Table of Contents
Toggleযুক্তরাজ্য গঠনের ইতিবৃত্ত
ঐতিহাসিক পরিক্রমা
Historical Survey
“ব্রিটিশ সংবিধান তৈরি করা হয়নি, বরং তা গড়ে উঠেছে”–এ. ভি. ডাইসি / “ব্রিটিশ সংবিধান বহু শতাব্দির বিবর্তনের ফল”
ব্রিটেন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। আমরা সাধারণত যাকে ব্রিটেন বা ইংল্যান্ড বলি তার সরকারি নাম হলো গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্য (United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland). একে সংক্ষেপে যুক্তরাজ্য (United Kingdom) বলে অভিহিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ব্রিটেন, ১৯৮৯ (Britain, 1989) এ যুক্তরাজ্যকে ব্রিটেন (Britain) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে যুক্তরাজ্যকে কেবল ব্রিটেন নামেও অভিহিত করা যায়।
ব্রিটেন হলো ইউরোপের একটি ক্ষুদ্রায়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্র। এর আয়তন ২,৪৩,৬১০ বর্গ কিলোমিটার। ব্রিটেনের রাজধানীর নাম হলো লন্ডন (London)। এর চারদিক সমুদ্র পরিবেষ্টিত। এর উত্তর ও পশ্চিম উপকূলে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর । ৩৫ কিলোমিটার প্রশস্ত ইংলিশ চ্যানেল দেশটিকে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দ্বীপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে অনুপ্রাণিত করেছে। ব্রিটেনের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। নর্মান্ডির উইলিয়ামের দ্বারা ইংল্যান্ড বিজিত হওয়ায় পরে ইংল্যান্ড আর কোনো বিদেশি শক্তির অধীনস্থ হয়নি। সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ার কারণে ব্রিটেন এক সময় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নৌশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটেনের শক্তিশালী নৌবহর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। .
জনসংখ্যা : ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যা হলো ৬ কোটি ৪৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৪২৮ জন (২০১৬)। জনসংখ্যার শতকরা ৮১.৫ ভাগ হলো ইংরেজ। স্কট, ওয়েলেশম্যান, আইরিশ ও আলস্টারম্যানদের সংখ্যা হলো শতকরা ১৬.৫ ভাগ । এরা ইংরেজি ভাষাভাষী হলেও নিজেদের ইংরেজ বলে মনে করেন না। এশীয়, পশ্চিম ভারতীয় ও আফ্রিকানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২ ভাগ। ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী হলেও এখানে রোমান ক্যাথলিক, ইহুদি, হিন্দু ও মুসলমান রয়েছে। ব্রিটেনে মুসলমান সম্প্রদায়ের শতকরা হার ৩%। ব্রিটেনের জনগণের জাতীয়তা ব্রিটিশ।
ইংরেজ জাতির উদ্ভব : প্রাচীনকালে ইংল্যান্ডে সেল্টিক (Celtic) উপজাতিরা বাস করত। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৫৪. অব্দে ইংল্যান্ড দখল করেন এবং তা রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তারপর প্রায় চারশ বছর ইংল্যান্ড রোমানদের অধীনস্থ ছিল। পঞ্চম শতাব্দিতে মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ড থেকে অ্যাংলো স্যাকসন, নর্মান প্রভৃতি জাতের লোকেরা ইংল্যান্ডে আসে। ইংরেজরা অ্যাংলো-স্যাকসন ও নর্মান বংশোদ্ভূত। ইংরেজ ছাড়া আইরিশ, স্কট ও ওয়েলস এই তিনটি জাতি ইংল্যান্ডের পশ্চিম এবং উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করত। সেন্টিক (Celtic) উপজাতি থেকে এদের জন্ম। অ্যাংলো স্যাকসন ও নর্মান উপজাতিরা প্রথমে নিজেদের প্রধানের নেতৃত্বে সাতটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই সাতটি রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও যুদ্ধ চলতে থাকায় রাজগুলো একে একে দুর্বল হয়ে পড়ে। ওয়েসেক্সের উপজাতির লোকেরা অবশেষে অপর ছয়টি রাজ্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজত্ব স্থাপন করে। এভাবে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দিতে ওয়েসেক্স জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন উপজাতির সমন্বয়ে ইংরেজ জাতির উদ্ভব ঘটে। সেন্টিক ও ইংরেজ জাতির সাথে ব্রিটানি (Britanny) জাতির বিরাট সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকায় শেষ পর্যন্ত এই চারটি জাতি মিলে ব্রিটেন নামকরণ করা হয়। বর্তমানে ইংরেজ, আইরিশ, স্কট এবং ওয়েলস এই চারটি জাতিকে নিয়ে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য গঠিত। এই সাতটি রাজ্যের নাম ছিল সাসেক্স, অ্যাসেক্স, ওয়েসেক্স, পূর্ব অ্যাঙ্গেলিয়া, মার্জিা, নর্দাম্বিয়া ও কেন্ট।
যুক্তরাজ্য গঠনের ইতিবৃত্ত : বিশ্বের প্রাচীন দেশগুলোর অন্যতম হলো ইংল্যান্ড। ত্রয়োদশ শতাব্দিতে ওয়েলস ইংল্যান্ড কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং ১৫৩৬ সালে এর সাথে যুক্ত হয়। ১৭০৭ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সাথে স্কটল্যান্ড সংযুক্ত হয়। এদের ঐক্যবদ্ধ ভূখণ্ডকে সরকারিভাবে গ্রেট ব্রিটেন (Great Britain) বলা হয়। ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্ট গ্রেট ব্রিটেনের সাথে আয়ারল্যান্ডকে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এভাবে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে “গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্য (United Kingdom of Great Britain and Ireland) গঠিত হয়। ১৯২২ সালে দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের ২৬টি কাউন্টি (Counties) যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র (Republic of Ireland) গঠন করে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৯টি কাউন্টির মধ্যে ৬টিকে জোর করে যুক্তরাজ্যের সাথে থাকতে বাধ্য করা হয়। বর্তমানে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যাণ্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্য (United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland) গঠিত ।
অর্থনৈতিক অবস্থা : অষ্টাদশ শতাব্দির শিল্প বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেন ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। ব্রিটেনের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ছিল গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী। তাদের জীবনযাত্রার প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি। স্বাভাবিকভাবে কৃষি নির্ভর ব্রিটেনের
- অর্থনীতি ছিল প্রকৃতিগতভাবে সামন্ততান্ত্রিক। অষ্টাদশ শতাব্দিতে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব সাধিত হলে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি শিল্প নির্ভর হয়ে পড়ে। শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃষির উপর নির্ভরশীলতা কমে যায়। জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ শিল্পের সাথে যুক্ত। শিল্পোন্নত ব্রিটেনের শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ শহরে বসবাস করে। বর্তমানে জনসংখ্যার শতকরা চার ভাগ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন : পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দিতে ইংরেজরা আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। কিন্তু আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সেখানে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্রিটেন এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে বাধ্য হয়। আফ্রিকা মহাদেশের কাঁচামাল ও মধ্যপ্রাচ্যের তেল ব্রিটেনের হস্তগত হওয়ায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে ব্রিটেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বিদেশ থেকে আহূত সম্পদে দেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। এক একটি করে বহু উপনিবেশ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটেনের প্রভাব প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে ।
বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি : ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় কাঠামো হলো এককেন্দ্রিক। ব্রিটেন ‘সংসদীয় শাসনব্যবস্থা’ (Parliamentary Goverment)-র মাতৃভূমি নামে পরিচিত। ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ শাসন কার্যাদির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র সচিব ( Home Secretary)-এর হাতে অর্পণ করা হয়েছে। তাঁর কার্যালয় লন্ডনে অবিস্থিত। কিন্তু ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের শাসনকার্যাদি পরিচালনার জন্য পৃথক পৃথক স্বরাষ্ট্র সচিব রয়েছেন। তাদের কার্যালয় ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়রল্যান্ডের রাজধানী যথাক্রমে কারডিফ, এডিনবার্গ ও বেলফাস্ট এ অবস্থিত। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ইংল্যান্ড ও ওয়েলসকে ৪৭টি কাউন্টি, ৩৬৯টি জেলা এবং জেলাগুলোকে কয়েক হাজার প্যারিশে (Parishes ) বিভক্ত করা হয়েছে। বৃহত্তর লন্ডন {Greater London) ২৮টি বরো ও লন্ডন সিটি (City of London)-তে বিভক্ত। স্কটল্যান্ডকে ৯টি অঞ্চলে (Regions) বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চল আবার ৫৩টি জেলা এবং ৩টি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত। উত্তর আয়ারল্যান্ড মোট ৬টি কাউন্টিতে বিভক্ত। কয়েকটি জেলা নিয়ে এক একটি কাউন্টি গঠিত হয়েছে। ইংল্যান্ড ব্রিটেনের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রদেশ। ব্রিটেনের পতাকার নাম ইউনিয়ন জ্যাক। ঐ দেশের জাতীয় প্রতীক হলো গোলাপ। ব্রিটেনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ভিক্টোরিয়া ক্রস ।