Table of Contents
Toggleমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।
মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট অপরাপর যে কোনো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তুলনায় অনেক বেশি সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী। আইনের ব্যাখ্যা ও বৈধতা বিচার এবং সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা তার ক্ষমতা ও কার্যাবলির পরিধিকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছে। কোনো নির্দিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে এমন ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন যাতে করে সে প্রত্যেক সরকারি সংস্থা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে কি-না তা নির্ধারণ করতে পারে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে। যে কারণে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টকে মার্কিন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক বলা হয় ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার কাঠামো বা সংগঠন
Federal Judicial Structure
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের কাঠামো অনেকটা পিরামিডের আকৃতির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিরামিড আকৃতির আদালতসমূহকে দুটি ভাগ করা যায় । যথা—
১. সাবিধানিক আদালতসমূহ (Constitutional Courts);
২. বিশেষ আদালতসমূহ (Special Courts)।
১. সাবিধানিক আদালতসমূহ (Constitutional Courts) : মার্কিন সংবিধানের ৩নং ধারা অনুসারে সাংবিধানিক আদালতসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবিধানিক আদালত তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট। সংবিধানের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা একটি সুপ্রিমকোর্ট এবং বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস কর্তৃক স্থাপিত ‘অধস্তন আদালতসমূহ’ (Inferior Courts) এর হাতে অর্পণ করা হয়েছে। যদিও এসব অধস্তন আদালত স্থাপন করতে কংগ্রেসকে বাধ্য করা যায় না তথাপি প্রয়োজন মনে করলে কংগ্রেস স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব আদালত প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ১৭৮৯ সালের ‘বিচার বিভাগ সংক্রান্ত আইন’ (The Judiciary Act of 1789) থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত নানা প্রকার আইন প্রণয়ন করে কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রীয় অধস্তন আদালতসমূহের প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’ধরনের অধস্তন যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত রয়েছে। এগুলো হলো : যুক্তরাষ্ট্রীয় আপিল আদালত (Federal Courts of Appeal) এবং জেলা আদালত (District Courts) সমূহ। তবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হলো সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকা (Original jurisdiction) এবং আপিল এলাকা (Appellate Jurisdiction) উভয়টি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় আপিল আদালত এবং জেলা আদালতসমূহের কেবল যথাক্রমে আপিল এলাকা ও মূল এলাকা রয়েছে। পূর্বোক্ত তিন প্রকার আদালত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ আদালত (Special Courts) রয়েছে। নিম্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার বিভিন্নস্তরের আদালতসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. সুপ্রিমকোর্ট (The Superme Court) : মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিমকোর্ট হলো মার্কিন জাতির সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন পিরামিড আকৃতির বিচারব্যবস্থার শীর্ষদেশে অবস্থিত। অগ ও রে (Ogg and Ray ) ম ব্য করেন, “At the top of the system stands our most august tribunal the supreme court of the United States” সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকা (Original Jurisdiction) এবং আপিল এলাকা (Applellate Jurisdication) উভয় এলাকাই রয়েছে। জন্মলগ্নে সুপ্রিমকোর্ট কোনো শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের ন্যায় ঐতিহ্যবাহী ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে এ আদালত স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তির বলয় এমন এককভাবে বৃদ্ধি করেছে যে একে সন্দেহাতীতভাবে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। আর এ ধরনের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতির কারণেই আইন ও সংবিধানের যে কোনো ব্যাখ্যায় সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয় ।
খ. যুক্তরাষ্ট্রীয় আপিল আদালত (Federal Courts of Appeal) : ১৮৯১ সালে কংগ্রেস আপিল আদালত গঠন করে এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এসকল আদালত ভ্রাম্যমাণ আপিল আদালত নামে পরিচিত ছিল। সুপ্রিমকোর্টের আপিল সংক্রান্ত মামলার ভার লাঘব করার জন্যই ভ্রাম্যমাণ আপিল আদালত গঠন করা হয়। এসকল আদালতের কেবলমাত্র আপিল সংক্রান্ত এখতিয়ার রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ১১টি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেক অঞ্চলকে একট করে আপিল আদালতের আয়ত্তাধীন করা হয়েছে। এসকল আদালতে জেলা আদালত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যান্য আধা-বিচার বিভাগীয় প্রশাসনিক এজেন্সির রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের বিচার করা হয়। এসকল আদালত আপিল সংক্রান্ত বেশির ভাগ মামলার ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করে। কেননা, এসকল আদালতে যেসব মামলার বিচার হয়, সেগুলোর মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক মামলাই সুপ্রিমকোর্টে শুনানির জন্য প্রেরিত হয়। সুপ্রিমকোর্টের বিচারের বোঝা হ্রাস করার জন্যই এসব আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আপিল আদালতসমূহের বিচারপতির সংখ্যা ৩ থেকে ১৫ জন হয়ে থাকে। বিচারপতিদের মধ্যে থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তিনি আপিল আদালত এবং এ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত জেলা আদালত সমূহের কাজ-কর্মের তত্ত্বাবধান করেন। তিন জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিচারিক প্যানেল আপিল আদালতে মামলার শুনানি পরিচালনা করেন ।
গ. জেলা আদালত (District Courts) : যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার বিদ্যমান সাংবিধানিক আদালতসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে জেলা আদালত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যকে ৮৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটি আদালত স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া কলম্বিয়া জেলা এবং পুয়ার্তোরিকো-তে একটি করে জেলা আদালত রয়েছে। এভাবে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে ৯১টি জেলা আদালত রয়ো ২। জেলা আদালতসমূহের কেবলমাত্র মূল এলাকা বা এখতিয়ার আছে, কোনো আপিল এলাকা নেই । জেলা আদালতসমূহে যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার আয়ত্তাধীন বেশির ভাগ মামলার বিচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন ও সন্ধি, জাহাজ চলাচল ও নৌবাহিনী সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলার মূল বিচার এসব আদালতে হয়। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দেওয়ানি মামলার সংখ্যা শতকরা ৫৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ফৌজদারি বিধির সম্প্রসারণের ফলে জেলা আদালতসমূহের ফৌজদারি মামলার দায়িত্বও বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। জুরির সাহায্যে জেলা আদালতে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় আপিল আদালতে আপিল করা যায়। সাধারণত ১ থেকে ২৭ জন বিচারপতি নিয়ে জেলা আদালত গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি সিনেটের সম্মতিক্রমে অন্যান্য আদালতের বিচারকদের ন্যায় জেলা আদালতের বিচারকদের নিয়োগ করে থাকেন। কেবলমাত্র কলম্বিয়া জেলা ব্যতীত অন্য সকল জেলার জেলা আদালতের বিচারপতিদের সংশ্লষ্ট জেলার অধিবাসী হতে হয়। জেলা আদালতের অধিবেশন বিভিন্ন সময়ে জেলার বিভিন্ন শহরে বসে।
২. বিশেষ আদালত (Special Courts) : জেলা আদালত এবং আপিল আদালত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ট্রাইব্যুনাল হিসেবে তিন ধরনের বিশেষ আদালত রয়েছে। এগুলো হলো :
ক. দাবি আদালত (Court of Clamis);
খ. শুল্ক আদালত (Court of Customs) ;
গ. শুল্ক ও প্যাটেন্ট সংক্রান্ত আপিল আদালত (Court of Customs and Patent Appeals);।
এসব বিশেষ আদালত সংবিধান কর্তৃক সৃষ্টি হয়নি; কংগ্রেস বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এসব আদালত গঠন করেছে। যে কারণে বিশেষ আদালতসমূহকে ‘আইন বিভাগীয় আদালত’ (Legislative courts) হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকে। কারণ, এসমস্ত আদালত গঠনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হয় । বিশেষ আদালতের বিচারপতিগণও সিনেটের পরামর্শ ও অনুমোদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। এদের কার্যকালের মেয়াদ আজীবন ।
নিম্নে একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের কাঠামো তুলে ধরা হলো :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা
(Federal Judicial System of USA)
সাংবিধানিক আদালত (Constitutional Court)
১. সুপ্রীমকোর্ট
(এখতিয়ার : মূল এলাকা ও আপীল এলাকা মর্যাদা : দেশের সর্বোচ্চ আদালত)
↓
২. যুক্তরাষ্ট্রীয় আপীল আদালত
(এখতিয়ার : কেবলমাত্র আপীল এলাকা মর্যাদা : অধস্তন আদালত, সুপ্রিমকোর্টের পরেই অবস্থান। সংখ্যা : ১১টি। )
৩. জেলা আদালত
↓
(এখতিয়ার : কেবলমাত্র মূল এলাকা
মর্যাদা : অধস্তন আদালত, আপীল আদালতের
পরেই অবস্থান ।
সংখ্যা : ১১টি।)
বিশেষ আদালত (Special Court)
১. দাবি আদালত
২. শুল্ক আদালত
↓
৩. শুল্ক ও প্যাটেন্ট
সংক্রান্ত আদালত
সাংবিধানিক আদালত ও বিশেষ আদালতের পার্থক্য (Diferencess between Constitutional Court & Special Court) :
সাংবিধানিক আদালত ও বিশেষ আদালতের কয়েকটি বিশেষ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এগুলো হলো :
প্রথমত : সাংবিধানিক আদালতসমূহ কোন কোন মামলা ও বিরোধের বিচার করতে পারবে সে সম্পর্কে সংবিধানের ২নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ আদালতসমূহ সৃষ্টি হয়েছে আন্ত:রাজ্য বাণিজ্য, আমদানি শুল্ক (import duties) ধার্য ও সংগ্রহ, সরকারি অর্থ (public funds) ব্যয় প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করার জন্য।
দ্বিতীয়ত : সাংবিধানিক আদালতের সব বিচারপতি সিনেটের পরামর্শ ও সম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং ইম্পিচমেন্ট ব্যতীত তাঁদের পদচ্যুত করা যায় না। কিন্তু বিশেষ আদালতের বিচারপতিগণ অনুরূপ পদ্ধতিতে নিযুক্ত হলেও সাধারণত তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিযুক্ত হন এবং তাঁদের অপসারণের জন্য ইম্পিচমেন্টের প্রয়োজন হয় না।
উপরিউক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিশেষ আদালতসমূহ যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই কাজ করে এবং ঐসব আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আদালতসমূহে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রীয় আপিল আদালতে আপিল করা যেতে পারে।
সুপ্রিমকোর্ট
The Supreme Court
সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদলত। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট বর্তমানে কেবলমাত্র জাতীয় বিচার ব্যবস্থার শীর্ষের অবস্থিত নয়, এ কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো (federal questions) এর বিচার করতে পারে বিধায় সুপ্রিমকোর্টকে প্রত্যেক রাজ্যের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ আদালতও বলা হয়। অ্যালেন পটার (Allen Potter) তাঁর American Government and Politics গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “The Supreme Court of the United States is not only at the apex of the national judiciary hierarchy but also in effect the highest court of each state system for what are known as federal question.”
ক. সুপ্রিমকোর্টের গঠন : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট একজন প্রধান বিচরপতি সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা নির্ধারিত কয়েকজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হয়। সর্বপ্রথম সুপ্রিমকোর্ট ১৭৮৯ সালের ‘বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত আইন’ অনুসারে একজন প্রধান বিচারপতি এবং পাঁচ জন অন্যান্য বিচারপতি নিয়ে গঠিত হয়। ১৮০৭ সালে রাষ্ট্রপতি জেফারসনের সময় বিচারপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৭ জন করা হয়। ১৮৬৯ সালে কংগ্রেস বিচারপতিদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়। ফলে তখন থেকে বর্তমান পর্যন্ত ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং ৮ জন সহকারী বিচারপতি নিয়ে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট গঠিত ।
খ. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ ও যোগ্যতা : সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিগণ সিনেটের পরামর্শ ও অনুমোদনক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে মার্কিন সংবিধানে তেমন কিছু উল্লেখ করা হয় নি। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে দলীয় মনোভাবের দ্বারা বিশেষভাবে পরিচালিত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন স্বীয় দলের সদস্যদের মধ্য থেকেই বিচারপতি নিয়োগের উদাহরণ সৃষ্টি করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বিচরপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ নীতির প্রয়োগ হচ্ছে। তবে সর্বদাই যে রাষ্ট্রপতি নিজ দলীয় ব্যক্তিদেরকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করেন, এমন কোনো কথা নেই । রাষ্ট্রপতি হুভার নিজে রিপাবলিকান হলেও ডেমোক্র্যাট দলের এক ব্যক্তিকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি ।
সাধারণভাবে খ্যাতনামা আইনজ্ঞগণ সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলেও সর্বদা এ নীতি অনুসৃত হয় না । নিযুক্ত বিচারপতিগণ আইনজ্ঞ হলেও ১৭৮৯-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ৯২ জন বিচারপতির মধ্যে ৩৫ জনের পূর্বে বিচারপতি হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিচারপতি মার্শাল, স্টোরি ট্যানি, হিউজেস, ব্রাইভেজ ও আল ওয়ারেনের বিচার বিভাগীয় কার্যে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষত বিচারপতি মার্শাল বহু যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করে বিচার বিভাগের প্রাধান্য অটুট রেখেছিলেন ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিজে বিচারপতিদের নাম স্থির করেন না। অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর থেকে রাষ্ট্রপতির নিকট বিচারপতিদের নাম সুপারিশ করা হয়। সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পরীক্ষা করে। আমেরিকান বার এসোসিয়েশন, শ্রমিক ও মালিক সংঘও প্রস্তাবিত বিচারপতিদের ব্যক্তিপঞ্জি সম্পর্কে উৎসাহ প্রকাশ করে ।
শিক্ষা, পারিবারিক পটভূমিকা, রাজনৈতিক ও পেশাগত জীবনের দিক বিবেচনায় বিচারপতিদের একটি ‘বাছাই করা গোষ্ঠী’ নামে অভিহিত করা যায়। জন আর স্কিমিউহাউসার ১৭৮৯ এবং ১৯৫৮ সালের মধ্যে নিযুক্ত ৯২ জন বিচারপতির সামাজিক পটভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বিচারপতির নিকট জনের বিচার বিভাগীয় কার্যে নিযুক্ত থাকার ঐতিহ্য ছিল। নয় জন ব্যতীত অন্যান্য বিচারপতিগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাভোগী অংশের অন্ত র্ভুক্ত। ৯০% বিচারপতি ইংরেজ বংশোদ্ভূত এবং ৮৮% ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট। বিচারপতিগণ সক্রিয় রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবারভুক্ত। ৮০% বিচারপতি নামী আইনজ্ঞ বা প্রখ্যাত আইনজীবী ও বিচারপতিদের নিকটে আইন অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণকায় বিচারপতি হিসেবে তুর্গভ মার্শালকে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিমকোর্টে কোনো মহিলা বিচারপতি ছিলেন না। রাষ্ট্রপতি রিগান সর্বপ্রথম সুপ্রিমকোর্টে মহিলা বিচারপতি হিসেবে সানড্রা ডে ও’ কোনোর-কে নিয়োগ করেন ।
গ. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা : সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিদের বাৎসরিক বেতন ও প্রাপ্য সকল ভাতাদি সময়ে সময়ে বৃদ্ধি করা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হয়। দশ বছর বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর প্রত্যেক বিচারপতি সম্পূর্ণ বেতনসহ সত্তর বছর বয়সে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারেন যদিও সংশ্লিষ্ট আইনে অবসর গ্রহণের কোনো বয়সসীমা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা হয় নি
ঘ. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কার্যকাল ও অবসর : সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কার্যকাল সম্পর্কে সংবিধানে স্পষ্টভাবে তেমন কিছু উল্লেখ নেই। কোনো ব্যক্তি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হলে আমৃত্য কিংবা যতদিন যথাযথভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হবেন, ততদিন পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন। বর্তমানে অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের ব্যাপারে একটি প্রথা মেনে চলা হয়। তা হলো ৭০ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর বিচারপতিদের অবসর গ্রহণ কিংবা পদত্যাগ করতে হয়। কোনো বিচারপতি অন্তত ১০ বছর বিচারপতি হিসেবে বিচারকার্য সম্পাদন করে অবসর গ্রহণ কিংবা পদত্যাগ করলে তিনি পুরো বেতন পান। কোনো বিচারপতি পদত্যাগ না করে যদি কেবলমাত্র অবসর গ্রহণ করে তবে অবসরকালীন সময়েও তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি বলে বিবেচিত হন এবং যে কোনো সময় তিনি বিচারকার্য সম্পাদনের দায়িত্ব লাভ করতে পারেন। আবার রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করার পর কোনো বিচারপতিকে পুনরায় নিয়োগ করতে পারেন। এ ধরনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পরে। ১৯১০ সালের ২ মার্চ চার্লস ইভান্স হিউজ সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯১৬ সালে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার জন্য তিনি বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হুভার ১৯৩০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় তাঁকে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করেন ।
ঙ. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বিচারপতিদের পদচ্যুতির ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। তবে সংবিধানের ৩ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সদাচরণের উপর তাদের কার্যকাল নির্ভর করে। সুতরাং এদিক থেকে বিচার করলে বিচারপতিদের কার্যকালের মেয়াদ শর্তসাপেক্ষ। কংগ্রেস কর্তৃক অসদাচরণের অভিযোগ উত্থাপন করতে হয়। প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে ইম্পিচমেন্ট প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে বিচারের জন্য অভিযোগটি সিনেটে প্রেরণ করা হয় ।
চ. সুপ্রিমকোর্টের বিচার প্রক্রিয়া : সুপ্রিমকোর্টে যে কোনো মামলার বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে অন্তত ৬ জন বিচারপতির উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। বিচারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির সমর্থনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। প্রধান বিচারপতি অন্যান্য বিচারপতির চেয়ে বেশি বেতন পেলেও কোনো মামলার বিচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিচারকের চেয়ে তিনি অধিক আইনানুগ ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি সুপ্রিমকোর্টের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। প্রধান বিচারপতি নিজে যেমন রায় প্রদান করেন, তেমনি সহযোগী বিচারপতিদেরকেও রায় প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন ।
সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ার
Jurisdiction of the Supreme Court
সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সর্বোচ্চ আদালত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের হাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। যেমন :
ক. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে ।
খ. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তারূপে কাজ করে। সংবিধানের কোনো অংশের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিরোধের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃতি লাভ করে ।
গ. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন, আদেশ, সন্ধি ও চুক্তির বৈধতা বা সাংবিধানিকতা বিচার করে। এই আদালত কোনো আদেশ, আইন বা সন্ধিকে অবৈধ বা সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করলে সেগুলো আর কার্যকর হয় না।
ঘ. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট আন্তঃরাজ্য বিরোধের মীমাংসা করে।
ঙ. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারের সংরক্ষক ও অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট এসব দায়িত্ব কতটা এবং কীভাবে পালন করে তা আলোচনা করা প্রয়োজন। মার্কিন সংবিধানে সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ারকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা :
ক. মূল এলাকা (Original Jurisdiction); এবং
খ. আপিল এলাকা (Appellate Jurisdiction)।
নিয়ে এসকল এখতিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. মূল এলাকা (Original Jurisdiction) : মূল এলাকাভুক্ত মামলাসমূহ সরাসরি সুপ্রিমকোর্টের নিকট বিচারের জন্য আনা হয়। সংবিধানের ৩ (২) ধারায় বলা হয়েছে, “In all cases affecting ambassadors, other public ministers and consuls and those in which a state shall be a party, the superme court shall have jurisdiction.” অর্থাৎ, সংবিধানের ৩নং ধারায় দু’ধরনের মামলার কথা উল্লেখ আছে। প্রথমত : রাষ্ট্রদূত, অন্যান্য কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও কপাল সম্পর্কিত মামলা। দ্বিতীয়ত: যে মামলার কোনো একটি পক্ষ হিসেবে কোনো অঙ্গরাজ্য সংশ্লিষ্ট, সেসকল মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত। উপরোক্ত ধারাটি বিশ্লেষণ করলে মূল এলাকার ভিত্তিতে চার ধরনের মামলা হতে পারে। যথা :
১. রাষ্ট্রদূত, অন্যান্য কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও কন্সাল সম্পর্কিত মামলা ।
২. কোনো অঙ্গরাজ্যের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মামলা ।
৩. আন্ত:অঙ্গরাজ্যের মামলা ।
৪. কোনো অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের সঙ্গে অন্য অঙ্গরাজ্যের নাগরিক ও বিদেশিদের মামলা ।
যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কিত মামলার বিচার করতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্টকে অনেক সময় আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকর ব্যাখ্যাও প্রদান করতে হয়। তবে উল্লেখ্য যে- রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও কন্সাল প্রমুখ পদাধিকারীগণ কূটনৈতিক বিধি ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে মার্কিন আদালতের এখতিয়ারভুক্ত নন। যে কারণে এ সমস্ত মামলার সংখ্যা নিতান্তই কম। আবার যে সমস্ত মামলায় কোনো অঙ্গরাজ্য একটি পক্ষ, কংগ্রেস আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এসমস্ত ক্ষেত্রে অধঃস্তন আদালতকে যুগ্ম ক্ষমতা দিতে পারে। দুই বা ততোধিক আদালতের বিরোধ সম্পর্কিত মামলার ক্ষেত্রে কংগ্রেস এককভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছে। কিন্তু কেবলমাত্র একটি অঙ্গরাজ্য জড়িত আছে এমন মামলার ক্ষেত্রে কংগ্রেস অধঃস্তন আদালতের হাতে ন্যস্ত করতে পারে। এসমস্ত কারণে সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকা (Original jurisdiction)-এর মামলার সংখ্যা অত্যন্ত কম। ১৭৮৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট মাত্র ১২৭ টি ক্ষেত্রে তার মূল এখতিয়ারকে প্রয়োগ করেছে। মার্কিন কংগ্রেস আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতাবলির হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে না। কারণ এধরনের পদক্ষেপ সংবিধান সংশোধনের সমার্থক বলে পরিগণিত হবে। তবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার
সম্প্রসারণ সম্ভব ।
খ. আপিল এলাকা (Appellate Jurisdiction) : সংখ্যার বিচার মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের অধিকাংশ মামলা হলো আপিল সংক্রান্ত মামলা। যে কারণে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের আপিল এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা চলে। এই নিম্ন আদালত হলো অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত, আপিল আদালত, জেলা আদালত । এসকল ক্ষেত্রে আপিলের অধিকার কোনো চরম ক্ষমতা নয়। কেননা, আপিলের সঙ্গে আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত না থাকলে সুপ্রিমকোর্ট মামলা বাতিল করে দিতে পারে। আপিল এলাকার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয় (federal questions ) সংক্রান্ত মামলা। এখানে সুপ্রিমকোর্টের স্ববিবেচনার প্রশ্ন জড়িত। সুপ্রিমকোর্ট উৎক্ষেপণ পদ্ধতির (Certiorari procedure) মাধ্যমে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে। ঐ রায়ের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় জড়িত থাকলে তা বিবেচনা করে ।
যখন নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তের সাথে সংবিধানরে মৌলিক নীতির ব্যাখ্যা বা বিধিবদ্ধ আইনের ব্যাখ্যা জড়িত থাকে বা কোনো মামলার ক্ষেত্রে আপিল আদালতগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে বিরোধ থাকে অথবা যখন কোনো অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সে বিষয়টি পূর্বে কখনো নির্ধারিত হয় নি, তখন এসব ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট নিজস্ব আপিল এলাকাকে প্রসারিত করতে পারে। আপিল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করার অধিকারী হলেও দু’টি ক্ষেত্রে আপিলের আবেদন গ্রাহ্য করা বাধ্যতামূলক। যেমন :
ক. যেখানে মামলার কোনো চুক্তি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে এবং অঙ্গরাজ্যের আদালত তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
খ. যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে অঙ্গারাজ্যের আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা সত্ত্বেও অঙ্গরাজ্যের আদালত তার বৈধতা বজায় রেখেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরই সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত অর্থে আপিল আদালত ও জেলা আদালতকে বুঝায় । নিম্ন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল থেকে সরাসরি আপিল করা যায় না।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল এখতিয়ারকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : বাধ্যতামূলক এখতিয়ার এবং স্বেচ্ছাধীন বা ঐচ্ছিক এখতিয়ার । নিম্নে এসব এখতিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাধ্যতামূলক এখতিয়ার : কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ সুপ্রিমকোর্ট আপিল করতে পারে এবং সুপ্রিমকোর্ট এরূপ আপিলের শুনানি গ্রহণ করতে বাধ্য। এ ধরনের এখতিয়ারকে ‘বাধ্যতামূলক এখতিয়ার’ বলে ।
২. স্বেচ্ছাধীন বা ঐচ্ছিক এখতিয়ার : সুপ্রিমকোর্ট নিজস্ব বিবেচনায় ‘রীট অব সারসিউরেরী’ বা উৎক্ষেপণ পদ্ধতির অধীনে কতগুলো আপিল শুনানীর জন্য গ্রহণ করতে পারে- এটিই সুপ্রিমকোর্টের স্বেচ্ছাধীন বা ঐচ্ছিক এখতিয়ার। এ এখতিয়ার বলে সুপ্রিমকোর্ট লিখিত আদেশ জারি করে কোনো নিম্ন আদালত হতে কোনো মামলা পর্যালোচনার জন্য তলব করে নিতে পারে । বার্নস ও অন্যান্য লেখক যথার্থই উল্লেখ করেছেন, “সুপ্রিমকোর্ট এর বিবেচ্য বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারী। কোন কোন মামলা বিবেচনা করতে চায় তা এ আদালত নিজেই স্থির করে। সুপ্রিমকোর্টের নিকট পেশকৃত অসংখ্য মামলার মধ্যে কেবল কিছু সংখ্যক মামলা, বিশেষত জাতীয় বা সাংবিধানিক গুরুত্ববহ মামলাই শুনানির জন্য গ্রহণ করে।
সুপ্রিমকোর্টের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাসমূহ আপিল এলাকার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট বিচার বিভাগের প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম হতে অনেকটা মুক্ত। সুপ্রিমকোর্ট প্রচলিত বিধি-বিধান পর্যালোচনা করে এবং এভাবে নিম্ন আদালত ও সরকারের বিভাগসমূহের কার্যধারার পথ নির্দেশ করে। এ পথে আইন প্রণয়নকারী সংস্থার ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন শাসনব্যবস্থার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অ্যালেন পটার (Allen Potter) তাঁর American Politics and Government গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “Indeed the scope of this role-making authority make it a political institution of prime importance in the American Governmental system.” যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয় সংক্রান্ত মামলা বিচারের সময় অনেক ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টকে আস্ত জাতিক আইনেরও ব্যাখ্যা করতে হয়। সুপ্রিমকোর্ট অনুমিত ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তার আপিল এলাকাকে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে। আর আপিল বিভাগের মাধ্যমেই সুপ্রিমকোর্ট তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ বা ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের মতো মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের কোনো পরামর্শমূলক এখতিয়ার নেই ।
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা ও গুরুত্ব
Role and Importance of the American Supreme Court
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বের যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থার চেয়ে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন শাসনব্যবস্থার গতি প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট তাঁর ভূমিকাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে। নিম্নে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
ক. আইনের ব্যাখ্যা (Interpretation of Law) : মার্কিন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা হ্যামিল্টনের মতে, আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের অর্থ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা বিচারকগণ চর্চা করেন। কোনো আইন ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট তার সঠিক অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ঘোষণা করে এবং সে ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেস রচিত যে কোনো আইনের বা ধারার ব্যাখ্যা করে এবং সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোনো মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সে আইন প্রয়োগ করা
হয়। বিচারপতি মার্শাল (Marshal) মারবারী বনাম ম্যাডিসন (Marbery vs Madison, 1803 ) মামলার রায় প্রকাশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, আইনের অর্থ ব্যাখ্যা করার স্পষ্ট ক্ষমতা আদলতের আছে। তিনি বলেন “It is emphatically the province and the duty of the judicial department to say what the law is”. অর্থাৎ, আইনের অর্থ ব্যাখ্যা করার স্পষ্ট ক্ষমতা আদালতের আছে ।
খ. সবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও অভিভাবক (Interpreter and Gurdian of the constitution) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা এবং সুপ্রিমকোর্টের প্রদত্ত ব্যাখ্যা যেমন চূড়ান্ত তেমনি তা সর্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট স্ব উদ্যোগে সংবিধান ব্যাখ্যার দায়িত্ব গ্রহণ করে না। কোনো মামলার সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন জড়িত থাকলেই সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশের ব্যাখ্যা করে। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানকে যেভাবে ব্যখ্যা করে সংবিধানের অর্থ সেভাবেই স্থির হয়। সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হিউজেস ( Hughes) মন্তব্য করেছেন, “আমরা একটি সংবিধানের ছত্রছায়ায় আছি। কিন্তু সে সংবিধান বলতে কী বুঝায় তা নির্ভরশীল বিচারপতিদের সিদ্ধান্তের উপর।” (We are under a costitution, but the constitution is what the judges say it is ) । সুতরাং বিচারপতিদের ব্যাখ্যাই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। বিচারপতিগণ যেভাবে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করবেন, সংবিধানের ধারণাও সেভাবে স্থির হবে। যে কারণে অনেকে মন্তব্য করেছেন, সুপ্রিমকোর্টই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। বিচারপতি ফ্রাংকার্টার (Justice Frankfurter) এর মতে, “The Supreme Court is the Constitution.” এ ধরনের মন্তব্য অতিশয়োক্তি হিসেবে মনে হলেও মূলত বাস্তবসম্মত এবং সুপ্রিমকোর্টের কার্যকলাপের সাথে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বাস্তব রাজনীতির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচনি ফলাফল অনুযায়ী নিজের মতামতের পরিবর্তন করে। অর্থাৎ, পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে সুপ্রিমকোর্ট এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এস. ই. ফাইনারের (S,E Finner) মতে, “সুপ্রিমকোর্ট বিদ্যমান রাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে” (…..the Supreme Court follows the prevalent political trend )। সুপ্রিমকোর্ট সমসাময়িককালের ব্যাপক রাজনৈতিক চিন্তা ও অনুমানের সঙ্গে সংবিধানের সঙ্গতি সাধনে সফল হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের প্রধান দায়িত্ব হলো সরকারি ক্ষমতার বৈধতা ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা। যতক্ষণ সুপ্রিমকোর্ট এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে ততক্ষণ সে মর্যাদা ও ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু যখন সুপ্রিমকোর্ট এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তখন তার মর্যাদার অবমূল্যায়ন ঘটে এবং সরকারের নির্বাচিত শাখা হিসেবে আইনসভা তার উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে। রবার্ট ডাল সুপ্রিমকোর্টকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যকারী রাজনৈতিক জোটের বা প্রাধান্যকারী জাতীয় জোটের একটি অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাঁর মতে, প্রাধান্যকারী জোটের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি উপাদান হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট ঐ জোটের মূলনীতিকে সমর্থন করে। সুপ্রিমকোর্ট কেবল এই জোটের প্রতিনিধি নয়; সে রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও অংশ। সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতার যে ভিত্তি রয়েছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধান ব্যাখ্যার বৈধ ক্ষমতার স্বীকৃতি। প্রধান জোটের মূলনীতির বিরোধিতায় তার বৈধতা সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠে।
গ. সংবিধানের বিকাশ ও সম্প্রসারণে ভূমিকা (Role indevelopment and Exepansion of the Constitution) : মার্কিন সংবিধানের বিকাশেও সুপ্রিমকোর্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট পরিবর্তিত সময়ের সাথে সংবিধানের সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে। সংবিধানের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকে বিভিন্ন সময়ে ও প্রয়োজনে ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান সম্প্রসারণে সহায়তা করেছে। সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই সংবিধান নতুন রূপ ও অর্থ লাভ করে। সুপ্রিমকোর্টের এ ভূমিকা সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। মার্কিন সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল বিধায় দ্রুত সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। ফলে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় গতিশীলতা রক্ষায় সফল হয়েছে। প্রায় দু’শত বছর পূর্বে গৃহীত সংবিধানের গতিশীল চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সংশোধনের তুলনায় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বজায় রেখে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানকে পরিবর্তনশীল ও গতিশীল হতে সাহায্য করেছে। এক কথায় বলা যায়, সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের আধুনিকীকরণে সহায়ক হয়েছে। এস. ই. ফাইনার যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, সংবিধান পরিবর্তনের সমস্যাই হলো প্রধান সমস্যা। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সংবিধানের সংগতি বিধানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) এর মতানুসারে, “The Superme Court is the living voice of the constitution’. “অর্থাৎ, সুপ্রিমকোর্টই হলো ‘সংবিধানের জীবন্ত কণ্ঠস্বর’। “
ঘ. সংবিধানের নিয়ামক (Regulator of the Constitution) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট নিজেকে সংবিধানের নিয়ামক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় এবং রাজ্য সরকারসমূহের আইন ও শাসন বিভাগ সংবিধানের নির্দেশ অনুসারে কাজ করছে কি-না তা বিচার করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আইন ও শাসন বিভাগ সংবিধানের সীমা লঙ্ঘন করে কোনো কাজ করলে সুপ্রিমকোর্ট সেই কাজকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। অধ্যাপক কে. সি. হুয়ার (K. C. Wheare) বলেছেন, “The last word about the meaning of the constitution and consequently of the division of powers is with a body, the Supreme Court. ” মার্কিন শাসনব্যবস্থায় কার্যক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য অঙ্গগুলোর উপর আদালত আধিপত্য বিস্তার করছে। অধ্যাপক ফাইনার (Finer)-এর ভাষায়, “The Courts are superior to the judgement of all other institutions including Congress.”
ঙ. নিরবচ্ছিন্ন সাংবিধানিক সম্মেলনের ভূমিকা : মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, সুপ্রিমকোর্ট হলো একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংবিধানিক সম্মেলন। এর অর্থ হলো সাংবিধানিক সম্মেলন যেমন সংবিধান রচানার কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং একাধিক্রমে এ কাজ সম্পাদন করে, মার্কিন সুপ্রিমকোর্টও অনুরূপ নিরবচ্ছিন্নভাবে সংবিধানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার সঙ্গে নতুন অর্থ যুক্ত করে। অনেকে মন্তব্য করেছেন যে, সুপ্রিমকোর্ট যখন কোনো আইনের ব্যাখ্যা আরম্ভ করে তখন সংবিধানের নতুন অর্থ যুক্ত হয়। সংবিধান নতুন রূপ লাভ করে। যে কারণে সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যা সংবিধান বিকাশের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।
চ. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট শুধুমাত্র আইনের ব্যাখ্যাই করে না, আইনের বৈধতাও বিচার করে। আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট দেখে যে, বিচার্য আইন বা শাসন বিভাগীয় কোনো কাজ সাংবিধানের সীমা লঙ্ঘন করেছে কি-না। আইন ও শাসন বিভাগীয় কার্যকলাপের বৈধতা বিচারের মাধ্যমে সংবিধান বহির্ভূত বা অসাংবিধানিকতার দায়ে সুপ্রিমকোর্ট আইন বা শাসন বিভাগের সে কাজ বাতিল করে দিতে পারে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট আইনের বৈধতা বিচার তথা বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বস্তুত বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও পরিধি বিশেষভবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট শাসন বিভাগের সিদ্ধান্ত বা আদেশের বৈধতা বিচার করে এবং কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনের সাংবিধানিকতাও বিচার করে। এ বৈধতা বিচারের ক্ষমতা বা বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার মাধ্যমে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ছ. বিরোধ মীমাংসা : মার্কিন শাসনব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে নির্দিষ্ট ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোর মধ্যে কোনো রকম বিরোধের সৃষ্টি হলে তার মীমাংসা করে সুপ্রিমকোর্ট। কোনো বিশেষ ক্ষমতা কংগ্রেসের, নাকি রাজ্যের আইনসভাসমূহের, নাকি কারোরই নয়, নাকি উভয়ের সে বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আবার মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ হেতু রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের মধ্যেও বিরোধের আশংকা থাকে। বিধিবদ্ধ ও স্বীকৃত ক্ষমতা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমেও সুপ্রিমকোর্ট উভয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে । মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরোধের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিচারপতি মার্শাল (Marshal) ১৮১৯ সালে ম্যাকুলচ বনাম মেরিল্যান্ড (Macklus vs Mariland, 1889) মামলায় ব্যাপক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় সরকারের ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, জাতীয় সরকারের ক্ষমতার ব্যাপক বিস্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তিনি কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা বিচারের তুলনায় অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনের বৈধতা বিচারের প্রয়োজনীয়তার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গিবন বনাম অগডেন (Gibon vs Ogden, 1889) মামলায় আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সুপ্রিমকোর্ট জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় আইনসভার ক্ষমতার পক্ষেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। সুপ্রিমকোর্টের ধারণা, কোনো রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট রাজ্য ভোগ করলেও আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত। বিচারপতি মার্শাল (Marshal)-এর মতে, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কংগ্রেসের অন্যান্য ক্ষমতার মতোই পূর্ণাঙ্গ ।
জ. নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ (Protection of Civil Right) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্কিন সবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী দ্বারা নাগরিকদের কতগুলো মৌলিক অধিকার সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে। কেন্দ্রিয় ও অঙ্গরাজ্য সরকারের আইন ও শাসন বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ হতে নাগরিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করা সুপ্রিমকোর্টের জন্য অপরিহার্য। কোর্ট শাসনতন্ত্র ও আইনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের মূল বিষয় এবং অর্থ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। মার্কিন কংগ্রেসের কোনো আইন বা শাসন বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত সংবিধানে সন্নিবেশিত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী হলে সুপ্রিমকোর্ট সংশ্লিষ্ট আইন বা সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারে। অধ্যাপক কে. সি. হুয়ার (K. C. Wheare)-এর মতে, “সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তিগত অধিকারের ব্যাখ্যা এবং কার্যকর করার কর্তব্য ও দায়িত্ব মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে অনেকখানি স্থান দখল করে আছে।”
ঝ. রক্ষণশীল ভূমিকা (Conservative role) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৮৬৬ সালের গৃহযুদ্ধের সময় থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট ধনিক শ্রেণির সম্পত্তির অধিকার সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট কখনো কখনো সাধারণ ও শ্রমজীবী শ্রেণির অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার পরিবর্তে বাস্তবে ধনিক ও বণিক গোষ্ঠীর স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষায় মনোযোগী ছিল। আবার শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধানে শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা সুনির্দিষ্ট করা। ক্ষমতা সরকারের নেই বলে সুপ্রিমকোর্ট অভিমত দিয়েছে। এরূপ অভিমতের সপক্ষে যেসকল যুক্তি প্রদর্শন করা হয় তাতে প্রতীয়মান হয় যে, সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেধে দিলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের স্বাধীনতা বিনষ্ট হবে।
ঞ. জাতীয় নীতি নির্ধারণ (National Policy Making) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় জাতীয় নীতি নির্ধারণে সুপ্রিমকোর্ট বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোনো আইনের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য বিবেচনার পর সুপ্রিমকোর্ট যখন সংশ্লিষ্ট আইনকে সংবিধান বিরোধী ঘোষণা করে তখন আদালত মূলত এ আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিরই বিরোধিতা করে। এভাবে আইনের বিষয়বস্তু বিবেচনার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। আর এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের নীতি নির্ধারণকারী ভূমিকা হলো মূলত রাজনৈতিক ভূমিকা। রবার্ট ডাল (Robert Dhal)-এর মতানুসারে সুপ্রিমকোর্ট নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সম্পন্ন রাজনৈতিক জোট (Dominant Political Alliance) বা জাতীয় জোটের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আদালত যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ মোর্চা বা জোটের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে ততক্ষণ আদালতের সিদ্ধান্তের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে না। তাই মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমকালীন আর্থ- সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে ।
মার্টিন শাপিরি (Martin Shapiri) মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, “বিগত ২৫ বছরে বা তার বেশি সময়ে সুপ্রিমকোর্ট নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় আপেক্ষিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছে।” সাপিরির মতে নিম্নোক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে :
১. বিদ্যালয়ে শ্বেতকায় ও অশ্বেতকায় ছাত্রদের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নিগ্রোদের অধিকার প্রসারিত করেছে।
২. মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট ফৌজদারি মামলা পরিচালনা ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করেছে। প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ গ্রহণের জন্য আইনজীবীর ব্যবস্থা করেছে। বেআইনিভাবে স্বীকারোক্তি আদায়, পুলিশের অসদাচরণের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
৩. সুপ্রিমকোর্ট অশালীন সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ।
৪. মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালের স্থায়ী বাসিন্দার শর্ত বাতিল করে দিয়েছে। এর পরে নির্বাচনি রাজনীতির উপর সুপ্রিমকোর্টের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
(. বিদ্যমান আইনের সমালোচনার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলির আলোকে একে ‘সমন্বয় চক্র’ বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের গুরুত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেন সেগুলোর সারবস্তু অনেকটা এমন : সুপ্রিমকোর্ট হচ্ছে ‘আইনসভার তৃতীয় কক্ষ’। তাই আধুনিককালে বিচার বিভাগের গুরুত্ব ও ভূমিকা নির্ধারণের জন্য আমরা নির্দ্বিধায় মার্কিন সুপ্রিমকোর্টকে নজির হিসেবে উল্লেখ করতে পারি।