Table of Contents
Toggleমার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি
মার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি
Amendment Procedure of the American Constitution
মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকলেও তাঁরা সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতিকে সহজসাধ্য করতে চাননি। যে কারণে মার্কিন সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সংশোধন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ফলে মার্কিন সংবিধান শুধু লিখিতই নয়, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানেরও একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। লিখিত ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান সংশোধনের আনুষ্ঠানিক ও বিধিসম্মত পদ্ধতির গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে মার্কিন সংবিধানের ৫নং ধারায় সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। মার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতির দু’টি স্তর বা পর্যায়
রয়েছে। যথা:
ক. সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পর্যায় (Proposal for Amendment);
খ. সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের পর্যায় (Retification of Proposal) ।
মার্কিন সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব দু’ভাবে উত্থাপন করা যায় এবং সেই প্রস্তাবের অনুমোদনও দু’ভাবে হতে পারে। সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন (Proposal for Amendment) : মার্কিন সংবিধানের ৫নং ধারা অনুসারে দু’টি উপায়ে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা যেতে পারে। উপায় দু’টি হলো :
প্রথমত : মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য প্রয়োজন মনে করলে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন ।
দ্বিতীয়ত : মোট রাজ্যসমূহের মধ্যে অন্তত: দুই-তৃতীয়াংশ অঙ্গরাজ্যের আইনসভা আবেদন করলে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য কংগ্রেসকে একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করতে হবে।
মার্কিন সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের উল্লিখিত পদ্ধতি দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টি এ পর্যন্ত একবারও ব্যবহৃত হয় নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব উত্থাপনে উদ্যোগী হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক রাজ্যের সমর্থনের অভাবে সেই সমস্ত প্রস্তাব কার্যকর হয় নি। তবে কংগ্রেসের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য বলতে সঠিক কী বুঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট হয় নি। তবে পরবর্তীকালে এ ব্যাখ্যাই গৃহীত হয়েছে যে, উপস্থিত দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব উত্থাপন করা যাবে।
সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন ( Retification of Propasal) : মার্কিন সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের ন্যায় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনও দুটি পর্যায়ে হতে পারে। উপায় দু’টি হলো :
প্রথমত : সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবটি প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় উপস্থাপন করা হয়। মোট অঙ্গরাজ্যসমূহের মধ্যে অন্তত তিন-চতুর্থাংশ (৩৮টি) অঙ্গরাজ্যের আইনসভা প্রস্তাবটি অনুমোদন করলে সংবিধান সংশোধিত হতে পারে ।
দ্বিতীয়ত : সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যে একটি বিশেষ গণসম্মেলন (Convention) আহ্বান করা হয়। এভাবে অঙ্গরাজ্যসমূহে আহূত সম্মেলনগুলোর তিন-চতুর্থাংশ সম্মেলনে সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হলে সংবিধান সংশোধিত হতে পারে।
সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের ব্যাপারে এ পদ্ধতি দু’টির মধ্যে কোনটি গৃহীত হবে তা কংগ্রেসই স্থির করবে। সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদ্ধতি মাত্র একবার (সংবিধানের ২১তম সংশোধনী) ব্যবহৃত হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা নেই। দীর্ঘ ৮০ বছর পর সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের নজিরও রয়েছে। তবে মার্কিন কংগ্রেস প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। বর্তমানে এটি স্থির হয়েছে যে, সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ৭ বছরের মধ্যে অনুমোদিত হতে হবে, তা না হলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাবে।
তবে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি কিংবা অঙ্গরাজ্যের গভর্নরদের সম্মতির প্রয়োজন হয় না।
নিম্নে একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি তুলে ধরা হলো :
মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি
সংশোধন প্রস্তাব উত্থাপন
সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন
কংগ্রেসের উভয়কক্ষের উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের
কংগ্রেসের উভয়কক্ষের
যুক্তরাষ্ট্রের ২/৩
উপস্থিত ও
অঙ্গরাজ্যের
ভোটদানকারী
সদস্যদের ২/৩
সদস্যদের সম্মতিক্রমে
প্রস্তাব উত্থাপন করা
যেতে পারে।
আইনসভাসমূহের অনুরোধক্রমে কংগ্রেস কর্তৃক আহুত কনভেনশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা যেতে
২/৩ সদস্যদের সম্মতিক্রমে প্রস্তাব
উত্থাপন করা যেতে
পারে।
পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ২/৩
অঙ্গরাজ্যের
আইনসভাসমূহের
অনুরোধক্রমে কংগ্রেস কর্তৃক আহুত
কনভেনশনে প্রস্তাব
উত্থাপন করা যেতে
পারে।
মার্কিন সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও অনুমোদনের ব্যাপারে দু’টি করে পদ্ধতি থাকলেও সাধারণত মার্কিন কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে প্রস্তাব উত্থাপন এবং অঙ্গরাজ্যসমূহের তিন-চতুর্থাংশ আইনসভার দ্বারা সেই প্রস্তাব অনুমোদনকে মার্কিন সংবিধান সংশোধনের স্বাভাবিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
মার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
Characteristics of amending process of the constitution of USA
মার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে এ পদ্ধতির বিশেষ কতগুলো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এসকল বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
ক. মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ন্যায় অঙ্গরাজ্যসমূহের ভূমিকাও স্বীকৃত হয়েছে। অঙ্গরাজ্যসমূহ যেমন সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে, তেমনি আবার তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের সম্মতি ব্যতীত সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় না।
খ. মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও অঙ্গরাজ্যসমূহের ভূমিকা মোটেই সমান নয়। অঙ্গরাজ্যসমূহের আবেদনক্রমে শুধু কংগ্রেসই কনভেনশন আহ্বান করার অধিকারী। অর্থাৎ, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যসমূহ নিজেরা ইচ্ছেমতো এককভাবে অগ্রসর হতে পারে না। অপরদিকে, কংগ্রেসেরও এক্ষেত্রে একক ক্ষমতার অভাব রয়েছে ।
গ. মার্কিন অঙ্গরাজ্যের আইনসভাসমূহের দুই-তৃতীয়াংশের আবেদনক্রমে মার্কিন কংগ্রেসকে একটি শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন বা সম্মেলন আহ্বান করতে হয়। মার্কিন কংগ্রেস অঙ্গরাজ্যগুলোর অনুমোদনের জন্য কোনো সংশোধনী প্রস্তাবকে প্রেরণ করতে অস্বীকার করলে অঙ্গরাজ্যসমূহ এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এ কনভেনশনে সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রস্তাবকে রাজ্য আইনসভাসমূহের অনুমোদনের জন্য প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে কংগ্রেসকে তা মেনে নিতে হয়।
ঘ. কতদিনের মধ্যে রাজ্যসমূহকে সংশোধনী প্রস্তাবের ব্যাপারে তাদের মতামত জানাতে হবে সে ব্যাপারে সংবিধানে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। তবে বর্তমানে প্রতিটি সংশোধনী প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অনুরূপ সময়সীমা বেঁধে দেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর (১৯১৯ সালে) মাধ্যমে স্থির করা হয় যে, তিন-চতুর্থাংশ অঙ্গরাজ্যকে সাত বছরের মধ্যে তাদের মতামত জ্ঞাপন করতে হবে। ডিলন বনাম গ্লস মামলায় ( ১৯২১ সাল) মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট এ সময়সীমাকে যুক্তিসঙ্গত বলে স্বীকার করেছে।
৫. অঙ্গরাজ্যসমূহ কোনো সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করার পর তা প্রত্যাহার করতে পারে না। তবে কোনো সংশোধনী প্রস্তাবে পূর্বে অসম্মতি জানিয়ে থাকলে পরবর্তীতে সম্মতি জ্ঞাপন করতে পারে।
চ. কোনো অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ব্যতীত মার্কিন সিনেটে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যায় না।
ছ. সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বে যেমন রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন নেই, আবার প্রয়োজনীয় সংখ্যক অঙ্গরাজ্যের দ্বারা সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বা গভর্নরদের সম্মতির প্রয়োজন হয় না।
জ. মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি জটিল ও দুষ্পরিবর্তনীয়। কেননা, সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব উভয় কক্ষের দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের দ্বারা গৃহীত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলতে উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বুঝায় ।
ঝ. মার্কিন সংবিধানের সংশোধনের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষমতা সঙ্কুচিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে বৃদ্ধি পায় নি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট-এর ‘নিউ ডিল নীতি’ (New Deal Policy)-এর মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সংশোধন ব্যতীত সরকারের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্রের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক সংশোধনগুলোর মাধ্যমে সরকারের এখতিয়ার ও ক্ষমতা তেমন বৃদ্ধি পায় নি ।
মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির সমালোচনা
Criticism of amending process of the constitution of USA
বিভিন্নভাবে মার্কিন সংশোধন পদ্ধতির সমালোচনা করা হয়। নিম্নে এসব সমালোচনা তুলে ধরা হলো :
ক. মার্কিন সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বিধায় এর সংশোধন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ। মার্কিন কংগ্রেসের দুটি কক্ষে যদি দুটি ভিন্ন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকে তবে সংবিধানের কোনো সংশোধনী প্রস্তাবের পক্ষে উভয় দলের বা উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। আবার অঙ্গরাজ্যসমূহের তিন- চতুর্থাংশের সমর্থন আদায় করাও সহজ কথা নয়। যে কারণে ১৭৮৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মার্কিন সংবিধান মাত্র ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রথম ১০টি সংশোধনী কেবল একটি ‘অধিকার বিল’ সংক্রান্ত সংশোধন এবং এগুলো ১৭৯১ সালে একসঙ্গে করা হয়েছিল। ফলে বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে সুদীর্ঘ সময়ে কেবলমাত্র ১৬ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
খ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মার্শাল-এর মতানুসারে, মার্কিন সংবিধান সংশোধনের নির্ধারিত পদ্ধতি প্রয়োগের অনুপযোগী এবং দুরূহ ( Unwidely and cumbrous)। অর্থাৎ, সমালোচকদের মতে, মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি মোটেই সহজসাধ্য নয় ।
গ. অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিকে ‘মন্থর গতিসম্পন্ন পন্থা’ বলে অভিহিত করেছেন। যে কারণে মার্কিন সংবিধান দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সহজে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারে না ।
ঘ. বিধি অনুযায়ী মার্কিন সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব অন্তত তিন-চতুর্থাংশ (৩৮টি) অঙ্গরাজ্যের আইনসভা দ্বারা অনুমোদিত হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় সংবিধানের সংশোধন কার্যকর হয় না। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১৩টি অঙ্গরাজ্য অনুমোদন না করলে সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সমালোচনার বিষয় হলো যে, মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঙ্গরাজ্যের তুলনায় সংখ্যালঘিষ্ঠ অঙ্গরাজ্যের মতামত প্রাধান্য পায় ।
ঙ. মার্কিন সংবিধান সংশোধনের কোনো পর্যায়েই মার্কিন জনগণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। জনগণ উদ্যোগী হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধান সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। আবার জনগণের মতামত জানার জন্য কোনো সংশোধনী প্রস্তাব গণভোটে দেয়া হয় না ।
অথচ, সুইজারল্যান্ডে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট ও গণউদ্যোগই প্রধান ভূমিকা পালন করে। যে কারণে অনেকে মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিকে অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছেন।
চ. সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবে মার্কিন অঙ্গরাজ্যসমূহের তিন-চতুর্থাংশের অনুমোদন আবশ্যক। কিন্তু এ বিষয়ে রাজ্যসমূহকে তাদের সম্মতি জ্ঞাপনের সময়সীমা সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নি। ফলে নানা রকম অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষিতে একটি অবিশ্বাস্য নজির হলো জর্জিয়া, ম্যাসাচুসেটস এবং কানেকটিকেট ১৭৯১ সালের প্রথম দশটি সংশোধনী বিলে ১৯৩৯ সালে সম্মতি দিয়েছিল। তবে বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকটি সংশোধনী প্রস্তাবের সাথে অঙ্গরাজ্যসমূহের সম্মতি প্রদানের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম সময় ১০০ দিন লেগেছিল ভোটারদের ১৮ বছর বয়ঃসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত ২৬তম সংবিধান সংশোধনীতে। রাষ্ট্রপতির কার্যকাল সম্পর্কিত ২২তম সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনে সময় লেগেছিল ৩ বছর ৩৪০ দিন।
ছ. কোনো কোনো সমালোচকের মতে, মার্কিন সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীর ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতার স্থলে এককেন্দ্রিক প্রবণতা প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা, তত্ত্বগতভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যসমূহের ভূমিকাকে স্বীকার করা হলেও কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভূমিকা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সংবিধান সংশোধনের পদক্ষেপ হিসেবে ‘সাংবিধানিক সম্মেলন (Constitutional Convention) আহবানের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত অঙ্গরাজ্যসমূহ সফল হয় নি। মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক প্রস্তাবিত ২৬টি সংবিধান সংশোধনী অঙ্গরাজ্যসমূহ অনুমোদন করেছে, যদিও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৭টি সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করে নি। অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব উত্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক রাজ্যের সমর্থনের অভাবে সেই সমস্ত প্রস্তাব কার্যকরী হয় নি। আবার প্রথম ১০০ বছরে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক সম্মেলন আহবানের জন্য কংগ্রেস রাজ্য আইনসভাসমূহের নিকট থেকে ১০টি আবেদন পেলেও ১৮৯৩-১৯৭৪ সালের মধ্যে কংগ্রেস ৩০০টি আবেদন পেয়েছে। কিন্তু মার্কিন সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের এ পদ্ধতিটি এ পর্যন্ত একবারও কার্যকর হয় নি।
জ. মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বৈরাচারের সুযোগ রয়েছে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের তিন-চতুর্থাংশের অনুমোদন না পেলে সংবিধান সংশোধন করা যায় না। মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজ্য একজোট হয়ে সংশোধনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যান্য জনবহুল রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ সংশোধনের পক্ষপাতি হলেও সীমিত জনসংখ্যার অধিকারী কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্য সংশোধনের বিরোধিতা করে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে পারে ।
ঝ. মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সাংবিধানিক পরিবর্তনের পথেই হয়ে থাকে। সাংবিধানিক পরিবর্তন যদিও আইনগত পরিবর্তন, তথাপি এতে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয় না। অনুরূপভাবে, মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যসমূহের আইনসভার সম্মতির প্রয়োজন হলেও অঙ্গরাজ্যসমূহের গভর্নরের কোনো প্রকার সম্মতির প্রয়োজন হয় না।
মার্কিন সংবিধানের সংশোধনীসমূহ
Amendments of the Constitution of USA
১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘Federal State’-এর শুভযাত্রা ঘটে। প্রাথমিকভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন অঙ্গরাজ্যসমূহের মতপার্থক্য থাকলেও অবশেষে ১৭৮৯ সালে ১৩টি অঙ্গরাজ্যের অনুমোদনক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘Federal State’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ক… এবং তাঁরা একটি Federal Constitution’ রচনা করে। ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে একটি প্রস্তাবনা ও ৭টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত মার্কিন সংবিধান গৃহীত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে মার্কিন সংবিধানের সংশোধন করতে হয়েছে। মূলত মার্কিন সংবিধান হচ্ছে গণতন্ত্রের এক জীবন্ত দলিল, যা যুগের প্রয়োজনের তাগিদে পরিমার্জিত ও সংশোধিত হয়েছে। মার্কিন সংবিধান প্রবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। মার্কিন সংবিধান প্রণয়নের মাত্র দুই বছরের মাথায় অর্থাৎ, ১৭৯১ সালের মধ্যেই সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী আনা হয়। মার্কিন সংবিধানের সংশোধনীসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
প্রথম সংশোধনী : সংবিধান প্রণয়নের দশ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৭৯১ সালে সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী কার্যকর করা হয়। প্রথম সংশোধনীর মূল কথা ছিল জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, যার অর্থ হলো স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ (Freedom of Opinion) ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (Freedom of Press)।
দ্বিতীয় সংশোধনী : মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে দুটি ব্যাপারে নির্দেশনা ছিল। এগুলো হলো :
১. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন, যা হবে সকল অঙ্গরাজ্যের অনুমোদন সাপেক্ষে ।
২. জনগণের অস্ত্র রাখা ও বহন করার অধিকার প্রদান প্রসঙ্গে ।
তৃতীয় সংশোধনী : এই সংশোধনী ছিল ‘Quartering of Soldiers’ সংক্রান্ত। কোনো মালিকের বাড়িতে সৈন্য সমাবেশ করার জন্য আইনসম্মত দিকগুলো এতে সন্নিবেশিত করা হয়।
চতুর্থ সংশোধনী : এই সংশোধনীর বিষয় ছিল নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা বিধান করা এবং বিনা বিচারে কাউকে
আটক না করা সংক্রান্ত ।
পঞ্চম সংশোধনী : সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও নৌবাহিনী কর্তৃক একই অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দু’বার আটক করে তাঁর ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না ।
ষষ্ঠ সংশোধনী : মার্কিন সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী ছিল ‘Crime Court Procedure’ সংক্রান্ত। যার মূল বক্তব্য হলো, সকল ফৌজদারি মামলায় অপরাধী রাজ্য ও জেলায় নিরপেক্ষ জুরি কর্তৃক দ্রুত ও একান্ন বিচারের অধিকার পাবে। এক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষী থাকতে হবে।
সপ্তম সংশোধনী : এই সংশোধনীর মাধ্যমে জুরি কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো রায়কে অপর কোনো আদালতে পরীক্ষা করা নিষিদ্ধ করা হয় ।
অষ্টম সংশোধনী : এই সংশোধনীর মূল কথা হলো, অতিরিক্ত জামিনের প্রয়োজন হবে না বা অতিরিক্ত জরিমানা আরোপ করা যাবে না। আসামির উপর নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক শাস্তি আরোপ করা যাবে না ।
নবম সংশোধনী : মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী জনগণের কয়েকটি অধিকারকে অস্বীকার বা অসম্মান করা যাবে না । দশম সংধোধনী : সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে প্রদত্ত ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ও জনগণ কর্তৃক সংরক্ষিত থাকবে। একাদশ সংশোধনী : ১৭৮৯ সালে আনীত এই সংশোধনীতে রাজ্যের ভেতর ও বাইরের নাগরিকদের ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কোনো একটি রাজ্যের নাগরিক অপর কোনো রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে না। বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা প্রজাদের ব্যাপারেও একই নীতি প্রযোজ্য ।
দ্বাদশ সংশোধনী : মার্কিন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে বলা হয়েছে, “একই রাজ্য থেকে এ দুটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যাবে না।” আর তাদের নির্বাচকগণ স্ব স্ব এলাকায় মিলিত হবেন এবং রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির স্বপক্ষে ভোট প্রদান করবেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী : ১৮৬৫ সালে আনীত এ সংশোধনীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রে অথবা এর এলাকাভুক্ত কোনো স্থানে দাসপ্রথা প্রচলিত থাকতে পারবে না, তবে অপরাধের জন্য শাস্তি হলে তা প্রয়োগযোগ্য হবে না ।
চতুর্দশ সংশোধনী : ১৮৬৮ সালে আনীত সংশোধনীটিতে কয়েকটি ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ : ধারা-১ : যুক্তরাজ্যের যে কোনো রাজ্যে জন্মলাভকারী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে।
ধারা-২ : জনসংখ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব সমানভাবে ভাগ করতে হবে। ২১ বছর বয়স্ক ভোটারদের ভোটাধিকার অন্যায়ভাবে ক্ষুণ্ন করা যাবে না ।
ধারা-৩ : রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দায়ে দোষী সাব্যস্ত কোনো ব্যক্তি সিনেট হতে আরম্ভ করে নিম্ন কোনো পদে নির্বাচনের জন্য বিবেচিত হতে পারবে না ।
ধারা-৪ : সরকারি ঋণ এবং চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তদের ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
পঞ্চাদশ সংশোধনী : ১৮৭০ সালের এ সংশোধনীতে দাস ও নিম্ন বর্ণের জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ।
ষোড়শ সংশোধনী : ১৯১৩ সালে আনীত এ সংশোধনীতে বলা হয়, আয়ের উপর কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে কংগ্রেসের উপর। এ দায়িত্ব পালনে কংগ্রেস বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ভাগাভাগি অথবা সংখ্যা গণনার বিষয় বিবেচনা করতে বাধ্য থাকবে না।
সপ্তদশ সংশোধনী : ১৯১৩ সালে আনীত এ সংশোধনীতে সিনেট নির্বাচন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্য থেকে দু’জন করে সিনেটর নিয়ে সিনেট গঠিত হবে। সিনেটরগণ জনগণ কর্তৃক ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন । প্রত্যেক সিনেটরের একটি করে ভোট থাকবে । প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচকদের যথাযথ যোগ্যতা থাকতে হবে ।
অষ্টাদশ সংশোধনী : ১৯১৯ সালের এ সংশোধনী অনুযায়ী মাদকদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় অথবা পরিবহন নিষিদ্ধ অথবা এসব দ্রব্যের আমদানি কিংবা রপ্তানিও নিষিদ্ধ করা হয়।
উনিশতম সংশোধনী : ১৯২০ সালের এ সংশোধনী অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশতম সংশোধনী : ১৯৩৩ সালে আনীত এই সংশোধনীতে নিম্নোক্ত কয়েকটি ধারার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়: ধারা-১ : জানুয়ারি মাসের বিশ তারিখ দুপুরে রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হবে। সিনেটর এবং প্রতিনিধিসভার সদস্যদের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারি মাসে ৩ তারিখ দুপুরে। এরপর তাদের উত্তরাধিকারীদের কার্যকাল ও মেয়াদ আরম্ভ হবে।
ধারা-২ : প্রতি বছর অন্তত একবার কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। আইনের দ্বারা অন্য কোনো রকম বিধানে কংগ্রেসের এই অধিবেশন না করা হলে জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ দুপুরে আরম্ভ হবে।
ধারা-৩ : রাষ্ট্রপতির মৃত্যু হলে গেলে বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। উভয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা মারা গেলে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেবে কে রাষ্ট্রপতি হবে।
একুশতম সংশোধনী : ১৯৩৩ সালে আনীত এ সংশোধনীতে আইন অমান্য করে মাদকদ্রব্য বহন, আমদানি অথবা সরবরাহ ও বণ্টন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয় ।
বাইশতম সংশোধনী : ১৯৫০ সালে আনীত বাইশতম সংশোধনীর মাধ্যমে একই ব্যক্তির দু’বারের বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয় ।
তেইশতম সংশোধনী : ১৯৬১ সালে আনীত এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ৷
চব্বিশতম সংশোধনী : ১৯৬৪ সালে আনীত এই সংশোধনীতে কর পরিশোধ না করার কারণে ভোটাধিকার খর্ব না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
পঁচিশতম সংশোধনী : ১৯৬৭ সালে আনীত এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, মৃত্যু অথবা পদত্যাগ করলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন সে ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা দেয়া হয় ।
ছাব্বিশতম সংশোধনী : ১৯৭১ সালে আনীত এই সংশোধনীতে ভোটারদের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে আনীত উপরিউক্ত সংশোধনীসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা সহজেই বলতে পারি এসকল সংশোধনী প্রতিটি যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা যুগের প্রয়োজনেই গৃহীত হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের সংশোধনীসমূহের মধ্যে ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা নির্মূল বিষয়ক ত্রয়োদশ সংশোধনী ও ১৯২০ সালের নারী ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংশোধনী মানব ইতিহাসে এক অনবদ্য দলিল হিসেবে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। তাছাড়া অপরাপর সংশোধনীসমূহের আলোকে মার্কিন সংবিধানের ন্যূনতম দোষ-ত্রুটি পরিমার্জনের মাধ্যমে বর্তমানে একটি সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ অবয়ব লাভ করেছে।
মার্কিন সংবিধানের অনানুষ্ঠানিক সংশোধন প্ৰক্ৰিয়া
Informal Amending Procedures of the Constitution of USA
মার্কিন সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সংশোধন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মার্কিন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিই একমাত্র উপায় নয়। তা যদি হতো তবে মার্কিন সমাজের পরিবর্তিত অবস্থা এবং গতিশীল জাতীয় জীবনের প্রয়োজনের সাথে এ সংবিধান সঙ্গতি রক্ষা করতে পারত না। সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হতো এবং সংবিধান মূল্যহীন হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। আনুষ্ঠানিক সংশোধন ছাড়াই মার্কিন সংবিধান মার্কিন সমাজ ও সমাজবাসীদের প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হয়েছে এবং সামাজিক পরিবর্তন ও জাতীয় জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পেরেছে। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক সংশোধন পদ্ধতি দুরূহ হলেও মার্কিন শাসনব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন ব্যাহত হয় নি। যে কারণে মার্কিন সংবিধানকে একটি ‘জীবন্ত সংবিধান’ (a living constitution) বলা হয়। অধ্যাপক মুনরো (Munro) এর মতে, “মার্কিন জাতির রূপান্তরের সাথে সাথে মার্কিন সংবিধানেরও পরিবর্তন ঘটেছে।” তাঁর কথায়, “The American Constitution has necessarily changed as the nation has changed. ” মার্কিন সংবিধান সামাজিক মুক্তির বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে নি, বরং পুঁজিবাদী মার্কিন সমাজব্যবস্থার বিকাশ ও অগ্রগতিতে প্রয়োজনমতো সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছে। আনুষ্ঠানিক সংশোধন ছাড়াই মার্কিন সংবিধানের এ গতিশীলতা বা
পরিবর্তনশীলতার কারণ হিসেবে বিচারালয়ের ভাষ্য ও রায়, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রথা, কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইন প্রভৃতির কথা বলা হয়। এসব কারণে মার্কিন সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হয়েও বাস্তবে সুপরিবর্তনীয়তা ও গতিশীল চরিত্র লাভ করেছে।
মার্কিন সংবিধানের ব্যাখ্যাকারক তথা অভিভাবক হলো সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্ট সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুধাবন করে সংবিধান ব্যাখ্যা করে থাকে। ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট মার্কিন সংবিধানের মূল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখেও সংবিধানের সংশোধন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন মামলার রায়দানকালে সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয় করে তুলেছে। ফলে মার্কিন সংবিধান সংশোধনের সমস্যা ও জটিলতা দূর হয়। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন-এর মতানুসারে, মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট একটি সাংবিধানিক সম্মেলনের ন্যায় কাজ করে। এ সম্মেলনের অধিবেশন বিরতিহীনভাবে চলে। অগ ও রে (Ogg and Ray) তাঁদের ‘Essential of American Government’ এছে মন্তব্য করেছেন যে, সুপ্রিমকোর্ট শুরু থেকেই একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংবিধানিক সম্মেলন হিসেবে সংবিধান ব্যাখা করে আসছে। ফলে সংবিধানের সম্প্রসারণ ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে। এমনও বলা যায় যে, সুপ্রিমকোর্টের প্রত্যেক সাপ্তাহিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সংবিধান ক্ষেত্রবিশেষে নতুন রূপ লাভ করেছে ।
শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রথা মার্কিন সংবিধানের অনেক পরিবর্তন সাধন করেছে। আনুষ্ঠানিক সংশোধন ছাড়াও মার্কিন সংবিধান শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রথার দ্বারাও সম্প্রসারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে মার্কিন কেবিনেট ব্যবস্থা, কার্যত রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইন, শাসন ও বিচার বিভাগীয় কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু রীতিনীতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সংশোধনের সমস্যা ও জটিলতাকে যেমন অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে তেমনি সংবিধানের নমনীয়তা ও গতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুতপক্ষে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির উদ্ভব সংবিধানকে অনেকাংশে সুপরিবর্তনীয় করে তুলেছে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare) বলেন, “Usage and convention can bring changes which the law cannot comprehend.”
মার্কিন সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেস প্রণীত আইনের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সংবিধানের অনেক শূন্যস্থান কংগ্রেস প্রণীত আইনের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। মার্কিন কেবিনেট ও অন্যান্য বহু প্রশাসনিক বিভাগ, সুপ্রিমকোর্টের অধস্তন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রভৃতি কংগ্রেস আইনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ।
পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন সংবিধানের আনুষ্ঠানিক সংশোধন পদ্ধতি দুরূহ ও দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়া সত্ত্বেও যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন সমাজ ও জাতীয় জীবনের ক্রমবিবর্তনের ক্ষেত্রে সংবিধান কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, বরং প্রয়োজনমতো সহযোগিতা করেছে। এসকল কারণে অনেকে দাবি করেন যে, ব্রিটিশ সংবিধানের তুলনায় মার্কিন সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। তবে মার্কিন সংবিধানের এ নমনীয়তা আনুষ্ঠানিক সংশোধন পদ্ধতির ফল নয়। মার্কিন সংবিধানের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির পরিবর্তে অন্যান্য পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার উপর অধিক নির্ভরশীল। আর এসব প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল সংবিধান সময়ের চাহিদা অনুসারে নমনীয় হয়েছে।