Table of Contents
Toggleমার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
Powers and Functions of the Sentate of USA
মার্কিন সিনেট The Senate of USA
মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয় কক্ষের নাম হলো সিনেট। সিনেটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহের প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী কেন্দ্রিয় আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট হয়। নিম্নকক্ষকে জনসাধারণের এবং উচ্চকক্ষকে অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি রূপে গণ্য করা হয়। মার্কিন সিনেট কেন্দ্রিয় আইনসভার উচ্চকক্ষ এবং সেই হিসেবে এই কক্ষকে অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ বলা হয়।
সিনেটের গঠন
Composition of the Senate
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহের সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট গঠিত হয়। মার্কিন সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কোনো অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে সিনেটের সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এভাবে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল অঙ্গরাজ্যকে সমান প্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। যদিও অনেকে এ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেছেন। স্বল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যসমূহের সংখ্যা মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের অধিক হওয়ায় তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধান সংশোধন, সন্ধি বা চুক্তি অনুমোদন; ইম্পিচমেন্টের বিচার প্রভৃতি কার্যে বাধা প্রদানে সক্ষম। কারণ, এসকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিনেটের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। এভাবে সংবিধান রচয়িতাগণ কার্যত: সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহৎ অঙ্গরাজ্যগুলো অপেক্ষা সংখ্যালঘিষ্ঠ রাজ্যসমূহের ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধিতা করেছেন বলে সমালোচকদের ধারণা।
সিনেটের সদস্য সংখ্যা
Members of the Senate
মার্কিন অঙ্গরাজ্যসমূহের আয়তন ও লোকসংখ্যার তারতম্য থাকলেও প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে সিনেটে দুই জন করে সদস্য নির্বাচিত হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা হলো ৫০টি। ফলে সিনেটে মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০।
সিনেটের নির্বাচন পদ্ধতি
Election Method of the Senate
১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে সিনেটের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থির হয় যে, সিনেটের সদস্যগণ পরোক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। এক্ষেত্রে, অঙ্গরাজ্যসমূহের আইনসভা সিনেট সদস্যদের নির্বাচিত করবে। কিন্তু এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করে সংবিধান প্রণেতাদের মোহভঙ্গ ঘটে। তাঁরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেন যে, দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে সিনেট নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় নেতাগণ অস্বাভাবিকভাবে প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে সক্ষম। তাছাড়া, এ ব্যবস্থায় নানা প্রকার দুর্নীতিও প্রশ্রয় পেতে থাকে। ফলে, ১৯১৩ সালে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনের মাধ্যমে স্থির হয় যে, সিনেট সদস্যগণ অঙ্গরাজ্যসমূহের ভোটদাতাগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন।
সিনেট সদস্যদের যোগ্যতা
Qualification of the Members of the Senate
মার্কিন সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় সিনেট সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে :
ক. প্রার্থীর বয়স হবে সর্বনিম্ন ৩০ বছর;
খ. প্রার্থীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধারে ৯ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে;
গ. যে নির্বাচনি এলাকা থেকে নির্বাচন করবেন সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
ঘ. সিনেটের সদস্য থাকাকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কোনো চাকরিতে কর্মরত থাকতে পারবেন না।
সিনেটের কার্যকাল
Tenure of the Senate
সিনেট একটি স্থায়ী সভা। প্রতিনিধি সভার ন্যায় নির্দিষ্ট সময়ের পর তার কার্যকালের অবসান ঘটে না। অর্থাৎ, এটি কখনো একেবারে ভেঙে যায় না। তবে, সিনেট সদস্যগণ ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রত্যেক দু-বছর অন্তর সিনেটের
-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করলে তাদের স্থলে সমান সংখ্যক নতুন সদস্য নির্বাচন করা হয়। যে কোনো সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন ।
সিনেট সদস্যদের বেতন ও ভাতাদি :
সিনেট সদস্যগণ বছরে ৫৭,৫০০ ডলার বেতন সহ অন্যান্য সুবিধা লাভ করে থাকেন। নিজেদের প্রয়োজনে কর্মচারী নিয়োগের জন্য বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা লাভ করেন। তবে এই ভাতার পরিমাণ সদস্যদের নিজ নিজ রাজ্যের লোকসংখ্যার উপর নির্ভর করে। প্রত্যেক সদস্যদের যাতায়াতের জন্য ভাতা, ওয়াশিংটন ও নিজ রাজ্যের দপ্তর পরিচালনার জন্য আবাসন, বিনা মাশুলে ডাক ও তার বিভাগের সুযোগ-সুবিধার বিধান আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কোনো দেশের আইনসভার সদস্যদের জন্য এমন ব্যাপক সুবিধা নেই ।
সিনেটের অধিবেশন :
সিনেটের অধিবেশন প্রতি বছর ৩ জানুয়ারি শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট সিনেটে সভাপতিত্ব করেন। সভার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর হাতে ন্যস্ত। উপ-রাষ্ট্রপতি যে দলনিরপেক্ষ হয়ে কার্য পরিচালনা করেন এমন নয়। তাঁরও দলীয় আনুগত্য আছে। দলীয় কর্মসূচির বাস্তবায়ন তাঁর অন্যতম কর্তব্য । অগ ও রে যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, প্রতিনিধিসভার স্পিকারের ন্যায় তিনিও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তাঁর দপ্তরকে ব্যবহার করা হয় ।
সিনেটের কমিটি ব্যবস্থা
Committee System of the Senate
মার্কিন প্রতিনিধি সভার ন্যায় সিনেটের কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও কমিটি ব্যবস্থার গুরুত্ব যথেষ্ট। কমিটির মাধ্যমেই বিভিন্ন বিল, সরকারি নীতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিনেটকে মতামত ব্যক্ত করতে হয়। বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি, অর্থ কমিটি, আয়-ব্যয় সম্পর্কিত কমিটি, বিচার বিষয়ক কমিটি, কৃষি ও বনজ সম্পদ বিষয়ক কমিটি, আন্তঃরাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক কমিটি প্রভৃতি ১৮টি কমিটির মাধ্যমে সিনেটের কার্যাবলি সম্পাদিত হয় ।
মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
Powers and Functions of the Sentate of USA
মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ হলেও সিনেটের ক্ষমতা ও মর্যাদা নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভার তুলনায় অনেক বেশি। সিনেটের উচ্চমর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে এর ক্ষমতা ও কার্যক্রমের ব্যাপক প্রভাব। মার্কিন সংবিধান অনুসারে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট নিম্নরূপ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা চর্চা করে থাকে :
১. আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেস সাংবিধানিকভাবে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে । আর কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। তবে সাধারণ বিল ও অর্থ বিলের ক্ষেত্রে এ ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান । যেমন :
ক. সাধারণ বিল : সাধারণ বিল প্রতিনিধি সভা কিংবা সিনেট যে কোনো কক্ষেই উপস্থাপন করা যায়। উভয় কক্ষে উপস্থিত ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভে সক্ষম হলে বিলটি কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। তবে সিনেট প্রয়োজনে প্রতিনিধি সভার মাধ্যমে গৃহীত বিলের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
খ. অর্থ বিল : অর্থ বিল প্রথমে সিনেটে পেশ করা সম্ভব নয়। অর্থ বিল ও বাজেট প্রথমে প্রতিনিধি সভায় পেশ করতে হয়। তবে সংবিধান অনুসারে সিনেটে কোনো অর্থ বিল উত্থাপন করা না গেলেও অর্থ বিল সংশোধনের ক্ষমতা সিনেটের রয়েছে। কেবলমাত্র শিরোনাম ব্যতীত সিনেট প্রতিনিধি সভায় পাসকৃত অর্থ বিলের যে কোনো অংশ সংশোধন করতে পারে ।
২. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেট ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাষ্ট্রদূত, পদস্থ সরকারি কর্মচারী, বাণিজ্যিক প্রতিনিধিসহ প্রায় কয়েক হাজার উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী মনোনয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি সিনেটের সৌজন্যবিধি অনুযায়ী বিশিষ্ট ও নেতৃত্বস্থানীয় সিনেটরদের সাথে পরামর্শক্রমে এ সমস্ত মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। নচেৎ সিনেট রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সময় হতে সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবিত একাধিক মনোনয়নের ক্ষেত্রে সিনেট এরকম ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ঐসকল মনোনয়ন বাতিলও করা হয়েছে।
৩. চুক্তি ও সন্ধি অনুমোদন ক্ষমতা : শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি যেসকল আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেগুলোও সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ । সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুমোদন করলেই কেবলমাত্র এসব সন্ধি-চুক্তি কার্যকর হতে পারে; অন্যথায় এসমস্ত সন্ধি ও চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দলীয়ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে সিনেট রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত এসকল সন্ধি-চুক্তি মেনে নেয় । তবে সর্বদাই যে এসকল সন্ধি-চুক্তি মেনে নেয় তা কিন্তু নয় ৷ মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্পাদিত সন্ধির চুক্তি বাতিল, আংশিক পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৯ সালে রাষ্ট্রপতি উইলসন কর্তৃক স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি সিনেটের অনুমোদন পায়নি বিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতিপুঞ্জে’ যোগদান করতে পারে নি।
৪. তদন্ত করার ক্ষমতা : মার্কিন সিনেটের শাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত বা অনুসন্ধান পরিচালনা করার ক্ষমতাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সিনেটের এ ধরনের অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। কমিটি নিয়োগ করে সিনেট যে কোনো পদস্থ সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে। এ ধরনের অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে এসকল অনুসন্ধান কার্যের ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ (Live Telecast) হয়, যা দেশের অভ্যন্তরেও অনেকে অতি আগ্রহের সাথে লক্ষ করে থাকে ।
৫. ́ বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সিনেট রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা ‘ইম্পিচমেন্ট’ আনতে না পারলেও ইম্পিচমেন্টের বিচার করতে পারে। প্রতিনিধি সভা ইম্পিচমেন্টের যে অভিযোগ আনে সিনেট তা বিচার বিবেচনা করার পর দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব পাস করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে হয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, সিনেট যখন ইম্পিচমেন্টের বিচার করে তখন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। এছাড়া সরকারি কার্যক্রম ও দুর্নীতি সম্পর্কে অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য সিনেট তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। আবার সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্তের জন্য সিনেট তদন্ত কমিটি নিযুক্ত করতে পারে।
৬. সংবিধান সংশোধনমূলক ক্ষমতা : সিনেট সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ক্ষমতাও ভোগ করে। সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত সংবিধান সংশোধন কার্যকর হয় না। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব যখন কংগ্রেসে পাস হয় তখন সিনেটের দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি আবশ্যক হয় ।
৭. নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা : অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে হলেও মার্কিন সিনেটের নির্বাচনমূলক ক্ষমতা রয়েছ। উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সিনেট সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত তিনজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করার ক্ষমতা ভোগ করে থাকে ।
৮. নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা : অনেকের মতে, মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ রাষ্ট্রপতি ও প্রতিনিধিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সিনেট গঠনের বিষয়টি মাথায় এনেছিলেন। এক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’-কে বাস্তবে রূপায়িত করার মাধ্যম হিসেবে সিনেটকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে মার্কিন সংবিধানে স্বল্প সদস্য বিশিষ্ট এবং স্থায়ী প্রকৃতি সম্পন্ন সিনেটের হাতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করে। এ সমস্ত ক্ষমতার সাহায্যে সিনেট রাষ্ট্রপতি ও প্রতিনিধি সভার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র মার্কিন প্রশাসনব্যবস্থায় এর প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়।
৯. বৈদেশিক ক্ষমতা : পররাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর অর্পিত হলেও বৈদেশিক বাণিজ্য, প্রতিনিধি প্রেরণ, সাহায্য প্রভৃতি বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সিনেটের পরামর্শ ও অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। সর্বাধিনায়ক হিসেবে সেনাবাহিনী। পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণেও সিনেটের সম্মতি আবশ্যক। তাছাড়া, সিনেট যে কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে আলাপ-আলোচনা চালানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাতে পারে। অনেক সময় রাষ্ট্রপতির পক্ষে সিনেটের এই অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। কেননা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিনেটের সম্মতি রাষ্ট্রপতির জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য বিধায় তাঁর পক্ষে সর্বদা সিনেটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয় না।
১০. যুদ্ধ ঘোষণা : একমাত্র সিনেট যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা রাখে। সিনেটের সম্মতি ব্যতীত রাষ্ট্রপতি ৩ মাসের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য । অধ্যাপক লাস্কি (Laski) তাঁর “The American Democracy” গ্রন্থে বলেন, “Unaided by the Senate the American president is a sailor on a uncharteredship.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিনেটের ভূমিকা ও কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষ হিসেবে সিনেট আইন প্রণয়ন ছাড়াও শাসন ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষমতা চর্চা করে। মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও প্রভাবের কাঠামো ও কার্যগত মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে, অন্য কোনো দেশের আইনসভার উচ্চ কক্ষের হাতে এত বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা অর্পণ করা হয় নি। সিনেট একদিকে প্রতিনিধি সভার গণতান্ত্রিক হঠকারিতা প্রতিরোধ ও সংযত করে, আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির রাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে । ক্ষমতার এরূপ ভারসাম্য ও সংমিশ্রণ বিরল। তদুপরি প্রতিনিধি সভার তুলনায় সিনেটের উচ্চমান, সদস্যদের স্বাধীন মনোভাব, বিজ্ঞ আইনজীবী, বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে সিনেট গঠিত। সামগ্রিকভাবে সিনেটকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় কক্ষ বলে অভিহিত করা যায় ৷
মার্কিন সিনেটের প্রাধান্যের কারণসমূহ
Factors Responsible for Dominance of the Senate of USA
সিনেটের ক্ষমতা ও প্রভাবকে কেবলমাত্র একটি ব্যতিক্রম হিসেবে আলোচনা করা ছাড়াও যে সকল শক্তি ও উপাদানের সমন্বয়ে তার ক্ষমতার ব্যাপকতা নির্ধারিত হয়েছে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ প্রতিনিধিসভা ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিনেটকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এর গঠন ও ক্ষমতার বিন্যাসের মধ্যে সেটিই লক্ষণীয় ।
খ. সিনেট একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। এটি কখনো ভেঙে যায় না। প্রতি ২ বছর পর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে শূন্য আসন পূর্ণ করা হয়। যে কোনো সদস্য প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। এই স্থায়িত্বের কারণেও সিনেট যথেষ্ট অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করতে পারে ।
গ. সিনেট সদস্যদের কার্যকাল ৬ বছর, কিন্তু প্রতিনিধি সভার সদস্যদের কার্যকাল মাত্র ২ বছর। সিনেট সদস্যদের দীর্ঘ কার্যকাল সিনেটের প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। সিনেট সদস্যগণ প্রতিনিধি সভার সদস্যদের তুলনায় অধিক সময় সরকারি নীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিজ কক্ষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।
ঘ. পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সিনেট সদস্যরা জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন বিধায় এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৯১৩ সালের পূর্বে সিনেট সদস্যগণ অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত হতেন বিধায় তাঁদের জনপ্রিয়তা ও নির্বাচকমণ্ডলীর অনুমোদনের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত। কিন্তু সংবিধানের ১৭তম সংশোধনের পর সিনেটরগণ সরাসরি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এ ব্যবস্থা সিনেট সদস্যদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিস্তারে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
ঙ. সিনেটের সদস্য সংখ্যা প্রতিনিধি সভার মোট সদস্য সংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও কম। সিনেটের সদস্য সংখ্যা কম হওয়ার কারণে সদস্যগণ যে কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া সিনেটে অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে সমতাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের কারণে সার্বভৌমত্বের প্রতিফলন ঘটে থাকে ।
চ. প্রতিনিধিসভার তুলনায় রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞতার ধারক ব্যক্তিগণই সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। দলের মধ্যে প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরকেই সিনেট নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন করা হয়ে থাকে। যে কারণে সিনেটকে প্রবীণদের কঙ্ক বলা হয়ে থাকে। সাধা ণভাবে প্রতিনিধি সভার সদস্য হিসেবে কয়েক বছর রাজনৈতিক শিক্ষানবিশির পরই সিনেট নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ সম্ভব হয়। সিনেট সদস্যদের দীর্ঘ কার্যকাল এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রতিনিধি সভার তুলনায় সিনেটের প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের বেশি আকর্ষণ করে। সিনেটের গৌরব বৃদ্ধির পক্ষে তা সহায়ক হয়েছে।
ছ. মার্কিন জনগণ সিনেটকে নিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক বলে মনে করে। রাষ্ট্রপতির দলীয় সিনেটরগণও রাষ্ট্রপতির অযৌক্তিক কাজে বাধাদানে দ্বিধাবোধ করে না। পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সিনেটেরও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা, সিনেট রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
জ. সিনেটের সদস্যদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের ক্ষমতা তাদের প্রভাব বিস্তারের অন্যতম ভিত্তি। সিনেটের মাধ্যমেই পৃষ্ঠপোষকতার ধারা অঙ্গরাজ্যের দলীয় সংগঠন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়।
ঝ. সিনেটের বিশেষ ক্ষমতাও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সাহায্য করেছে। সিনেট সদস্যদের কার্যকাল এবং আর্থিক ক্ষমতা, নিয়োগ ও বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত ক্ষমতা এবং সর্বোপরি ক্ষুদ্রায়তন তার ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগে সাহায্য করেছে।
ট. সিনেটের কার্যপরিচালনার পদ্ধতিও তার প্রভাবের সম্প্রসারণে সাহায্য করেছে। সিনেটের আলোচনা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই— সদস্যগণ দীর্ঘ সময় যাবত বক্তব্য পেশ করতে পারেন। কিন্তু প্রতিনিধি সভায় আলোচনা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। যে কারণে অনেক সময়ে কোনো বিষয়ে মতান্তর দেখা দিলে প্রতিনিধি সভা সিনেটের মতামত গ্রহণ করে। আবার দীর্ঘায়িত আলোচনার সুযোগ এবং কক্ষের মর্যাদা রক্ষার, ক্ষেত্রে সদস্যদের সচেতনতা সিনেটের মতামতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে।
ঠ. সিনেট সদস্যগণের মনোভাব এই কক্ষের প্রভাব বিস্তারে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে রাজনৈতিক মতামতের প্রভেদ সত্ত্বেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে মতৈক্য লক্ষ্য করা গেছে যে, তাঁরা সকলেই এ সিনেটের মর্যাদা ও ক্ষমতা রক্ষার ব্যাপারে এত সচেতন যে, তাঁদের পারস্পরিক বিরোধের ফলে এই কক্ষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হোক, এমন কোনো কার্যে তাঁরা লিপ্ত হন না। অনেকক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতির কথা বিবেচনা না করে একে অপরের প্রস্তাব সমর্থন করে নেয় ।
ড. প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে একই সময়ে মাত্র এক জন করে সিনেট সদস্য নির্বাচন হতে পারেন। কিন্তু একই সময়ে একই অঙ্গরাজ্য থেকে প্রতিনিধি সভার একাধিক সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ফলে জনসাধারণ সিনেটের একমাত্র সদস্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচিত করে থাকেন। যে কারণে সিনেট সদস্যগণ স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের নিকট অধিক শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন ।
ঢ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত ডাক্তার, আইনজীবী, অধ্যাপক প্রমুখ সিনেটের সদস্য হওয়াকে বিশেষ সম্মানের বিষয় বলে মনে করেন। ফলে সিনেট সদস্যদের মধ্যে যেরূপ বাগ্মী ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, প্রতিনিধি সভার সদস্যদের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে সিনেট সদস্যদের মধ্যে থেকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার ফলে সিনেটের মর্যাদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ত. অনেকের মতে, সিনেট সদস্যদের নিরপেক্ষতা তাঁদের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতির দলীয় সিনেট সদস্যগণও অনেক সময় রাষ্ট্রপতির অযৌক্তিক কাজের সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। বিশেষত রাষ্ট্রপতি যদি প্রচলিত ‘সিনেটারীয় সৌজন্যবোধ’ ভঙ্গ করে কোনো কাজ করেন তবে দলমত নির্বিশেষে সিনেট সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধাচরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এর ফলে সিনেট সদস্যগণ জনসাধারণের চোখে নিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন।
মার্কিন সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাই সিনেটের প্রভাব ও প্রাধান্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। মার্কিন সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্রে যারা অবস্থান করছে তাঁদের মধ্যে লক্ষ্যের বিষয়ে ব্যাপক মতৈক্য রয়েছে। তাঁরা এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে চান যেখান থেকে অতি সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঐ সিদ্ধান্তকে কার্যকর করা সম্ভব হয়। অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি ও সিনেটের ঐক্যের মাধ্যমে সেই ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
মার্কিন সিনেটের সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনা
Limitation of the Senate of USA
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় সিনেটের ব্যাপক ক্ষমতা ও প্রাধান্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও সিনেটের কিছু সীমাবদ্ধতা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়াতে সক্ষম হয় নি। মার্কিন সিনেটের যে সকল সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. সমপ্রতিনিধিত্বের ত্রুটি : মার্কিন সিনেটে অঙ্গরাজ্যসমূহের সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রবর্তিত হওয়ায় সিনেটে গ্রামীণ ও গোষ্ঠীগত প্রতিনিধিত্বের সংরক্ষণ সহায়ক হয়েছে। সিনেটে গ্রামকেন্দ্রিক রাজ্যসমূহের জনসংখ্যার তুলনায় তাদের প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা বেশি হয়েছে। দেশের মোট ভূখণ্ডের তুলনায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়তনের নগরায়িত অঞ্চলে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বাসস্থান হলেও সিনেটের তিন-চতুর্থাংশ সদস্য গ্রামাঞ্চল থেকেই নির্বাচিত হন। প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার এই ত্রুটির ফলে লাভবান হয়েছে কৃষি ও খনির সাথে জড়িত স্বার্থ। স্বল্প জনসংখ্যাবহুল গ্রামীণ এবং দরিদ্র অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ শহরকেন্দ্রিক এবং শিল্পোন্নত সম্পদশালী অঙ্গরাজ্যের তুলনায় বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার সিনেটের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রকে ব্যাহত করেছে বলে অনেকেই মনে করেন।
খ. পরিচালনাগত ত্রুটি : মার্কিন সিনেটের পরিচালনা পদ্ধতি দ্রুততার সঙ্গে কার্যাবলি সম্পাদনে সহায়তা করে না। যে কারণে সিনেটের কার্য পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করা হয়ে থাকে। সিনেটে আলোচনা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না বিধায় সিনেট সদস্যগণ যে কোনো ইস্যুতে দীর্ঘ সময়ব্যাপী বক্তৃতা করতে পারেন। ফলে সিনেট সদস্যগণ তাঁদের বক্তব্যকে অকারণে দীর্ঘায়িত করে কালক্ষেপণ করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। এ কারণে সিনেটের কার্য পরিচালনার গতি শিথিল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সংখ্যালঘু দল বা গোষ্ঠীর সদস্যগণ কোনো প্রস্তাব বা বিলের বিরোধিতা করার জন্য এ শপথ গ্রহণ করতে পারে। ফলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপোষক ও অভিপ্রেত আইন প্রণয়নের পথে বাধার সৃষ্টি হয়।
গ. গোষ্ঠী স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা : সিনেটে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ কেবল প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয় নি। তার কার্য পরিচালনার পদ্ধতিও ঐ স্বার্থকে শক্তিশালী করেছে। সিনেটের সৌজন্যবিধিকে কখনো গোষ্ঠীস্বার্থ ব্যাহত করার জন্য ব্যবহার করা হয় নি। সিনেটে বিতর্কের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুবিধা থাকায় কোনো বিশেষ অংশের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বা বিল প্রণয়নে অন্য গোষ্ঠী বাধা দিতে পারে। কখনো কখনো কংগ্রেসের এক অংশ কোনো বিলের বিষয়ে উৎসাহ প্রদর্শন করলে অন্য অংশ তার বিরোধিতার চেষ্টা করে।
ঘ. –নিগ্রোদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট নয় : সৌজন্যবিধির সহায়তায় সিনেট কখনো দক্ষিণের নিগ্রোদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেনি। উত্তরাংশের সদস্যগণ কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করলেও দক্ষিণের শ্বেতকায় সদস্যদের বাধাদানের ফলে তা কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। সিনেটের সদস্যগণ ‘সৌজন্যবিধি’র সাহায্যে ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অপদার্থ, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাকেই সমর্থন জানিয়েছেন ।
ঙ. নিগ্রোদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নেই : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের বিশেষত নিগ্রোদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে। জাতি-বৈরিতাই নিগ্রো সমাজের প্রতি শ্বেতকায়দের বিদ্বেষের মূল কারণ। মার্কিন গণতন্ত্রে সকলের সমতা ও সমমর্যাদার আদর্শ ঘোষিত হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি বর্তমানেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
চ. অনধিকার চর্চা : রাষ্ট্রপতির নিয়োগ ও চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে সিনেট কখনো কখনো অনধিকার চর্চা করে থাকে । যে কারণে রাষ্ট্রপতি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন না ।
ছ. পক্ষপাতিত্ব : সিনেটের বিশেষ তদন্ত কমিটি অনেক সময় পক্ষপাতিত্ব করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব পক্ষপাত নীতিতে আক্রান্ত হন ।
সিনেটের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তার প্রভাব হ্রাস বা ম্লান হয় নি। সংবিধান প্রণেতাগণ যে উদ্দেশ্যে সিনেট গঠন করেছিলেন সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতে, সিনেট সংবিধান প্রণেতাদের মূল লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হয়েছে— সে লক্ষ্য ছিল সরকারের মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, এমন একটা কর্তৃত্ব গড়ে তোলা যা একদিকে প্রতিনিধি সভার গণতান্ত্রিক হঠকারিতা (Democratic Recklessness) প্রতিরোধ ও সংযত করবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির রাজতান্ত্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে (Monarchical Ambition) নিয়ন্ত্রণ করবে।
মার্কিন সিনেট পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ
The Senate of USA is the Most Powerful Second chamber in the world
“সাধারণত আইনসভার নিম্নকক্ষেরপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে বিধায় এটিকে দ্বিতীয় কক্ষের চেয়ে শক্তিশালী করা হয়”- অস্কার এইচ. আর. বেলসের উপরোক্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আইন সভার নিম্নকক্ষের শ্রেষ্ঠত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে ( ১৭৮৭) বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নিয়েছেন। সেখানে আইন পরিষদের দ্বিতীয় কক্ষ অর্থাৎ সিনেটকে সাংবিধানিকভাবেই প্রতিনিধি পরিষদের চেয়ে শক্তিশালী করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সেখানে সিনেটকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের উচ্চ কক্ষের চেয়ে অনেক বেশি। তে ‘মার্কিন সিনেট পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ’ কিনা সেটা যাচাই করতে হলে সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও প্রাধিকারের ভিত্তিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উচ্চকক্ষের সাথে এর তুলনা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. আইন প্রণয়ন ক্ষমতার ক্ষেত্রে ক্ষমতা : আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ব্যাপক ক্ষ ভোগ করে থাকে। অর্থ বিল ব্যতীত যে কোনো বিল সিনেটে উত্থাপিত হতে পারে। অধিকন্তু প্রতিনিধি সভা থেকে অর্থ বিপ সিনেটে আসলে সিনেট অর্থবিলের শিরোনাম ব্যতীত বিলের যে কোনো অংশ পরিবর্তন সাধন করতে পারে। সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত অর্থবিলসহ কোনো বিলই আইনে পরিণত হয় না। কিন্তু ব্রিটেনে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভার তুলনায় নিম্নকক্ষ কমন্সসভা অধিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভা সাধারণত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সুইজারল্যান্ডেও কেন্দ্রীয় আইনসভার দুটি কক্ষই সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।
খ. আর্থিক ক্ষমতা বিবেচনায় : মার্কিন সংবিধানের ধারা ১ এর ৭ উপধারা অনুসারে যে কোনো অর্থ বিল প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপনের বিধান রয়েছে। কিন্তু মার্কিন সিনেট অন্য যে কোনো বিলের ন্যায় অর্থ বিলকেও সংশোধন করতে পারে। বস্তুতপক্ষে বিলটির শিরোনামটি বাদ দিয়ে অর্থ বিলের বিষয়বস্তুর আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে সিনেট কার্যত একটি নতুন অর্থ বিল উত্থাপনের সুযোগ পেয়ে যায়। তাছাড়া মার্কিন সিনেটের আয়-ব্যয়ের দাবি পরিবর্তনের ক্ষমতাও রয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনের লর্ডসভা প্রকৃতপক্ষে আর্থিক ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারে না । কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার আইনসভার উচ্চ কক্ষের অর্থ বিল সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা থাকলেও সেটি মার্কিন সিনেটের ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ।
গ. নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে : মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। যে কারণে তাঁরা অধিক মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ লর্ডসভার সদস্যগণ রাজা-রানী কর্তৃক মনোনীত হন। সেখানে আবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের নীতি কাজ করে। কানাডার সিনেট সদস্যগণ গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হন। অস্ট্রেলিয়ার সিনেটরগণও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। ফলে এসব দেশের উচ্চ কক্ষের মনোনীত সদস্যদের মর্যাদা মার্কিন উচ্চকক্ষ সিনেটের নির্বাচিত সদস্যদের তুলনায় অনেক কম।
ঘ. সন্ধি ও চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে : শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি যেসকল আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেগুলোও মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ। সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুমোদন করলেই কেবলমাত্র এসব সন্ধি-চুক্তি কার্যকর হতে পারে; অন্যথায় এসমস্ত সন্ধি ও চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। সিনেট ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্পাদিত সন্ধির চুক্তি বাতিল, আংশিক পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৯ সালে রাষ্ট্রপতি উইলসন কর্তৃক স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি সিনেটের অনুমোদন পায়নি বিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতিপুঞ্জে’ যোগদান করতে পারে নি। কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা সন্ধি ও চুক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেটের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে না। সন্ধি, চুক্তি প্রভৃতি অনুমোদনের ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেট এককভাবে যে ক্ষমতা ভোগ করে অনুরূপ ক্ষমতা এককভাবে অন্য কোনো দেশের আইনসভার উচ্চকক্ষ ভোগ করে না ।
৫. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা বিবেচনায় : সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাষ্ট্রদূত, পদস্থ সরকারি কর্মচারী, বাণিজ্যিক প্রতিনিধিসহ প্রায় কয়েক হাজার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী মনোয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি সাধারণত সিনেটের ‘সৌজন্যবিধি’ অনুযায়ী বিশিষ্ট ও নেতৃস্থানীয় সিনেটরদের সাথে পরামর্শক্রমে এ সমস্ত মনোনয়ন দিয়ে থাকেন । নচেৎ সিনেট রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সময় হতে সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবিত একাধিক মনোনয়নের ক্ষেত্রে সিনেট এরকম ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ঐসকল মনোনয়ন বাতিলও কথা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের আইনসভার উচ্চকক্ষ অনুরূপ ক্ষমতা ভোগ করে না ।
চ. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা বিবেচনায় : মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে । এক্ষেত্রে সিনেট রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা ‘ইম্পিচমেন্ট’ আনতে না পারলেও ইম্পিচমেন্টের বিচার করতে পারে। প্রতিনিধি সভা ইম্পিচমেন্টের যে অভিযোগ আনে সিনেট তা বিচার বিবেচনা করার পর দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব পাস করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে হয়। রাষ্ট্রপতি জনসন, উইলিয়াম ব্ল্যান্ট, নিক্সন, বিল ক্লিনটন সিনেট কর্তৃক অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অপরদিকে, ব্রিটিশ লর্ডসভার বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকলেও মার্কিন সিনেটের ন্যায় এত ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী নয়। ভারত, কানাডা, সুইজারল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়া কোনো দেশের দ্বিতীয় কক্ষই মার্কিন সিনেটের ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে না। সেদিক থেকে বিচার করলেও মার্কিন সিনেট বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ।
ছ. সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে : মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ক্ষমতাও ভোগ করে । সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত সংবিধান সংশোধন কার্যকর হয় না। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব যখন কংগ্রেসে পেশ হয় তখন সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি আবশ্যক হয়। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে বিশ্বের যে কোনো দ্বিতীয় কক্ষের তুলনায় মার্কিন কংগ্রেস অধিক ক্ষমতাশালী ।
জ. নির্বাচনমূলক ক্ষমতা বিবেচনায় : অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে হলেও মার্কিন সিনেটের নির্বাচনমূলক ক্ষমতা রয়েছে । উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে কোনো প্রার্থী প্রয়োজনীয় সংখ্যক Electoral Vote না পেলে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত দুজনের মধ্যে থেকে সিনেট একজনকে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করতে পারেন। এভাবে ১৮০১ সালে রিচার্ড জনসনকে সিনেট কর্তৃক ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের উচ্চকক্ষ এককভাবে সাধারণত এ কাজটি করে না ।
ঝ. মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে : সিনেট সদস্যগণ নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদের চেয়ে বেশি যত্নবান। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রাটদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও সমান মর্যাদা ও ক্ষমতা চর্চার বিষয়ে সচেতন। অনেক সময় দলীয় স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ রেখে যে কোনো প্রস্তাব সকল সদস্য গ্রহণ করেন। পর বিশ্বের অন্য কোনো দেশের দ্বিতীয় কক্ষে এরূপ সমঝোতার মনোভাব বিরল ।
সুতরাং সামগ্রিকভাবে অন্যান্য দেশের উচ্চ কক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলির সাথে সিনেটের কার্যাবলির তুলনামূলক আলোচনার প্রেক্ষিতে সিনেট যে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ এ বক্তব্যের সত্যতা যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধানই মার্কিন সিনেটকে মর্যাদার আসন দান করেছে। Lindsay Roger-এর মতে, মার্কিন সিনেট
আধুনিক রাজনীতির স্মরণীয় আবিষ্কার। বিশিষ্ট ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Alex De Toquville মার্কিন কংগ্রেস পরিদর্শন করে বলেন, “ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি পরিষদে প্রবেশ করে যে কেউ এই বিরাট পরিষদের অশোভন আচরণে মর্মাহত হতে পারেন। এন কিন্তু সিনেটের সুললিত বক্তব্য, মর্যাদাসম্পন্ন পরিচালক, জ্ঞানী শাসনকর্তা ও বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কগণ নিয়ে গঠিত ও তাঁদের আলাপ-আলোচনা ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারী বক্তব্যকেও হার মানিয়ে দেয়।” সি. এফ. স্ট্রং (C. F. Strong ) এর মতে, “” The
of the Senate are very great. Probably no second chamber in the world today has an influence so real and direct.” ফলে সঙ্গত কারণেই বলা যায় মার্কিন সিনেট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দ্বিতীয় কক্ষ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং ব্রিটেনের লর্ডসভার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা
Comparative study of the American Senate and the British House of Lords
বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং একদা সমগ্র বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ বিস্তারকারী ব্রিটেন উভয়েই সমসাময়িককালের দু’টি বৃহৎ শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জননির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। উভয় দেশের আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। ব্রিটেনের আইনসভা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা আর নিম্নকক্ষ কমন্সসভা। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনির্বাচিত উচ্চকক্ষ লর্ডসভার গুরুত্ব অত্যন্ত কম হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জননির্বাচিত উচ্চকক্ষ সিনেট পৃথিবীর যে কোনো দেশের উচ্চ কক্ষের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী। আপীল বিচারের ক্ষমতা ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রেই লর্ডসভার তুলনায় সিনেট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।
গ্রেট ব্রিটেনের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা হলো বিশ্বের বৃহত্তম দ্বিতীয় কক্ষ। এর সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। ১৯৭৪ সালের তথ্য অনুসারে লর্ডসভার সর্বমোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ১১০০। আজ পর্যন্ত কখনই এই সভার কোনো সদস্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হননি। মূলত উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডসভার সদস্যরা সদস্যপদ পেয়ে থাকেন। তবে তাঁর বয়স অন্তত ২১ বছর হতে হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা রাজানুগ্রহে লর্ডসভার সদস্যপদ প্রাপ্ত লর্ডগণকে ৫টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় । যথা- ১. ডিউক (Duke); ২. মার্কোয়েস (Marquess); ৩. আর্ল (Earl); ৪. ভাইকাউন্ট (Viscount) এবং ৫. ব্যারন (Baron)। রাজা বা রানী লর্ডসভার অধিবেশন আহ্বান ও সমাপ্তি ঘোষণা করেন। মাত্র ০৩ জন সদস্য উপস্থিত থাকলেই লর্ডসভার কোরাম হয়। কিন্তু কোনো বিল পাসের জন্য ৩০ জন সদস্যের উপস্থিতি আবশ্যক। সাধারণত সোম থেকে বৃহস্পতি সপ্তাহে এই চারদিন লর্ডসভার অধিবেশন বসে। লর্ডসভায় সভাপতিত্ব করেন লর্ড চ্যান্সেলর। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী একজন কেবিনেট মন্ত্রীকে এই পদে নিয়োগ দেন ।
সাদৃশ্যসমূহ Similarities
ক. মার্কিন সিনেট এবং ব্রিটিশ লর্ডসভা উভয়েই স্থায়ীসভা। ফলে সিনেট এবং লর্ডসভা কখনো ভেঙে যায় না।
খ. মার্কিন সিনেট এবং ব্রিটিশ লর্ডসভার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক জন করে সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। সিনেটে পদাধিকার বলে উপ-রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন। লর্ডসভার সভাপতিকে বলা হয় লর্ড চ্যান্সেলর। ব্রিটিশ কেবিনেটের এক জন সদস্যকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী লর্ড চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।
গ. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিসভাকে নিজস্ব দায়দায়িত্বের জন্য সিনেট কিংবা প্রতিনিধি পরিষদ কোনো কক্ষেই জবাবদিহিতা করতে হয় না। অপরদিকে, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ব্রিটিশ কেবিনেটকে দায়দায়িত্বের জন্য নিম্নকক্ষ কমন্সসভায় জবাবদিহি করতে হলেও উচ্চকক্ষ লর্ডসভার নিকট জবাবদিহি করতে হয় না।
ঘ. কমন্ত্রসভা এবং লর্ডসভা উভয়েই নিম্নকক্ষ কর্তৃক আনীত ইম্পিচমেন্ট বিচার করে থাকে ।
বৈসাদৃশ্যসমূহ Dissimilarities
সার্বিক বিচারে মার্কিন সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভার মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের পাশাপাশি ব্যাপক বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। যার ভিত্তিতে উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। বৃটেনের লর্ডসভা এবং মার্কিন সিনেটের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উদ্ভবগত পার্থক্য : ব্রিটেনের লর্ডসভার উদ্ভব কোনো প্রকার শাসনতান্ত্রিক আইনের আওতায় হয়নি। বৃটেনে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য এবং অনেকাংশে বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে বিবর্তনের ফলস্বরূপ লর্ডসভার উদ্ভব এবং একই সাথে এর ক্ষমতা ও মর্যাদার বিকাশ ঘটেছে। অতীতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ছিল এক কক্ষ বিশিষ্ট। নরম্যান রাজাদের শাসনামলে ব্যারন, যাজক ও সাধারণ সম্প্রদায়ের লোকদের সমন্বয়ে পার্লামেন্ট গঠন করা হতো। এর অনেক পর পার্লামেন্ট দুটো কক্ষে বিভক্ত হয়ে যায় এবং আরও পরে অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা নামে খ্যাত হয়।
বিপরীতে মার্কিন সিনেটের উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমে না হয়ে বরং মার্কিন সংবিধানের সুনির্দিষ্ট বিধি মোতাবেক গঠিত হয়েছে এবং এই সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি প্রসঙ্গেও মার্কিন সংবিধানে বিস্তারিত উল্লেখ আছে ৷
২. গঠনগত পার্থক্য : গঠনগত দিক থেকে মার্কিন সিনেট ও ব্রিটিশ লর্ডসভার মধ্যে যেসকল ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
ক. আয়তনের ক্ষেত্রে পার্থক্য : বৃটিশ লর্ডসভা সাধারণত মার্কিন সিনেটের তুলনায় বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে নির্বাচন অনুযায়ী লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০ জন। যদিও ১৯৯৯ সালে এক আইনের মাধ্যমে লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা ৬৬৯ জন স্থির করা হয় ।
অপরদিকে মার্কিন সিনেটের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১০০ জন। আকার ও আয়তন নির্বিশেষে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে দু’জন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে মার্কিন সিনেট গঠিত হয়। আয়তনে অনেক ছোট বিধায় মার্কিন সিনেট অনেক সক্ৰিয় ।
খ. নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্থক্য : গণতান্ত্রিক বিচারে ব্রিটেনের লর্ডসভা একটি অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কেননা, বৃটিশ লর্ডসভা উত্তরাধিকার সূত্রে বা মনোনয়নের মাধ্যমে গঠিত হয়। লর্ডসভার অধিকাংশ সদস্যই জন্মসূত্রে এবং বংশ পরিচিত্তির মাধ্যমে পদাধিকার অর্জন করে থাকেন, আবার কিছু কিছু যাজক আছেন যারা রাজা বা রানী কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন ৷
অপরদিকে, মার্কিন সিনেটের গঠনব্যবস্থা পুরোপুরি গণতান্ত্রিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে মার্কিন সিনেট গঠিত হয়। যদিও ১৯১৩ সালের পূর্বে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে সিনেট গঠিত হতো, কিন্তু ১৯১৩ সালের পর থেকে প্রত্যক্ষভাবে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মার্কিন সিনেট গঠিত হয়।
গ. ধর্মীয় উপাদান : ব্রিটেনের লর্ডসভা গঠনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপাদান বর্তমান। পক্ষান্তরে, মার্কিন সিনেট নির্বাচনে ধর্মের কোনো স্থান নেই বা ধর্মের ভিত্তিতে সিনেটের সদস্য নির্বাচন করা হয় না। এখানে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনাই প্ৰাধান্য পেয়ে থাকে ।
৩. মেয়াদ এর ক্ষেত্রে পার্থক্য : ব্রিটেনের লর্ডসভা একটি স্থায়ী সভা এবং লর্ডগণ সাধারণত আজীবনের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অপরদিকে, সিনেট স্থায়ী সভা হলেও সিনেট সদস্যদের কার্যকাল হলো ৬ বছর। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। মৃত্যু বা পদত্যাগ ব্যতীত সিনেটরদের কার্যকাল সুনির্দিষ্ট। তবে পুনর্নির্বাচনের সুযোগ থাকায় কোনো কোনো সিনেটর ২৪ থেকে ৩০ বছর অবধি সিনেটের সদস্য থাকেন।
৪. স্পিকার নির্বাচনের পার্থক্য : প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী ব্রিটিশ কেবিনেটের একজন সদস্য রাজা বা রানী কর্তৃক লর্ড চ্যান্সেলর হিসেবে মনোনীত হয়ে স্পিকারের ভূমিকা পালন করেন। অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপ-রাষ্ট্রপতি সিনেটে সভাপতিত্ব করে থাকেন এবং স্পিকারের ভূমিকা পালন করেন ।
৫. স্পিকারের ভূমিকাগত পার্থক্য : সিনেটের সভাপতি হিসেবে উপ-রাষ্ট্রপতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী । নৌবিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশ সিনেট সদস্যকে বোর্ড অব ভিজিটার্সে মনোনীত করা, জাতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থার সদস্যপদ প্রদান করার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর হাতে ন্যস্ত। অন্যদিকে, লর্ড চ্যান্সেলরের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। লর্ডসভায় সভাপতিত্ব করা এবং প্রস্তাবসমূহকে ভোট গ্রহণের জন্য সভার নিকট উপস্থাপন করা ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষমতা লর্ড চ্যান্সেলরের নেই । এমনকি সভার নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তিনি কোনো সদস্যকে শাস্তি দিতে পারেন না ।
৬. কার্য পরিচালনা পদ্ধতির পার্থক্য : মার্কিন সিনেটের কার্য পরিচালনার দায়িত্ব সভার সভাপতি হিসেবে উপ-রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত রয়েছে। কোনো প্রস্তাব বা বিলের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট প্রদত্ত হলে তিনি অচলাবস্থা দূর করতে একটি ‘নির্ণায়ক ভোট’ (Casting Vote) প্রদান করতে পারেন। তবে তিনি কোনো আলোচনায় কিংবা সাধারণত কোনো ভোটে অংশগ্রহণ করেন না। বিপরীতে, লর্ড চ্যান্সেলর লর্ডসভার কার্য পরিচালনা করেন। তিনি নিরপেক্ষভাবে সভার কার্য পরিচালনা করেন না। তিনি আলোচনা ও ভোটে অংশগ্রহণ করেন। তবে মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতির ন্যায় তাঁর নির্ণায়ক ভোট’ (Casting Vote) প্রদানের অধিকার নেই ।
৭. আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্থক্য : মার্কিন সিনেট আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন কংগ্রেসের যে কোনো কক্ষে সাধারণ বিল উত্থাপন করা গেলেও উভয় কক্ষের সম্মতি ব্যতীত কোনো বিল পাস করা সম্ভব হয় না। অধিকন্তু মার্কিন সিনেট অন্যান্য বিলের মতো অর্থ বিলকেও সংশোধন করতে পারে ।
অপরদিকে, বৃটিশ লর্ডসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে সংকুচিত করা হয়েছে। লর্ডসভা কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত সাধারণ বিলকে এক বছর এবং অর্থ বিলকে এক মাসের জন্য বিলম্বিত করতে পারে মাত্র। লর্ডসভা এক মাসের মধ্যে অর্থ বিলে সম্মতি না দিলে তার সম্মতি ব্যতীতই অর্থ বিলটি রাজা বা রানীর আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
৮. আর্থিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে পার্থক্য : যদিও সংবিধান অনুসারে অর্থ বিল ও বার্ষিক বাজেট মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপন করতে হয়। তথাপি, প্রতিনিধি পরিষদে অর্থ বিল ও বাজেট অনুমোদিত হওয়ার পরও সিনেট তা সংশোধন করতে পারে। এই সংশোধন ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন সিনেট অর্থ বিলের শুধু শিরোনামটি বাদ দিয়ে অন্য সকল অংশ সংশোধনের মাধ্যমে কার্যত একটি নতুন বিল সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন সিনেটের হাতে আয়-ব্যয়ের দাবি পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে।
অপরদিকে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে বৃটেনে একমাত্র কমন্সসভায় অর্থ বিল ও বাজেট উত্থাপন করতে হয়। কিন্তু কমন্সসভায় অনুমোদিত কোনো অর্থ বিল বা বাজেটকে লর্ডসভা সংশোধন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। লর্ডসভা সুপারিশ করতে পারে মাত্র। লর্ডসভার সুপারিশ গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান কমন্সসভার বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। লর্ডসভা কোনো অর্থ বিলকে এক মাসের বেশি বিবেচনার জন্য সংরক্ষণ করতে পারে না। লর্ডসভা যদি এক মাসের মধ্যে নিজ মতামত কমন্সসভাকে না জানায় তবে ধরে নেয়া হবে যে উক্ত অর্থ বিল লর্ডসভা গ্রহণ করেছে।
৯.. আইন ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে : সংবিধান ও আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সিনেট ও লর্ডসভার ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ব্রিটেনে সাধারণ আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত পদ্ধতির মধ্যে কোনো পার্থক্য না থাকার জন্য লর্ডসভাকে চূড়ান্তভাবে কমন্সসভার প্রাধান্য স্বীকার করতে হয়। মার্কিন সিনেট সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রস্তাব সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন ব্যতীত উত্থাপন করা যায় না। কিন্তু ব্রিটেনের লর্ডসভার এমন কোনো ক্ষমতা নেই ।
১৫. মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে : মার্কিন রাষ্ট্রপতির কেবিনেটের সদস্যগণ কংগ্রেসের কোনো কক্ষের সদস্য নন। কংগ্রেসের কোনো আলোচনা বা বিতর্কে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেন না। প্রতিনিধি সভা কিংবা সিনেট কোনো কক্ষের কাছে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। সিনেট মার্কিন কেবিনেটের সদস্যদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ কিংবা অপসারণও করতে পারেন না।
বৃটেনে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা বা সরকার গঠিত হয়। মন্ত্রীগণ নিজ নিজ বিভাগীয় কাজকর্মের জন্য পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্সসভার নিকট জবাবদিহি করলেও তাদেরকে উচ্চকক্ষ লর্ডসভার নিকট জবাবদিহি করতে হয় না ৷
১১. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে : মার্কিন সিনেটের ব্যাপক নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে। কেননা, সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রভৃতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করতে পারেন না ।
অপরদিকে বৃটেনের লর্ডসভার অনুরূপ কোনো নিয়ে সংক্রান্ত ক্ষমতা নেই। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও লর্ডসভার নেই ।
১২. অপসারণ সংক্রান্ত ক্ষমতা : বৃটেনের লর্ডসভা এবং মার্কিন সিনেটের অপসারণ সম্পর্কিত ক্ষমতার মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, বিচারপতি এবং অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তাদের অপসারণ সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রথমে প্রতিনিধি সভায় উত্থাপন পরবর্তীতে অনুমোদিত হলেও সিনেট অভিযোগ সম্পর্কিত প্রস্তাব বিচার এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত · গ্রহণ করে।
অপরদিকে, বৃটেনে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে কমন্সসভায় অভিযোগ সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য লর্ডসভায় প্রেরণ করা হয়। তবে লর্ডসভা অনুমোদন না করলেও বিচারপতিদের পদচ্যুতি সংক্রান্ত সেই প্রস্ত বি কমন্সসভা রাজা বা রানীর নিকট পাঠিয়ে দিতে পারে।
১৩. সন্ধি-চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে : মার্কিন সিনেট পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি যেসকল কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক দূত নিয়োগ করেন তাদের নিয়োগ যেমন সিনেট অনুমোদন করেন, তেমনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যেসকল সন্ধি ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন সিনেটের উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি ব্যতীত তা কার্যকর করা যায় না। তাছাড়া সিনেট যে কোনো চুক্তিকে বাতিলও করে দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি উইলসন ভার্সাই সন্ধি এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলে সিনেট তা অনুমোদন করে নি। যে কারণে মার্কিন সিনেট চুক্তির সমাধিস্থল হিসেবে পরিচিত।
অপরদিকে, বৃটেনের লর্ডসভার হাতে অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পদিত সন্ধি ও চুক্তি অনুমোদনের কোনো ক্ষমতা রাখা হয়নি।
১৪. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে : ব্রিটিশ লর্ডসভা দেশের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি কমন্সসভা কর্তৃক আনীত সকল ইম্পিচমেন্ট বিচার লর্ডসভাই করে থাকে। মার্কিন সিনেটও রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিনিধি সভা কর্তৃক আনীত ইম্পিচমেন্টের বিচার করে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এবং সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য দ্বারা সমর্থিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর পদ থেকে অপসারিত হন। তবে মার্কিন সিনেট দেশের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে কাজ করে না। সুতরাং, কেবলমাত্র আপীল বিচারের ক্ষমতা বাদ দিলে অন্য সকল ক্ষেত্রে লর্ডসভা অপেক্ষা সিনেট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।
১৫. নির্বাচন সংক্রান্ত : মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেলে সিনেট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বিবেচনা করে প্রথম দুই জন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে গোপন ভোটে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। কিন্তু বৃটেনের লর্ডসভার এ ধরনের কোনো নির্বাচনমূলক ক্ষমতা বা দায়িত্ব নেই।
১৬. দল প্রথার পার্থক্যের ক্ষেত্রে : সিনেট সদস্যগণ রাজনৈতিক দলের সদস্য। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে নির্বাচন করে তাঁরা সিনেটের সদস্য হন। অপরদিকে, লর্ডসভার সদস্যগণ দলীয় কাঠামোর ভিত্তিতে কাজ করেন না, বরং তাঁরা কিছুটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন ।
১৭. প্রতিষ্ঠানগত পার্থক্য : মার্কিন সিনেট একটি বাস্তব প্রতিষ্ঠান; এটি যথেষ্ট কর্মতৎপর, কার্যকর এবং প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে, ব্রিটেনের লর্ডসভা মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। দেশের সাংবিধানিক অগ্রগতি এবং ইতিহাসের সাথে এটি বিশেষভাবে জড়িত ।
১৮. অধিবেশন আহ্বানের ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের কমন্সসভা এবং লর্ডসভার অধিবেশন একই সময় শুরু হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষের অধিবেশন একই সময়ে আহ্বান করা হয় না। সিনেটের অধিবেশন শুরু হলেও প্রতিনিধি সভার অধিবেশন শুরু নাও হতে পারে ।
উপরোক্ত তুলনামূলক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন সিনেটের ক্ষমতা ও প্রভাব ব্রিটিশ লর্ডসভার তুলনায় অনেক বেশি। সিনেটের ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হলেও লর্ডসভার প্রভাব দ্রুত অপসৃয়মান। গ্রেট ব্রিটেনে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থের প্রতিভূ লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাস অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। অপরদিকে, উদারপন্থী গণতন্ত্র এবং মার্কিন রাজনীতির অন্যতম ঝটিকাকেন্দ্র হিসেবে সিনেট পুঁজিপতি অর্থনৈতিক-সামাজিক বিন্যাসের রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন সিনেট এবং প্রতিনিধিসভার মধ্যে তুলনা/মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষের মধ্যে সম্পর্ক
Comparison between the Senate and the House of Representative/ Relation between the two Houses of the Congress
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভা। মার্কিন সংবিধান রচয়িতাগণ সিনেট এবং প্রতিনিধিসভার ক্ষমতা, গঠন ও পদমর্যাদার ক্ষেত্রে সমজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন নি। এর মূলে রয়েছে তৎকালীন ঐতিহাসিক পটভূমি এবং তার দ্বারা প্রভাবিত সংবিধান প্রণেতাগণের দৃষ্টিভঙ্গি। নিম্নে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা বা সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হলো :
ক. আয়তন : প্রথমে কংগ্রেসের প্রতিনিধিসভার ও উচ্চ সিনেটের সদস্য সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৫ ও ২৬ জন। বর্তমানে প্রতিনিধিসভার সদস্য সংখ্যা ৪৩৫ এবং সিনেটের সদস্য সংখ্যা ১০০। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিনিধিসভার তুলনায় সিনেটের আয়তন অনেক ছোট।
খ. নির্বাচন প্রক্রিয়া : প্রতিনিধিসভার সদস্যগণ অঙ্গরাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত হন। জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা স্থির হয়। সিনেট সদস্যগণও প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। যদিও ১৯১৩ সালের পূর্বে সিনেট সদস্যগণ প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। কিন্তু ১৯১৩ সালে সংবিধানের ১৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সিনেট সদস্য নির্বাচনের বিধান করা হয়। সমপ্রতিনিধিত্বের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য’ থেকে দু’জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। অঙ্গরাজ্যের আয়তন, লোকসংখ্যা, অগ্রগতি বা সম্পদ সমগ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে তারতম্য সৃষ্টি করে না ।
গ. সদস্যদের কার্যকাল : প্রতিনিধিসভার সদস্যদের কার্যকাল ২ বছর। সদস্যগণ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। সিনেট সদস্যদের কার্যকাল ৬ বছর। প্রতি দুই বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং ঐ শূন্য আসন পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, সিনেট সদস্যদের কার্যকাল একই সাথে শেষ না হওয়ার জন্য এ কক্ষ একটি “আধা স্থায়ী” (Semi Permanent) কক্ষে পরিণত হয়েছে
ঘ. সদস্যদের যোগ্যতা : প্রতিনিধিসভায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়সসীমা হলো ২৫ বছর এবং প্রার্থীকে কমপক্ষে ৭ বছর পর্যন্ত মার্কিন নাগরিকতার অধিকারী হতে হয়। কিন্তু সিনেট সদস্যদের বয়স ও নাগরিকতার সীমা যথাক্রমে ৩৫ ও ৯ বছর স্থির করা হয়েছে। সিনেট সদস্যদের বয়সসীমা বৃদ্ধির দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, মার্কিন সংবিধানে প্রণেতাগণ সিনেটকে ‘প্রবীণদের কক্ষে’ (House of the elders) পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
ঙ. কার্য পরিচালনার পদ্ধতি : প্রতিনিধিসভার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত স্পিকার বা অধ্যক্ষের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, যিনি প্রতিনিধিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার পরিবর্তে তিনি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার দ্বারা পরিচালিত হন। তিনি সভার আলোচনা ও ভোটে অংশগ্রহণ করেন ।
অপরদিকে, মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে সিনেটের সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন না। কোনো প্রস্তাব বা বিলের পক্ষে-বিপক্ষে সমান ভোট পড়লে তিনি নির্ণায়ক ভোট দিতে পারেন। কিন্তু কক্ষের কার্য পরিচালনার সাথে কমিটি ব্যবস্থা বিশেষভাবে জড়িত ।
চ. গঠনগত পার্থক্যের কারণ : প্রতিনিধিসভা ও সিনেটের গঠনগত যে তারতম্য বিদ্যমান তা সংবিধান প্রণেতাগণ স্বেচ্ছায় সংযোজন করেছেন। তাদের ধারণা ছিল যে, সিনেট আংশিকভাবে শাসন বিভাগের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করবে। তাঁরা ধারণা করেছিলেন, সিনেট স্বল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট অঙ্গরাজ্যসমূহের স্বাধিকারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। তাঁরা তাও মনে করতেন যে, সিনেট প্রতিনিধিসভার উপর নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে ।
ছ. রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির নির্বাচন : রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যথাক্রমে প্রতিনিধিসভা ও সিনেটকে বিশেষ পেলে ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রার্থী নির্বাচকমণ্ডলীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না প্রতিনিধিসভা সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত তিন জন প্রার্থীর মধ্যে থেকে এক জনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৮০১ ও ১৮২৫ সালে প্রতিনিধিসভা এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। আবার উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রার্থী নির্বাচকমণ্ডলীর নিরঙ্কুশ অংশের সমর্থন না পেলে সিনেট সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত দুই জন প্রার্থীর মধ্যে থেকে এক জনকে উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৮৩৭ সালে সিনেটকে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়েছিল।
জ. বিল সম্পর্কিত ক্ষমতা : সাধারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিসভা ও সিনেটের ক্ষমতা সমান। উভয় কক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোনো বিল কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে না। অর্থ ও রাজস্ব সম্পর্কিত বিষয়ে প্রতিনিধিসভাকে বিল উত্থাপনের প্রাথমিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিল প্রথমে প্রতিনিধিসভায় উত্থাপিত হবে। প্রতিনিধিসভায় উত্থাপনের পর ঐ বিল অনুমোদনের জন্য সিনেটের নিকট পাঠানো হবে। সিনেট রাজস্ব ও অর্থ বিলের শিরোনাম ব্যতীত অন্য সকল অংশ পরিবর্তন করতে পারে। ফলে বলা যায় যে, আর্থিক ক্ষেত্রে সিনেটের নিকট প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের দ্বিতীয় কক্ষের নিকট এধরনের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় নি।
ঝ. সংবিধান সংশোধন বিষয়ক ক্ষমতা : সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সিনেট ও প্রতিনিধি সভার ক্ষমতা সমান। উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদনে কংগ্রেস সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রস্তাব পেশ করতে পারে। কোন পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে সে বিষয়ে উভয় কক্ষকে সমান ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে।
ঞ. ইম্পিচমেন্ট সম্পর্কিত ক্ষমতা : প্রতিনিধিসভার হাতে রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ইম্পিচমেন্টের জন্য প্রস্তাব উত্থাপনের একক ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিনিধিসভা কর্তৃক প্রস্তাব অনুমোদনের পরই সিনেট অভিযোগের বিচার এবং সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পদাধিকারী সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ট. নিয়োগ সংক্রান্ত : নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সিনেটের ক্ষমতা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতির নিকট অর্পণ করলেও সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতির এসমস্ত নিয়োগ কার্যকর হয় না। প্রতিনিধিসভার হাতে নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো ক্ষমতা অর্পণ করা হয় নি ।
I
ঠ. সন্ধি ও চুক্তি : বহির্বিশ্বের সাথে যে কোনো ব্যাপারে সন্ধি ও চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকলেও সিনেটের উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি ব্যতীত রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত কোনো সন্ধি ও চুক্তি কার্যকর হয় না। প্রতিনিধিসভা কোনো সন্ধি ও চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে পারলেও এসকল সন্ধি ও চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
ড. পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয় : পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়ে প্রতিনিধিসভার তুলনায় সিনেটের ক্ষমতা অনেক বেশি। সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত কমিটি পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রাধান্য লাভে সক্ষম হয়েছে। প্রতিনিধিসভার পক্ষে এ ধরনের প্রাধান্য অর্জন করা সম্ভব হয় নি।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, প্রতিনিধিসভার তুলনায় সিনেট অধিকতর শক্তিশালী। প্রতিনিধিসভার সদস্য পদের চেয়ে সিনেটের সদস্য পদ রাজনৈতিক নেতাদের নিকট অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দীর্ঘদিন প্রতিনিধিসভার সদস্যরূপে যোগ্যতা প্রমাণের পরই সিনেটে মনোনয়ন দেয়া হয়। এভাবে বিখ্যাত ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদগণ নির্বাচিত হবার ফলে সিনেটের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিধিসভার সদস্যগণ কোনো বিষয়ে অনির্দিষ্টকাল আলোচনা করতে পারে না। কিন্তু সিনেটের কোনো সদস্য কোনো বিষয়ে আলোচনা শুরু করলে অনির্দিষ্টকাল ধরে সে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। দুটি কক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টিতে প্রতিনিধিসভা সিনেটের মতামতকেই গ্রহণ করে ।
মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
Powers and Functions of the Congress of USA
যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা হিসেবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভা এবং উচ্চকক্ষ সিনেটের সমন্বয়ে গঠিত। সংবিধান মতে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কংগ্রেসের উপর ন্যস্ত হলেও আইন প্রণয়নই কংগ্রেসের একমাত্র কাজ নয়। মার্কিন সংবিধান রচয়িতাগণ ‘পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’ অনুসারে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতার বাইরেও কংগ্রেসের উপর কতগুলো ক্ষমতা ন্যস্ত করেছেন। মার্কিন সংবিধান প্রণয়নকালে সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদে কংগ্রেসকে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ২৭টি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৬তম সংশোধনীতে কংগ্রেসকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কর আরোপের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ১৩, ১৪, ১৫, ১৯, ২৪ এবং ২৬তম সংশোধনীতে কংগ্রেসকে অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রেও কার্যকরী ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত ক্ষমতা ছাড়াও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সুপ্রিমকোর্টের রায়ের মাধ্যমেও কংগ্রেস বিভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতাসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
ক. আইন প্রণয়ন ক্ষমতা; ও খ. অন্যান্য ক্ষমতা।
ক. আইন প্রণয়ন ক্ষমতা (Law Making powers) : আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মার্কিন সংবিধান সুনির্দিষ্টভাবে কংগ্রেসের উপর ক্ষমতা অর্পণ করেছে। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষ, অর্থাৎ প্রতিনিধি সভা ও সিনেটের সম্মতি ব্যতীত কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। কোনো বিলের ব্যাপারে কংগ্রেসের দুটি কক্ষের মধ্যে যদি বিরোধ দেখা দেয় তবে উভয় কক্ষের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ‘কনফারেন্স কমিটি’ (Conference Committee) -তে তার নিষ্পত্তি হয়। মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা নিম্নরূপ :
১. সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধান কংগ্রেসকে দু’ধরনের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে। এগুলো হলো— হস্তান্তরিত ক্ষমতা এবং যুগ্ম ক্ষমতা। নিম্নে উভয় প্রকার ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
- হস্তান্তরিত ক্ষমতা (Deligated Powers) : যে সকল ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে কংগ্রেসের নিকট অর্পণ করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হস্তান্তরিত ক্ষমতা হিসেবে পরিচিত। এসকল ক্ষমতা এককভাবে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত।
- যুগ্ম ক্ষমতা (Concurrent Powers ) : যুগ্ম ক্ষমতা বলতে এমন সকল ক্ষমতাকে বুঝায় যেগুলো কেন্দ্রিয় আইনসভা কংগ্রেসের উপর ন্যস্ত করা হলেও অঙ্গরাজ্যের আইনসভাও এসব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে সংবিধান অনুযায়ী মার্কিন কংগ্রেসের অনুমতি ব্যতীত অঙ্গরাজ্যের পক্ষে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যুগ্ম ক্ষমতা অনুসারে যেসকল বিষয়ে কেন্দ্রিয় আইনসভা বা মার্কিন কংগ্রেস আইন প্রণয়ন করতে পারে সে সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যের আইনসভাও আইন প্রণয়ন করতে পারে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে কংগ্রেস নিজস্ব ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য রাজ্য আইনসভাকে অনুমতি দিতে পারে।
এখানে উল্লেখ্য যে, আন্তঃরাষ্ট্র বাণিজ্য এবং নাগরিকাধিকার সম্পর্কিত কোনো কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যকে দেয়া হয়েছে। তেমনি আবার ঋণ ও করব্যবস্থা সম্পর্কিত ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যের হাতে ন্যস্ত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো যুগ্ম ক্ষমতার ন্যায় ব্যবহৃত হয়। কর বিষয়ক অঙ্গরাজ্যের কোনো আইন কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যপরিচালনার বিরোধী হলে সে আইনের বৈধতা লোপ পায় ৷
২. শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেস শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও বিচার বিভাগীয় রায়ের মাধ্যমেও অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। এ সম্পর্কিত ক্ষমতা দু’প্রকার। যথা- অনুমিত ক্ষমতা ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ।
- অনুমিত ক্ষমতা (Implied Powers ) : বিশেষ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োজন তাকে অনুমিত ক্ষমতা বলে। অনুমিত ক্ষমতা দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। ম্যাককুলাম বনাম মেরিল্যাণ্ড মামলার রায় প্রদানকালে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি মার্শাল (Marshal) ও তাঁর সহযোগীগণ এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কংগ্রেস অনুমিত ক্ষমতা বলে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে পারে। কংগ্রেসকে যে সকল বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকতে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য সকল বিষয়ে কংগ্রেস আইন প্রণয়ন করতে পারে । কংগ্রেস এভাবে অনুমিত ক্ষমতাবলে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে ।
- অন্তর্নিহিত ক্ষমতা (Inherent Powers) : বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য যেসব ক্ষমতা বিশেষভাবে প্রয়োজন তাকেই সাধারণভাবে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে। যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন, কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণ প্রভৃতি হলো অন্তর্নিহিত ক্ষমতার উদাহরণ।
৩. পুলিশী ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়নের ক্ষমতার কোনো কোনো দিককে পুলিশী ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জনস্বার্থ, নিরাপত্তা, নীতিবোধ এবং জনকল্যাণমূলক আইন সম্পর্কিত ক্ষমতা রাজ্যের হাতে ন্যস্ত থাকলেও বিগত তিন দশক যাবৎ এ ক্ষমতা কংগ্রেস প্রয়োগ করে আসছে। ফলে এ ক্ষমতা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
৪. হস্তান্তরের ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত ক্ষমতা কংগ্রেস অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করতে পারে কি-না এ ব্যাপারে দীর্ঘকাল বিতর্ক চলছে। কংগ্রেস আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রশাসনিক এজেন্সী ও নিয়ন্ত্রণ কমিশনগুলোর হাতে আধা আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতা অর্পণ করেছে। কিন্তু আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টও কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ধারা বজায় রাখতে পারে নি।
খ. অন্যান্য ক্ষমতা (Other Powers) : আইন প্রণয়ন ছাড়াও মার্কিন কংগ্রেসকে অন্যান্য অনেক বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় মার্কিন কংগ্রেসের এসমস্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলির গুরুত্বও কম নয়। নিম্নে মার্কিন কংগ্রেসের এ সমস্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রমের উপর কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা আছে । রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত, বাণিজ্যিক দূত, কেবিনেটের সদস্য এবং পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করলেও সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতির এসমস্ত নিয়োগ কার্যকর হয় না। সিনেট অনুমোদন না করলে এধরনের নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির বিরোধী দলের সদস্যগণ সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে রাষ্ট্রপতির এ সংক্রান্ত নিয়োগ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমন ঘটনা রাষ্ট্রপতি নিক্সনের আমলে একাধিকবার ঘটেছে। প্রতিনিধি সভার এ ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই ।
২. সংবিধান সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেসের সংবিধান সংক্রান্ত ক্ষমতা হলো সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা এককভাবে মার্কিন কংগ্রেসের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা না থাকলেও কংগ্রেসের ভূমিকা ব্যতীত সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। মার্কিন শাসনতন্ত্রের ৫ ধারায় সংবিধান সংশোধনের নিয়মাবলি বর্ণিত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দু’ভাবে আনয়ন করা যেতে পারে। প্রথমত কংগ্রেসের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত: অঙ্গরাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশের অনুরোধে কংগ্রেস কর্তৃক আহূত ‘জাতীয় সম্মেলন’ এ প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে। দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত মার্কিন সংবিধানের ২৬টি সংশোধনীর কোনোটির প্রস্তাব আনা হয় নি। যে কারণে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব আনয়নের ক্ষমতা কংগ্রেসেরই বলে ধরে নেয়া হয় ।
৩. চুক্তি বিষয়ক ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা হলো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত সন্ধি ও চুক্তি অনুমোদনের ক্ষমতা। এই ক্ষমতা এককভাবে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ভোগ করে থাকে। সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত কোনো সন্ধি বা চুক্তি সিনেট উপস্থিত সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদন লাভ করলেই কেবল কার্যকর হয়। সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি সকল সন্ধি ও চুক্তি পর্যালোচনার পর সংশোধনের প্রস্তাবসহ অথবা অপরিবর্তিত অবস্থায় চুক্তি বা প্রত্যাখানের জন্য সিনেটের নিকট সুপারিশ করতে পারে। ১৯১৯ সালে রাষ্ট্রপতি উইলসন ভার্সাই সন্ধি এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেও সিনেট তা অনুমোদন করে নি ।
৪. যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধান অনুসারে কংগ্রেস যুদ্ধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করার অধিকারী। মার্কিন সংবিধানের ১ (৮) ধারা অনুসারে সামরিক বাহিনী গঠন ও নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধ ঘোষণা, অভ্যুত্থান দমন, প্রতিরোধ, আক্রমণ, সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৮১২ সালের যুদ্ধ, মেক্সিকো যুদ্ধ, স্পেনের যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এই পাঁচটি ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেস যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। কংগ্রেসের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি যুদ্ধ ঘোষণা বা প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের আদেশ দিতে পারেন না ৷
৫. নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইলেক্ট্রোরাল ভোট গণনার সময় কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কেউ প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হলে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত তিন জন প্রার্থীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি সভা একজনকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করে। আবার উপ-রাষ্ট্রপতি পদে কোনো প্রার্থী এককভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রথম দুজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে সিনেট একজনকে উপ- রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করেন। প্রতিনিধি সভা ১৮০১ ও ১৮২৫ সালে এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি এবং সিনেট ১৮৭৬ সালে উপ- রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। আবার প্রতিনিধিসভা ও সিনেট সদস্যদের যোগ্যতা এবং নির্বাচন সংক্রান্ত নিয়মাবলি নির্ধারণের ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে যে কোনো সদস্যকে সভার অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করতে পারে। নির্বাচনি প্রচারে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগে সিনেট ১৯২৬ সালে উইলিয়াম ভারে-কে সভায় আসন গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করেছিল।
৬. প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতা : কংগ্রেস সদস্যদের স্ব স্ব নির্বাচনি এলাকা ও নির্বাচকমণ্ডলীর স্বার্থের দিকে নজর দিতে হয়। সদস্যগণ স্ব স্ব নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন স্বার্থকে সংঘবদ্ধ করেন; নির্বাচকমণ্ডলীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করেন। অর্থাৎ, তাঁরা বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক কাজে জড়িত থাকেন। তাছাড়া পুনর্নির্বাচনের সুবিধার্থে দলীয় স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যদের স্ব স্ব নির্বাচকমণ্ডলীর স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগ দিতে হয় এবং তাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে হয়।
৭. অর্থ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেস হচ্ছে কর ধার্য ও অর্থ মঞ্জুর করার অভিভাবক। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে অর্থ মঞ্জুরির দাবি উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের উপর সমালোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে কংগ্রেস মার্কিন শাসনব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রাখার সুযোগ পায়। আবার কংগ্রেস মুদ্রা প্রচলন, প্যাটেন্ট ও কপিরাইট, পোস্ট অফিস ও রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রভৃতি বিষয়েও অনন্য ক্ষমতা চর্চা করে। তাছাড়া মার্কিন সংবিধান কংগ্রেসকে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও অর্পণ করেছে। বৈদেশিক ও আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের উপর কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমেও স্বীকৃত হয়েছে।
৮. কর আরোপ সংক্রান্ত ক্ষমতা : জনকল্যাণের লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেসকে শুল্ক, কর, আবগারি শুল্ক, ঋণ প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাৎসরিক রাজস্ব বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কয়েক ট্রিলিয়ন কর সংগ্রহ করে। অর্থ সংক্রান্ত কর সাংবিধানিকভাবে কংগ্রেসের কর আরোপের ক্ষমতায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে । যেমন:
ক. কংগ্রেস কর্তৃক যে কর আরোপিত হবে তা জনকল্যাণের লক্ষ্যে আরোপিত হবে, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়;
খ. কংগ্রেস কর্তৃক আরোপিত কর বহির্বিশ্বে বিনিয়োগ করা যায় না;
গ. দেশের জনগণের মধ্যে কর অবশ্যই ন্যায্যভাবে বণ্টিত হবে।
৯. তথ্য সরবরাহমূলক ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেস সরকারি নীতি, কার্যকলাপ ও রাজনীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। জাতীয় নীতির আলোচনা ও নীতি নির্ধারণ কংগ্রেসকেই সম্পন্ন করতে হয়। এ বিষয়ে যাবতীয় সংবাদ কংগ্রেস সরবরাহের মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করে। এদিক দিয়ে কংগ্রেসের শিক্ষামূলক ভূমিকাও রয়েছে।
১৫. নির্দেশ ও তত্ত্বাবধান ক্ষমতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন বিভাগের কার্যক্রমসমূহ রাষ্ট্রপতি পরিচালনা করলেও প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসই এগুলোর মুখ্য পরিচালক। কংগ্রেস এ বিভাগসমূহের উপর পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখে। মার্কিন কম্পট্রোলার জেনারেল কংগ্রেসের নিকট দায়ী থাকেন। কংগ্রেস কম্পট্রোলার জেনারেল ও তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তার মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থার উপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। আবার বিভিন্ন প্রশাসনিক এজেন্সী, দপ্তর, কমিশন প্রভৃতি কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও লোকবল কংগ্রেসকেই অনুমোদন দিতে হয় ।
১১. তদন্ত সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধানে কংগ্রেসের তদন্ত সংক্রান্ত কোনো ক্ষমতার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের মতানুসারে তদন্তের কাজ কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতার সহযোগী। একে কংগ্রেসের ‘অনুমিত ক্ষমতা’ বলা হয়। প্রচলিত আইনের প্রয়োগ, প্রস্তাবিত আইন এবং জনস্বার্থ সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে তদন্ত করার সঙ্গে এ ক্ষমতা জড়িত। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ তদন্তমূলক কাজের জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করে। কংগ্রেসের সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো যে কোনো ব্যক্তির উপর সাক্ষ্যদানের জন্য সমন জারি করতে পারে। এ ক্ষমতাবলে কংগ্রেস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছে। তদন্ত বিষয়ক এ ক্ষমতার দ্বারা কংগ্রেস কর্তৃক প্রস্তাবিত কোনো বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, জনমত গঠন বা আইন প্রয়োগ করে এমন সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কংগ্রেস ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে ৪৯৬টি তদন্ত বিষয়ক কার্য সম্পাদন করেছে। অথচ, ১৭৮৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এ রকম তদন্তমূলক কার্যের সংখ্যা ছিল ৫০০টি। তবে এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাটির প্রয়োগ পদ্ধতির উপর মার্কিন কংগ্রেসের মর্যাদা বহুলাংশে নির্ভরশীল।
১২. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন কংগ্রেসের হাতে গুরুত্বপূর্ণ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে
আলোচনা করা হলো:
ক. মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা সংবিধানে বিশেষভাবে বিধিবদ্ধ থাকলেও সুপ্রিমকোর্টের গঠন এবং আপীল সম্পর্কিত এখতিয়ার কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমে স্থিরীকৃত হয়েছে।
খ. রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ দেন। কিন্তু এ নিয়োগে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদন আবশ্যক । এছাড়া আদালতের ব্যয় কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদিত হওয়া জরুরি।
গ. রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্য পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস অভিযোগ এনে ইম্পিচমেন্ট পদ্ধতিতে বিচার করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিনিধি সভা অভিযোগ আনে এবং সিনেট অভিযোগের বিচার-বিবেচনা করে দুই- তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব গ্রহণ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, সিনেট যখন ইম্পিচমেন্টের বিচার করে তখন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। এই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত সিনেট ১৩ জন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল। ১৯৭৪ সালে ইম্পিচমেন্টের সম্মুখে রাষ্ট্রপতি নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
ঘ. কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট আনয়ন করা সম্ভব না হলেও উভয় কক্ষই নিজ নিজ সদস্যদের আচরণবিধি নির্ধারণ করতে পারে। কোনো সদস্য তা ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট কক্ষ দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেই সদস্যকে বহিষ্কার করতে পারে। অবশ্য সাধারণভাবে এরূপ ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না।
ঙ. কংগ্রেসের কোনো কক্ষের সদস্য নয় এরূপ কোনো ব্যক্তি কংগ্রেসের কাজে হস্তক্ষেপ করলে কিংবা বাধাদান করলে সংশ্লিষ্ট কক্ষ তাকে শাস্তি দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কংগ্রেসের কোনো কমিটির সামনে কোনো সাক্ষী প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করলে সংশ্লিষ্ট কক্ষ কংগ্রেসের অবমাননার দায়ে সেই ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। প্রয়োজন মনে করলে সংশ্লিষ্ট সেই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে হাজতে রাখার জন্য সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মসকে নির্দেশ দেয়। অবশ্য কংগ্রেসের অধিবেশন যতদিন চলে তার বেশি সময়ের জন্য কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। তবে এরূপ কোনো ঘটনা ঘটলে কংগ্রেস সাধারণত নিজে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আইন অনুসারে যথোচিত শাস্তি প্রদানের জন্য বিষয়টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি-জেনারেলের নিকট প্রেরণ করেন।
মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা
Limitation of the Powers of the USA Congress
মার্কিন সংবিধান মার্কিন কংগ্রেসকে বহুবিধ ক্ষমতার অধিকারী করে তুললেও কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেসকে বহু সাংবিধানিক ও অন্যান্য বাধানিষেধের গণ্ডির মধ্যে কাজ করতে হয়। মার্কিন কংগ্রেসের উপর নিম্নলিখিত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও কার্যকারণগত সীমাবদ্ধতা দেখা যায় ।
১. আইন প্রণয়ন ক্ষমতা অনির্দিষ্ট ও অনিয়ন্ত্রিত নয় : মার্কিন সংবিধান মার্কিন কংগ্রেসের হাতে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করে থাকলেও তা অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নয়। কারণ কংগ্রেসকে একটি দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের নির্দেশিত সীমানার মধ্যে থেকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। সংবিধানে উল্লিখিত বিষয়ের বাইরে আইন প্রণয়ন করার অধিকার কংগ্রেস রাখে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়নের অধিকার সীমিত। যে কারণে মার্কিন কংগ্রেসকে ‘অ-সার্বভৌম আইন প্রণয়ন সংস্থা’ রূপে চিহ্নিত করাই শ্রেয়।
২. আইন প্রণয়ন ক্ষমতা হস্তান্তরযোগ্য নয় : মার্কিন কংগ্রেসের হাতে অর্পিত আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কংগ্রেস মার্কিন শাসন বিভাগের নিকট হস্তান্তর করতে পারে না। সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মার্কিন কংগ্রেস আইনের কাঠামো ও সাধারণ নীতি নির্ধারণের দ্বারা খুঁটিনাটি বিষয় প্রশাসনের হাতে হস্তান্তর করতে পারে। কিন্তু কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নের সম্পূর্ণ ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করতে পারে না ।
৩. আপদকালীন ক্ষমতা নেই : মার্কিন সংবিধান কংগ্রেসের নিকট কোনো প্রকার আপদকালীন ক্ষমতা ন্যস্ত করে নি । সংবিধান নির্দেশিত ক্ষমতার সাহায্যেই কংগ্রেসকে জাতীয় সংকটের মোকাবেলা করতে হয়। সংবিধান প্রণেতাগণ স্বাভাবিক ও আপদকালীন অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্দেশ করেন নি। ১৯৩৪ সালে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, আপদকালীন অবস্থা নতুন কোনো ক্ষমতার সৃষ্টি করে না। ১৯৩৫ সালে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট অপর আরেকটি রায়ে ঘোষণা করে যে, আপদকালীন অবস্থা সাংবিধানিক ক্ষমতা সৃষ্টি বা সম্প্রসারিত করে না। জরুরি অবস্থায় কংগ্রেস যে ক্ষমতাই প্রয়োগ করুক না কেন সাংবিধানিক গণ্ডির দ্বারা এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় সংকটকালীন সময়ে কংগ্রেস কর্তৃক এমনসব ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় যার কোনো প্রয়োজন দেখা দেয় না ।
৪. সংবিধান সংশোধনের একক ক্ষমতার অভাব : সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেস একক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। কেননা, অঙ্গরাজ্যসমূহের তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি ব্যতীত সংশোধনী প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয় না। আর দুই- তৃতীয়াংশ অঙ্গরাজ্য অনুরোধ করলে কংগ্রেস বাধ্য হয়ে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব সম্পর্কে অঙ্গরাজ্যসমূহের সম্মেলন আহ্বান করে।
৫. রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। রাষ্ট্রপতি বাণী প্রেরণ ও ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ভেটো প্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ, জনপ্রিয়তা, লবি ব্যবস্থা এবং যোগাযোগের বাহন- সমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করেছেন। এর ফলে রাষ্ট্রপতিই এখন প্রধান আইন প্রণেতার ভূমিকা পালন করেন। সংবিধান প্রণেতাগণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও বাস্তবে শাসন বিভাগ নিজেকে প্রাধান্যের স্তরে উন্নীত করেছে।
৬. নাগরিক অধিকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না : কংগ্রেস বিদ্রোহ অথবা আক্রমণের সময় ব্যতীত অন্য কোনো সময় আইন প্রণয়ন করে বন্দী প্রত্যক্ষীকরণের অধিকার (Habeas Corpus) বাতিল করতে পারে না। নাগরিক অধিকার সংকোচনের ক্ষমতাও কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত করা হয়নি। ইতিপূর্বে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে (Ex-post facto law) কংগ্রেস পরবর্তীতে আইন করে উক্ত আইনকে প্রয়োগ করতে পারে না। আবার কোনো আইন প্রণয়ন করে রাজদ্রোহের অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তির অধিকার লোপ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত (Bill of attainder) করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না।
৭. অঙ্গরাজ্যের সীমানা বা প্রতিনিধিত্ব পরিবর্তন করতে পারে না : মার্কিন কংগ্রেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কোনো অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলেও অঙ্গরাজ্যসমূহের অনুমতি ব্যতীত তাদের সীমানা পরিবর্তন অথবা পুনর্গঠন সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারেও কংগ্রেসের ক্ষমতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস কোনো আইন প্রণয়ন করে অঙ্গরাজ্যকে সিনেটে সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
৮. জুরি ব্যবস্থা : কংগ্রেসের ক্ষমতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হলো কংগ্রেস জুরির সাহায্যে বিচার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারে না।
১. সম্পত্তির অধিকার সীমিত করতে পারে না : সম্পত্তির অধিকার মার্কিন সংবিধানে পবিত্র অধিকার হিসেবে পরিগণিত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পত্তির অধিকার সকল অধিকারের ভিত্তি। সংবিধান অনুযায়ী উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ব্যতীত কোনো আইন কোনো ব্যক্তিকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না ।
১৫. বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ভাগ কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট ‘বিচার বিভাগীয় পুনরীক্ষণ’ (Judicial Review) এর মাধ্যমে অসাংবিধানিক ও অসঙ্গত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। শাসনতন্ত্র বা ন্যায়নীতির (natural justice ) বিরোধী মনে করলে সুপ্রিমকোর্ট যে কোনো আইনকে বাতিল করতে পারে। ফলে কংগ্রেস প্রণীত আইন আর কার্যকর হয় না ।
১১. কার্যগত সীমাবদ্ধতা : উপরিউক্ত সাংবিধানিক বাধানিষেধ ছাড়াও কংগ্রেসকে আরো কতিপয় কার্যগত সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করতে হয়। এসব কার্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
সরকারি কার্যকলাপের ক্ষেত্রে বর্তমানে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধ, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রাত্যহিক জীবনের বিবিধ প্রয়োজন প্রভৃতি ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের উপর জনসাধারণ ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের উপর জনগণের এ ধরনের আস্থার কারণে বর্তমান বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও মর্যাদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির এধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা মার্কিন কংগ্রেসের গুরুত্ব ও মর্যাদার হানি ঘটিয়েছে।
খ. নির্বাচনের সাফল্যকে সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে সাহায্য করে।
যে কারণে কংগ্রেস সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁর অনুগ্রহভাজন হওয়ার চেষ্টা করেন। কংগ্রেসে দলীয় সদস্যদের উপর জাতীয় নেতা হিসেবে রাষ্ট্রপতি কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন ।
গ. মার্কিন কংগ্রেসকে পুঁজিপতি ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের ধারক ও বাহক হিসেবে মনে করা হয়। এ অর্থে কংগ্রেস জনগণের বিত্তবান সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এভাবে সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের বাহক হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ায় কংগ্রেসের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।
ঘ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব গোষ্ঠী নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থের অনুকূলে আইন প্রণয়নকে প্রভাবিত করার জন্য কংগ্রেসের সদস্যদের উপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের ব্যবস্থা করে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কংগ্রেস সদস্যদেরকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থে কাজ করতে দেখা যায় ৷
ঙ. মার্কিন জনমতকে উপেক্ষা করে কংগ্রেসের পক্ষে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। বস্তুত জনমতের দিকে সদা জাগ্ৰত দৃষ্টি রেখে কংগ্রেসকে কাজ করতে হয়।
১২. রজার ডেভিডসন এবং ওয়াল্টার ওলেসজেক (Roger Davidson and Walter Oleszek)-এর অভিমত : রজার ডেভিডসন এবং ওয়াল্টার ওলেসজেক মার্কিন কংগ্রেসের কয়েকটি দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এগুলো হলো
প্রথমত : মার্কিন কংগ্রেস সংবাদপত্রের সমালোচনার কষাঘাতে জর্জরিত। শাসন বা বিচার বিভাগের তুলনায় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অনেক বেশি প্রকাশ্য। কমিটি বা আইনসভায় বক্তব্য উপস্থাপনের সময়ে কোনো সদস্য যদি তথ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয় দেন অথবা কোনো অযৌক্তিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন তবে তাঁর বক্তব্যের বিষয়বস্তুর তুলনায় মুখরোচক উপাদানকেই সংবাদপত্র বেশি গুরুত্ব প্রদান করে ৷
দ্বিতীয়ত : রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের তুলনায় অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে গণসংযোগের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য জনসাধারণের নিকট পেশ করেন। ফলে কংগ্রেস অপেক্ষা জনসাধারণের নিকট রাষ্ট্রপতি অধিক গুরুত্ব পান ।
তৃতীয়ত : কংগ্রেস সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপতির বেশিরভাগ প্রস্তাবে সাড়া দিলে কংগ্রেসকে ‘রাষ্ট্রপতির সীলমোহর’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আবার রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব প্রত্যাখানেও কংগ্রেসকে ৰাধা প্রদানকারী রূপে চিহ্নিত করা হয়।
চতুর্থত : কংগ্রেস সদস্যগণ কর্তৃক কংগ্রেসের কার্যাবলির সমালোচনার ফলেও মার্কিন কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে । পঞ্চমত : সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তথ্য সংগ্রহ এবং বিন্যাসে কংগ্রেস শাসন বিভাগের ন্যায় আধুনিক প্রযুক্তি কৌশল প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে।
ষষ্ঠত : মার্কিন কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন দল স্বাধীন কর্মসূচির বিন্যাসে ব্যর্থ হয়েছে ।
সপ্তমত : মার্কিন কংগ্রেসের বিভিন্ন স্থায়ী কমিটি একই ধরনের বিষয়ের সাথে জড়িত হবার ফলে কোনো ঐক্যবদ্ধ সমন্বয়সাধনমূলক নীতি প্রণয়নে কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে।
অষ্টমত : কংগ্রেসের মতামত স্পষ্টভাবে উপস্থাপনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মুখপাত্র নেই ।
নবমত : নীতি প্রণয়নে উদ্যোগ ও নৈপুণ্য প্রদর্শনে মার্কিন কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে।
শেষত : মার্কিন কংগ্রেসের পদ্ধতিগত ব্যবস্থার ফলেও আইন প্রণয়নে কংগ্রেসের ভূমিকা সীমিত হয়েছে । উপরিউক্ত কারণে মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতা ও মর্যাদা ক্ষীয়মাণ হচ্ছে এবং পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে প্রসারিত হওয়ায় কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির অন্যতম ভৃত্যের পরিচয় পেয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষমতা ও কার্যাবলি মার্কিন শাসনব্যবস্থায় এখনও গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, এমন অনেক আইন আছে যা কংগ্রেস প্রণয়ন করে এবং এসব ক্ষেত্রে অন্য কারো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। যেমন— কর ধার্য, কর সংগ্রহ বা সংগৃহীত অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে কংগ্রেসের অনুমোদন ব্যতীত মার্কিন শাসন বিভাগ এসব ক্ষমতা চর্চা করতে অপারগ। এভাবেই মার্কিন কংগ্রেস শাসনব্যবস্থার শীর্ষে তার অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতার মূল্যায়ন
Evaluation of the Powers of the Congress
মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতা ও প্রভাব পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, আপাতদৃষ্টিতে কংগ্রেস প্রভৃত ক্ষমতার অধিকারী। কংগ্রেসের আইন প্রণয়নমূলক, শাসন বিভাগীয়, বিচার সংক্রান্ত, সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত, তত্ত্বাবধান এবং তদন্তমূলক ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস জনসংযোগ ও তথ্যপ্রদানকারী সংস্থারূপেও কাজ করে। সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার ভূমিকাও সামান্য নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের কোনো ক্ষমতাই অবাধ ও অপ্রতিরোধ্য নয়। মার্কিন সংবিধানের প্রণেতাগণ কংগ্রেসের হাতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করলেও এ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণবিহীন করেন নি। শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার অন্তরালে কংগ্রেস যেন নিজের হাতে বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে না পারে সংবিধান প্রণেতাগণ সেদিকে লক্ষ রেখেছিলেন। সেজন্য তাঁরা কংগ্রেসের ক্ষমতার উপর নানা প্রকার বাধানিষেধ ও সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিলেন। ‘ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ’ এবং ‘পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’ অনুযায়ী সংবিধান প্রণেতাগণ যে সীমাবদ্ধ সরকারি ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তার মাধ্যমে আইনসভার ক্ষমতাও স্বাভাবিকভাবে সীমিত হয়ে পড়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, কংগ্রেসের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের মূল উৎস হলো সংবিধান প্রণেতাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ।
পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশকে সুনিশ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সীমিতকরণের প্রয়োজন ছিল। পুঁজিবাদ নিজের অগ্রগতির সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণের জন্য নেতিবাচক রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করে। রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের এই নেতিবাচক ধারণা থেকেই সীমাবদ্ধ সরকারের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধান প্রণেতাদের এই চিন্তাধারা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায় কংগ্রেসের ক্ষমতার সীমিতকরণের একটি উৎস হলো কাঠামোগত পরবর্তীকালে কার্যে পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসকল কার্যগত প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যার (functional obstacles and problems) সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমেও কংগ্রেসের ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। ক্ষমতা ও প্রভাবের অন্তরালে অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার গণ্ডি কংগ্রেসকে আবদ্ধ করে রেখেছে। যে কারণে অধ্যাপক মুনরো (Prof. Munro) কংগ্রেসকে ‘একটি শৃঙ্খলিত লেভিয়াথান’ (A Leviathan in Chains) নামে অভিহিত করেছেন। কারণ কোনো বিশালায়তন দৈত্যকে যেমন শৃঙ্খলাবদ্ধ করলে তার পক্ষে নিজ শৌর্য প্রকাশ করা সম্ভব হয় না, কংগ্রেসের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। তার হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলেও সে ক্ষমতা প্রয়োগের উপর এমন সব সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে যে, তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পথে এগুলো যথেষ্ট অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
৩. রাষ্ট্রপতির নিয়োগ অনুমোদন; ৪. উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করলে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত দুই জনের মধ্যে থেকে একজনকে উপ- রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করা ।
যুক্তরাজ্যে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি না থাকায় কেবিনেট সদস্যগণ আইন প্রয়ণনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আইনসভা হিসেবে মার্কিন কংগ্রেস সকল প্রকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রবর্তিত হওয়ায় তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর কেবিনেটের সদস্যগণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে কিংবা কংগ্রেসের বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ ব্যাপারে কংগ্রেস এবং তার কমিটিগুলো করণীয় সবকিছু করে থাকে।