ব্রিটেনে কেবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

ব্রিটেনে কেবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

ব্রিটেনে কেবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

কেবিনেট ব্যবস্থার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ

Origin and Development of the Cabinet System

ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে সপ্তদশ থেকে বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত ব্যাপ্ত ক্রমবিকাশের ধারায় গড়ে উঠেছে। প্রিভি কাউন্সিলই হলো কেবিনেট ব্যবস্থার মূল উৎস, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন বা ঐতিহাসিক দলিল দ্বারা ব্রিটিশ কেবিনেটের উৎপত্তি হয়নি। ব্রিটিশ কেবিনেটের নির্দিষ্ট কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কেবিনেট সম্পর্কিত যাবতীয় নিয়ম-নীতি ব্রিটেনের সাংবিধানিক প্রথা ও রীতিনীতির উপর নির্ভরশীল।

ক. কেবাল থেকে কেবিনেটের উৎপত্তি : আইনগত বিচারে কেবিনেট হলো প্রিভি কাউন্সিলের একটি কমিটি মাত্র। স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে প্রিভি কাউন্সিল একটি বৃহদায়তন বিশিষ্ট সংস্থায় পরিণত হয়। বিভিন্ন শ্রেণির বহু লোককে নিয়ে এই সংস্থা গঠিত হয়। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় চার্লস কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে প্রীতিভাজন পাঁচজনকে নিয়ে একটি পরামর্শক সভা গঠন করেন। এই পাঁচজন ব্যক্তি হলেন— ক্লিফোর্ড (Cliford), অ্যাশলে (Ashley), বাকিংহাম (Buckinghamn), আরলিংটন (Arlington) এবং লডারডেল ( Louderdale)। এ পাঁচজন ব্যক্তির নামের প্রথম অক্ষর এ পরামর্শ সভাকে বলা হয় ক্যাবাল (CABAL)। অনেকের মতে, এই CABAL থেকেই কেবিনেটের উৎপত্তি হয়েছে।

খ. গৌরবময় বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া : ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পর ব্রিটেনের সাংবিধানিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সময় ব্রিটেনের উদীয়মান ধনিক-বণিক শ্রেণির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। এদের দাবি অনুযায়ী তৃতীয় উইলিয়াম পার্লামেন্টের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের ভেতর থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করতে সম্মত হন। তাছাড়া এই নীতিও স্বীকৃত হয় যে, মন্ত্রীদের অস্তিত্ব পার্লামেন্টের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল থাকবে |

গ. সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একদলীয় মন্ত্রিসভা : গৌরবময় বিপ্লবের পর থেকে ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলসমূহের উদ্ভব ঘটে। ব্রিটেনে এ সময় হুইগ (Whig) ও টোরী (Tory) এই দুটি রাজনৈতিক দল বর্তমান ছিল। রাজা তৃতীয় উইলিয়াম শুরুতে দুটি দল থেকেই মন্ত্রী নিযুক্ত করতে থাকেন। কিন্তু উভয় দলের সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে তৃতীয় উইলিয়াম কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হুইগ দল থেকেই মন্ত্রী নিয়োগ করতে শুরু করেন। এভাবে রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের রাজত্বকালে প্রথম পার্লামেন্টের আস্থাভাজন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে একদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের রীতি চালু হয়। রানী অ্যানও এ নীতি অনুসরণ করেন। রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ও রানী অ্যান মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করতেন ।

ঘ. আধুনিক কেবিনেট ব্যবস্থার জন্ম : হ্যানোভার বংশের রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও আধুনিক কেবিনেট ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে বলা যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় জর্জের আমলে কেবিনেট শাসনের কতকগুলো মূলনীতির সৃষ্টি হয়। রাজা প্রথম জর্জ বিদেশি ছিলেন। তিনি ইংরেজি জানতেন না। তাই তিনি কেবিনেটের অধিবেশনে উপস্থিত থাকতেন না। রাজা প্রথম জর্জ কেবিনেটের অন্যতম প্রবীণ সদস্য স্যার রবার্ট ওয়ালপোল (Robert Walpole)-কে কেবিনেট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার এবং কার্যপরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

ঙ. রবার্ট ওয়ালপোল প্রথম প্রধানমন্ত্রী : স্যার রবার্ট ওয়ালপোলকেই ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। তাঁর সময় (১৭২১-১৭৪২) কেবিনেট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়। এই সংস্থা রাজার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করে। রবার্ট ওয়ালপোল এর সময় কেবিনেট শাসনব্যবস্থার কয়েকটি মূলনীতির উৎপত্তি হয়। তাঁর আমলেই রাজার প্রধান পরামর্শদাতা, কমন্সসভার নেতা এবং কেবিনেটের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। ১৭৪২ সালে ওয়ালপোল কমন্সসভার অধিবেশন সদস্যের সমর্থন হারানোর পর পদত্যাগ করেন। ফলে কমন্সসভার কাছে মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতার নীতি প্রবর্তিত হয়।

চ. রাজা তৃতীয় জর্জ-এর আমলে কেবিনেট প্রথার পূর্ণবিকাশ : ব্রিটেনে কেবিনেট প্রথার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে রাজা তৃতীয় জর্জের আমলে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উইলিয়াম পিট শাসন ব্যবস্থায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০৭ সালে রাজা তৃতীয় জর্জ গ্রেনভিল মন্ত্রিসভার উপর এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাপ সৃষ্টি করেন যে, রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু গ্রেনভিল মন্ত্রিসভা তৃতীয় জর্জের এই নির্দেশ মেনে নিতে অস্বীকার করে। কেবিনেট এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে The crown must not fetter its advisers by exacting pledge as to their future action অর্থাৎ রাজা কোনো কিছু করার জন্য বাধ্য করতে পারেন না ।

ছ. বিভিন্ন ধরনের আইন : ১৮৩২ সালে সংস্কার আইন (Act of Reform) গৃহীত হলে রাজার শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় এবং কেবিনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে রাজকীয় মন্ত্রী আইন (The Ministers of the Crown Act) প্রণয়নের দ্বারা মন্ত্রীদের বেতন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে “মন্ত্রীদের বেতন এবং সদস্যদের অবসরকালীন ভাতা আইন” (The Ministerial Salaries and Members Pensions Act, 1965) এর মাধ্যমে একমাত্র লর্ড চ্যান্সেলর ছাড়া মন্ত্রী এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি করা হয় ।

 

কেবিনেটের সংজ্ঞা Definition of Cabinet

ব্রিটিশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কেবিনেট। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব কেবিনেটের উপর ন্যস্ত। ব্রিটেনের কেবিনেট ব্যবস্থা সাংবিধানিক প্রথা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৩৭ সালে রাজকীয় মন্ত্রী আইন (The ministers of the crown Act) এর পূর্বে পার্লামেন্ট প্রণীত কোনো আইনেই কেবিনেটের উল্লেখ ছিল না।

রাজার আস্থাভাজন প্রিভি কাউন্সিলরদের নিয়ে যে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো তাকেই ঐতিহাসিক দিক থেকে কেবিনেট বলা হয়। (Historically the cabinet is a private meeting of those Privy councilors in whom the sovereign has particular confidence for the time being) পরবর্তীকালে পার্লামেন্টের উদ্ভব ঘটায় কেবিনেটের সদস্যগণ পার্লামেন্টের সদস্য হন এবং সদস্য হওয়া সাংবিধানিক রীতিনীতির দিক থেকে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য কেবিনেটকে পার্লামেন্টের

 

একটি কমিটি বলা হয় এবং এ কমিটি গণতন্ত্র বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। (The Cabinet is a committee of Parliament tending to be with the advance of democracy, a committee of the House of Commons)

ম্যারিয়ট (Marriot) বলেছেন, কেবিনেট হলো এমন একটি কীলক, যাকে কেন্দ্র করে সমগ্র রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হয়। (The pivot round which the whole political machinery revolves)। লাওয়েল (Lowel) বলেছেন, কেবিনেট হলো রাজনৈতিক তোরণের মধ্যপ্রস্তর। (The key stone of the political arch).

এস. ই. ফাইনার (S.E. Finer) বলেছেন, “কেবিনেট হলো সমগ্র সরকারি কাঠামোর ক্ষমতার কেন্দ্রস্বরূপ।” (The cabinet is the power house of the entire government system,)

এল.এস. আমেরী (I..S. Amery)-এর মতে, “কেবিনেট হলো সরকারের প্রধান নির্দেশদানকারী সংস্থা।” (The cabinet is the central directing instrument of government).

ওয়াল্টার বেজহট (Walter Bagchot) এর মতে, “কেবিনেট হলো একপ্রকার সংযোজক চিহ্ন এবং ঢাল বিশেষ, যা শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগকে একত্রে বেঁধে দেয়।” (The cabinet is a hypen that joins the buckle that fastens the executive and legislative departments together).

লর্ড মলি (Lord Morley) বলেছেন, ‘কেবিনেট হলো রাজনৈতিক তোরণের মূল ভিত্তি।’ (‘The Cabinet is the keystone of the political arch).

আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings)-এর মতে, “কেবিনেট হলো জাতীয় নীতি নির্ধারক সংস্থা বিশেষ।” (The cabinet is the directing body of the national policy)। তিনি আরও বলেন, “Cabinet is the board of control.”

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, কেবিনেট হলো ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং মস্তি * বিশেষ। একে কেন্দ্র করেই সমগ্র প্রশাসন আবর্তিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সংযোগ রক্ষিত হয় এবং উভয় বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

 

ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

Characteristics of the British Cabinet System

ব্রিটেনে কেবিনেট শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। ব্রিটিশ কেবিনেট শাসনব্যবস্থার কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. সাংবিধানিক প্রথার উপর কেবিনেট প্রতিষ্ঠিত : ব্রিটেনের কেবিনেট শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি সাংবিধানিক প্রথার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনের দ্বারা নির্ধারিত নয়। তবে ১৯৩৭ সালের রাজকীয় মন্ত্রী আইনে কেবিনেটের অতি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে। এর মাধ্যমে কেবিনেট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ” সুতরাং ব্রিটিশ কেবিনেটের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এটি ক্রমবিবির্তনের ফল ।

খ. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র : কেবিনেট শাসনব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করছেন রাজা বা রানী। তবে তিনি নামমাত্র শাসক প্রধান। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা কেবিনেটের হাতে ন্যস্ত। রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন না, এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। হ্যানোভার বংশের রাজা প্রথম জর্জের আমল থেকে এ প্রথার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বলা হয়, ব্রিটেনের রাজা রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না ।

গ. কেবিনেটই প্রকৃত শাসক : ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার প্রকৃত শাসক হলো কেবিনেট। ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা মন্ত্রীদের হাতে ন্যস্ত থাকে। কেবিনেটের সদস্যগণ রাজা বা রানীর নামে নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগ করেন। কিন্তু রাজা বা রানীর কোনো রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব নেই। সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে কেবিনেটের উপরই বর্তায়। কেবিনেটই প্রকৃত শাসন বিভাগ। ব্রিটেনে প্রকৃত প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বলতে কেবিনেটকেই বোঝায় ৷

ঘ. প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য : প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও প্রাধান্য ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানী কর্তৃক নিযুক্ত হন। তাঁর পরামর্শে রাজা বা রানী মন্ত্রীদের নিযুক্ত করেন এবং তাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন। তিনি কেবিনেটের সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সরকারি নীতি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই কেবিনেটের উত্থান-পতন ঘটে। অধ্যাপক কে. সি. হোয়ার (K.C. Wheare) বলেছেন, “In theory, primus inter pares, he is in practice the motive force and directing head of the whole government.” অধিবেশনকালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এত বেড়েছে যে, অনেকে ব্রিটেনের সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলে অভিহিত করেন।

৫. কেবিনেট সদস্যগণ পার্লামেন্টের সদস্য ব্রিটেনের কেবিনেটের সাথে পার্লামেন্টের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কেবিনেটের সদস্যদের পার্লামেন্টের যেকোনো কক্ষের সদস্য হতে হয়। পার্লামেন্টের সদস্য না হয়েও কোনো ব্যক্তি কেবিনেটের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে ৬ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের সদস্যপদ লাভ করতে হয়। তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে কমন্সসভার সদস্য হতে পারেন, আবার রাজা বা রানী দ্বারা মনোনীত হয়ে লর্ডসভার সদস্য হতে পারেন। অন্যথায় তাকে কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করতে হয়।

চ. সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি : ব্রিটেনে কমন্সসভার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল সরকার গঠন করে। ঐ দলের নেতাকে রাজা বা রানী কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানান। কমন্সসভায় কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে কমন্সসভার আস্থাভাজন ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ফলে একাধিক দলের সমন্বয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।

ছ. আইন বিভাগ শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক : কেবিনেট সদস্যগণ পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে। কেবিনেট পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন ও আস্থা অর্জন করে। পার্লামেন্ট কেবিনেটের কোনো কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। মন্ত্রিগণ পার্লামেন্টে বসেন, বক্তৃতা করেন এবং ভোটাভুটিতে অংশ নেন।

জ. মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতা : ব্রিটিশ কেবিনেট সদস্যগণ তাদের নীতি ও কাজের জন্য কমন্সসভার কাছে ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকেন। প্রত্যেক মন্ত্রী নিজ দপ্তরের সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলির জন্য কমন্সসভার কাছে ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য। আবার কেবিনেট যে সব নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার জন্য সকল মন্ত্রীকে যৌথভাবে কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। লর্ড মর্লি (Lord Morley) বলেছেন, The first mark of the cabinet is united and.. indivisible responsibility। কেবিনেটের এই দায়িত্বশীলতার জন্য কেবিনেট শাসনব্যবস্থাকে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা বলা হয়।

ঝ. গোপনীয়তা রক্ষা : কেবিনেট ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর গোপনীয়তা রক্ষা করা। কেবিনেট বৈঠকের আলোচনা, কার্যবিবরণী, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি হলো অতি গোপনীয় ব্যাপার। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার শপথ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে কেবিনেটের আলোচনা বা সিদ্ধান্ত যদি বাইরে প্রকাশিত হয় তাহলে দেশের সার্বিক স্বার্থের মারাত্মক ম – হতে পারে।

ঞ. ঐক্য সংহতি : কেবিনেট মন্ত্রীদের ঐক্য ও সংহতি হলো ব্রিটেনের কেবিনেট শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কেবিনেটের সদস্যগণ একই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন বলে তাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ় বন্ধন থাকা জরুরি । কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু তা পার্লামেন্টে কিংবা জনসমক্ষে প্রচার করা যায় না। কেবিনেটকে একটি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ সংস্থা হিসেবে কাজ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে লর্ড মেলবোর্ন (Lord Melbourne ) বলেন, “It does not in the least matter what we say, but we must all say the same.”

ট. বিরোধী দলের অস্তিত্ব : কেবিনেট ব্যবস্থার অন্যতম বিষয় হলো শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব। এই বিরোধী দলকে মহামান্য রাজা বা রানীর বিরোধী দল ( His or Her Majesty’s Opposition) বলে অভিহিত করা হয়। বিরোধী দল সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করে এবং সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি জনসমক্ষে তুলে ধরে। তাছাড়া কোনো কারণে সরকারের পতন ঘটলে বিরোধী দলকে সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তাই বিরোধী দলকে ব্রিটেনে রাজা বা রানীর বিকল্প সরকার (His or Her Majesty’s Alternative Government) বলা হয়।.

 

ঠ. দলীয় শাসনব্যবস্থা : ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থা মূলত দলীয় শাসনব্যবস্থা। কমন্সসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাজা বা রানী সেই দলকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। তবে নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে একাধিক দলের সমন্বয়ে যৌথ সরকার (Coalition Government ) গঠিত হয়। সাধারণত একই রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিয়ে কেবিনেট গঠিত হয়।

ড. কমন্সসভার নেতা প্রধানমন্ত্রী হন: প্রথাগত বিধান অনুসারে কমথসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন। আগে লর্ডসভা থেকেও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী কমন্সসভা হতে আসেন। কমথসভায় কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে রাজা বা রানী পার্লামেন্টের আস্থাভাজন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে পারেন। যেমন- ১৯২৪ সালে রামজে ম্যাকডোনাল্ডকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল, যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্য ছিলেন না ।

চ. কেবিনেটের একনায়কত্ব : আধুনিককালে লর্ড হিউয়ার্ট (Lord Hewart), ত্রুসমান (Crossman) প্রমুখ লেখক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে একনায়কত্বের অভিযোগ এনেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পার্লামেন্টের উপর যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। বর্তমানে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সার্বভৌম বাস্তবে কেবিনেটের একনায়কত্বে ( Cabinet Dictatorship) রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং আধুনিককালে পার্লামেন্ট নয়, কেবিনেটই সর্বেসর্বা।

কেবিনেট এমন একটি সংস্থা যা সমগ্র ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ব্রিটেনে কেবিনেট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং ব্রিটেনে কেবিনেটই প্রকৃত শাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

 

মন্ত্রিসভা কেবিনেটের মধ্যে পার্থক্য

Distinction between the Ministry and the Cabinet

অনেক সময় মন্ত্রিসভা ও কেবিনেটকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাস্তবে উভয়ের মধ্যে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার শুরুতে মন্ত্রিসভা ও কেবিনেটের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভা ও কেবিনেটের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাই হোক, এখনও কতকগুলো ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা ও কেবিনেটের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়।

ক. সাধারণ নির্বাচনের পর যে দল কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলের নেতাই একসাথে কেবিনেট ও মন্ত্রিসভা গঠন করেন।

খ. কেবিনেট ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক i

গ. কেবিনেট ও মন্ত্রিসভাকে পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতে হয়। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্সসভার আস্থা হারালে উভয়কেই পদত্যাগ করতে হয়।

উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান মৌলিক পার্থক্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো :

ক. গঠনগত পার্থক্য : গঠনগত বিচারে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় কেবিনেট মন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ( Minister of state), লর্ড চ্যান্সেলর, সংসদীয় অধস্তন কর্মসচিব (Parliamentary under – Secretary), অ্যাটর্নি জেনারেল, সলিসিটর জেনারেল, কম্পট্রোলার প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে। কিন্তু কেবল কেবিনেট মন্ত্রীদের নিয়েই কেবিনেট গঠিত হয় ।

খ. আয়তনগত পার্থক্য : মন্ত্রিসভা সাধারণত বৃহদায়তন বিশিষ্ট হয়। মন্ত্রিসভা হলো সকল মন্ত্রীর একটি সমষ্টিগত সংস্থা। এই মন্ত্রিসভাই হলো ব্রিটেনের সরকার। মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা সাধারণত ৬০-৭০ জন, এমনকি এর সদস্য সংখ্যা শতাধিকও হতে পারে। অপরদিকে, কেবিনেটের আয়তন মন্ত্রিসভার আয়তন অপেক্ষা অনেক ক্ষুদ্র। কেবিনেটের সদস্য সংখ্যা সাধারণত ২৫-৩০ জনের বেশি হয় না ।

গ. সদস্য পদ : মন্ত্রিসভার সব সদস্যই প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য বলে বিবেচিত হন না। কিন্তু কেবিনেটের প্রত্যেক মন্ত্রীকেই প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যপদ প্রদান করা হয় ।

ঘ. স্তরভেদ : মন্ত্রিসভা গঠিত হয় কেবিনেট মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সংসদীয় সচিবদের সমন্বয়ে। সাধারণত কেবিনেট মন্ত্রীদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তবে কেবিনেটে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাদের দপ্তর বিহীন মন্ত্রী বলা হয়। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ডগলাস হিউমের কেবিনেটে এ ধরনের দু’জন মন্ত্রী ছিলেন। তাছাড়া কেবিনেট স্তরের (Cabinet rank) মন্ত্রী নামে আর এক ধরনের মন্ত্রী আছেন। বেতন ও সম্পদ মর্যাদায় এরা কেবিনেট মন্ত্রীর সমান। বিভিন্ন দপ্তরের একক দায়িত্বও তাদের হাতে ন্যস্ত থাকে ।

৫. প্রধানমন্ত্রী নিজেই কেবিনেট গঠন করে : মন্ত্রিসভার সদস্যগণ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাজা বা রানী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্য থেকে কাদের নিয়ে কেবিনেট গঠিত হবে তা প্রধানমন্ত্রী স্থির করেন। ওয়েড ও ফিলিপস (Wade and Philips)-এর মতে, “দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীকে পরামর্শ দেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার যেসকল সদস্যকে আহ্বান করেন, তারাই কেবিনেটের সদস্য হন।”

চ. রাজা বা রানীকে পরামর্শদানের ক্ষেত্রে : কেবল প্রধানমন্ত্রীসমেত কেবিনেট রাজা বা রানীকে শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। কিছু রাজা বা রানীকে পরামর্শদানের ক্ষমতা মন্ত্রিসভার নেই।

ছ. দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে : মন্ত্রিসভার সদস্যগণ একত্রে বসে একটি সংস্থা হিসেবে আলাপ-আলোচনা ও নীতি নির্ধারণ করেন না, তাই মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন। অন্যদিকে, কেবিনেট সদস্যগণ একত্রে বসে আলাপ-আলোচনা, নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁরা যৌথভাবে কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকেন। অগ ও জিংক (Ogg and Zink) এর মতে, “The Ministry as such never meets it never deliberates on matters of policy, it is indeed, misleading to speak of it as a body of all. “

.জ. কার্যগত পার্থক্য : কেবিনেটের কাজ হলো সরকারি নীতি নির্ধারণ করা। মন্ত্রিসভার হাতে এরূপ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা নেই। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ কেবিনেট কর্তৃক নির্ধারিত নীতিসমূহ কার্যকর করেন। তাই বলা হয়, “কেবিনেট মন্ত্রী আলোচনা করেন ও পরামর্শ দেন, প্রিভি কাউন্সিলার নির্দেশ (Decree) জারি করেন এবং মন্ত্রী নির্দেশ কার্যকর করেন।”

ঝ. বৈঠকের নিয়ম : সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণকল্পে সাধারণত কেবিনেটের সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালীন অবস্থায় সাধারণত সপ্তাহে দু’বার এবং অন্য সময়ে একবার বা তারও কম কেবিনেটের বৈঠক বসে। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠক বসার বিষয়ে এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণ পেলেই কেবল কেবিনেটের বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু কেবিনেটের সদস্যগণ পদাধিকার বলেই কেবিনেটের সভায় উপস্থিত থাকেন।

ঞ. মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব : কেবিনেটের উত্থান-পতনের সাথে মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কেবিনেটের কার্যকালের উপর মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব নির্ভর করে। কেবিনেট পদত্যাগ করলে মন্ত্রিসভাকেও পদত্যাগ করতে হয়।

ট. আইনগত পার্থক্য : মন্ত্রিসভা একটি আইনগত রাজনৈতিক সংস্থা। এটি আইন অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত হয় । কিন্তু কেবিনেট ব্যবস্থার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। মূলত প্রথার উপর ভিত্তি করে তা গড়ে উঠেছে।

ঠ. গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে : কেবিনেট মন্ত্রীদের যতখানি গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয় সাধারণ মন্ত্রীদের ততখানি গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নেই ।

ব্রিটেনে কেবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

Leave a Reply