Table of Contents
Toggleমার্কিন ও ব্রিটিশ দলীয় ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা
মার্কিন ও ব্রিটিশ দলীয় ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা
Comparative Discussion between Political Party System of U.K. and U.S.A.
সাধারণভাবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে দলীয় ব্যবস্থাকে একান্তভাবে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন বর্তমান বিশ্বের দুটি সমৃদ্ধশালী ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। উভয় দেশেই দলীয় ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উভয় দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনার প্রেক্ষিতে উভয় দেশের দল ব্যবস্থার সংগঠন, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কতগুলো ক্ষেত্রে সাদৃশ্য এবং কতগুলো ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য দেখা দেয় ।
সাদৃশ্যসমূহ (Similarities) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের দল ব্যবস্থার মধ্যে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বিদ্যমান। ক. ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা নিজ নিজ দেশের উত্তরাধিকার বহন করছে। উভয় দেশই উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বে ব্রিটেনে উদারনৈতিক চিন্তা ও কাঠামোর বিকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে আমেরিকায় তা উদারনীতিবাদের ফসল ফলিয়েছে। উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থা দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ ও কাঠামো অর্জন করেছে। উভয় দেশই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শে নিজেদের গড়ে তুলেছে।
খ. দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয় দেশেই গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা অর্জন, জনমতের প্রতি অঙ্গীকার, জনগণের সার্বভৌমিকতা, প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার, নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন অনুষ্ঠান, নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন প্রভৃতি নীতি বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত্তিগত উপাদানে পরিণত হয়েছে।
গ. সাংবিধানিক স্বীকৃতির অভাব : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থাই সংবিধানের দ্বারা স্বীকৃতি অর্জন করে নি। মার্কিন সংবিধানের কোথাও দলীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ নেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী সেখানে ধীরে ধীরে দলীয় কাঠামোর রূপান্তর ঘটেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির অধিকারী মালিক শ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এবং সাংবিধানিক প্রয়োজনের নীতির মাধ্যমে সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে থেকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং প্রয়োজনেই গ্রেট ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে I
ঘ. কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা : তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করলে উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থাকে বহুদলীয় হিসেে আখ্যায়িত করা যায়। বাস্তবে ব্রিটেনে রক্ষণশীল ও শ্রমিক দল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের মধ্যেই নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমিত থাকে। অন্যান্য দল থাকলেও তাদের ভূমিকা গৌণ। এজন্য মার্কিন দলীয় ব্যবস্থাকে কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা নামে অভিহিত করা হয়। ব্রিটেনে নির্বাচনি রাজনীতির লড়াই কেবলমাত্র রক্ষণশীল ও শ্রমিকদের মধ্যেই সীমিত থাকে ।
৫. রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতা সম্পর্কে মতৈক্য : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয় দেশেই প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতা স্বীকার করেই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয়েই বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতা স্বীকার করেছে। সংবিধান নির্দিষ্ট পথেই দল দু’টি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করে। তাদের রাজনীতি হলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার রাজনীতি। ব্রিটেনের রক্ষণশীল ও শ্রমিক দল হলো রাজনৈতিক দিক থেকে প্রাধান্যকারী দল। রক্ষণশীল দল সামন্ততান্ত্রিক ও কায়েমি স্বার্থের রক্ষক। কিন্তু বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি উভয়েরই সমর্থন রয়েছে। দু’টি দলই নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়।
চ. গঠনগত সাদৃশ্য : উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে গঠনগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। দু’টি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গঠন প্রকৃতি খানিকটা পিরামিডের ন্যায়। তাদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন ও নেতৃত্ব রয়েছে। নির্বাচনি রাজনীতির কারণে সকল পর্যায়ের সংগঠনের ভূমিকাও উভয় দেশেই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ.।
ছ. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয় দেশে দল ব্যবস্থাই হলো রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রধান অনুপ্রেরণাদাতা। শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়েই রাজনৈতিক দল নির্বাচকমণ্ডলীকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে না; বরং অন্যান্য সময়েও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে একমত যে, যে দল অন্য দলের তুলনায় বেশি সংখ্যক নাগরিককে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে সফল হয়, সেই দলই জনমানসে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে ।
জ. আঞ্চলিক আনুগত্য : উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থায় আঞ্চলিকতা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড রক্ষণশীল দলের শক্ত ঘাঁটি বলে বিবেচিত। আবার, উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ন্যায় শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে শ্রমিক দলের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত। অনুরূপভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল এবং বৃহৎ শহরাঞ্চলে ডেমোক্র্যাটিক দল এবং উত্তরাঞ্চল, ক্ষুদ্র শহরাঞ্চল ও কৃষি খামার অঞ্চলে রিপাবলিকান দলের প্রাধান্য লক্ষ করা যায় ।
ঝ. ক্ষমতা দখলের পন্থা : উভয় দেশের বৃহৎ দলসমূহ সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, এই দু’টি দেশেই প্রধান দলগুলো বৈপ্লবিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের পক্ষপাতি নয় ।
ঞ. পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহযোগিতা : উভয় দেশের প্রভুত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী হওয়ায় তাদের মধ্যে আপসরফার মনোভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সহনশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান নীতি । তাছাড়া তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা দলের আবির্ভাব ও বিকাশ না ঘটার ক্ষেত্রে উভয় দেশের প্রধান দুটি দলের মধ্যে এক অলিখিত সমঝোতা আছে বলেই প্রতীয়মান এবং সম্ভবত এ কারণেই এ দুটি দেশে শক্তিগুলো তৃতীয় কোনো দলের উন্মেষ ঘটে নি।
ট. স্বার্থগোষ্ঠীর সহিত সংশ্লিষ্টতা : উভয় দেশেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান । রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন বিভিন্ন শ্রমিক সংঘ, মালিক সংঘ, কৃষক সংগঠন, যুব সংগঠন প্রভৃতি গড়ে উঠেছে, তেমনি বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠী নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচনি প্রচার পরিচালনা, নির্বাচনি ব্যয় বহন প্রভৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা করে।
ঠ. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থা রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে প্রভৃত অবদান রাখে। রাজনৈতিক দল নাগরিকদের স্ব স্ব রাজনৈতিক মতাদর্শে দীক্ষিতকরণের পন্থা অবলম্বন করে। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে উভয় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং এর যুগোপযোগী পরিবর্তনে সচেষ্ট থাকে। উভয় দেশের রাজনৈতিক দলই প্রচলিত সমাজ কাঠামোর সংরক্ষণ ও সংস্করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
ড. রাজনৈতিক স্থিতাবস্থায় আস্থা : উভয় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও শাসনতন্ত্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কৃতসংকল্প। ব্রিটেনের শ্রমিক দল সীমিত ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক উদ্যোগ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে সমর্থন করে। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে রক্ষণশীল দলের ন্যায় শ্রমিক দলও প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষপাতি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি দলও বিদ্যমান বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে চেষ্টা করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই দল দু’টির নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।
বৈসাদৃশ্যসমূহ (Dissimilarities) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে উপরিউক্ত সাদৃশ্যের পাশাপাশি ব্যাপক বৈসাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়। নিম্নে এ বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
ক. আদর্শ ও কর্মসূচির ক্ষেত্রে পার্থক্য : ব্রিটেনের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় রক্ষণশীল দল ও শ্রমিক দলের মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্ভব এবং তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেছনে আদর্শ ও নীতিগত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল দুটির উদ্ভবের কারণ এবং তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতটা সংগঠনগত ততটা আদর্শগত নয় ।
খ. ভূমিকাগত পার্থক্য : ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় দলীয় ব্যবস্থার ভূমিকার ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় পার্থক্য বিদ্যমান । ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি দলীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হলেও মার্কিন শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা সর্বাংশে ঠিক নয়। যে কারণে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দল দুটির ভূমিকা এবং মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দল দু’টির ভূমিকা পৃথক প্রকৃতির। মার্কিন ও ব্রিটিশ দলীয় ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা
সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত বিধায় ব্রিটেনে সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ব্রিটেনের যে দল সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ভোটে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন করে সে দল সরকার গঠন করে এবং সে দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এ দলীয় সরকার নিজেদের দলীয় কর্মসূচির ভিত্তিতে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। সরকারের স্থায়িত্ব কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভর করে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ব্রিটেনের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোনো বিশেষ দলের দ্বারা গঠিত বা পরিচালিত হয় না। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সর্বদা ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে থাকে না। মার্কিন রাষ্ট্রপতির কার্যকাল কংগ্রেসের আস্থার উপর নির্ভর করে না। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। এখানে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান উভয় দলের সদস্যদেরই সরকারের বিরোধিতা করতে দেখা যায়। আবার, মার্কিন রাষ্ট্রপতি যে দলের সদস্য নন সে দলের সদস্যগণ ক্ষেত্রবিশেষ তাঁকে সমর্থন করতে দেখা যায় ।
গ. কাঠামোর ক্ষেত্রে পার্থক্য : ব্রিটেনের রাজনৈতিক দল দু’টি কেন্দ্রীভূত বিধায় প্রকৃত ক্ষমতা সংগঠন দুটির সর্বোচ্চ স্তরে কেন্দ্রীভূত। ব্রিটেনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত বিধায় এখানে দলীয় কাঠামোও এককেন্দ্রিক। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দু’টি দলের প্রকৃত ক্ষমতা সংগঠনের নিম্নস্তরে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করে। অর্থাৎ, মার্কিন দল দু’টি বিকেন্দ্রীভূত। মার্কিন ব্যবস্থায় প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আঞ্চলিক সমস্যা ও স্বার্থের ব্যাপারে বিশেষভাবে নজর দেয় ।
ক্ষেত্রবিশেষে দল দু’টি আঞ্চলিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে দল দু’টি জাতীয় দল হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও কংগ্রেসের নির্বাচনের সময় আঞ্চলিক স্বার্থের বিচারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেয়।
ঘ. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য : সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও নীতির ভিত্তিতে ব্রিটেনের প্রধান দু’টি দল নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। সরকারি ক্ষমতা দখল করতে পারলে দল দু’টি দলীয় নীতি ও কর্মসূচি রূপায়ণে আত্মনিয়োগ করে । কিন্তু পটার-এর মতানুসারে, মার্কিন দল দু’টির মধ্যে কর্মসূচি ও নীতিগত তেমন কোনো পার্থক্য না থাকার কারণে কেবল ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে।
ঙ. দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পার্থক্য : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক পারিবারিক ধারায় দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে ভোট প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ, পিতৃপুরুষের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে মার্কিন ভোটদাতাগণ ভোট প্রদান করেন। কিন্তু ব্রিটেনে পারিবারিক ঐতিহ্য দলীয় আনুগত্যের নির্ণায়ক হিসেবে এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে না ।
চ. সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যেকার সম্পর্কগত পার্থক্য : ব্রিটেনের কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার পরিচালনা করে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ দল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। উভয় দলই নিজস্ব নীতি ও কর্মসূচি অনুসারে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে। ব্রিটিশ কমন্সসভায় উভয় দলের মধ্যে অবিরাম রাজনৈতিক সংগ্রাম চলতে থাকে। মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উভয় দলের সদস্যদের মধ্যে সমঝোতা ও বুঝাপড়ার মনোভাব দেখা যায়। ব্রিটিশ কমন্সসভায় বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী হলেও মার্কিন কমন্সসভায় বিরোধী দল অনুরূপ মর্যাদা ভোগ করে না ।
ছ. দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে পার্থক্য : ব্রিটেনের প্রধান রাজনৈতিক দল দু’টির মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সংহতি পরিলক্ষিত হয়। দলীয় শৃঙ্খলা ও সংহতির ক্ষেত্রে শৈথিল্য সৃষ্টি হলে সংসদীয় সরকারের স্থায়িত্ব বিনষ্ট হয়ে পড়বে বিধায় ব্রিটেনে দলীয় শৃঙ্খলার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি দলের দল দু’টির মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যগণ স্বাধীনভাবে যে যার মতামত প্রদান করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের সমর্থনের উপর সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল নয় বিধায় সেখানে দলীয় শৃঙ্খলা ও সংহতির ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখা যায়। যে কারণে মার্কিন কংগ্রেসে দলীয় আনুগত্য অতিক্রম করে প্রায় ক্ষেত্রে “আড়াআড়ি ভোট” (Cross Vote) দেখা যায়। ব্রিটিশ কমন্সসভায় কিন্তু দলীয় নিয়মানুবর্তিতা অস্বীকার করে আড়াআড়ি ভোটের ঘটনা সাধারণত ঘটে না।
উপরোক্ত আলোচন হতে এটাই পরিলক্ষিত হয়, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলব্যবস্থার মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। তবে ব্রিটেনে দলব্যবস্থার কার্যকারিতা যতটা অধিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দলব্যবস্থার কার্যকারিতা তেমনটি নয় ।