মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বৈশিষ্ট্যসমূহ

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্বপূর্ণ দিক/বৈশিষ্ট্যসমূহ

 

 

Characteristics of the Theory of Sepraration of Power of Montesquieu

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সংক্রান্ত ধারণা বিশ্লেষণ করলে যে সকল প্রধান প্রধান দিক বা বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুট ও তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. ক্ষমতার বণ্টন : মন্টেস্কু (Montesquieu)-এর মতে, সরকারের সকল ক্ষমতা তিনভাগে ভাগ করে সরকারের তিনটি পৃথক বিভাগের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। অর্থাৎ, আইন বিভাগীয় ক্ষমতা আইন বিভাগের হাতে, বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে এবং শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

২. ক্ষমতার ভারসাম্য : মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। কেননা, বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতা বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হলে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয়। আর ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থেকে স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।

৩. ব্যক্তিস্বাধীনতার সংরক্ষণ : ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের কথাও বলেছেন। সরকারের ক্ষমতা আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত হলে প্রত্যেকটি বিভাগ স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবে বিধায় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

৪. হস্তক্ষেপমুক্ত : মন্টেস্কুর তত্ত্বে এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ আরোপকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কেননা, তাঁর তত্ত্বে বলা হয়েছে এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না। হস্তক্ষেপ করলে এ বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বিনষ্ট হবে। আর এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে সংবিধানের আওতায় বিভাগসমূহের ক্ষমতা বণ্টন করতে হবে। ৫. পৃথক ব্যক্তির পরিচালনা/ পৃথক নেতৃত্ব : মন্টেস্কুর মতে সরকারের প্রতিটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি যেমন সীমাবদ্ধ

থাকবে, তেমনি পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির নেতৃত্বে তিন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পাদিত হবে।

৬. কর্মপরিধি : মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে প্রতিটি বিভাগের কর্মপরিধি নির্ধারিত হবে। প্রত্যেক বিভাগের ক্ষমতা নিজ নিজ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

৭. জবাবদিহিতা : মন্টেস্কুর মতে, সরকারের প্রত্যেক বিভাগের মধ্যে জবাবদিহিতা আবশ্যক। জবাবদিহিতা থাকলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তাই প্রতিটি বিভাগ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব জবাবদিহিতার সাথে সম্পাদন করবে। জবাবদিহিতা গণতন্ত্রের জন্যও অত্যাবশ্যক ।

৮. স্বৈরশাসন রোধ : মন্টেস্কু তাঁর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের পাশাপাশি স্বৈরশাসন প্রতিহতকরণের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মন্টেস্কুর সমসাময়িককালে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশেই স্বৈরশাসন বিরাজ করছিল। আর স্বৈরশাসনের যাতাকলে জনগণ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। পাশাপাশি ইংল্যাণ্ড সরকারের বিভাগসমূহ পৃথক পৃথকভাবে কাজ করছিল। সেখানে স্বৈরশাসন এতটা ছিল না। যে কারণে তিনি স্বৈরশাসন রোধের জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অপরিহার্যতার কথা বলেন।

মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমালোচনা  Criticism of the Theory of Separation of Power of Montesquieu

মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে বিভিন্ন গবেষক বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে সমালোচনার প্রয়াস পান। নিম্নের ‘সমালোচনামূলক আলোচনায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে :

১. বিভিন্ন বিভাগের বিভক্তিকরণ সঠিক নয় : মন্টেস্কুর বিভক্তিকরণের সমালোচনা করে জেঙ্কস্ বলেন যে, ক্ষমতা মূলত দুটি। যথা : শাসন বিভাগীয় ও আইন বিভাগীয়। তাঁর মতে, বিচার বিভাগ মূলত শাসন বিভাগের অন্তর্গত। আবার উইলোবী রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনকেও বিভাগের মর্যাদা প্রদানে আগ্রহী।

২. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণে দায়িত্বহীনতার সৃষ্টি হয় : অধ্যাপক লাস্কি মনে করেন যে, সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ যদি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে কাজ করে তবে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে। ফলে স্বতন্ত্র বিভাগগুলো পরস্পরের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করবে এবং সংঘাত থেকে বিপ্লরের সৃষ্টি হবে।

৩. শাসন বিভাগের কার্যক্রম প্রসঙ্গে। শাসন বিভাগ সাধারণত অন্য বিভাগের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে। কিন্তু তিনটি বিভাগের পৃথকীকরণ হলে শাসন বিভাগ তাঁর সমময়মূলক ভূমিকা পালন করতে না পারার দরুন সকল ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে।

৪. আইন বিভাগের প্রাধান্য। মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের তিনটি বিভাগকে সমমর্যাদা সম্পন্ন করা হয়েছে বিধায় অনেকে এর সমালোচনা করেছেন। কেননা, আধুনিক শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগের স্থান অন্য বিভাগের ঊর্ধ্বে। শাসন বিভাগের উপর আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ব্রিটেনে এই নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ অধিক হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে কম ।

৫. সংসদীয় ব্যবস্থায় অসম্ভব : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, যে কারণে মন্ত্রিগণ একাধারে আইনসভা ও মন্ত্রিসভার সদস্য। আর শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের সদস্য একই ব্যক্তি হওয়ার কারণে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী প্রকৃত পৃথকীকরণ সম্ভব হয় না।

৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রসঙ্গে : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে বলে অনেকে মনে করেন। যেমন : ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রশ্নে আইন বিভাগ আইন পাস করল, কিন্তু শাসন বিভাগ তা বাস্তবায়ন করল না। এতে করে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনা থাকবে ।

৭. শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের ফলে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে। কেননা, শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে শাসন বিভাগের। এক্ষেত্রে আইন বিভাগ কর্তৃক পাসকৃত আইন দ্বারা শাসন বিভাগ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে উভয় বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের ফলে সমন্বয় ব্যাহত হবে।

৮. অচলাবস্থার সৃষ্টি করে : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিল (Mill) তাঁর “Representative Government” গ্রন্থে বলেন যে, সরকারের প্রত্যেক বিভাগ যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র হয়, তবে একে অপরের কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।

৯. কর্মদক্ষতা হ্রাস : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির কঠোর প্রয়োগ সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। ফলে এতে করে ঐক্যের মনোভাব ক্ষুণ্ণ হয় এবং সরকারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। যে কারণে, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য অবাঞ্ছনীয় বটে।

১০. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাম্য নয় : অনেকেই রাষ্ট্রকে জীবদেহের সাথে তুলনা করে বলেছেন, জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন পরস্পরের সাথে রক্ত-মাংসের সম্পর্কে আবদ্ধ, সরকারের তিনটি বিভাগও তেমনি ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। একটিকে অপরটি হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করলে সরকারের অপমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

১১. পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ অবাস্তব : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবে কোথাও কার্যকর হয়নি। মার্কিন সংবিধানে যদিও এর প্রবর্তন হয়েছিল তথাপি এর পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। যেমন : মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইন পরিষদ কর্তৃক অপসারিত হন। আবার বিচার বিভাগ ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে অনেক সময় আইন প্রণয়ন করেন।

১২. ফাইনারের অভিমত : ফাইনারের (Finer) মতে, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা হলে সরকার কখনো বা মূর্ছিত হবে, আবার কখনো বা ধনুস্টংকার রোগীর মতো হাত-পা ছুঁড়তে থাকবে।

১৩. মন্টেস্কুর অভিমত অসম্পূর্ণ : মন্টেস্কু অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, “ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ব্যতীত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হতে  পারে না।” কিন্তু তাঁর এই অভিমত ঠিক নয়। কারণ জনগণের সতর্ক দৃষ্টিই ব্যক্তি স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব আলোচনা পরবর্তীতে এটা বলা যায় যে, আধুনিক যুগে সরকারের ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যেক বিভাগকেই একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হয় তাই ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সম্ভব নয় এবং যুক্তিযুক্ত বা কাম্যও নয়। এই নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা অনৈক্য সৃষ্টি হবে, বরং বিভিন্ন বিভাগ যাতে করে সুবিন্যস্ত ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন

করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

Leave a Reply