Table of Contents
Toggleমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ
Application of the Theory of Separation of Power in U.S.A.
মার্কিন শাসনব্যবস্থা একটি উন্নত শাসনব্যবস্থা এবং দেশটি পৃথিবীর একটি সেরা গণতান্ত্রিক
নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যব স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগও ঘটেছে অত্যধিক। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষরণ নীতির প্রয়োগ হওয়ার পশ্চাতে সমস্ত কারণ রয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনবान বিদ্যমান। আর এ ধরনের সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কেননা, এ ব্যবস্থায় তিনটি বিভাগের এখতিয়ার আপাদ্য। তবে রাষ্ট্রপতিই মূল ক্ষমতার অধিকারী । Borgan-এর ভাষায়, “He is the formal head of the nation, he is also the effective head of the executive.”
২. যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সামন্য রয়েছে। কেননা, মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি এতে সংযোজন করেছেন। সংবিধান প্রণেতারা ১৭৮০ সালে রচিত মার্কিন সংবিধানকে “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর রচিত একটি নাতিদীর্ঘ রচনা” বলে অভিহি
৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা চালু থাকায় এ ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। ফলে একে অপরের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও অর্থসহ রাষ্ট্রের সামগ্রিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অর্পণ করা হয়। অপরদিকে নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ অঙ্গরাজ্যের নিকট অর্পণ করা হয়।
৪. সংবিধানের প্রাধান্য : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস হলো সংবিধান। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সংবিধান অনুসারে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়ে থাকে এবং উভয় সরকার সংবিধান কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ডাইসি (Diecy)-এর মতে, “The constitution of the united states is the most completely federal constitution in the world.”
৫. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। এমনকি সংবিধানের অভিভাবকত্বও বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার কথা বলা যায়।
৬. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত রয়েছে। এই আদালত কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক সরকারের আন্তঃবিরোধ মীমাংসা করে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত।
৭. জনগণের সার্বভৌমত্ব : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। মার্কিন সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে যে, “We the people of the United States.” আর জনগণের সার্বভৌমত্ব গণতন্ত্রের ভিত্তিস্বরূপ। গণতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পথ সুগম হয়। তাই বলা যায়, জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষিতে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি যুক্তিযুক্ত।
৮. ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ : ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ দেখা যায়। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকৃত। ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণে জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা অপরিহার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো যথেষ্ট পরিমাণে গৃহীত হয়েছে।
৯. নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির একটি ইতিবাচক দিক হলো নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি। এ নীতির মূল প্রতিপাদ্য হলো সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোনোটির অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী না হওয়া। সকল বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকাই হলো ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বাস্ত বসম্মত হওয়ায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনেকটা কার্যকরী।
উপরিউক্ত আলোচনার পর এটাও বলা যায় যে, মার্কিন সংবিধান প্রণেতারাও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে গুরুত্ব প্রদান করেই সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। হ্যামিল্টন ও ম্যাডিসনসহ অনেকেই সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে এ নীতির পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। সংবিধান প্রণেতাগণ সরকারের ক্ষমতাকে তিনটি বিভাগের হাতে পৃথক পৃথকভাবে ন্যস্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন।
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সীমাবদ্ধতা
Limitation of the Separation of Power in the Administration of U.S.A
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রযোগ হলেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রযোগ করা সম্ভन । কেননা, বিভিন্নভাবে এই নীতির কার্যকারিতা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো।
১. মার্কিন শাসনব্যবস্থায় কংগ্রেসের আধিপত্য স্বীকৃত। কংগ্রেসের আধিপত্যের কারণে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যাহত হচ্ছে। মার্কিন সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “All legislative powers here granted shall be vested in Congress of the United States.”
২. মার্কিন শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির আধিপত্যের কারণে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ অনেকটা সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ব্যতীত কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। ফলে তিনি একাধারে আইন ও শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা ভোগ করেন।
৩. মার্কিন শাসনব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটের অনুমোদন আবশ্যক। সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন না। ফলে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাধাগ্রস্ত হয় ।
৪. মার্কিন শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগ ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় ব্যর্থ। কেননা, বিশ্লেষকদের মতে, সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা উপেক্ষিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অতটা কার্যকরী নয়।
৫. শ্রমিককল্যাণ বিরোধী কোনো নীতি ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের সফলতা আনতে পারে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কখনো কখনো শ্রমিক কল্যাণ বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ হয়নি। তবে এ তত্ত্ব এখানে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে গৃহীত ও সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে বিধায় বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ প্রয়োগ অসম্ভব। যে কারণে মনীথী জিঙ্ক ( Jink) বলেন, “A complete separation of powers is hardly feasible in practice.”