মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে তুলনা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে তুলনা

Comparison between the Law Making Process of the USA & the UK

বিলের প্রকারভেদ

Types of Bills

যে সকল আইনের খসড়া গ্রহণের জন্য কংগ্রেসের নিকট উপস্থাপন করা হয় তাদেরকে ‘বিপ’ (Bill) বলে। যুক্তরাজ্যে ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘সরকারি বিল’ বলে কোনো বিল নেই। এখানে দু’ধরনের বিল থাকে, যথা- ক) প্রাইভেট বিল (Private, Bills) এবং খ) পাবলিক বিল (Public Bills)। যেসব বিলের সঙ্গে সরকারি নীতি বা বৃহত্তর স্বার্থ অঙ্কিত থাকে সেশন বিলকে পাবলিক বিল এবং যেসব বিলের সাথে বিশেষ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির স্বার্থ অড়িত থাকে সেসন বিপকে বাইে বিল বলা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতিদের বিধবা পত্নীদের পেনশন প্রদান, পোস্ট অফিস কিংবা সৈন্যবাহিনীর যানবাহন কর্তৃক যেসব ব্যক্তির ক্ষতি সাধিত হয় তাদের ক্ষতিপূরণ দানের বিষয় ইত্যাদি প্রাইভেট বিলের অন্তর্ভুক্ত ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস অনেক সময় বিল ছাড়াও যৌগ প্রস্তাব (Joint Resolution) এবং যুগ্ম প্রস্তাব (Concurren Resolution) পাস করতে পারে। যৌথ প্রস্তাব এবং বিলের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও উভয়ের পরিচিত পরিব্যাপ্তি এবং উদ্দেশ্যের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সাময়িকভাবে কোনো আইন প্রবর্তনের জ যৌথ প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়। বিলের মতোই এই প্রস্তাবগুলোকে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে গৃহীত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেই কেবলমাত্র এগুলো আইনে পরিণত হয়। কিন্তু যুগ্ম প্রস্তাব পাস করার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, এসব প্রস্তাব কখনোই আইনের মতো কার্যকর হয় না। যুগ্ম প্রস্তাব পাস করে কংগ্রেস কোনো একটি বিষয়ে তার উদ্দেশ্য বা মতামত জ্ঞাপন করে মাত্র।

কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত যে কোনো একটি বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করলেই কেবলমাত্র আইনে পরিণত হয় এবং বাস্তবে কার্যকর করা যায়। মার্কিন কংগ্রেসে একটির বিলের আইনে পরিণত হওয়ার পদ্ধতিকে ৫টি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। নিম্নে এসকল পর্যায়সমূহ আলোচনা করা হলো :

১. বিল উত্থাপন (Introduction of Bill) : অর্থ বিল ব্যতীত অন্য সকল বিল কংগ্রেসের যে কোনো কক্ষে পেশ করা যায় । অর্থ বিল একমাত্র প্রতিনিধি সভায় পেশ করা যায়। সাধারণত বিল পেশকারী সদস্যের নামেই আইনটি খ্যাতি লাভ করে। প্রথমে সিনেট বা প্রতিনিধি সভার যে কোনো সদস্য স্বীয় কক্ষে বিল পেশ করতে পারেন। সিনেটের সেক্রেটারী এবং প্রতিনিধি সভার ক্লার্কের টেবিলে বিল উত্থাপনের জন্য একটি ‘বাক্স’ (Hopper) নির্দিষ্ট থাকে। উত্থাপক সদস্য নিজের স্বাক্ষরযুক্ত বিলের খসড়া প্রস্তাবটি সে বাক্সে ফেলে দিলে বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে বলে গণ্য হয়। এভাবে বিল উত্থাপনকেই বিলের ‘প্রথম পাঠ’ (first reading) বলা হয়।

২. কমিটি পর্যায় (The Committee Stage) : মার্কিন ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের নেতৃত্ব কমিটির হাতে ন্যস্ত রয়েছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন-এর ভাষায়, মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিসমূহ ক্ষুদে আইনসভায় রূপ লাভ করেছে। যে কারণে উত্থাপনের পর বিলের শিরোনাম / বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিলটি সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে (Standing Committee) প্রেরণ করা হয়। ১৯১০-১১ সালের পূর্বে কোনো বিল কোনো কমিটির নিকট প্রেরণ করা হবে তা নির্ধারণ করতেন প্রতিনিধি সভার স্পিকার। কিন্তু বর্তমানে প্রতিনিধি সভার স্পিকার আর এককভাবে এ কাজটি করেন না। প্রতিনিধি সভার স্পিকার বা সিনেটের সভাপতি উভয়েরই দায়িত্ব হলো বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিলকে সংশ্লিষ্ট কমিটির নিকট পাঠানো। আইন প্রণয়ন সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা তা প্রকৃতপক্ষে এ কমিটিগুলোতেই হয়ে থাকে। যেসমস্ত বিল কমিটি সমর্থন করে সেগুলোই কেবল কংগ্রেসে পেশ করা হয়। .

কমিটির নিকট বিল প্রেরণের পর প্রথমেই সংশ্লিষ্ট কমিটি বিলের গুরুত্ব সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করে। কমিটি যেসব বিলকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সেগুলো সম্পর্কে কোনো আলোচনা না করে ফাইল বন্দী করে রাখা হয়। সাধারণত শতকরা ৫০-৭৫ ভাগ বিলের উপর কমিটিতে কোনো আলোচনা হয় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিলসমূহকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কমিটি বিচার-বিশ্লেষণ করে। এসব বিল বিচার-বিশ্লেষণের সময় কমিটি নানা সূত্র থেকে সংশ্লিষ্ট বিল সম্পর্কে তথ্য ও মতামত সংগ্রহ করে। প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি সূত্র থেকে অর্থাৎ শুনানি (Public hearing), বিভিন্ন স্বার্থ- গোষ্ঠীর প্রতিনিধি কিংবা শাসন বিভাগীয় কর্মচারীগণ কর্তৃক প্রদত্ত সংবাদাদি এবং আইন বিষয়ক রেফারেন্স কমিটির বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাদি থেকে সংশ্লিষ্ট বিল সম্পর্কে কমিটিগুলো সংবাদ সংগ্রহ করে। কাজের চাপ বেশি হলে কমিটিগুলো প্রয়োজনে

উপ-কমিটি (Sub-committee) গঠন করে উপ-কমিটির নিকট সমগ্র বা আংশিকভাবে বিলটি বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস প্রতিটি কমিটির কাজে সাহায্য সহায়তা করার জন্য ‘রিসার্চ স্টাফ’ (Research Staff) নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।

আইন প্রণয়নের এই স্তরে রাষ্ট্রপতি কমিটিগুলোর প্রভাবশালী সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আইন প্রণয়ন পদ্ধতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। তাছাড়া, বিভিন্ন প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী কমিটির সদস্যদের প্রভাবিত করে নিজেদের অনুকূলে আইন পাস করাতে সক্ষম। উত্থাপিত বিলটিকে বিস্তারিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণের পর কমিটি সংশ্লিষ্ট বিলটি সম্পর্কে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে :

ক. কোনো প্রকার সংশোধন না করে বিলটিকে অবিকৃত অবস্থায় গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিকট সুপারিশ করতে পারে ।

খ. বিলের সামান্য কিছু অংশের পরিবর্তন করে সেই পরিবর্তিত বিলটিকে গ্রহণ করার জন্য কক্ষের নিকট সুপারিশ করতে

গ. মূল বিলের কেবলমাত্র শিরোনামটি ব্যতীত বাকী সব অংশ পরিবর্তন করে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিকট রিপোর্ট করতে পারে।

ঘ. বিলটিকে গ্রহণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিকট সুপারিশ করতে পারে।

ঙ. বিলকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে এমন সময় কক্ষের নিকট রিপোর্ট পেশ করে যখন সময়ের অভাবে সংশ্লিষ্ট কক্ষ বিলটিকে পাস করতে পারে না ।

সাধারণত কমিটির চেয়ারম্যান কিংবা তাঁর মনোনীত কোনো সদস্য বিল সম্পর্কে কক্ষের নিকট রিপোর্ট পেশ করেন । গুরুত্বপূর্ণ বিলের ক্ষেত্রে কমিটিকে বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। তবে কোনো কমিটিকে তার কাছে প্রেরিত বিল সম্পর্কে রিপোর্ট প্রেরণে বাধ্য করার কোনো বিধান নেই। উত্থাপিত বিলটি পর্যালোচনার পর কমিটি অনাবশ্যক মনে করলে বিলটির পাঠ এখানেই সমাপ্তি ঘটে। সদস্যগণের পক্ষে সব বিল পর্যালোচনা করাও অসম্ভব। লক্ষ করা গেছে যে, শতকরা ৯৫টি বিলই এ স্তরে শেষ হয়ে যায়। যেসব বিল অনুমোদিত হয় তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান ও বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৩. প্রতিনিধি সভায় বিলের অনুমোদন : কমিটির রিপোর্টসহ বিলটি কক্ষের নিকট ফেরত আসার পর প্রতিনিধি সভার ক্লার্ক প্রকৃতি ও শ্রেণি অনুযায়ী বিলটিকে তালিকাভুক্ত করেন। এই তালিকাকে ক্যালেন্ডার বলা হয়। প্রতিনিধি সভায় তিন প্রকার ক্যালেন্ডার রয়েছে। বিলের প্রকৃতি অনুযায়ী ক্যালেন্ডারসমূহ হলো :

ক. ইউনিয়ন ক্যালেন্ডার (The Unoin Calender) : রাজস্ব ও বিনিময় সংক্রান্ত বিলসমূহ ইউনিয়ন ক্যালেন্ডারের

অন্তর্ভুক্ত।

খ. হাউস ক্যালেন্ডার (The House Calender) : পাবলিক বিলসমূহ হাউস ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত।

গ. প্রাইভেট ক্যালেন্ডার (The Private Calender) : সমস্ত প্রাইভেট বিলসমূহ প্রাইভেট ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত।

রাজস্ব ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলোকে বিচার-বিবেচনার জন্য প্রতিনিধি সভা ‘সমগ্র কক্ষ কমিটি’ (Committee of the whole house) হিসেবে কাজ করে। এ সময় স্পিকারের পরিবর্তে স্পিকার কর্তৃক মনোনীত একজন চেয়ারম্যান সভার কার্য পরিচালনা করেন। সভার সাধারণ নিয়মকানুন এ সময় শিথিল করা হয়। ১০০ জন সদস্য উপস্থিত থাকলে সমগ্র কক্ষ কমিটির ‘কোরাম’ (Quorum) পূর্ণ হয় এবং সভার কাজ চলতে থাকে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক সদস্যকে পাঁচ মিনিটের বেশি বক্তৃতা করতে দেয়া হয় না। এ কমিটির আলোচনাকে বিলের ‘দ্বিতীয় পাঠ’ (Second reading) বলা হয় । সমগ্র কক্ষ কমিটি বিলটি সম্পর্কে বিচার-বিবেচনার কার্য সমাপ্তি পর সভা পুনরায় প্রতিনিধি সভা হিসেবে বিলটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

প্রতিনিধি সভায় বিল সম্পর্কে বিতর্কের সমাপ্তি ঘটলে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে প্রতিনিধি সভায় বিলের উপর ব্যালটের মাধ্যমে গোপন ভোটদান পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। প্রতিনিধি সভায় বিলের উপর ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত চারটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় :

ক. প্রথমে সদস্যগণ মৌখিকভাবে (Vote by voice), অর্থাৎ চিৎকার করে ভোটদান করেন।

খ. এরূপ মৌখিক ভোটদানের ফলাফল সম্পর্কে সদস্যগণ প্রশ্ন তুললে ‘দাড়িয়ে ভোট’ (A rising vote) দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ পদ্ধতিতে বিলের পক্ষে ও বিপক্ষে যারা ভোট প্রদান করেন তারা দণ্ডায়মান হন এবং তাদের সংখ্যার ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারিত হয়।

গ. এরূপ পদ্ধতিতেও যদি সদস্যগণ সম্ভুষ্ট না হন তবে ভোট গণনাকারীর (Bellers) ব্যবস্থা করা হয়। ভোট গণনাকারীগণ স্পিকারের ডেস্কের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রথমে বিলের সমর্থকগণ সারি বেঁধে গণনাকারীদের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকলে তাঁদের সংখ্যা গণনা করা হয়। অনুরূপভাবে বিলের বিরোধিতাকারীদের সংখ্যাও গণনা করা হয়।

ঘ. এতেও যদি সদস্যগণ সন্তুষ্ট না হন তবে উপস্থিত সদস্যদের এক-পঞ্চমাংশের দাবিতে প্রতিনিধি সভার কার ভোটদানের জন্য সদস্যদের নাম একের পর এক ডাকতে থাকেন এবং তাঁদের ভোট লিপিবদ্ধ করেন। এভাবে ভোট গ্রহণের পর সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলের পরিণতি নির্ধারিত হয়।

৪. সিনেট কর্তৃক বিলের অনুমোদন : প্রতিনিধিসভার ন্যায় সিনেটে বিল পাসের পদ্ধতিও মোটামুটিভাবে অভিন্ন। প্রতিনিধিসভার ন্যায় সিনেটেও বিলটিকে নির্দিষ্ট কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট বিশ্বের দীর্ঘতম বিতর্ক ক্লাবের অন্যতম একটি। সিনেটে বিতর্কের সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয় না বিধায় এখানে দীর্ঘ বক্তৃতা করা সম্ভব। দীর্ঘ বক্তৃতাকে সংখ্যালঘুদের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। সিনেটরগণ ইচ্ছা করে কোনো বিলের অপমৃত্ব ঘটাতে পারেন। প্রতিনিধি সভায় পাস হওয়া বিলে সিনেট সম্মতি জ্ঞাপন করলে বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য তার নিকট প্রেরণ হয়। তবে তার পূর্বে মুদ্রিত বিলটিতে কোনো ভুলভ্রান্তি আছে কি-না তা সিনেটের ‘নিয়ম ও পরিচালনা কমিটি’ (The Senate Committee on Rules and Administration) এবং প্রতিনিধি সভার ‘পরিচালনা কমিটি’ (The Committee on House Administration) পরীক্ষা করে দেখে। এর পর প্রতিনিধি সভার স্পিকার এবং সিনেটের সভাপতির স্বাক্ষরযুক্ত বিলটি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরিত হয় ।

কিন্তু সিনেট যদি প্রতিনিধি সভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করে অর্থাৎ, উভয় কক্ষের মধ্যে যদি মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়, তাহলে বিলটিকে ‘কনফারেন্স কমিটি’ (Conference Committee)-তে প্রেরণ করা হয়। উভয় কক্ষের সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে কনফারেন্স কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিনিধি সভার স্পিকার এবং সিনেটের সভাপতি জ্যেষ্ঠতার নীতিতে এ কমিটির সদস্যদের মনোনীত করেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কমিটি উভয় কক্ষের মধ্যে মতানৈক্যের আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেন। কনফারেন্স কমিটির সুপারিশসমূহ উভয় কক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়। কক্ষ দুটি কমিটির প্রদত্ত সুপারিশ বিবেচনা করে এবং গ্রহণযোগ্য হলে তা গ্রহণ করে, তা না হলে প্রত্যাখ্যান করে। তবে আপস-মীমাংসা করতে না পারলে কনফারেন্স কমিটি কোনো সুপারিশ করে না। তখন এ কমিটিতে বিলটির অপমৃত্যু ঘটে।

৫. রাষ্ট্রপতির অনুমোদন : কংগ্রেসের উভয় কক্ষে কোনো বিল পাস হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয় । রাষ্ট্রপতি তাঁর নিকট প্রেরিত বিলটি সম্পর্কে নিম্নোক্ত তিন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন :

প্রথমত : তিনি বিলে স্বাক্ষর প্রদান, অর্থাৎ অনুমোদন দিতে পারেন। ফলে বিলটি আইনে পরিণত হবে।

দ্বিতীয়ত : তিনি যে-কোনো বিলে স্বাক্ষর প্রদানের অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারেন, অর্থাৎ ‘ভেটো’ (Veto) প্রদান করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিলটি আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিলটি পুনরায় যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হয় তবে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীতই আইনে পরিণত হয়।

তৃতীয়ত : কোনো বিলে স্বাক্ষর না করে রাষ্ট্রপতি বিলটিকে আটকে রাখতে পারেন। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য বিল প্রেরণের ১০ দিনের মধ্যে তিনি যদি বিলটিতে সম্মতি প্রদান না করেন কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কংগ্রেসের অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে তবে সংশ্লিষ্ট বিলটির স্বভাবিক অপমৃত্যু হয়। বিল নাকচের এ ব্যবস্থাকে ‘পকেট ভেটো’ (Pocket Veto) বলা হয়। রাষ্ট্রপতি ভেটো প্রয়োগ বা ভেটো প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও ট্রুম্যান যথাক্রমে ৬৩১ ও ২৫১ বার ভেটো প্রয়োগ করেছিলেন।

উপরোক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপিত কোনো একটি বিল আইনে রূপ লাভ করে। মার্কিন কংগ্রেসে বিল পাসের এই প্রক্রিয়াটিকে নিম্নে একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হলো :

প্রতিনিধি সভায় আলোচনা

পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মাধ্যমে কংগ্রেসের উপর আইন প্রণয়নের ব্যাপক ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ব্যবস্থায় একটি বিলের আইনের রূপ লাভ করতে কমিটি ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। অবশ্য সমালোচকগণ অভিযোগ করেন যে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা কিছুটা অগণতান্ত্রিক। কারণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, প্রবীণ কমিটির চেয়ারম্যানগণ প্রগতিশীল ও উদার আইন প্রণয়নে প্রতিবন্ধকস্বরূপ। সে যাহোক না কেন, দু’শতাব্দির অধিক সময় পর্যন্ত আমেরিকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান উৎস হলো কংগ্রেস। আর আগামি দিনগুলোতেও কংগ্রেস একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে এটা সুনিশ্চিত ও প্রত্যাশিত ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে তুলনা
Comparison between the Law Making Process of the USA & the UK

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তেমনি আবার অনেক ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এই দুটি রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার তুলনামূলক আলোচনা করা হলো :

ক. সাদৃশ্যসমূহ (Similarities) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে যেসকল সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে আইনের খসড়া প্রস্তাব সম্বলিত বিলসমূহকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা— সরকারি বিল (Public Bill) ও বেসরকারি বিল (Private Bill)। সরকারি বিল আবার দু’ভাগে বিভক্ত। যথা— সাধারণ সরকারি বিল ও অর্থ সম্পর্কিত সরকারি বিল ।

২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেন, উভয় দেশেই সাধারণ বিলসমূহ আইনসভার যে কোনো কক্ষে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু অর্থ সম্পর্কিত বিল আইনসভার যে কোনো কক্ষে উপস্থাপন করা যায় না। অর্থ সম্পর্কিত বিল শুধুমাত্র আইনসভার নিম্নকক্ষেই উত্থাপন করা যায় ।.

৩. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্সসভার এবং মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভায় বিল গৃহীত হবার পর তা অনুমোদনের জন্য অপর কক্ষে প্রেরিত হয়। উভয়কক্ষে বিলটি পাস হওয়ার পর বিপটিকে অনুমোদনের জন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট প্রেরণ করা হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন ব্রিটিশ রাজা বা রানী ।

৪. ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং মার্কিন কংগ্রেসের উভয়কক্ষেই যে কোনো বিলের উপর বিতর্ক হয়। বিলসমূহকে কমিশন বা কমিটির নিকট পাঠানো হয় এবং কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়।

৫. ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং মার্কিন কংগ্রেসে বিচার্য বিলের উপর সংশাধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় ও গ্রহণ করা যায়। খ. বৈসাদৃশ্যসমূহ (Dissimilarities) : ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যের পরিমাণই বেশি। বিল পাসের ক্ষেত্রে উভয় দেশের আইনসভার মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে এসব পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. ব্রিটেনের অধিকাংশ সরকারি বিল শাসন বিভাগ, অর্থাৎ মন্ত্রিগণ উত্থাপন করে থাকেন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন যে, তাদের দ্বারা উত্থাপিত সব কয়টি বিলই পাস হয়ে আইনে পরিণত হবে। কেননা, কমন্সসভায় সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান থাকে এবং মন্ত্রিপরিষদের ইচ্ছানুযায়ী বিল পাস হয়ে থাকে। যদি কমন্সসভা মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত কোনো বিল পাস করতে অসম্মত হয় তবে মন্ত্রিসভার প্রধান অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী কমন্সসভা ভেঙে দেয়ার হুমকি দিয়ে কমন্সসভাকে প্রভাবিত করতে পারেন ।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারি বিল এবং সরকারি বিলের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা যায় না। ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ কংগ্রেসের কোনো কক্ষেই উপস্থিত থাকতে পারেন না। ফলে কংগ্রেসে সকল প্রকার বিল বেসরকারি সদস্য কর্তৃক উত্থাপিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো বিলের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা বা কোনো সরকারি বিভাগের ইচ্ছা প্রভাব বিস্তার করে। তবে এক্ষেত্রে কংগ্রেসের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। অনেক সময় কংগ্রেস রাষ্ট্রপতি বা শাসন বিভাগের ইচ্ছানুসারে বিল পাস করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন, যা ব্রিটেনে কখনো হয় নি। ২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কমিটির সভাপতিগণ বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিলসমূহ কমিটির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় এবং এসব বিলের মাধ্যমে প্রণীত আইন সভাপতির নামানুসারে পরিচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের শারম্যান আইন (Sheian Law), অ্যাডামসন আইন (Adamson Law), ম্যান আইন (Mann Law) প্রভৃতির নামকরণ হয়েছে।

অপরদিকে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন সংক্রান্ত যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্ব সরকার তথা মন্ত্রীদের উপর ন্যস্ত করা হয়। মন্ত্রিগণ বিল পাসের প্রতিটি স্তরের সাথেই জড়িত থাকেন। ব্রিটেনে কমিটিসমূহের সভাপতিগণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন না, বরং সভাপতিগণ যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিটির সভাপতিগণ যথেষ্ট ক্ষমতাবান এবং তাঁরা অতি সহজেই কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করেন। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হবার জন্য বেশ প্রতিযোগিতা দৃষ্ট হয়, কিন্তু ব্রিটেনে তা দেখা যায় না ।

৩. ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিলের প্রথম পাঠ কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক। সাধারণভাবে পরিষদ প্রক্রিয়ায় কোনো বিলের শিরোনাম ছাপা হলেই বিলের প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পাঠের (First reading) পরেই বিলটি কোনো না কোনো কমিটিতে প্রেরিত হয়ে থাকে এবং পরে তা বিলের আকারে ছাপা হয়। কিন্তু ব্রিটেনে কোনো বিলের দ্বিতীয় পাঠ (Second reading) শেষ হলেই কেবল তা কমিটিতে প্রেরণ করা হয় ।

৪. ব্রিটেন কমন্সসভা এবং লর্ডসভা কর্তৃক বিলসমূহের মৌলিক নীতিমালা অনুমোদিত হবার পরপরই, অর্থাৎ বিলের দ্বিতীয় পাঠের পরই বিলগুলো বিভিন্ন কমিটিতে প্ররেণ করা হয়। কমিটির সদস্যগণ খুব ভালো করেই জানেন যে, তাদের সম্মুখে যেসমস্ত বিল আনীত হয় সেগুলো শেষ পর্যন্ত অবশ্যই পাস হয়ে যাবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা হয় না। সেখানে বিলের সাধারণ নীতিসমূহ আলোচিত হবার পূর্বেই বিলসমূহ কমিটিতে প্রেরিত হয়ে থাকে। ফলে এমন অবস্থা হতে পারে যে, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত যদি বিলের সাধারণ নীতিমালা সম্পর্কে আপত্তি করেন তা হলে সদস্যদের সমগ্র পরিশ্রমই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রে বিল পাসের ব্যাপারটি অনেকটা অনিশ্চিত; কিন্তু ব্রিটেনে বিল পাসের ব্যাপারটি তুলনামূলকভাবে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় ৷

৫. ব্রিটেনের কমন্সসভার কমিটিসমূহ কোনো বিলকে বানচাল করে দিতে পারে না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের কমিটি সমূহ যে কোনো বিলকে বানচাল করে দেয়ার অধিকার ভোগ করে। সেখানে কমিটিগুলো বিলসমূহকে পরীক্ষা করার পর তাদের সম্পর্কে বিবরণ পেশ করে থাকে; আবার অনেক সময় তাদের ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে কোনো বিল সম্পর্কে বিবরণ পেশ নাও করতে পারে। এমনিভাবে যখন কোনো বিলের বিবরণ পেশ না করা হয় তখন উক্ত বিলটি অগ্রাহ্য হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ব্রিটেনে কমিটিগুলো যে কোনো বিলের বিবরণ পেশ করতে বাধ্য থাকে। এদিক হতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের কমন্সসভার কমিটিগুলো কংগ্রেসের কমিটিগুলো অপেক্ষা দুর্বল ।

৬. ব্রিটেনের কমন্সসভায় আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত সকল বিলের উপরই সভার সদস্যগণ বক্তৃতা প্রদান করেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত সকল বিলের উপর কংগ্রেস সদস্যগণ বক্তৃতা প্রদান করেন না। সেখানে অনেক বক্তৃতা সরাসরি পরিষদে প্রদান না করে লিখিতভাবে ছাপিয়ে দেয়া হয়। কংগ্রেস সদস্যগণ মনে করে ছাপার মাধ্যমেই তাদের বক্তৃতা ভালোভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে ।

Leave a Reply