ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস Sources of British Constitution
ব্রিটিশ সংবিধান কোনো গণপরিষদ কর্তৃক রচিত হয়নি বা কোনো বিপ্লব-বিদ্রোহের ফলশ্রুতি নয়। তাই ব্রিটিশ সংবিধানকে একটি মাত্র দলিলের মধ্যে পাওয়া যায় না। দীর্ঘকালের ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই সংবিধান ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ সংবিধান ক্রমবিবর্তনের ফল। এ সংবিধান কোনো একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে উদ্ভূত হয়নি বরং এর উৎস অনেক। অধ্যাপক মুনরো (Munro) বলেছেন, The British constitution is not derived from one source, but from several. [W. B. Munro, “The Gvernment of Europe p-23] ব্রিটিশ সংবিধান স্থিতিশীল নয় বরং গতিশীল। প্রথা ও ঐতিহ্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে নতুন প্রথা পুরনো প্রথার স্থান দখল করছে। ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসের এই বৈচিত্র্যের জন্য বলা হয় যে, সারা জীবন অধ্যয়ন করলেও এ সংবিধান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। জে.এইচ. প্রাইস (J. H. Price) যথাথই বলেছেন, A lifetime study would not make any student an expert on all aspects of British constitution, since the source which he would have to study are so vast and ramified.
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলোকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা (ক) সংবিধানিক আইন (Constitutional law) এবং (খ) সাংবিধানিক প্রথা (Conventions of the constitution ) । সাংবিধানিক আইন হলো সেই সব বিধিবদ্ধ আইন, যেগুলো আদালত কর্তৃক স্বীকৃত এবং বলবৎযোগ্য। কিন্তু সাংবিধানিক প্রথা বলতে শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত সেই সব নিয়ম-পদ্ধতিকে বোঝায়, যেগুলো পারস্পরিক বোঝাপড়া, চুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এবং যেগুলোকে শাসনকার্যে ব্যাপৃত প্রতিটি ব্যক্তি বাধ্যতামূলক বলে স্বীকার করে নিয়েছে। এসব সাংবিধানিক প্রথা আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। সাংবিধানিক আইনগুলোকে আবার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যায়, যথা (১) ঐতিহাসিক সনদ ও চুক্তিপত্র, (২) বিধিবদ্ধ আইন, (৩) বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত এবং (৪) প্রথাগত আইন। ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
ক. ঐতিহাসিক সনদ ও চুক্তিপত্র (IHistorical Charters and Documents) : ব্রিটিশ সংবিধানের প্রথম উৎস হলো ঐতিহাসিক সনদ ও চুক্তিপত্র। এগুলো বিভিন্ন সময়ে সামন্ত ও বণিক শ্রেণির চাপে এবং বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ প্রতিটি সনদকেই ইংরেজ জাতির রাজনৈতিক জীবনের প্রগতি নির্দেশক এক-একটি স্মারক চিহ্নরূপে বিবেচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ ১২১৫ সালের মহাসনদ (Magna-Carta) এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয় যে, বৃহত্তর পরিষদের সম্মতি ছাড়া রাজা ইচ্ছেমতো কর আদার করতে পারবেন না, কোনো স্বাধীন প্রজাকে বেআইনিভাবে বন্দী অথবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। ১৬২৮ সালের অধিকারের আবেদন পত্র (Petition of Rights) এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয় যে, পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতীত রাজা কর ধার্য করবেন না। বিশেষ আদেশে কোনো ব্যক্তিকে বন্দী এবং শাস্তির সময়ে সামরিক আইন জারি করতে পারবেন না। ১৬৮৯ সালে অধিকারের বিল (Bill of Rights) প্রণয়নের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। তাছাড়া ১৭০৭ সালের স্কটল্যান্ডের সাথে এবং ১৮০০ সালের আয়ারল্যান্ডের সাথে সংযুক্তিকরণের চুক্তিপত্রের কথাও উল্লেখ করা যায় ।
খ. বিধিবদ্ধ আইন (Statutes ) : ব্রিটিশ সংবিধানের আর একটি বড় উৎস হলো পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে সাধারণ আইনের পাশাপাশি সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন সংবিধান রচনার পথ সুগম করেছে। পার্লামেন্ট এই সকল আইনের মাধ্যমে রাজার ক্ষমতা হ্রাস ও নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি, জনগণের ভোটাধিকার সম্প্রসারণ, শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ ইত্যাদি নিষ্পত্তি করেছে। উদাহরণস্বরূপ ১৬৭৯ সালে প্রণীত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পর্কিত ‘হেবিয়াস কর্পাস আইন’ (Habeas Corpus Act, 1679) প্রণীত হয়। ১৭০১ সালে নিষ্পত্তি আইন (The Act of Settlement, 1701) পাস হয়। এই আইনের সাহায্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা নির্দিষ্ট হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় এবং পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া যুদ্ধে যোগদান নিষিদ্ধ হয়। তাছাড়া ১৮৩২, ১৮৬৭ ও ১৮৮৪ সালে প্রণীত ভোটাধিকার সম্প্রসারণ সংক্রান্ত সংস্কার আইন (Reforms Acts), ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালে প্রণীত লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসকারী পার্লামেন্ট আইন (Parliamentary Acts), ১৯৩১ সালের ওয়েস্টমিনিস্টার আইন (Westminister Act), ১৯৩৮ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, (Representation of the people Act, 1938), ১৯৭১ সালের আদালত আইন, ৭২ সালের স্থানীয় সরকার আইন (Local Grovernment Act, 1972) ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
গ. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত (Judicial Decisions) : বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সনদ, চুক্তিপত্র ও পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের মধ্যে অস্পষ্টতা থেকে যায়। বিচার বিভাগ সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে নতুন আইনের সৃষ্টি করে। আবার বিচারকগণ বিভিন্ন মামলার রায় দানের সময় কখনো এমন অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যা সাংবিধানিক আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অধ্যাপক ডাইসি (Diecy) বলেছেন, “ব্যক্তির অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারালয়ে আনীত মামলার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই সংবিধানের সাধারণ সূত্রগুলো গড়ে উঠেছে।” (The English constitution, from elaing the result of legislation in the ordinary sense of the term, is the fruit of contests carried on in the courts on behalf of the rights of the individuals.) তিনি ব্রিটিশ সংবিধানকে বিচারকগণ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান (judge made constituiton) বলে বর্ণনা করেছেন। বিচারকদের অনেক রায় পরবর্তীকালে সংবিধানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ ১৬০৬ সালে আদালত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজার শুল্ক নির্ধারণের স্বৈরাচারী ক্ষমতার ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর ক্ষমতা সীমিত করে দেয়। ১৬৭০ সালে বুসেলের মামলায় (Bushell’s case of 1670) জুরিদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। ১৬৭৮ সালে হাওয়েলের মামলায় বিচারকদের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা হয়, সমারসেট মামলায় ব্রিটেনে ক্রীতদাস প্রথার উচ্ছেদ ঘোষিত হয়। তাছাড়া রবিন অ্যাড সন লিমিটেড বনাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী (১৯২৯), বেইনব্রিজ বনাম পোস্ট মাস্টার জেনারেল (১৯০৬), লিভার সিজ বনাম অ্যান্ডারসন (১৯৪২) প্রভৃতি মামলা উল্লেখযোগ্য ।
ঘ. প্রথাগত আইন (Common Law) : ব্রিটিশ সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে প্রথাগত আইন থেকে । প্রথাগত আইন হলো সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত সেই সব প্রথা ও রীতিনীতি, যেগুলো কালক্রমে আদালতের মাধ্যমে আইনের মর্যাদা লাভ করেছে। ব্রিটিশ নাগরিকগণ যে সব স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করে তাদের অনেকগুলো প্রথাগত আইন থেকে এসেছে। প্রথাগত আইনগুলো পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত ও বিধিবদ্ধ হয়নি কিংবা রাজন্যবর্গ সেগুলোকে অধ্যাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন নি। বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে এগুলো সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা পেয়েছে। অধ্যাপক কার্টার, রেনি ও হাজ (Carter, Ranny and Herz.) বলেছেন, “From the judicial recognition of the customs of realm there has grown up a body of principles which stand as bullwork of British freedom and an essential part of the British constitution.” প্রথাগত আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজার বিশেষাধিকারসমূহ, জুরির সাহায্যে বিচারের অধিকার, বাক্- স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি। বিধিবদ্ধ আইনসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে প্রণীত হয়, কিন্তু প্রথাগত আইনসমূহ গড়ে ওঠে। অগ ও জিঙ্ক (Ogg and Zink) যথার্থই বলেছেন, “Common law merely grew up statutes law was made.”
ঙ. প্রথাগত বিধান (Conventions ) : প্রথাগত বিধান ব্রিটিশ সংবিধানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি দেশের শাসনকার্য সম্পূর্ণরূপে লিখিত সংবিধান দিয়ে চালানো যায় না। এই কারণে প্রায় প্রত্যেকটি দেশে সাংবিধানিক প্রথার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। জন স্টুয়ার্ট মিল ( J. S. Mill) প্রথাগুলোকে সংবিধানের অলিখিত বিধান ( Unwritten maxims of the constituion) বলে গণ্য করেছেন। ব্রিটিশ সংবিধানে প্রথাগত বিধানের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। সাংবিধানিক প্রথাসমূহ আইনের মতো আদালত কর্তৃক বলৎযোগ্য না হলেও সেগুলো আইন অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ব্রিটিশ সরকার ও জনগণ সকলেই এগুলো মেনে চলে। কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare ) বলেন, “By convention is meant a whole collection of rules which though not part of the law, are accepted as binding and which regulate politica! institutions in a country and clearly form a part of the system of government.” ব্রিটিশ সংবিধান থেকে প্রথাগত বিধানকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ রাজশক্তির ক্ষমতা, রাজার সাথে মন্ত্রীদের সম্পর্ক, মন্ত্রীদের সাথে পার্লামেন্টের সম্পর্ক, পার্লামেন্টের কার্যপদ্ধতি, কমনওয়েলথ সম্পর্কিত বিষয় ইত্যাদি বহু বিষয় প্রথাগত বিধানের অন্তর্ভুক্ত।
চ. সংবিধানের উপর গ্রন্থসমূহ (Text books on constitution) : প্রখ্যাত আইন বিশারদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত সংবিধান সংক্রান্ত পুস্তকসমূহ ব্রিটিশ সংবিধানের বিরাট স্থান দখল করে আছে। প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এই সকল পুস্তকের মূল্য অপরিসীম। সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে রচনাবলির মধ্যে ওয়ালটার বেজহট (Walter Bagehot) এর ইংল্যান্ডের সংবিধান (The English Constitution), অ্যানসন (Anson) এর সংবিধানের আইন ও রীতি (Law and custom of the constitution), আরস্কিন মে (May) এর সংসদীয় কার্যবিধি (Parliamentary Practise), আইভর জেনিংস (Ivor Jennings)-এর আইন এবং সংবিধান (Law and the constitution) ও কেবিনেট শাসনব্যবস্থা (Cabinet Government), এ.ভি. ডাইসি (A.V. Diecy)-র সাংবিধানিক আইনের ভূমিকা (An Introduction to the law of the constitution), লাস্কি (Laski)-র ইংল্যান্ডের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা (Parliamentary Grovernment in England), ওয়েড এবং ফিলিপ (Wade and Philip)-এর সংবিধানিক আইন (Constitutional Law) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটেনে রাজার মৃত্যু নাই (The king never dies), রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না (The king can do no wrong) প্রভৃতি প্রবচনের সৃষ্টি হয়েছে উইলিয়াম ব্লাকস্টোন (Blackstone)-এর ইংল্যান্ডের আইনসমূহের উপর মন্তব্য ( Commentaries on the laws of England) গ্রন্থের মাধ্যমেই। অনেকে রাজকীয় বিশেষাধিকারকেও (Royal Prerogatives) সংবিধানের উৎসরূপে চিহ্নিত করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে ব্রিটিশ সংবিধান গড়ে ওঠেনি। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) যথার্থই বলেছেন, The English constitution is to be found in the great constitutioal landmarks, statutes, judicial decisions, common law and conventions. ব্রিটিশ সংবিধান পূর্ণাঙ্গ দলিল নয়, অবিরাম বিকশিত হচ্ছে। পরিবর্তনশীল পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে ব্রিটিশ সংবিধান খাপ খাইয়ে চলেছে। মুনরো এবং আয়ার্স্ট (Munro and Ayearst) মন্তব্য করেছেন, ব্রিটিশ সংবিধান হলো প্রতিষ্ঠান, নীতি ও আচার-ব্যবহারের এক জটিল সংমিশ্রণ ।