে এবং উপযুক্ত পরামর্শ পেলে সরকারি নীতি নির্ধারণের উপর এখনও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। (An energetic monarch, skillfully advised can still play considerable part in shaping the emphasis of policy.) বার্কার (Barker)-এর মতে, রাজা বা রানী ব্রিটিশ সংবিধানের ক্রিয়াশীল অংশ। (active part of the British constitution)। রাজা বা রানী যতটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, মন্ত্রীদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তাই রাজা বা রানী শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে যদি কোনো পরামর্শ দেন তা উপেক্ষা করা কঠিন।
ড. বেজহটের মতামত : প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ওয়াল্টার বেজাইট (Walter Bagehot) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The English Constitution এ একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন। সেটি হলো ব্রিটেনের রাজার তিনটি অধিকার আছে। যথা— পরামর্শ দানের অধিকার, উৎসাহ দানের অধিকার এবং সতর্ক করার অধিকার। (The crown has three rights the right to be consulted, the right to encourage and the right to warn.)
শাসনকার্যের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে রাজা খোঁজখবর নিতে পারেন। প্রয়োজনবোধে তিনি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারেন। আবার মন্ত্রিসভাকে কোনো ভালো কাজের জন্য তিনি তাঁদের উৎসাহ দিতে পারেন। আবার মন্ত্রিসভা কর্তৃক রাষ্ট্রস্বার্থ বিরোধী কোনো নীতি গৃহীত হলে তিনি তাঁদের সতর্ক করতে পারেন ।
ঢ. আইভর জেনিংস-এর মতামত : স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) রাজার চারটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয় উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে,
ক. রানীর প্রভাব সংবিধানের সকল অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে;
খ. কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে;
গ. রানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং
ঘ. রাজনৈতিক এলাকার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করেন।
পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটেনের রাজা বা রানী ব্রিটিশ জনগণের আনন্দ উৎসব ও ঐতিহ্যের প্রতীক। তিনি যেখানেই যান না কেন সর্বত্রই প্রধান আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিণত হন। বিশ্ব রাজনীতিতেও রাজা বা রানীর ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলনে রাজা বা রানী প্রধান আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ব্রিটিশ জনগণের কাছে রাজা বা রানীর জনপ্রিয়তা ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান। অধ্যাপক কে. সি. হোয়ার (K. C. Wheare) বলেন, “ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রানী নিয়মতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করলেও তাঁকে পুতুল মনে করা ভুল হবে।” (It would be incorrect to suppose that because the Queen occupies a strictly constitutional role, she is therefore a puppet monarch.)