Characteristics of the American Constitution
Table of Contents
Toggleমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত। মার্কিন সংবিধান রাষ্ট্রটির গণতান্ত্রিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করলে মার্কিন শাসনব্যবস্থার বাস্তব স্বরূপটি যেমন উপলব্ধি করা যায় তেমনি আবার এসব বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে অন্যান্য দেশের সংবিধানের সাথে মার্কিন সংবিধানের তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব হয় ।
সংবিধানের অর্থ ও সংজ্ঞা
Meaning and Definition of the Constitution
সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে “Constitution”, যা ল্যাটিন শব্দ “Constiture” থেকে এসেছে। এই “Constiture” শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আদেশ ।
কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সংবিধান বলতে আমরা এমন কিছু নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান বা অনুশাসনকে বুঝি যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এসকল সাংবিধানিক নিয়মকানুনকে অনুসরণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে ।
ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল ( Aristotle) সংবিধানের সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন, “Constitution is the way of life the state has choosen for itself” অর্থাৎ “সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এমন এক জীবন পদ্ধতি, যা রাষ্ট্র স্বয়ং নিজের জন্য বেছে নিয়েছে।”
গু সি. এফ. স্ট্রং (C. F. Strong ) তাঁর “Modern Political Constitution” গ্রন্থে বলেন যে, “Constitution is a collection of principles according to which the powers of the government, the rights of the governed and the relation between two are adjusted.” অর্থাৎ, “সংবিধান হচ্ছে সেই সকল নিয়ম-কানুনের সমষ্টি যা দ্বারা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং এ দুয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে। ”
ণ্ড অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার (K.C. Wheare) তাঁর “Modern Constitution” গ্রন্থে সংবিধানের সংজ্ঞায় বলেন যে, “সংবিধান হচ্ছে সে সমস্ত নিয়মের সমষ্টি যা কী উদ্দেশ্যে এবং কোন বিভাগের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা পরিচালিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।”
১ মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞ লেসলি লিপসন সংবিধানের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন যে, “সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নিয়মপ্রণালি ও তার সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক সংবলিত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। বলা বাহুল্য এই প্রকল্পের মূল কাঠামো হলো লিখিত সংবিধান । “
েলর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) সংবিধানের সংজ্ঞায় বলেন, “Constitution is the aggregate of laws and customs hunker which the life of the state goes on; or the complex totally of laws embodying the principles and rules whereby the community is organized, governed and held together.” অর্থাৎ, সংবিধান হচ্ছে এমন কতগুলো আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়, অথবা এমন কতিপয় আইনের সমন্বয় ঘটে যাতে সম্প্রদায়তে সংগঠিত, শাসন ও একত্রীকরণের নীতিমালা এবং নিয়মাবলি সংযোজিত হয়েছে।
্ অস্টিন রেনী (Austin Ranney)-এর মতানুসারে, “A constitution is the whole body of the fundamental rules, written and unwritten, legal and extra legal according to which a particular government operates.” অর্থাৎ, লিখিত বা অলিখিত বিধিসম্মত বা বিধি বহির্ভূত সকল মৌলিক নিয়মকানুন যা দেশের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাই হলো সংবিধান ।
সুতরাং, চূড়ান্তভাবে বলা যায় যে, সংবিধান হলো কতিপয় নিয়ম-কানুনের সমষ্টি, যা সরকার গঠন, দেশ পরিচালনা, সরকার ও জনগণের অবস্থান নির্ণয় এবং সর্বোপরি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
মার্কিন সংবিধানের প্রকৃতি
Nature of the U.S. Constitution
বিশ্বের অপরাপর দেশের লিখিত সংবিধানের মতো মার্কিন সংবিধানও একটি নির্দিষ্ট সংস্থা কর্তৃক রচিত ও গৃহীত হলেও মার্কিন জনগণই সংবিধানের প্রধান উৎস। কেননা, মার্কিন জনগণের অনুমোদনক্রমে এ সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়েছে। ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায় যে সমস্ত মৌলিক নীতি ও আদর্শের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোকে প্রস্তাবনায় গুরুত্ব সহকারে সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও সমালোচকদের মতে, মার্কিন জনগণকে মার্কিন সংবিধানের উৎস হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। কেননা, মার্কিন জনগণ এ সংবিধান প্রণয়ন বা গ্রহণ করেনি। মার্কিন জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। প্রধানত কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিগণই ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনকে প্রভাবিত করেছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষের কোনো ইচ্ছা মার্কিন সংবিধানে প্রতিফলিত না হয়ে মূলত কায়েমি স্বার্থই প্রতিফলিত হয়েছে।
মার্কিন সংবিধান বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন লিখিত সংবিধান। মার্কিন শাসনব্যবস্থা পরিচালনার মৌলিক বিধি ও পদ্ধতি, নিয়মকানুন, কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা ও তাদের সম্পর্ক সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। তবে প্রায় দু’শ বছরের অধিক সময়ে ক্রমবিবর্তনের ধারায় লিখিত নিয়ম ও পদ্ধতির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক অলিখিত নিয়ম ও পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেগুলোকে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও প্রথা বলে ।
সমালোচকদের মতে সংবিধানের অলিখিত অংশ আছে, যেগুলো মূলত শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, বিচারালয়ের রায়, কংগ্রেস প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রপতির ক্যাবিনেট, রাষ্ট্রপতির কার্যত প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা সংবিধানে বলা না হলেও বাস্তবে এগুলোর ভূমিকাকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে তত্ত্বগতভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হলেও বর্তমানে দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে অতি সহজেই তা সংশোধন করা যায় না। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তত্ত্বগতভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হলেও বর্তমানে দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে অতি সহজেই তা সংশোধন করা যায়। সর্বোপরি কোনো দেশের সংবিধান পরিবর্তিত বা সংশোধিত হবে কিনা তা সংশোধন পদ্ধতির ওপর যতখানি নির্ভরশীল, তদপেক্ষা অনেক বেশি নির্ভর করে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। সংবিধান সাধারণভাবে শাসক শ্রেণির স্বার্থের পরিপন্থী হলে অতি বড় দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান ও বারংবার সংশোধিত হতে পারে। এতে সংবিধান সংশোধনের আইনগত বাধা সংবিধান পরিবর্তনের পথে কোনোরূপ কার্যকর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। যে কারণে মার্কিন সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী ১৭৯১ সালেই সম্পাদিত হয়েছিল। মার্কিন সংবিধান যদি প্রকৃতিগতভাবে সত্যিই দুষ্পরিবর্তনীয় হতো তবে প্রণয়নের মাত্র এক বছরের মধ্যে তাকে ১০ বার সংশোধন করা সম্ভব হতো না ।
মার্কিন সংবিধান প্রকৃত অর্থে একটি গতিশীল সংবিধান। আপাত বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এ পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছরের ইতিহাসে মাত্র ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। আবার ২৬ টি সংশোধনীতেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। তথাপি বলা যায় যে, মার্কিন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংশোধন ব্যতীতই সংবিধানের মৌল পরিবর্তন হয়েছে ।
জন লক (John Locke), টমাস পেইন (Thomas Paine) প্রমুখের উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শনের দ্বারা মার্কিন সংবিধান রচয়িতাগণ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে সেখানে উদারনৈতিক গণতন্ত্র তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ, একাধিক দলের অস্তিত্ব, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন, সার্বিক প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, আমলাতন্ত্রের অস্বাভাবিক প্রাধান্য বৃদ্ধি, জনকল্যাণকামি নীতি গ্রহণ প্রভৃতি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ মার্কিন শাসনব্যবস্থার মধ্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন সংবিধানে সংযোজিত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে বিচার করে এটিকে একটি ‘বুর্জোয়া সংবিধান’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কেননা, এই সংবিধান সমাজের অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী ধনিক বণিক শ্রেণির প্রতিনিধিগণ কর্তৃক তাঁদের শ্রেণি স্বার্থেই রচিত হয়েছে। শ্রমিক কৃষকের স্বার্থরক্ষার কোনো ব্যবস্থা এই সংবিধানে গ্রহণ করা হয়নি ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
Characteristics of the American Constitution
১৭৮৭ সালে প্রণীত মার্কিন সংবিধান বিভিন্ন দলিলে লিপিবদ্ধ। এটি ১৭৮৮ সালে অনুমোদিত এবং ১৭৮৯ সালে কার্যকর হয়। নিম্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
ক. সংবিধানের প্রস্তাবনা (Preamble to the Constitution) : ১৭৮৭ সালে রচিত মার্কিন সংবিধানে সর্বপ্রথম একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত করা হয়। মার্কিন সংবিধানের পূর্বে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা সংযোজনের কোনো নজির নেই। মার্কিন সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে, “We the people of the United States, in order
to form a more perfect union, establish justice, insure domestic tranquility, provide for the common defence, promote the general welfare, and secure the blessing of liberty to ourselves and our posterity do ordain and establish this constitution for the United States of America.” (আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ একটি অধিকতর সার্থক রাজ্যসংঘ গঠন, ন্যায়বিচার, অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বসাধারণের কল্যাণ বৃদ্ধি, আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এবং স্বাধীনতার আশীর্বাদ লাভ করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ সংবিধান বিধিবদ্ধ ও প্রতিষ্ঠা করেছি)।
প্রস্তাবনা অনুসারে মার্কিন জনগণই সংবিধানের উৎস। কেননা, মার্কিন জনগণের অনুমোদনক্রমে এ সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়েছে। ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায় যে সমস্ত মৌলিক নীতি ও আদর্শের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোকে প্রস্তাবনায় গুরুত্ব সহকারে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে সমালোচকদের মতে, মার্কিন জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধি .ফিলডেলফিয়া সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। প্রধানত কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিগণই ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনকে প্রভাবিত করেছিলেন। ফলে সাধারণ জনগণের কোনো ইচ্ছা মার্কিন সংবিধানে প্রতিফলিত না হয়ে মূলত কায়েমি স্বার্থই প্রতিফলিত হয়েছে।
খ. লিখিত সংবিধান (Written Constitution) : মার্কিন সংবিধান বিশ্বের প্রথম ও সর্বপ্রাচীন লিখিত সংবিধান, যা আজও বলবৎ আছে। মার্কিন সংবিধানের শাসনতান্ত্রিক আইনসমূহ লিখিতভাবে সন্নিবেশিত আছে। মার্কিন শাসনব্যবস্থা পরিচালনার মৌলিক বিধি ও পদ্ধতি, নিয়মকানুন, কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা ও তাদের সম্পর্ক সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। অন্যান্য দেশের লিখিত সংবিধানের মতো মার্কিন সংবিধানও একটি নির্দিষ্ট সংস্থা কর্তৃক রচিত ও গৃহীত। মার্কিন সংবিধান ফিলাডেলফিয়ার সাংবিধানিক সম্মেলনে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে।
মার্কিন সংবিধান মূলত লিখিত সংবিধান হলেও প্রায় দু’শ বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারায় লিখিত নিয়ম ও পদ্ধতির পাশাপাশি অনেক অলিখিত নিয়ম ও পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেগুলোকে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও প্রথা বলে। এসব রীতিনীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রপতির কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা, রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও প্রভাব, প্রকৃতি বিচারে রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রভৃতি । দীর্ঘকাল যাবৎ কার্যকর থাকার কারণে এসকল প্রথা ও রীতিনীতি আইনের মতোই প্রভাবশালী।
গ. সংক্ষিপ্ত সংবিধান (Precise Constitution) : মার্কিন সংবিধান যেমন সর্বপ্রাচীন সংবিধান, তেমনি এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত সংবিধানও বটে। ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে গৃহীত মূল সংবিধানে ১টি প্রস্তাবনাসহ মাত্র ৭টি ধারা ছিল । ফলে সংবিধানটির আয়তন মুদ্রিত অবস্থায় ১০-১২ পৃষ্ঠার অধিক ছিল না, যার শব্দ সংখ্যা ৪,০০০ এর মধ্যে সীমিত ছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশোধনীর ফলে যদিও সংবিধানের আকার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তথাপি এটা পরিলক্ষিত হয় যে, ২৬ বার সংশোধন পরবর্তীতেও সংবিধানের শব্দ সংখ্যা ৬,০০০ অতিক্রম করেনি। মার্কিন সংবিধানের সংক্ষিপ্ত আকারের অন্যতম একটি কারণ হলো সংবিধান প্রণেতাগণ কেবলমাত্র শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতিসমূহই এ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, এসকল নীতির বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি। তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের পৃথকভাবে নিজস্ব সংবিধান থাকায় মার্কিন সংবিধানের আয়তন বৃদ্ধি পায় নি । I
ঘ. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান (Rigid Constitution) : মার্কিন সংবিধান শুধু লিখিতই নয়, বরং বিশেষভাবে দুষ্পরিবর্তনীয়ও বটে। কেননা, ‘মার্কিন সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি অতিমাত্রায় জটিল। মার্কিন সংবিধানের ৫ ধারা অনুসারে, সংবিধান সংশোধনের জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভা কংগ্রেসের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন ছাড়াও অঙ্গরাজ্যসমূহের অন্তত তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। সংশোধন পদ্ধতির এ জটিলতার কারণে প্রায় দু’শ বছরের ইতিহাসে মার্কিন সংবিধান মাত্র ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। তবে সংবিধান সম্পর্কিত বিচার বিভাগীয় ব্যাখ্যা, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাষ্ট্রপতিদের যোগ্য নেতৃত্ব, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রভৃতির কারণে সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয় চরিত্রও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনো রকম অসুবিধার সৃষ্টি করেনি। যে কারণে মুনরো মনে করেন, “মার্কিন সংবিধান স্থিতিশীল নয় গতিশীল, নিউটোরিয়ান নয় ডারউইনিয়ান” ।
ঙ. সংবিধানের প্রাধান্য (Supremacy of the Constitution) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের ৬ (২) ধারায় সংবিধানকে “দেশের সর্বোচ্চ আইন” (The supreme law of the land) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যে কারণে রাষ্ট্রে সংবিধান রোধী কোনো আইন প্রণীত হলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়। আবার মার্কিন সংবিধান যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎসও বটে। যে কারণে মার্কিন রাষ্ট্রপতি সমেত সমগ্র শাসন বিভাগ, কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট প্রভৃতি মার্কিন রাষ্ট্রীয় সংস্থার সকল অঙ্গকে সংবিধান নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও এখতিয়ারের মধ্যে কাজ করতে হয় ৷
যদিও অনেকে সমালোচনা করে বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কার্যকলাপ ও আইনের সাংবিধানিকতা এবং বৈধতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত। আর সুপ্রিম কোর্ট নিজের বৈধতা বিচারের ক্ষমতাকে এতটাই সম্প্রসারিত করেছে যে, সংবিধানের প্রাধান্যের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চ. জনগণের সার্বভৌমত্ব (Pupular Sovereignty) : জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি মার্কিন সংবিধানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মার্কিন সংবিধান শুরু হয়েছে “আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ (We, the people of the United States)-এ কথাগুলোর দ্বারা, যা গণ-সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির অন্যতম পরিচায়ক। অর্থাৎ, ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণায় ন্যায়নীতি ও অন্যান্য মৌলিক আদর্শের সঙ্গে গণ-সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠার যে কথা বলা হয়েছিল, তা উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লর্ড ব্রাইস-এর মতে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সন্নিবেশিত জনগণের সার্বভৌমিকতাই গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
মার্কিন সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষিত জনসাধারণের সার্বভৌমিকতার ব্যাপারে সমালোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অধ্যাপক বিয়ার্ড (Charles Beard) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, জনগণ সংবিধানের উৎস নয়; প্রকৃতপক্ষে সংবিধান প্রণেতাদের ধ্যান-ধারণাই মার্কিন সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি সাধারণ মানুষের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন কমপক্ষে সরকারি ঋণপত্রের মালিক ৪০ জন, জমির ব্যবসায়ী ১৫ জন, জাহাজ উৎপাদন ও বণিক শ্রেণিভুক্ত ১১ জন এবং সুদখোর মহাজন ২৪ জন। ফলে মার্কিন সংবিধানে এসকল প্রতিনিধিদের আর্থিক স্বার্থের প্রতিফলন ঘটেছে। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংবিধানে স্থান পায় নি। সম্মেলনের আলোচনায় নিগ্রো সম্প্রদায়ের বা সাধারণ মানুষের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। সংবিধান অনুমোদনের ব্যাপারেও সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত ছিল না। যে কারণে মার্কিন সংবিধানকে জনগণের সার্বভৌমত্বের অভিব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করা যায় না ।
ছ. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা (Federal form of Government) : মার্কিন সংবিধান একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন, সংবিধানের প্রাধান্য এবং লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় রূপ, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের কর্তৃত্ব, দ্বৈত নাগরিকতা প্রভৃতি মার্কিন সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। যে কারণে অধ্যাপক স্ট্রং (Prof. Strong) বলেন, “The constitution of the United States is the most completely federal constitution in the world.”
তবে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থায় এককেন্দ্রিকতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। যুদ্ধ ও যুদ্ধের আশংকা, আর্থিক সংকট, জনকল্যাণমূলক কার্যাবলির প্রসার, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি, আদালতের অনুকূল ভূমিকা প্রভৃতি কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে ।
জ. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Theory of Separation of Powers) : উপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of Powers)-কে ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। মার্কিন সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ অনুসারে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা আইনসভা তথা কংগ্রেসের হাতে, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ অনুসারে শাসন ক্ষমতা শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির হাতে এবং তৃতীয় অনুচ্ছেদ অনুসারে বিচার ক্ষমতা বিচার-বিভাগের হাতে ন্যস্ত। এই তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করে। কোনো বিভাগ অপর কোনো বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যে কারণে মার্কিন শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অধ্যাপক হোয়ার (K.C. Wheare) বলেছেন, (The constitution of the United States is usually quotes as the leading example of a constitution embodying the doctrine of the separation of powers).
যদিও কর্মক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগ সমক্ষমতাসম্পন্ন নয় এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তও নয়। রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের যৌথভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের বহু নজির আছে। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে কংগ্রেস প্রণীত আইনকে বাতিল করে দিতে পারেন। আবার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক যেকোনো প্রকার নিয়োগ এবং সন্ধি ও চুক্তি সংক্রান্ত ক্ষমতা সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ। শাসন বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি বিচার বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগ প্রদান করলেও বিচারপতিদের আবার রাষ্ট্রপতির নির্দেশ বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট “বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা (Judicial Review)-এর মাধ্যমে কংগ্রেস প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করতে পারে। যে কারণে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব নয়, কাম্যও নয় ।
ঝ. নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি (Theory of Checks and Balances) : মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির উল্লেখ রয়েছে। এই নীতি অনুসারে প্রত্যেক বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অন্য দুই বিভাগকে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে কোনো একটি বিশেষ বিভাগ অধিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ব্যাহত করতে না পারে ।
এই নীতি অনুসারে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভাগসমূহের মধ্যে এবং শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি কোনো বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন না, আবার বিপরীতে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনে ‘ভেটো’ (Veto) প্রয়োগ বা অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারেন। কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত কোনো আইন সংবিধান পরিপন্থী বা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী হে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করতে পারে। আবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন; আবার ইমপিচমেন্ট (Impeachment)-এর মাধ্যমে কংগ্রেস তাঁদের পদচ্যুত করতে পারে; মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বের রাষ্ট্রপতিকে কংগ্রেস পদচ্যুত করতে পারে, আবার রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীত কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। যদিও সংবিধান সংক্রান্ত বিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয় না। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্ট এবং সমগ্র বিচার বিভাগের কাঠামো ও ক্ষমতার পরিবর্তন সাধন করতে পারে। আবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকেও তার কার্যাবলির ক্ষেত্রে আইন ও শাসন বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয়। এভাবে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির বহু নজির রয়েছে। তবে তত্ত্বগত বিচারে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি অসঙ্গতিপূর্ণ হলেও মার্কিন শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের সমন্বয় সাধনের চেয়ে অপর কোনো অভিনব বৈশিষ্ট্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায় না।
ঞ. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা (Presidencial form of Government ) : মার্কিন সংবিধান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানের ২নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির হাতে মার্কিন শাসন বিভাগের যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতির একক শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য ও পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মন্ত্রিসভা বা কেবিনেট থাকলেও কেবিনেটের প্রকৃত ক্ষমতা বলে কিছু নেই। কেবিনেট বা মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারী মাত্র। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের নিকট যেমন দায়িত্বশীল নন, তেমনি কংগ্রেসও রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান লঙ্ঘন, দুর্নীতি, দেশদ্রোহিতা কিংবা অক্ষমতার অভিযোগ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে পদচ্যুত করতে পারে না। অধিকন্তু রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করতে হলে কংগ্রেসকে ‘ইমপিচমেন্ট’ (Impeachment)-এর ন্যায় জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় ।
ট. মার্কিন কেবিনেট ব্যবস্থা (Cabinet System) : ব্রিটেনের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কেবিনেট থাকলেও মার্কিন কেবিনেটের প্রকৃত কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নেই। মার্কিন কেবিনেটের সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারী মাত্র, যারা তাদের দায়িত্বের জন্য কংগ্রেসের নিকট দায়িত্বশীল না থেকে রাষ্ট্রপতির নিকট দায়িত্বশীল থাকেন। রাষ্ট্রপতি যেমন কেবিনেট সদস্যদেরকে নিয়োগ করে থাকেন, তেমনি তাদেরকে বরখাস্তও করতে পারেন।
ঠ. যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়ের প্রাধান্য (Supremacy of federal judiciary) : মার্কিন সংবিধান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টই তা ব্যাখ্যা করে এবং সেই ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। তাছাড়া মার্কিন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক এবং সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য অনেকে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট “আইনসভার তৃতীয় কক্ষ” হিসেবে অভিহিত করার পক্ষপাতি। সুপ্রিম কোর্ট তার এ ভূমিকার সুবাদে নিজেকে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিচার বিভাগের অগ্রগণ্যতা ও প্রাধান্য সম্পর্কে বিচারপতি হিউজেস (Hughes)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য । তাঁর কথায়, “We are under the constitution, but the constitution is what the judges say it is.”
ড. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial review) : বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) মার্কিন সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মার্কিন সংবিধান অনুসারে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার অধিকারী। যে ক্ষমতাবলে শাসন বিভাগের কোনো নির্দেশ কিংবা আইন বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত বা পাসকৃত আইন সংবিধান সম্মত না হলে বিচার বিভাগ তা অসাংবিধানিকতার দায়ে বা অসঙ্গত এই অভিযোগের ভিত্তিতে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।
ঢ. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা (Bi-cameral central legislature) : মার্কিন সংবিধান অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। যার উচ্চ কক্ষের নাম সিনেট (Senate) এবং নিম্ন কক্ষের নাম প্রতিনিধিসভা (House of Representatives)। মার্কিন অঙ্গরাজ্যসমূহের সমতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ সিনেট প্রতি অঙ্গরাজ্য থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। মার্কিন সিনেট পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ হিসেবে পরিচিত।
ন. দ্বৈত-নাগরিকতা (Dual citizenship) : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম নীতি হিসেবে দ্বৈত-নাগরিকতার নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বীকৃত হয়েছে। দ্বৈত-নাগরিকতার বিষয়টিকে সংবিধানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটি অনতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে গণ্য করা হয়। এই নীতি অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই একই সঙ্গে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং নিজ অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। তবে এই দ্বৈত নাগরিকতার মধ্যে কোনো স্ববিরোধ নেই। যে কারণে এই দ্বৈত নাগরিকতা’ সত্ত্বেও মার্কিনিরা একটি সংহত জাতিতে পরিণত হয়েছে এবং সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছে।
ত. সরকারি চাকরির ভাগ-বাঁটোয়ারা (The spoil system) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রাষ্ট্রপতি নিজ দলের সমর্থনকারী লোকজনকেই নিয়োগ করে। পূর্বতন রাষ্ট্রপতির শাসনামলে ঐ সমস্ত পদাধিকারীদিগকে নবাগতদের জন্য পদত্যাগ করতে হয়। সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার এই ভাগ- বাটোয়ারার ব্যবস্থাকে ‘Spoil System’ বলা হয়। সরকারি চাকরি ছাড়াও ‘কন্ট্রাক্ট’ প্রদান, কর প্রদানে ছাড় প্রভৃতি ক্ষেত্রেও স্পয়েল ব্যবস্থার প্রয়োগে পরিলক্ষিত হয়। এ পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে দলীয় স্বার্থে সরকার পরিচালিত হয়। তবে বর্তমানে এ ব্যবস্থার প্রয়োগ যথেষ্ট সীমাবদ্ধ হয়েছে। কেননা, ১৮৮৩ সালে Pandleton Act প্রণীত হওয়ার পর থেকে নির্বাচনমূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের নীতি স্বীকৃত হয়েছে। সরকারি চাকরির ৮০% এর ক্ষেত্রে নির্বাচনমূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও এখনও ২০% সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ‘Spoil System’ এর কার্যকারিতা দেখা যায়। দলীয় ভিত্তিতে ‘কন্ট্রাক্ট’ বিতরণের পদ্ধতিও অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়েছে ।
থ. প্রজাতান্ত্রিক প্রকৃতি (Republican Character) : প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন মার্কিন সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন ও আইন বিভাগ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন- মার্কিন রাষ্ট্রপতি চার বছরের জন্য একটি ‘নির্বাচক সংস্থা’ (Electoral College) কর্তৃক নির্বাচিত হন। আবার কংগ্রেসের দুটি কক্ষ সিনেট ও প্রতিনিধিসভার সদস্যগণও জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে যথাক্রমে ছয় ও দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকারও প্রজাতান্ত্রিক। কতগুলো অঙ্গরাজ্যে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব এখনও পরিলক্ষিত হয় ।
দ. মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) : মার্কিন সংবিধানেই সর্বপ্রথম নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে অধিকাংশ অঙ্গরাজ্য অনুমোদন না করায় মূল সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হয় নি। যে কারণে ১৭৯১ সালে সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনীর (Article I – X, Amendments, 1791 ) মাধ্যমে মৌলিক অধিকারসমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা, অভিযুক্ত হলে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতিতে বিচার পাওয়ার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রভৃতি মার্কিন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন নাগরিকদের এই সমস্ত অধিকারকে “অধিকারের সনদ” (Bill of Rights) বলা হয়।
ধ. উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শন (Liberal Political Philosophy ) : মার্কিন সংবিধানে রাজনৈতিক সাম্য, বহুদলীয় ব্যবস্থা, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রাধান্য, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি উদারনৈতিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ জন লক, টমাস পেইন-এর ন্যায় উদারনৈতিক চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হন ।
ন. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্রের সহাবস্থান (Co-existences of Direct and Indirect Democracy) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ও অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক পরোক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও এক-তৃতীয়াংশ অঙ্গরাজ্যে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে নাগরিকগণ ‘গণ-উদ্যোগ’ এর মাধ্যমে আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে কিনা সে ব্যাপারে ‘গণভোট’ এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারেন। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়।
প. সীমাবদ্ধ সরকার (Limited Government) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান রচয়িতাগণ সীমাবদ্ধ সরকারের ধারণাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোর ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। বস্তুত মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারসমূহের ক্ষমতাকে নির্দিষ্টভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আবার অধিকার সনদ (Bill of Rights)-এর মাধ্যমে সরকারি ক্ষমতার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
মার্কসবাদী সমালোচকদের মতানুসারে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বার্থে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত মালিকানার অবাদ বিকাশকে সুনিশ্চিত করার জন্য সীমাবদ্ধ সরকারের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিরবচ্ছিন্ন প্রসারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে রদ করা হয়েছে।
ফ. দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (Bi-party system ) : ব্রিটেনের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রিপাবলিকান দল (Republican Party) ও গণতন্ত্রী দল (Democratic Party) হলো মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুটি শক্তিশালী দল। পর্যায়ক্রমে এ দুটি দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। যদিও এই দুটি প্রধান দলের আদর্শ ও কর্মসূচির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। যে কারণে অ্যালমন্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থাকে ‘অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা’ বলার পক্ষপাতি।
ম. উপাধি নিষিদ্ধকরণ (Prohibition of distribution of titles) : মার্কিন সংবিধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সকল প্রকার উপাধি প্রদান ও গ্রহণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে (Art- 1, Sec-9)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহকে কষ্টিপাথরে বিচার করে একে ‘বুর্জোয়া শাসনতন্ত্র’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কেননা, এই শাসনতন্ত্রে ধনিক-বণিক শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করা হয়েছে। তবে মার্কিন সংবিধানের আনুষ্ঠানিক পরিবর্তন যথেষ্ট জটিল ও দুরূহ হওয়া সত্ত্বেও সংবিধানের যুগোপযোগী পরিবর্তন আটকে নেই।
সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি
Amendment Procedure of the Constitution
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজব্যবস্থা ও তার সমস্যাদির চরিত্রের পরিবর্তন হয়। যে কারণে একটি বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে রচিত সংবিধানের পক্ষে পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজনের তাগিদে সংবিধানেও প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হয়। এক্ষেত্রে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য পৃথিবীর সকল দেশের লিখিত সংবিধানের সাথে একটি সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি সংযোজন করা হয়। অন্যথায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং অসাংবিধানিক কোনো পন্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটি কার্যকর হয়। কারণ পরিবর্তন কখনো অপেক্ষা করে থাকে না ।
সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি দু’ধরনের হতে পারে। যথাঃ আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি (Formal Procedure) এবং অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি (Informal Procedure)। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে সংশোধন পদ্ধতির এ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।
সংবিধানে বিধিসম্মতভাবে উল্লিখিত সংশোধন পদ্ধতিকে সংবিধান সংশোধনের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি বলা হয়। যে সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় ও লিখিত সেই সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি আনুষ্ঠানিক এবং জটিল বা দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। এ ধরনের সংবিধান অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে সংশোধনের সুযোগ নিতান্তই কম ।
অপরদিকে, বিধিসম্মত আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ছাড়াও বিচার বিভাগীয় প্রথা, প্রথাগত আইন, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রভৃতির মাধ্যমেও সংবিধানের পরিবর্তন সাধিত হয়। সংবিধান সংশোধনের এ ধরনের পদ্ধতিকে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি বলা হয়। এককেন্দ্রিক ও অলিখিত সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি অনানুষ্ঠানিক এবং সহজ-সরল ও সুপরিবর্তনীয় হয়। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনের সংবিধানের কথা বলা যায়। এ ধরনের সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি অধিক কার্যকর হয়ে থাকে ।
সংশোধন পদ্ধতির প্রেক্ষিতে সংবিধান সুপরিবর্তনীয় বা দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। যে সংবিধান সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতিতে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় তাকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। অপরদিকে, যে সংবিধান সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না, বরং সংশোধনের জন্য কোনো এক বিশেষ জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় তাকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় ও লিখিত সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হয় এবং এককেন্দ্রিক ও অলিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হয় ।