ব্রিটেনে বিরোধী দলের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

ব্রিটেনে বিরোধী দলের ক্ষমতা ও কার্যাবলি  বিরোধী দল  The Opposition

পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থায় সাধারণ নির্বাচনে একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে এবং অন্যান্য দলের মধ্যে সর্ববৃহৎ দলটি বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফাইনার, লাস্কি, জেনিংস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন বিরোধী দল হলো ছায়া সরকার (Shadow Government)। স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) বলেছেন, “The opposition is at once the alternative to the

Government and a focus for the discontent of the people. If there is no opposition, there is no democracy.”

পেংগুইন অভিধানে বলা হয়েছে, বিরোধী দল বলতে এমন এক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলকে বোঝায়, যারা সরকারের নীতি ও আদর্শকে পরিবর্তন করতে চায় ।

মাইকেল কার্টিস (Michael Curtis) বলেছেন, যে দল সরকার গঠন করে না কিন্তু সরকার পরিচালনায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জড়িত থাকে, তাকে বিরোধী দল বলে ।

ব্রিটেনে বিরোধী দল : ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচনে যে দল কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল সরকার গঠন করে আর আসন সংখ্যার ভিত্তিতে যে দল সরকারি দলের পরবর্তী স্থান লাভ করে তাকে সরকারি বিরোধী দল বলা হয়। ১৮২৬ সালে স্যার জন ক্যাম হবহাউজ (Sir John Cam Hobhouse) মহামান্য রাজা বা রানীর সরকার (His or Her Majesty’s Government) এর অনুসরণে বিরোধী দলকে মহামান্য রাজা বা রানীর বিরোধী দল ( His or Her Majesty’s Opposition) হিসেবে অভিহিত করেন। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত সবসময় বিরোধী দলকে মহামান্য রাজা বা রানীর বিরোধী দল হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৩৭ সালে রাজমন্ত্রী আইনে (Ministers of the Crown Act, 1937 ) বিরোধী দল ও নেতার সংজ্ঞা ও স্বীকৃতি সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ব্রিটেনে সরকারকে বলা হয় মহামান্য রাজা যা রানীর সরকার (His or Her Majesty’s Government) এবং বিরোধী দলকে বলা হয় মহামান্য রাজা বা রানীর বিরোধী দল (His or Her Majesty’s Opposition ) ব্রিটেনে রক্ষণশীল দল (Conservative Party) এবং শ্রমিক দল (Labour Party) এই দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। তাই ব্রিটেনে সরকারি দল ও বিরোধী দলকে চিনতে অসুবিধা হয় না ।

বিরোধী দলের বিবর্তন : ১৮৩২ সালের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক অর্থে ব্রিটেনে কোনো বিরোধী দল ছিল না। ১৮৩২ সালের সংস্কার আইন প্রণীত হবার পূর্বে ব্রিটেনে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল কমন্সসভার উপর। কিন্তু এই বছরে সংস্কার আইন পাস হয়ে যাবার ফলে ভোটারের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং একই সাথে দলীয় ব্যবস্থা সুসংহতভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কমন্সসভা কার্যত দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায় : যথা-সরকারি দল ও বিরোধী দল। যে দল সরকার গঠন করত কমন্সসভায় সেই দলের সদস্যরা সরকারকে সমর্থন করতে শুরু করে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন নয় এমন দল বা দলগুলি সরকারের সমালোচনা অব্যাহত রাখে। তারপর ১৯৩৭ সালের রাজমন্ত্রী আইনে (Ministers of Crown Act) বিরোধী দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অংশ (Counter part) ঘোষণা করে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। বিরোধী দলের নেতাকে সঞ্চিত তহবিল থেকে বছরে ৪,৫০০ পাউন্ড বেতন দেওয়া হয় ।

কমন্সসভায় বিরোধী দলের স্থান : সাংবিধানিক স্বীকৃতির পর থেকে কমন্সসভায় স্পিকার বিরোধী দলের সদস্যদের আসন নির্দিষ্ট করে দেন। স্পিকারের ডান দিকে বসেন ক্ষমতাসীন দলের সদস্যগণ এবং বাম দিকে বসেন বিরোধী দলের সদস্যগণ। ডান দিকে একেবারে প্রথম সারিতে মন্ত্রীগণ আসন গ্রহণ করেন এবং বাম দিকে প্রথম সারিতে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার বিপরীত দিকে ছায়া মন্ত্রিসভা (Shadow cabinet) অবস্থিত। রাজা বা রানীর সরকার (His or Her Majesty’s Government)-এর বিপরীতে মহামান্য রাজা বা রানীর বিরোধী দল (His or Her Mejesty’s opposition ) অবস্থিত, বিরোধী দলকে আবার মহামান্য রাজা বা রানীর বিকল্প সরকার (His or Her Majesty’s Altenative Government ) বলা হয়। কারণ নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয় ঘটলে বিরোধী দল সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করে এবং আগেকার সরকারি দল তখন বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ।

ব্রিটেনে বিরোধী দলের ক্ষমতা কার্যাবলি
Powers and Functions of the Opposition in Britain

ব্রিটেনে বিরোধী দলের ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।

ক. সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা : বিরোধী দলের প্রধান কাজ হলো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। সরকারের প্রতিটি কাজে অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা করা বিরোধী দলের কাজ নয়। বিরোধী দল সরকারের নীতি, প্রস্তাব ও কাজ-কর্ম পর্যালোচনা করে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে বিরোধী দলের সমালোচনাকে অবশ্যই আনুগত্যপূর্ণ, গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল হতে হয়। বিরোধী দলের সমালোচনার জন্য সরকার দায়িত্বশীল থাকতে বাধ্য হয়। জে. এ. কোরি (J.A. Corry)-র মতে, বিরোধী দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে চেতনাই সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কোরী (Corry) বলেছেন, “It is not the repeated trial of strength between the horse and the fence that keeps the horse in pasture but that the fence is there and the horse knows it.”

খ. সরকারের বিরোধিতা করা : বিরোধী দলের অন্যতম কাজ হলো সরকারের বিরোধিতা করা। পূর্বে সরকারের প্রতিটি কাজের বিরোধিতা করাই ছিল বিরোধী দলের একমাত্র কাজ। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হুইগ নেতা টায়ার্নে (Tierney ) বলেছিলেন— “The duty of the opposition is propose nothing to oppose everything and to turn out the government.” বিরোধী দলের লক্ষ্য হলো সরকারের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি এবং অভিযোগ তুলে ধরে সরকারের জনসমর্থন নষ্ট করা। র‍্যানডলফ চার্চিল (Randolph Churchill) বলেন, “The function of the opposition was to oppose and not to support the government.”

অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের প্রকারভেদ
Different Kinds of Delegated Legislation

অর্পিত ক্ষমতা বলে সাধারণত ৪ ধরনের আইন প্রণীত হয়ে থাকে, যথা-(১) স-পরিষদ রাজাদেশ (orders in council) (২) আদেশ, বিধি-বিধান (Orders, Regulations ) প্রভৃতি, (৩) অনুমোদন সাপেক্ষ ও বিশেষ পদ্ধতিগত আদেশ (Provisioal & special procedure orders) এবং (৪) উপ-বিধি (By-Laws)। সপরিষদ রাজাদেশ আবার দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা—

ক. বিশেষাধিকার সংক্রান্ত আদেশ এবং খ. রাজকীয় ঘোষণা ।

 

অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইনের উদ্ভবের ইতিহাস

History of the Emergence of Delegated Legislation

ব্রিটেনে চতুর্দশ শতাব্দিতে অর্পিত ক্ষমতা বলে আইন প্রণয়নের নজির পরিলক্ষিত হয়। এ সময় রাজাই এই অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ১৩৮৫ সালের এক আইন অনুযায়ী আইন প্রণয়নের কিছু ক্ষমতা রাজার হাতে অর্পিত হয়। এরপর ১৫৩১ সালের একটি আইন অনুযায়ী অর্ডিন্যান্স ও ডিক্রি জারি সমেত নিয়ম কানুন প্রণয়নের ক্ষমতা রাজার হাতে ন্যস্ত হয়। স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন প্রণয়নের প্রথা অনেক বেড়ে যায়। ১৬৮৯ সালের পর কয়েকটি আইন পাস করে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নকে আরও জোরদার করা হয়। এগুলোর মধ্যে রাজদ্রোহ আইন (Mutiny Act) উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতাব্দিতে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। এ শতাব্দি থেকে অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন প্রণয়নের মাত্রা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে এবং উনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় ভাগে সরকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। বর্তমান শতাব্দিতে এ ধরনের আইন প্রণয়নের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ওয়েড (Wade) বলেছেন, “Now-a-

days if we are to retain parliamentary government in its present form no one can seriously question the jurisdiction of suborinate legislation on a grand scale.”

অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নের কারণ
Reasons of Delegated Legislation

অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে সব কারণে বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা : আধুনিককালে রাষ্ট্রের কার্যাবলি সংক্রান্ত ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দির পুলিশী রাষ্ট্রের ধারণা এখন পরিত্যক্ত হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এখনকার জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য কাজ করতে হয়। তাই রাষ্ট্রের কার্যক্ষেত্রের পরিধি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ক্রমবর্ধমান কাজের দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়। এজন্য সরকারকে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করতে হয়। পার্লামেন্টের পক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। হার্ভে এবং ব্যাথার (Harvey and Bather), “The functions of the state are now so extensive that parliament attempted to enact statutes in detail the legislative machinery would break down.”

খ. আইন প্রণয়নের জটিলতা : আধুনিক কালে আইন প্রণয়নের জটিলতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। অনেক কারিগরি, বৈজ্ঞানিক বা অত্যন্ত জটিল বিষয়ের উপর পার্লামেন্টকে আইন প্রণয়ন করতে হয়। অথচ আধুনিক কলাকৌশলের উপর আইন প্রণয়ন করা কষ্টসাধ্য। প্রয়োগিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলে আইন প্রণয়ন করা যায় না, এজন্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ ধরনের কলাকৌশলগত জ্ঞান রয়েছে উচ্চপদস্থ আমলাদের। মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে আমলাগণ প্রয়োজনীয় বিধি ও উপবিধি তৈরি করে দেন।

গ. সময়ের স্বল্পতা : পার্লামেন্টের সদস্যদের হাতে সময়ের অভাব অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতেক বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে অল্প কিছু দিনের জন্য পার্লামেন্টের অধিবেশন বসে। অথচ বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য আইন প্রণয়নের চাপ থাকে। এই ক্রমবর্ধমান আইন প্রণয়নের জন্য যে সময় নির্দিষ্ট থাকে তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তাছাড়া অল্প সময়ে আইনের খসড়া প্রণয়ন করলে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য পার্লামেন্ট শাসন বিভাগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে।

ঘ. জরুরি অবস্থার মোকাবিলা : জরুরি অবস্থা বা আপৎকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পার্লামেন্টের পক্ষে দ্রুত এবং দৃঢ়তার সাথে দেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রত্যেক দেশের শাসন বিভাগের হাতে আইন প্রণয়নের পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা দরকার। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য শাসন বিভাগের হাতে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা অর্পণ করে। ওয়েড (Wade) বলেছেন, “The Government relies mainly delegated legislation for the exercise of emergency powers.” যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সাম্রাজ্য প্রতিরক্ষা আইন (The Defence of Realms Act, 1914-15) এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জরুরি ক্ষমতা আইন (The Emergency Power Defence Act, 1939-40 ) এর মাধ্যমে বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার ব্যাপারে ব্যাপক ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে।

ঙ. পার্লামেন্টের সদস্যদের দক্ষতা বিশেষীকৃত জ্ঞানের অভাব : বর্তমানে আইন প্রণয়নের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ আইনের সকল দিক বিচার-বিশ্লেষণের পর সুষ্ঠু আইন প্রণয়নে সাহায্য করতে পারেন। আইন প্রণয়নের জন্য যে ব্যবহারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োজন তা পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যদের থাকে না। আইনসভার গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে এ কারণে আইনসভা আইন প্রণয়নের কিছু ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেছে।

চ. আইনের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ : পার্লামেন্ট সদস্যগণ সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এবং সম্ভাব্য অবস্থার অনুমানের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করেন। ভবিষ্যতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ও সমস্যাবলি আগে ভাগে অনুমান করে সেই অনুসারে আইন প্রণয়ন করা হয় না। ফলে প্রণীত আইনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি থেকে যায়। আইনকে ত্রুটিমুক্ত ও গতিশীল করার জন্য শাসনবিভাগকে কিছু দায়িত্ব নিতে হয় । শাসন বিভাগ পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের মূলকাঠামোর মধ্যে থেকে উপ-আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মূল আইনকে প্রাসঙ্গিক এবং যুগোপযোগী করে তোলে।

ছ. সন্তোষজনক আইন প্রণয়ন : একটি বিলের খসড়া রচনা করতে হলে সময় ও অবসর একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু পার্লামেন্টে সেই বিল যদি নির্দিষ্ট সময়ে পেশ করার তাগিদ থাকে তাহলে তাড়াহুড়োর কারণে বিলে অনেক ত্রুটি থেকে যায় ৷ স্যার উইলিয়াম গ্রাহাম হ্যারিসন (Sir William Graham Harrison)-এর মতে, যে অবস্থায় পার্লামেন্ট আইন পাস করে তা সন্তোষজনক নয় এবং এজন্য যে সময় দেওয়া হয় তাও অপর্যাপ্ত। কিন্তু অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের ফলে আইন হয় যুক্তিপূর্ণ এবং বোধগম্য ।

জ. পার্লামেন্টের কাজের উপর অসম্ভব চাপ : আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পার্লামেন্ট অধিক পরিমাণে আইন প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু সকল বিষয়ের উপর স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। তাই পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজের একটা বড় অংশ শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করতে বাধ্য হয়েছে। শাসনবিভাগের বিভিন্ন দপ্তর পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের সংশোধন, সংযোজন, ব্যাখ্যা ইত্যাদি কাজ করে। এমনকি প্রয়োজনবোধে নতুন আইন প্রণয়ন করে দেয় ।

ঝ. পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব : পার্লামেন্টের মতো একটি বিশাল সংস্থার পক্ষে আইন প্রণয়ন করে পরীক্ষা চালানো সম্ভব নয়। তাছাড়া পরীক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত সময় পার্লামেন্টের হাতে নেই। তাই আইনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি শাসন বিভাগ বা সরকারের অন্যান্য দপ্তরের উপর ন্যস্ত করে দিতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে আইন হয়ে ওঠে গণমুখি ও কল্যাণমুখি । এই কারণে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নকে উৎসাহিত করা হয়।

ঞ. পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব : আগে পার্লামেন্ট তথ্যের বড় উৎস হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে আইন প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পার্লামেন্টের সদস্যদের হাতে নেই। প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর হাতে আইন প্রণয়নের খুঁটিনাটি তথ্যাদি সঞ্চিত থাকে, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মন্ত্রীগণ উচ্চপদস্থ আমলাদের সাহায্যে বিলের খসড়া ও উপবিধিসমূহ প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন।

ট. আইন পরিপূর্ণ হয় : অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন সংক্ষিপ্ত আকারের হয়ে থাকে। সময়ের স্বল্পতার কারণে পার্লামেন্টে অতি দ্রুত বিল পাস করা হয়, বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে না। এভাবে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন অতি সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা দেখা দেয়, কিন্তু অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনকে সংক্ষিপ্ত করার কোনো প্রয়োজন থাকে না। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে শাসনবিভাগ এই আইন প্রণয়ন করে। ফলে পার্লামেন্ট প্রণীত আইন পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং আইনের অসম্পূর্ণতা দূরীভূত হয়।

ঠ. জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিবেশ : আধুনিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। শাসনবিভাগই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জটিলতার কারণে আইনবিভাগ আইন প্রণয়নের কিছু দায়িত্ব শাসনবিভাগের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে শাসন বিভাগ আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে থাকে। ১৯৩২ সালে মন্ত্রীর ক্ষমতা সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল। In truth whether good or bad the development of the practice (delegated legislation) is enevitable.

অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের সমালোচনা
Criticism of Delegated Legislation

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের সমালোচনা করা হয়েছে:

ক. পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার বিরোধী : ব্রিটেনে পার্লামেন্টের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত। কিন্তু অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থার মৌলিক রীতিনীতির বিরোধী। কেননা পার্লমেন্টারি শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টই আইন প্রণয়ন করে এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার এই মৌলিক নীতি অকার্যকর হয়ে পড়েছে ।

খ. ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পত্তি হরণকারী : অবাধ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নকে সমালোচনা করা হয়েছে। উদারনৈতিক সমাজে সম্পত্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর নাগরিকের অবাধ অধিকার থাকে এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু শাসনবিভাগের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করলে জনপ্রতিনিধিগণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং সরকারি কর্মকর্তাগণ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ইচ্ছেমতো আইন প্রণয়ন করবেন।

গ. পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বিরোধী : অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বিরোধী । আইন প্রণয়নের ব্যাপারে পার্লামেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিভাগ থাকবে না এবং পার্লামেন্টের দ্বারা প্রণীত আইন হবে চরম ও অবাধ, কিন্তু অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়ন মেনে নিলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে। এর ফলে শাসন বিভাগের আইন ও পার্লামেন্টের আইনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এতে পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে ।

ঘ. আমলাতান্ত্রিক : অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পার্লামেন্ট শাসনবিভাগের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করে। কার্যত শাসন বিভাগ পদস্থ আমলাদের সাহায্যে আইন প্রণয়ন করে থাকেন ৷ উচ্চপদস্থ আমলারাই বিচক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। আমলাগণ তাদের খেয়াল খুশিমতো আইন প্রণয়ন করেন বলে তা জনস্বার্থের অনুগামী হতে পারে না ।

ঙ. আইনের শাসন লঙ্ঘন করে : অর্পিত ক্ষমতা আইন আইনের শাসনের বিরোধী। শাসনবিভাগকে পালার্মেন্টের অধিবেশন আহ্বান, বিল উত্থাপন, বিতর্ক, কমিটি স্তরে বিল প্রেরণ, রাজা বা রানীর কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ এ সবস্তরের কোনোটাই পালন করতে হয় না, তাই অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন প্রণয়নের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

চ. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিরোধী : অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিরোধী, এই নীতি অনুযায়ী সরকারের কোনো বিভাগ অপর বিভাগের কাজ করবে না এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে শাসনবিভাগ আইন বিভাগীয় কার্যসম্পাদন করে।

অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইনের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন প্রণয়নকে অবধারিত বলা যায়। ওয়েড, হার্ভে, বেথার, জেনিংস প্রমুখ সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন যে, পার্লামেন্ট যদি শাসনবিভাগ বা মন্ত্রীদের হাতে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ না করত তাহলে আইন প্রণয়ন ও শাসন কার্যের সুষ্ঠু পরিচালন দুটোই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। লর্ড মরিসন (Lord Morrison) বলেছেন, “The principle of delegated legislation, I think right but I must emphasis that it is well for parliament to keep a watchful and even jealous eye on it at all stages.”

Leave a Reply