মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নেতৃত্বের ভূমিকা

Table of Contents

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নেতৃত্বের ভূমিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেতৃত্বের ভূমিকা

Powers and Role of Leadership of the President of U.S.A

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মার্কিন শাসনব্যবস্থার সর্বময় কর্তা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। মার্কিন রাষ্ট্রপতিই মার্কিন শাসনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মূলত তাঁর নামেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির অসীম ক্ষমতা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক স্ট্রং বলেছেন, “বর্তমান বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ন্যায় ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মচারীর সন্ধান অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।” যে কারণে ক্লিনটন রসিটার রাষ্ট্রপতিকে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘মুখ্য চরিত্র’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসমূহের এমন একটি যোগফল রয়েছে যা সিজার, চেঙ্গিস খান কিংবা নেপোলিয়নকেও ঈর্ষায় জর্জরিত করতে সক্ষম। হার্বার্ট হুভারের মতে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ব্রিটেনের রাজার মতো রাজত্ব করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মতো শাসন করেন। অর্থাৎ মার্কিন রাষ্ট্রপতি একাধারে ব্রিটেনের রাজা/ রানী এবং প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় ক্ষমতা ভোগ করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেন, “The president of the United States is both more or less than a king. He is also both more or less than a Prime Minister.” নিম্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হলো :

১. শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা (Executive Powers) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হলেন শাসন বিভাগের প্রধান । শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপক ক্ষমতা চর্চা করে থাকেন। মার্কিন সংবিধানের ২(১) ধারায় বলা হয়েছে, “The executive powers shall be vested in a president of the United States.”। মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যেসকল ক্ষমতা চর্চা করেন সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. আইন প্রয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধানের ২ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, the laws are faithfully executed.” সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে আইন প্রয়োগ করা রাষ্ট্রপতির গুরুত্বপূর্ণ শাসন সংক্রান্ত আবশ্যিক কর্তব্য। কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত অনেক আইন প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি ও তাঁর অধীন কর্মচারীদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়সমূহের রায়, কংগ্রেস প্রণীত আইনসমূহ, আন্তর্জাতিক সন্ধি, চুক্তি প্রয়োগ ও কার্যকর করা রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রপতি তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীদের সহায়তায় এসব আইন প্রয়োগ করে থাকেন। এক্ষেত্রে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে বিশৃঙ্খলা দমন এবং জাতীয় আইন প্রয়োগের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে পারেন। জাতীয় আইন প্রয়োগের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সুপ্রিমকোর্ট রাষ্ট্রপতির এ ধরনের ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েছে। ১৯৫৭ সালে লিটল রক, ১৯৬৩ সালে অক্সফোর্ড এবং ১৯৬৩ সালে টাসকালোসায় রাষ্ট্রপতি সামরিক বাহিনী প্রেরণে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে আরকানসাসের গভর্নর বিদ্যালয়ে বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আদেশ প্রতিরোধের জন্য রাজ্যের মিলিশিয়াকে নিয়োগের পর রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।

খ. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সিনেটের পরামর্শ ও অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত, কেবিনেটের সদস্য, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। উপরন্তু মার্কিন কংগ্রেস আইন করে নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীদেরকে নিয়োগের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির নিকট হস্তাস্তর করতে পারে। তবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারীদেরকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হলেও নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীদেরকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তবে রাষ্ট্রপতি যাদেরকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সিনেট সাধারণত তাদের নিয়োগকে অনুমোদন দেন; কেননা বর্তমানে এসব কর্মচারী নিয়োগের পূর্বে ‘সিনেটের সৌজন্য বিধি’ (Senatorial Courtesy) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সিনেটের নিজ দলীয় সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এ ধরনের নিয়োগকে সিনেট অনুমোদন করেনি এমন নজিরও আছে। যেমন— ১৯৫৯ সালে রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার কর্তৃক বাণিজ্য সচিব হিসেবে লুই স্ট্রাস (Strauss)-এর নিয়োগ, রাষ্ট্রপতি নিক্সন কর্তৃক সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে হ্যারল্ড কার্সওয়েল (Harold Carswell) এর মনোনয়ন সিনেট অনুমোদন করে নি। তবে বর্তমানে প্রায় ৮০% সরকারি কর্মাচারী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করেন বিধায় রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

গ. অপসারণ ক্ষমতা : সংবিধান প্রণেতাগণ অপসারণ ক্ষমতাকে শাসন বিভাগীয় ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করতেন বিধায় অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এই ক্ষমতাবলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি যেসকল কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে পারেন সেসকল কর্মকর্তাকে অপসারণও করতে পারেন। অপেক্ষাকৃত নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কংগ্রেস আইনের মাধ্যমে অপসারণ পদ্ধতি স্থির করতে পারলেও শাসন বিভাগীয় পদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ক্ষমতা স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারক, কেবিনেট সদস্য, কূটনৈতিক দূত, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি, রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধিবদ্ধ অনুযায়ী নিযুক্ত কর্মচারী, আংশিক আইন ও আংশিক বিচার বিষয়ক ক্ষমতাযুক্ত বোর্ড বা কমিশনের সদস্য প্রভৃতি কর্মকর্তাদের পদচ্যুতি রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তে সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সিনেটের অনুমোদন আবশ্যক। তবে যেসকল সরকারি কর্মচারী প্রশাসনিক কার্যাদির জন্য সরাসরি রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী তিনি তাদেরকে এককভাবে পদচ্যুত করতে পারেন। ফলে রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা অনুযায়ী প্রশাসনকে পরিচালনা করার সুযোগ পান। ১৮৬৭ সালে কংগ্রেস ‘অফিসের মেয়াদ আইন’ (Tenure of office act) দ্বারা অপসারণের ক্ষেত্রে সিনেটের পরামর্শ গ্রহণের নিয়ম প্রবর্তন করেন ।

ঘ. সামরিক ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (Commander in- chief) । ফলে জাতীয় প্রতিরক্ষার সার্বিক দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত। তিনি সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে সেনা ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে পারেন। এছাড়া বিদেশে সৈন্য প্রেরণ, অন্য কোনো দেশে আক্রমণ পরিচালনা কিংবা যুদ্ধ ঘোষণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার ১৯৫৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে, ১৯৫৫ ও ১৯৫৮ সালে ফরমোজায়, জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৯৪ সালে হুইস্কি বিদ্রোহ দমন, হ্যারি ট্রুম্যান ১৯৪৫ সালে জাপানে আণবিক বোমাবর্ষণ, কেনেডি ১৯৬২ সালে কিউবা থেকে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি অপসারণের জন্য, রিচার্ড নিক্সন ১৯৭০ সালে কম্বোডিয়া দখল, ১৯৯০-৯১ সালে সিনিয়র বুশ কুয়েতের উপর আক্রমণ, জুনিয়র বুশ ২০০১ সালে আফগানিস্তান এবং ২০০৩ সালে ইরাক দখলের জন্য সামরিক ও নৌবাহিনীকে কাজে লাগিয়েছেন।

তবে ১৯৭৪ সালে কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত ‘যুদ্ধ ক্ষমতা সম্পর্কিত আইন’ (War power act) এর দ্বারা রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। এ আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি বৈদেশিক সংঘাতের (Foreign conflict) ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কংগ্রেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রয়াস চালাবেন এবং কংগ্রেস সম্মতি না দিলে ৬০ দিনের মধ্যে তিনি সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য থাকবেন ।

ঙ. যুদ্ধকালীন বিশেষ ক্ষমতা : যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায় বিধায় তিনি নিয়মতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। যুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্য সংখ্যা নির্ধারণ, সৈন্য প্রেরণ, যুদ্ধ কৌশল, অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ এবং যুদ্ধের ব্যবহারিক যাবতীয় কলাকৌশলের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রপতি যুদ্ধকালীন সময়ে কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়ে যে কোনো অধিকৃত অঞ্চলে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি জাপান, কোরিয়া, ইতালি, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার অংশবিশেষে এ ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে এ পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।

চ. জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা : জরুরি অবস্থা বা সংকটকালীন সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি কিছু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হন বিধায় তাঁর শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। মার্কিন সংবিধানে জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতার কথা উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন জাতীয় সংকটের সময় কংগ্রেস ও জনসাধারণ রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ও আইসেনহাওয়ার কংগ্রেসের নিকট থেকে এ বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার লাভ করেন। তাছাড়া এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ গৃহযুদ্ধের সময় আব্রাহাম লিংকনের, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উড্রো উইলসনের এবং দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময় ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়।

ছ. ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন এবং সামরিক রেহাই ও অব্যাহতি দানের ক্ষমতা ভোগ করেন। সংবিধানের ২(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ইম্পিচমেন্ট বা অভিশংসন ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বা অপরাধ মওকুফ করার বা অব্যাহতি প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ছাড়া কংগ্রসেরও ক্ষমতা রয়েছে দণ্ডাদেশ হ্রাস করার। কিন্তু শাস্তি থেকে মুক্তিদানের একমাত্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। অপরাধের তুলনায় শাস্তি অধিক মনে হলে বা রাষ্ট্রপতির মনে যদি এ বিষয়ে প্রত্যয় জন্মায় যে, ভুলবশত শাস্তি দেয়া হয়েছে তবে তিনি অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন বা দণ্ডাদেশ সাময়িক স্থগিতও করতে পারেন। ১৯২৭ সালে বিডেল বনাম পেরোভিচ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করলে তা কার্যকর করা বাধ্যতামূলক।

জ. রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা : পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। তিনি হলেন পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে জাতির একমাত্র প্রতিভূ এবং বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট জাতির একমাত্র প্রতিনিধি। সংবিধান বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করেছে। রাষ্ট্রপতি অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, আবার এই সম্পর্ক ছিন্নও করতে পারেন। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের নিয়োগ করেন, অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিজ দেশে গ্রহণ করেন এবং বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদন করেন। যদিও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ ও চুক্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে সিনেট রাষ্ট্রপতির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেন। কেননা, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তি সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে অনুমোদিত হতে হয়। তা না হলে তা কার্যকরী হয় না। ১৯১৯ সালে রাষ্ট্রপতি উইলসন কর্তৃক সম্পাদিত ‘ভার্সাই চুক্তি’ সিনেট ১৯২ সালে বাতিল করে দেয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘লীগ অব নেশন্‌স এ যোগদান করতে পারে নি। তবে তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নেতৃত্বের ভূমিকা

ঝ. সন্ধি চুক্তি সম্পাদন : মার্কিন কংগ্রেস ও সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সন্ধি-চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা প্রদান করেছে। তবে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত কোনো সন্ধি-চুক্তি কার্যকর হয় না। ১৯২০ সালে সিনেট রাষ্ট্রপতি উইলসন কর্তৃক সম্পাদিত ‘ভার্সাই চুক্তি’ বাতিল করে দেয়। যে কারণে সমসাময়িককালে মার্কিন রাষ্ট্রপতিগণ ‘সন্ধি’ শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রশাসনিক চুক্তি’ (Executive agreement) শব্দ ব্যবহার করে। যে কোনো সন্ধিকে প্রশাসনিক চুক্তির পর্যায়ভুক্ত করে সিনেটের অনুমোদন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা মার্কিন রাষ্ট্রপতিগণ প্রায়ই করে থাকেন। এভাবে প্রশাসনিক সন্ধি আখ্যা দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো সিনেটের অনুমোদন এড়িয়ে যাওয়া। ১৯০৭ সালে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের সাথে জাপানের সম্রাটের চুক্তি ‘ভদ্রলোকের চুক্তি’ (Gentleman’s agreement) নামে খ্যাত। এছাড়া বক্সার প্রটোকল (Boxer protocal), আটলান্টিক সনদ (Atlantic charter) প্রভৃতি এভাবে সম্পাদিত হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে কংগ্রেস কর্তৃক প্রশাসনিক চুক্তি ও সন্ধির মধ্যে আইনগত পার্থক্য নির্দেশের প্রয়াস চালানো হয়ে থাকলেও অদ্যাবধি তার বাস্তবায়ন ঘটেনি।

ঞ. প্রধান প্রশাসক হিসেবে ভূমিকা : জাতীয় প্রশাসনের প্রধান হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। শাসন বিভাগীয় নীতি প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের দায়িত্ব তিনি পালন করেন। শাসন বিভাগীয় আদেশ জারি, প্রশাসনিক এজেন্সিসমূহের কাজের তদারকি, প্রশাসনিক কাঠামোর বিন্যাস সাধন, বিভিন্ন বিভাগের কাজের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান, কংগ্রেস প্রণীত আইন, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের রায়, অপর রাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ইত্যাদি যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কি-না তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন বিভাগের প্রধান এবং অন্যান্য কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি প্রদান করতে পারেন। প্রশাসনিক বিভাগসমূহের কাঠামো ও কর্তৃত্বের পরিধি কংগ্রেস কর্তৃক নির্ধারিত হলেও এসব বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত রয়েছে।

২. আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা (Legislative powers) : মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য না হলেও বাস্তবক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী তাঁকে আইন প্রণয়নে বা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আইন সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতা চর্চার কারণে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একজন বড় নেতা বলে অভিহিত করা যায়। এক্ষেত্রে অধ্যাপক ফাইনার (Finer) বলেন, “The constitution intended that the executive should be more than a more executive….. He has become a very active legislative leader as well as an executive.” প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট বলেন, “তত্ত্বগতভাবে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহীর কোনো ক্ষমতা নেই। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী সমগ্র জনসাধারণের প্রতিনিধি। একজন সুযোগ্য নির্বাহীকে আমেরিকার রাজনৈতিক জীবনের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সঠিক আইন প্রণয়নের জন্য কার্যকর আগ্রহ প্রদর্শন করতে হয়।” রুজভেল্টের এই উক্তি হতেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির অবস্থান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা করা যায় । সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের প্রধান হলেও পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি রাষ্ট্রপতিকে কংগ্রেসের সঙ্গে একেবারে সম্পর্কহীন করে নি। মার্কিন রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো “সাংবিধানিক পদ্ধতি” (Constitutional Method) এবং অপরটি হলো “সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতি” (Extra-Constitutional Method)। এই দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

সাংবিধানিক পদ্ধতি (Constitutional Methods) : মার্কিন রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক ও বহুমুখি সাংবিধানিক পদ্ধতি রয়েছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক পদ্ধতিসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. কংগ্রেসে বাণী-প্রেরণ : মার্কিন সংবিধানের ২নং অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কংগ্রেসের নিকট বাণী প্রেরণ করতে পারেন। এ বাণী প্রেরণের মাধ্যমে সংবিধান প্রণেতাগণ রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় নীতি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার অস্পষ্টতা দূর করতে সহায়তা করে। এ বাণীর মাধ্যমে তিনি দেশের অবস্থা ও কী কী বিষয়ের উপর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন তা কংগ্রেসকে অবহিত করবেন। যখন কোনো বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয় তখন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে এ ধরনের বাণী প্রেরণ করেন। ১৯২৩ সালে রাষ্ট্রপতি মুনরো প্রেরিত বাণীর মধ্যে ‘মুনরো মতবাদ বা ডকট্রিন’ এর কথা, কিংবা ১৯৪১ সালে রুজভেল্টের বাণীর মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল বক্তব্য ব্যক্ত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এ জাতীয় বাণী লিখিত, মৌখিক কিংবা নিজে উপস্থিত হয়ে কংগ্রেসের সভায় ভাষণ দানের মাধ্যমে করতে পারেন। ওয়াশিংটন ও অ্যাডামস প্রমুখ রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বাণী প্রদান করতেন। পরে রাষ্ট্রপতি জেফারসন লিখিতভাবে বাণী প্রেরণ করার নীতি প্রবর্তন করেন। যদিও আরও পরে রাষ্ট্রপতি উইলসন ওয়াশিংটনের নীতি তথা কংগ্রেসের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বাণী প্রেরণের নীতি পুনঃপ্রচলন করেন।

খ. কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান : মার্কিন রাষ্ট্রপতি সাধারণভাবে কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করতে না পারলেও জরুরি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি তাঁর সুপারিশ গ্রহণে কংগ্রেসকে বাধ্য করতে পারেন না। তবে যদি জনমত দৃঢ়ভাবে তাঁর পক্ষে থাকে এবং কংগ্রেসে যদি তাঁর নিজের দলের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হন তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কংগ্রেসকে তিনি নিজ অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারেন। অবশ্য ১৯৩৯ সালের পর থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের সংখ্যা বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে। আবার অধিবেশন মুলতবী করার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের উভয় কক্ষ ঐকমত্যে উপনীত হতে না পারলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু অধিবেশন মুলতবী রাখার ব্যাপারে সাধারণত কংগ্রেসের দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ হয় না বিধায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার গণ্ডি যথেষ্ট পরিমাণে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

গ. শাসন বিভাগীয় আদেশ জারি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ‘অধ্যাদেশ’ (Ordinance) বা শাসন বিভাগীয় আদেশ জারি’ (executive orders) জারি করতে পারেন। এই আদেশ আইনের মতোই কার্যকরী হয়। স্বযং রাষ্ট্রপতি কিংবা কংগ্রেস কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রশাসকগণ (administrators) এই আদেশ জারি করতে পারেন। আইনের সংখ্যা ও জটিলতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কংগ্রেসের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে প্রতিটি আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। তাই কংগ্রেস কর্তৃক আইনের মূলনীতিসমূহ নির্ধারণের পর রাষ্ট্রপতির পক্ষে সেগুলোকে পূর্ণতা দানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি সেসব আদেশের ফাঁক পূরণের জন্য শাসন বিভাগীয় আদেশ জারি করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৩ সাল প্রণীত ‘জাতীয় পুনর্গঠন আইন (National Recovery Act, 1933 ) কিংবা ১৯৩৪ সালে প্রণীত ‘বাণিজ্য চুক্তি আইন’ (Trade Agreement Act, 1034) এর কথা উল্লেখ করা যায়। এই দুটি আইনের মাধ্যমে যথাক্রমে জাতীয় পুনর্গঠন এবং বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। অনুরূপভাবে ১৯৩৯ সালের ‘পুনর্গঠন আইন (Reorganization Act, 1939 ) এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় ।

ঘ. ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের জন্য কোনো বিল প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসে উত্থাপন করতে না পারলেও কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংশোধনী বিল ব্যতীত অন্য যে কোনো বিল তাঁর অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হয়। কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত কোনো বিলে যদি রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদানে অস্বীকার করেন তবে সেই বিলটি আইনে পরিণত হতে পারে না। কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত কোনো বিল রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরিত হলে তিনি নিম্নলিখিত তিন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন :

প্রথমত : রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত বিলটি অনুমোদন দিতে পারেন। ফলে বিলটি আইনে পরিণত হবে।

দ্বিতীয়ত : রাষ্ট্রপতি কোনো বিলে সম্মতি জানাতে অস্বীকার করতে পারেন, অর্থাৎ ‘ভেটো’ (Veto) প্রয়োগ করতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে যে কক্ষ থেকে বিলটি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল ১০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে আপত্তিসহ সেই বিলটি কক্ষে ফেরত পাঠাতে হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিলটি যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কংগ্রেস কর্তৃক পুনরায় গৃহীত হয় তবে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীতই আইনে পরিণত হয় ।

তৃতীয়ত : কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত কোনো বিল স্বাক্ষর না করে রাষ্ট্রপতি সেটি আটকে রাখতে পারেন। এরূপ বিল প্রেরণের ১০ দিনের মধ্যে যদি কংগ্রেসের অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে তবে সংশ্লিষ্ট বিলটির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এই প্রক্রিয়ার বিল নাকচ করাকে ‘পকেট ভেটো’ (Pocket Veto) বলা হয় ৷

বর্তমান শতাব্দিতে ভেটো প্রয়োগের সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এবং ট্রুম্যান যথাক্রমে ৬৩১ ও ২৫১টি বিলে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি এক্ষেত্রে বিরোধিতার কারণ ব্যাখ্যা করতে বাধ্য নন ৷ তবে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট তাঁর বিরোধিতার কারণ ব্যাখ্যা করতেন। এভাবে ভেটো প্রয়োগ করে কিংবা ভেটো প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে পারেন ।

৫. বিল পুনর্বিবেচনার সুপারিশ : কংগ্রেস কর্তৃক উত্থাপিত ও গৃহীত কোনো বিল রাষ্ট্রপতির মনঃপুত না হলে সেক্ষেত্রে তিনি কংগ্রেসের নিকট বিলটির পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করতে পারেন ।

চ. অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। ১৯২১ সালের ‘বাজেট ও হিসাব সংক্রান্ত আইন’ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের নিকট বাজেট সম্পর্কিত বার্ষিক বাণী প্রেরণ করেন। ঐ বাণীতে অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে সরকারের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কংগ্রেসে বাজেট উপস্থাপনের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির। তাঁর নির্দেশেই বাজেট রচিত হয়। বাজেট রচনায় রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করেন বাজেট ব্যুরো। এই ব্যুরোর প্রধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। প্রয়োজন অনুসারে তিনি কংগ্রেসের নিকট পরিপূরক ব্যয় সংক্রান্ত দাবিও পেশ করেন। ১৯৪৬ সালের পূর্ণ নিয়োগ আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি প্রত্যেক বছর কংগ্রেসের নিকট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত বাণী প্রেরণ করেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি দেশের অর্থনৈতিক নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কংগ্রেসের পক্ষে রাষ্ট্রপতির এই প্রভাব প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিশ্বে আর্থিক বিষয় যত জটিল হয়ে উঠছে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা তত বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতির নিজ দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এই নিয়ন্ত্রণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে ।

ছ. চাকরি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিতরণ সংক্রান্ত ক্ষমতা : চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিতরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের অনেক সদস্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিতরণের ক্ষেত্রে ‘স্পয়েল সিস্টেম’ বা ‘ভাগ-বাটোয়ারা পদ্ধতি’ (Spoil System) চালু আছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নির্বাচন

পর্ব সমাপ্তির পর বিদায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে নতুন রাষ্ট্রপতি নিজের পছন্দ মোতাবেক ব্যক্তিদের ঐসব পদে নিয়োগ করেন। চাকরির ক্ষেত্রে ‘কন্ট্রাক্ট’ প্রদান, কর অব্যাহতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও স্পিয়েল সিস্টেম’ কার্যকর ছিল। তবে ১৮৮৩ সালে প্রণীত একটি আইনের সাহায্যে শতকরা ৮০ ভাগ পদ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণ করা হয় বিধায় বর্তমানে শতকরা ২০ ভাগ সরকারি পদের ক্ষেত্রে ‘স্পয়েন্স সিস্টেম’ কার্যকর হয়। তাছাড়া বর্তমানে দলীয় ভিত্তিতে ‘কন্ট্রাক্ট’ প্রদান, কর অব্যাহতি প্রভৃতি ব্যবস্থাও বহুলাংশে বিলুপ্ত হয়েছে।

জ. কমিশন গঠন সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিশেষ বিশেষ সমস্যার উপর অস্থায়ী কমিশন গঠন করতে পারেন। এ সকল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কংগ্রেসকে আইন তৈরির নির্দেশ দিয়ে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের উপর নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন।

সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতি (Extra-constitutional Methods) : বিভিন্ন সাংবিধানিক পদ্ধতি ছাড়াও মার্কিন রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতিও রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারেন। নিম্নে এসকল সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

ক. কংগ্রেসকে ভয় প্রদর্শন : মার্কিন প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসকে ভয় দেখিয়ে তাঁর প্রয়োজনীয় আইনসমূহ প্রণয়নে বাধ্য করে থাকে। কংগ্রেসকে ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত তিনটি উপায় অবলম্বন করেন :

১. কোনো বিশেষ বিল পাসের ব্যাপারে তিনি কংগ্রেসকে পূর্বেই অবহিত করেন যে, যদি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী বিল পাস করা না হয় তবে তিনি তাতে সম্মতি প্রদান করবেন না। এভাবে কংগ্রেস কর্তৃক বিল পাস হবার পূর্বেই তিনি তাঁর সূত্রপাত করতে পারেন ।

২. যদি সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির সমর্থিত আইন পাস করতে সম্মত না হন তবে তিনি তাদের পৃষ্ঠপোষকতার আবেদনের প্রতি কোনো প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে তাদেরকে তাদের নির্বাচনি এলাকা হতে পদচ্যুত করতে পারেন এবং পুনর্বিবেচনার পথ বন্ধ করে দিতে পারেন।

৩. রাষ্ট্রপতির নিজ দলীয় সদস্যগণ যারা তাঁর অনুসৃত নীতি সমর্থন করেন না তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান না করে কিংবা কোনো কোনো সময় খোলাখুলি বিরোধিতা করে তাদের নির্বাচনে জয়ী হবার আশা ভঙ্গ করতে পারেন ।

খ. কংগ্রেসকে তোষামোদ করা : যদিও প্রথাগত বিধান অনুযায়ী কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিক বাণী প্রেরণ ব্যতীত মার্কিন রাষ্ট্রপতির আর কোনো ক্ষমতা নেই তথাপি তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো নীতি বা বিধানের ব্যাপারে কংগ্রেস সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। এ ধরনের আলোচনা থেকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে তাঁর অফিসে বা হোয়াইট হাউস অফিসে, পড়ার ঘরে বা প্রাতঃরাশ টেবিলে করে থাকেন। এ ধরনের তোষামোদের (Persuation) মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের নিকট প্রয়োজনীয় আইন পাস করিয়ে নিতে পারেন।

গ. জনমত গঠন : মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট সময়ান্তর সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমগুলোর নিকট রাষ্ট্রের নীতি ও শাসনকার্য সম্পর্কে প্রেস কনফারেন্স কিংবা বেতার-টেলিভিশনের মাধ্যমে যেসকল বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রদান করেন সেগুলো জনমত গঠনে সহায়ক হয়। কংগ্রেসের পক্ষে এ ধরনের জনমত উপেক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব হয় না। এসকল প্রচেষ্টায় যদি রাষ্ট্রপতি অকৃতকার্য হন তবে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জাতির নিকট আবেদন জানাতে পারেন। ফলে জনসমর্থন হারাবার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবার জন্য কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নির্দেশকে আইনে রূপ দিতে বাধ্য হন। তবে এটি অতি সংকটাপন্ন সময়ে এবং কদাচিৎ গ্রহণ করা হয়। অত্যধিক গুণসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি ব্যতীত এ কাজে কেউ অবতীর্ণ হতে পারে না ।

ঘ. কংগ্রেস সদস্যদেরকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করা : রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কংগ্রেসের যে কোনো সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় তিনি সদস্যদেরকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন অথবা প্রলোভন দেখিয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারেন ।

৩. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা (Judicial Powers) : যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানীর মতো মার্কিন রাষ্ট্রপতির কিছু কিছু বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে। যেমন:

প্রথমত : মার্কিন রাষ্ট্রপতি সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। যদিও নিয়োগকৃত বিচারপতিদের পদচ্যুতি করার কোনো ক্ষমতা মার্কিন রাষ্ট্রপতির নেই ।

দ্বিতীয়ত : মার্কিন সংবিধানের ২ (২) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি দণ্ডিত ব্যক্তির শাস্তির পরিমাণ হ্রাস করতে অথবা তাকে শাস্তির হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দিতে পারেন। তবে আদালতে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বে কোনো ব্যক্তিকে তিনি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন কি-না সে বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা হয় নি। ফলে এই প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দিলে ১৮৮৬ সালে গারল্যান্ড মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রাষ্ট্রপতির এরূপ ক্ষমতা আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে :

ক. ইম্পিচমেন্টের মাধ্যমে দণ্ডিত ব্যক্তিকে তিনি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারবেন না;

খ. রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শাস্তি মওকুফ করতে পারেন। অঙ্গরাজ্যের আইন ভঙ্গের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ হ্রাস বা মওকুফ করার ক্ষমতা তাঁর নেই;

গ. কোনো বিশেষ অপরাধের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি জেফারসন ১৭৯৮ সালে প্রণীত দেশদ্রোহী আইন অনুসারে শাস্তিপ্রাপ্ত সকল অপরাধীর শাস্তি মওকুফ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করলে তা অবশ্যই কার্যকর হয়। ১৯২৭ সালে বিডেল বনাম পেরোভিচ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করলে তা আবশ্যিকভাবে কার্যকর করতে হবে।

৪. অন্যান্য ক্ষমতা (Others Powers) : শাসন, আইন ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার বাইরেও রাষ্ট্রপতি আরও কিছু কিছু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভোগ করেন। যেগুলোকে নিম্নোক্তভাবে আলোচনা করা যায় :

ক. নীতি নির্ধারণ প্রয়োগ : মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণকারী ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন নীতি সূচিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা কিংবা পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। শুধু নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নই নয়, বরং সেসব নীতি ও কর্মসূচিকে কার্যকর করার সিদ্ধান্তও রাষ্ট্রপতিকেই গ্রহণ করতে হয় ।

খ. সমন্বয় সাধনকারীর ভূমিকা : মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বিশাল আয়তন বিশিষ্ট প্রশাসনের সমন্বয়কের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থা রাষ্ট্রপতির জন্য তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ, তথ্যের বিন্যাস সাধন, পরামর্শদান, বিলের খসড়া প্রণয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করে। কিন্তু তাঁর দ্বারা ঘোষিত নীতি অনুযায়ী প্রশাসনিক কার্যাবলি পরিচালিত হচ্ছে কিনা, প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে সরকারি নীতি সুষ্ঠুভাবে রূপায়িত হচ্ছে কিনা সেসব বিষয় সর্বদা তাঁকে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। প্রশাসনের সকল স্তরের কার্যাবলির সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনই রাষ্ট্রপতিকে সাফল্য এনে দিতে পারে।

গ. জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা : মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতির নেতা, জনসাধারণের মুখপাত্র। ক্লিনটন রসিটার- এর মতে, “ব্রিটেনের রানী যেমন ব্রিটিশ জনগণের একক প্রতিরূপ, তেমনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন মার্কিন জনগণের একক প্রতিরূপ।” রসিটারের মতানুসারে, “মার্কিন নাগরিকদের ঘোষকবাদ্য হলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। তিনি স্পষ্ট ও সঠিকভাবে মার্কিন নাগরিকদের মনের কথাকে ঘোষণা করেন এবং এটাই হলো তাঁর বড় মহত্তম কাজ।” মার্কিন জনসাধারণের মূল্যবোধ ও স্বদেশপ্রেমের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি ব্যাপক জনসমর্থনের অধিকারী হতে পারেন। আর এই ব্যাপক জনসমর্থনই হলো তাঁর বড় মূলধন। বিচারপতি ডগলাস (W.O. Douglus)-এর মতানুসারে, “মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন জনসাধারণের প্রতিনিধি। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে তিনি হলেন তাদের মুখপাত্র।”

ঘ. রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভূমিকা : যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানী নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকেও অনুরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রধান। যুক্তরাজ্যের রানী, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এবং কানাডার গভর্নর জেনারেল জনসাধারণের জন্য যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেন মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে তার সবকিছুই করতে হয়। অনেক সময় তার চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হয়। কেননা, তিনি রাজা নন, কিংবা রাজার কোনো প্রতিভূ নন। ফলে জনগণ তাঁকে স্বাউট মাস্টার, চলচ্চিত্রাভিনেতা এবং অনগণের নেতা ভাবতে অভ্যস্ত। তাই জনগণ এমন সব জায়গায় তাকে প্রত্যাশা করে যা অনেক সময় মর্যাদাব্যঞ্জক বলে মনে হয় না। কিনটন রসিটারের মতে, “রাষ্ট্রপ্রধান বলে নয়, রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় থেকে আগত বিশিষ্ট অতিথিদের অভিবাদন জানান, অজাত সৈনিকের স্মৃতিতত্ত্বে ও লিঙ্কনের সমাধিক্ষেত্রে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন, ধন্যবাদ আপক ও সম্মানসূচক প্রস্তাব তিনি আনেন, সকল নাগরিককে পদক উপহার দেন, রাষ্ট্রদূত ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের ভোজসভায় আপ্যায়ন করেন, জাতির পক্ষে ক্রিস্টমাস উৎসবের আলোবৃক্ষ প্রজ্বলন করেন, “ইস্টার বাণী” উৎসবের আনন্তসূচক ডিমটি গড়িয়ে দেন। শুধুমাত্র হোয়াইট হাউস কিংবা নগরের চতুর্দিকে এসকল কাজকে সীমাবদ্ধ রাখার অধিকার রাষ্ট্রপতির নেই। জনসাধারণ চায়— তিনি বার বার তাদের মধ্যে আসুন, তাঁর মহান সফরে বেড়িয়ে পড়ুন।… সংক্ষেপে রানী যেমন ব্রিটিশ জনতার একক প্রতিরূপ, তেমনি মার্কিন নাগরিকদের একক প্রতিরূপ হলেন রাষ্ট্রপতি।”

৫. দলীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজ দলের নেতা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর তিনি দলের জাতীয় কমিটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। দলের জাতীয় পর্যায়ে যে কোনো নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পূর্বে তিনি যেসব দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন নির্বাচিত হবার পর তিনি তা বাস্ত বায়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেন। নেতা হিসেবে নিজের দলকে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত করার দায়িত্ব তাঁর। পরবর্তী নির্বাচনে যাতে নিজ দলের জয় নিশ্চিত হয় সেদিকে লক্ষ রেখে তিনি কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়াস পান।

চ. জাতীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা : মার্কিন রাষ্ট্রপতি যেমন নিজ দলের নেতা তেমনি জাতীয় নেতা। জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি মার্কিন জনগণের স্বার্থ দেখেন। মার্কিন সংবিধান, মার্কিন জনগণ ও তাদের নানাবিধ স্বার্থ ইত্যাদি বিষয়ের একজন একনিষ্ঠ রক্ষক হলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। বস্তুত মুক্ত বিশ্বে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভাবমূর্তি নির্ভর করে তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতা ও নেতৃত্বের উপর ।

ছ. আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে ভূমিকা : বিশ্ব রাজনীতি বর্তমানে দ্বিমেরু কেন্দ্রিকতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক এক মেরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকে জার্মানির একত্রীকরণের পর তৃতীয় শক্তির চিন্তা করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জার্মানি এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ফলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বর্তমানে এককেন্দ্রিক বিশ্বের (Uni-Polar World) অধিপতি। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বর্তমান সমস্যা সঙ্কুল বিশ্বে কোথায় কী ঘটছে সে ব্যাপারে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়ে থাকেন। বিশ্ব রাজনীতিতে সংঘাত মোকাবিলা ছাড়াও রাষ্ট্রপতি UNO, G-7, G-77, IMF, APEC, IFC, NATO প্রভৃতি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর সরকারের ভূমিকা বা অবস্থান নির্ধারণ করেন। ফলে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি মার্কিন রাষ্ট্রপতির মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকেন ।

মার্কিন রাষ্ট্রপতির অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা তাকে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন করেছে। এস.পি. হান্টিংটন এবং স্যামুয়েল নাই-এর ন্যায় পশ্চিমা তাত্ত্বিকগণ মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে ‘তথাকথিত একনায়ক’ বলার প্রয়াস পান। এছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক ঘোষিত ‘মুক্ত বিশ্বের মালিক’ এ ধারণাকে তাঁরা ‘দখলদারি মানসিকতা’ বলে সমালোচনা করেছেন। বস্তুত মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সমালোচনা আছে বটে, তবে তাঁর কৃতিত্বের পাল্লা অনেক ভারী। জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতির গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নির্ভর করে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দলের উপর অবস্থান, সর্বোপরি সামরিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের উপর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেতৃত্বের ভূমিকা

Leave a Reply