Table of Contents
Toggleব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির সাথে উপনিবেশগুলোর বিরোধ ও স্বাধীনতা ঘোষণার পটভূমি
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির সাথে উপনিবেশগুলোর বিরোধ ও স্বাধীনতা ঘোষণার পটভূমি
Conflict between British Colonial Power the Colonies and the Background of Declaration of Independence
টমাস জেফারসন কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন এবং জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা ।
দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন এবং ১৩টি উপনিবেশ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ।
ব্রিটেন পরাজয় মেনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেয়। ফলে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি হয় ।
শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন।
বিল অব রাইটস্ অনুমোদন ৷
জর্জ ওয়াশিংটন।
:
১৩টি। : ডেলাওয়্যার, পেনসিলভ্যানিয়া, নিউজার্সি, জর্জিয়া, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, ম্যারিল্যান্ড, সাউথ ক্যারোলিনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নিউইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা ও রোড আইল্যান্ড ।
৫০টি। এছাড়া ‘ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা আছে। যার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. ।
হাওয়াই, ২১ আগস্ট, ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করে ।
আলাস্কা; আয়তন ১৫,৩০,৭০০ বর্গকিলোমিটার।
রোড আইল্যান্ড; আয়তন ৩,১৩৯ বর্গকিলোমিটার ।
© ক্ষুদ্রতম রাজ্য ওয়াশিংটন ডি. সি।
৩ রাজধানী : ওয়াশিংটন ডি. সি।
- রাষ্ট্রীয় ভাষা : ইংরেজি ।
০ প্রধান ধর্ম : খ্রিস্টধর্ম ।
- মুদ্রার নাম : ইউ এস ডলার।
ও জাতীয় প্রতীক
জাতীয় পতাকা : স্বর্ণদণ্ড।
৫০টি সাদা তারকা, হালকা নীল রঙের মধ্যে লাল জমিনের উপর
১৩ টি ডোরা দাগ ।
সরকার পদ্ধতি
রাষ্ট্রপতির বাসভবন
কেন্দ্রীয় আইনসভার নাম
Q প্রতিনিধি পরিষদের আসন সংখ্যা :
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ।
হোয়াইট হাউস।
কংগ্রেস। কংগ্রেসের দু’টি কক্ষ হলো প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্ন কক্ষ) ও সিনেট (উচ্চ কক্ষ)।
৪৩৫টি।
O সিনেটের আসন সংখ্যা ১০০টি। প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন করে মোট ১০০ জন নির্বাচিত হন।
O প্রধান রাজনৈতিক দল
ইন্টারনেটর ডোমেইন
আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড
প্রধান প্রধান রপ্তানি
জনগোষ্ঠী
ধর্মীয় পরিচয়
কম্পিউটার ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি, যানবাহন, রাসায়নিক দ্রব্য, পশুখাদ্য, সমরাস্ত্র ও বিমান ।
: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবিধ জনগোষ্ঠীর সমাবেশ দেখা যায়। যেমন : শ্বেতাঙ্গ ৭৯.৯৬%; কৃষ্ণাঙ্গ ১২.৮৫%; এশিয়ান ৪.৪৩%; ভারতীয় বংশ ও আলাস্কা আদিবাসী ০.৯৭%; আদিবাসী হাওয়াইন এবং বিবিধ ০.১৮%
: খ্রিস্টান (প্রোটেস্টান্ট) ৫১.৩;% খ্রিস্টান (রোমান ক্যাথলিক) ২৩.৯%; জিউস ১.৭%, মরমন ১.৭%, মুসলিম ০.৬%; অন্যান্য ২.৫% এবং কোনো ধর্মে যুক্ত নয় এমন ১২.১%।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য এবং রাজধানী
যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ও অধিকৃত অঞ্চল
গুয়াম: প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। আয়তন ৫৪১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১,৩৮,০০০ জন।
ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ : ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। মোট আয়তন ৩৪২ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১,০২,০০০ জন। রাজধানী চারটলোট অ্যামালিয়া ।
সামোয়া : প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। মোট আয়তন ১৯৭ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪৬,৭৭৩ জন রাজধানী ফ্যাগাটোগো।
ম্যারিয়ান দ্বীপপুঞ্জ : আয়তন ৪৭১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪৩,৩৪৫ জন। রাজধানী সাইপান ।
- বাকার, আইল্যান্ড ও জারভিস দ্বীপপুঞ্জ : প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কতগুলো দ্বীপ। এখানে স্থায়ী জনবসতি নেই । মার্কিন নৌঘাঁটি অবস্থিত ।
জনস্টন অ্যাটল : হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত চারটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। দ্বীপগুলো হচ্ছে জনস্টন, স্যান্ড, হিকিন ও অ্যাকাউ । এখানে স্থায়ী জনবসতি নেই। তবে মার্কিন নৌঘাঁটি রয়েছে।
কিংম্যান রীফ : হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে অবস্থিত একটি দ্বীপ। জনবসতিহীন এই দ্বীপে মার্কিন নৌঘাঁটি রয়েছে।
মিডওয়ে দ্বীপপুঞ্জ : হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ।
ওয়াক দ্বীপপুঞ্জ : হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের গুয়াম দ্বীপ ও মিডওয়ে দ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত দু’টি দ্বীপ। জনবসতিহীন দ্বীপ দু’টি হলো উইলকেস এবং পিয়াল ।
বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। সপ্তদশ শতাব্দির মধ্যভাগ হতে এসকল উপনিবেশ ব্রিটিশ উপনিবেশিক নীতির বিরোধিতা করে আসছিল। উপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন এ বিরোধিতা দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শেষাবধি উপনিবেশগুলো সম্মিলিতভাবে ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং স্বাধীন মার্কিন জাতির উদ্ভব ঘটে। যে সংস্থার অধীনে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল তা দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস বা সংক্ষেপে শুধু কংগ্রেস নামেই পরিচিত। এ কংগ্রেসের অধীনেই উপনিবেশগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উপনিবেশগুলো মোটামুটি একটি রাষ্ট্র সমবায়-এ মিলিত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এ রাষ্ট্রে সমবায়ের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান রচিত হয়, যা সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমান আকার ধারণ করে।
ঐতিহাসিক পরিক্রমা : দেশ ও দেশবাসী
Historical Survey: Land and the People
বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় জাতিগত পরিচয়ের অধিকারী হলো মার্কিন জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্য ও জীবনধারার সমন্বয়ে গঠিত বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অভিবাসীদের দেশ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। উত্তর আমেরিকার ভারতীয়দের বাদ দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সকলেই মূলত বিদেশ থেকে আগত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশিদের আগমন সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও একাদশ শতাব্দির কোনো এক সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভিকিৎসগণই প্রথম নতুন ইংল্যান্ডের উপকূলে অবতরণ করে। কিন্তু তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেনি। এর কয়েক শতাব্দি পর স্পেন থেকে আগত একদল মানুষ আমেরিকা উপমহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ফ্লোরিডায় বসতি স্থাপন করে। তাঁরা নিউ-মেক্সিকোসহ কয়েকটি অঞ্চলের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত মানুষ আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে উপনিবেশ গড়ে তোলে। এদের মধ্যে অনেকগুলো উপনিবেশ স্থায়ী আকার লাভ করে। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের বাজত্বকালে ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষার্থে (১০০ জন) মে-ফ্লাওয়ার জাহাজযোগে ম্যাসচুসেটস্ এর উপকূলে অবতরণ করে বসবাস শুরু করে, ইতিহাসে যারা ‘Pilgrim Fathers’ নামে পরিচিত । ১৬২০ সালে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার সংক্রান্ত একটি চুক্তির মাধ্যমে এরা ‘নতুন প্লিমাউথ’ নামক একটি বসতি স্থাপন করে। এভাবে ইংল্যান্ডের রাজার নিকট থেকে পাওয়া সনদের মাধ্যমে আমেরিকায় ইংরেজদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার সূচনা হয় এবং
১৬৩৪ সালে অর্জিনিয়ার প্রথম উপনিবেশ স্থাপিত হয়। আমেরিকার অধিকাংশ উপনিবেশ ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমেরিকার জীবন ও চিন্তাদানার উপর ইংরেজদের রাজনৈতিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠানের প্রভাব প্রাধান্য পাভ করে। ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনে ম্যাসাচুসেটস, ভার্জিনিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি উপনিবেশে সরকার গঠন করা হয়। নিউইয়র্কের সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওলন্দাজ ও অন্যান্য স্থানে স্প্যানিশ ও ফরাসি প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। ফ্লোরিডার উত্তরদিকে আটলান্টিকের উপকূলে ১৩টি উপনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এ অগ্রগতিই ১৭৭৫ সালে বিপ্লবে পরিণত হয়। এ বিপ্লব ১৭৮৯ সালে ব্রিটিশ শাসন হতে স্বাধীনতা ঘোষণায় পরিণতি লাভ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
আটলান্টিকের উপকূলবর্তী ১৩টি উপনিবেশে আগত অধিবাসীবৃন্দ বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত ছিল এবং নানা কারণে উত্তর আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিল। এর ফলে ব্রিটেনের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক পটভূমি তাদের জীবনধারাকে প্রভাবিত করলেও সরকারের কাঠামোগত বিন্যাসের ব্যাপারে তাদের চিন্তাধারা সর্বক্ষেত্রে একরকম ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ম্যাসাচুসেটস-এর পিউরিটানগণ সরকারি ব্যবস্থার সাথে ধর্মের সংযোগ সাধনের পক্ষপাতি থাকলেও ভার্জিনিয়া উপনিবেশে রাজনৈতিক জীবনের সাথে ধর্মের ঐক্য সাধনের প্রবণতা ছিল অনেক কম। ১৩টি উপনিবেশের জলবায়ু আবার এক রকম ছিল না। বাণিজ্য এবং ছোট কৃষি খামারের উপর নির্ভরশীল উপনিবেশ এবং বৃহদায়তন কৃষি কার্যের উপর নির্ভরশীল উপনিবেশগুলোর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য ছিল। এর ফলে ম্যাসাচুসেটস এবং নতুন ইংল্যান্ডের উপনিবেশগুলো শহরকেন্দ্রিক সরকারি ব্যবস্থা গড়ে তুললেও দক্ষিণের কৃষিনির্ভর উপনিবেশগুলো গ্রাম্য জীবনকেন্দ্রিক সরকারি ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য সচেষ্ট ছিল। তবে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পর্যায়ে এ ১৩টি উপনিবেশের মধ্যে কতকগুলো ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বিদ্যমান ছিল। ১৩টি উপনিবেশের কয়েকটি রাজকীয় প্রদেশে পরিণত হয় যেখানে গভর্নরগণ ব্রিটেনের রাজার দ্বারা নিযুক্ত হতেন। রাজার সনদ অনুযায়ী অন্যান্য উপনিবেশও রাজকীয় প্রদেশে পরিণত হতে শুরু করে। আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রত্যেক উপনিবেশে আইনসভা গড়ে ওঠে। ১৩টি উপনিবেশের আদালত এবং আইনব্যবস্থার মধ্যেও সাদৃশ্য ছিল। ব্রিটেনের অনুগত উপনিবেশ হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষা নয় বরং উপনিবেশগুলোর জনসাধারণের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ উপনিবেশের স্বার্থরক্ষা করা।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির সাথে উপনিবেশগুলোর বিরোধ ও স্বাধীনতা ঘোষণার পটভূমি
Conflict between British Colonial Power the Colonies and the Background of Declaration of Independence
অষ্টাদশ শতকে ব্রিটেনের বুর্জোয়া শ্রেণি একদিকে নিজেদের আর্থিক স্বার্থকে ক্রমবর্ধমান প্রসারের জন্য পার্লামেন্টের মাধ্যমে আমেরিকার উপনিবেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের পণ্যের জন্য নতুন বাজার চাহিদা মেটাবার চেষ্টা করেছিল, অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য উপনিবেশিক শক্তির হাত হতে আমেরিকার উপনিবেশগুলোকে রক্ষার জন্য তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সচেষ্ট ছিল। আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশনের উপর উপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের পর এ অঞ্চলের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশের হাত থেকে এ উপনিবেশগুলোকে রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যভাগে উদ্যোগী হয়। ব্রিটেনের শিল্পপতি শ্রেণি এ সময় উপনিবেশগুলোতে সৈন্য প্রেরণের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও পার্লামেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। উপরন্তু অষ্টাদশ শতাব্দিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ‘সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ’ সংগঠিত হলে ব্রিটিশ সরকার শোচনীয় আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়ে। এ আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি লাভের অন্যতম উপায় হিসেবে আমেরিকার উপনিবেশগুলো থেকে করের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার কতগুলো বিশেষ আর্থিক নীতি অবলম্বন করে। উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক আইনকানুন ও আর্থিক নীতি উপনিবেশিক জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তাদের স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে আমেরিকার এসকল উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাদের উপর আরোপিত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের এখতিয়ারকে তারা চ্যালেঞ্জ করে এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে।
ব্রিটিশ সরকার আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে দেশের শিল্পপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে সক্রিয় হয়। ফলে আমেরিকার উপনিবেশগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকগণ তাদের আর্থিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয় । উপনিবেশিকগণ উপলব্ধি করতে পারেন যে, মাতৃভূমি ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে না পারলে তাদের আর্থিক বিকাশের স্বাধীনতা থাকবে না। যে কারণে তাঁরা মাতৃভূমি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে সংঘবদ্ধ হয়।
ব্রিটিশ সরকার ১৭৬৫ সালে আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে ‘স্ট্যাম্প আইন’ (Stamp Act) প্রণয়ন ও প্রবর্তন করে প্রত্যক্ষভাবে কর আদায়ের ব্যবস্থা করলে সাথে সাথে উপনিবেশগুলোতে ‘স্ট্যাম্প আইন’ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে ‘স্ট্যাম্প আইন কংগ্রেস’ (Stamp Act Congress) এর আয়োজন করা হয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ‘স্ট্যাম্প আইন’ বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কর ধার্যের বিষয়ে নিজস্ব এখতিয়ার সম্পর্কে সচেতন থাকায় উপনিবেশের অধিবাসীদের দাবি মেনে নেয় নি। ফলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে উপনিবেশগুলোর সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৩টি উপনিবেশ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের অনুসৃত নীতির বিরোধিতার জন্য ১৭৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ম্যাসাচুসেটস এর আহ্বানে ‘প্রথম মহাদেশীয় কংগ্রেস বা সম্মেলন’ (First Continental Congress) অনুষ্ঠিত হয়। ভার্জিনিয়ার জর্জ ওয়াশিংটন ও প্যাট্রিক হেনরি, ম্যাসাচুসেটস এর জন ও স্যামুয়েলসন অ্যাডমস প্রমুখ ৫৬ জন প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করেন। মহাদেশীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিগণ এ অধিকারের ঘোষণা দ্বারা ব্রিটেনের নিকট সকল অন্যায় আইনের বিলোপ সাধনের জন্য আহ্বান জানায় এবং ব্যাপকভাবে ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বর্জনের ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ব্রিটিশ সরকার বলপ্রয়োগ নীতি এবং দমনমূলক কর ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য কোনো প্রকার পুনর্বিবেচনায় সম্মত না হওয়ায় মাতৃভূমির সাথে ১৩টি উপনিবেশের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধ শুরু হলে ১৭৭৫ সালের মে মাসে ‘দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস বা সম্মেলন’ (Second Continental Congress) আহ্বান করা হয়। এ সম্মেলনে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন হ্যানকক, জেমস উইলসন, টমাস জেফারসন, গ্যালওয়ে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। জর্জ ওয়াশিংটনকে উপনিবেশগুলোর সামরিক বাহিনীর অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হয় এবং কংগ্রেস ১৪ মাস যাবৎ যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা
The Independence Declaration of U.S.A
মানব ইতিহাসের গতিধারায় যখন একটি জনগোষ্ঠীর জন্য অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করে প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী ঈশ্বরপ্রদত্ত স্বতন্ত্র ও সমান অবস্থান নিয়ে বিশ্বের রাষ্ট্রশক্তিগুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে, তখন মানবজাতির অভিমতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের খাতিরেই ঐ জনগোষ্ঠীকে তাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কারণসমূহ ঘোষণা করতে হয়।
আমরা এই সত্যগুলোকে স্বয়ংসিদ্ধ বলে মনে করি যে, জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান এবং স্রষ্টা তাদেরকে কতকগুলো অবিচ্ছেদ্য অধিকার প্রদান করেছেন; এসব অধিকারের মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার এবং সুখ সন্ধানের অধিকার।
এসব অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যেই মানবসমাজে সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সরকার শাসক, আর জনগণ শাসিত। কিন্তু জনগণের রায়ই সরকারের ন্যায্য ক্ষমতার উৎস। তাই যখনই কোনো সরকার জনগণের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তখনই সেই সরকার পরিবর্তন অথবা বিলোপ করে জনগণের সর্বাধিক নিরাপত্তা ও সুখ বিধানকারী নতুন নীতিমালার ভিত্তিতে নতুন পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার জনগণের আছে। তবে একথাও সত্য যে, তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী কারণে দীর্ঘকালের স্থায়ী কোনো সরকারকে পরিবর্তন করা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয় । অভিজ্ঞতায় এও দেখা গেছে যে, দুষ্কর্মের ফল মানুষকে ভোগ করতেই হয়। তাই ঠুনকো কারণে যখনই মানুষ কোনো অভ্যস্ত পদ্ধতির বিলোপ সাধন করে, তখনই তাকে দুর্ভোগের কবলে নিপতিত হতে হয়। কিন্তু যখন ক্ষমতার অপব্যবহার ও অধিকার হরণের পালা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং এভাবে স্বৈরতন্ত্রের আসনও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে, তখন এ ধরনের সরকারকে উৎখাত করে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জনগণের অধিকার ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এই কলোনিগুলো এরূপ দুর্ভোগই দীর্ঘকাল যাবৎ নীরবে সহ্য করে এসেছে; বর্তমান পরিস্থিতি তাদেরকে তাদের পূর্বতন সরকার পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে।
গ্রেট ব্রিটেনের বর্তমান রাজার রাজত্বের ইতিহাস হচ্ছে উপর্যুপরি ক্ষতিসাধন ও অধিকার হরণের ইতিহাস। এভাবে ক্ষমতাসীন রাজা ঐ অঙ্গরাজ্যগুলোর উপর চরম স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। প্রমাণস্বরূপ নিরপেক্ষ বিশ্বের সামনে নিম্নোক্ত তথ্যাবলি তুলে
ধরা যাক :
জনসাধারণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও প্রয়োজনীয় যে আইন রাজা তাকে স্বীকার করতে অসম্মত হয়েছেন।
রাজার সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত যেসব আশু প্রয়োজনীয় ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ আইনের কার্যকরীকরণ স্থগিত করা হয়নি, সেসব আইন পাস করতে তিনি তার গভর্নরদের নিষেধ করেছেন। আর যেসব আইন স্থগিত করা হয়েছে, সেগুলো সক্রিয় করার ব্যাপারে তিনি চরম অবস্থা প্রদর্শন করেছেন।
তিনি বৃহৎ জনগোষ্ঠীসম্পন্ন জেলাগুলো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন পাস করতে অস্বীকার করেছেন, যদি ঐ সক জনগোষ্ঠীর আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার পরিত্যাগ না করে; এই অধিকার জনগণের জন্য অপরিমেয় গুরুত্ব বহন করে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী রাজার জন্য ভয়ঙ্কর।
তিনি আইনসভাগুলো আহ্বান করেছেন এমন সব জায়গায়, যেগুলো অনধিগম্য, অস্বাচ্ছন্দ্যকর এবং সরকারি রেকর্ডপত্রের মহাফেজখানা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত; এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তার গৃহীত পদক্ষেপ মোতাবেক কাজ চাপিয়ে আইনসভাগুলোকে কর্মক্লান্ত ও বিরক্ত করে তোলা ।
প্রতিনিধিসভাগুলো পুরুষোচিত দৃঢ়তার সাথে জনগণের অধিকারের উপর তাঁর আক্রমণের বিরোধিতা করায় তিনি বারবার এই সভাগুলো ভেঙে দিয়েছেন।
এভাবে সভা ভেঙে দেবার পর দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি অন্যান্য আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন; এর ফলে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা নির্মূল না হয়ে বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হাতে ফিরে এসেছে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র বাইরের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
তিনি এসব অঙ্গরাজ্যের জনগণকে নানাভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করেছেন; এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশিদেরকে এখানে আসার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছেন এবং নতুনভাবে ভূমি দখলের উপর শর্ত আরোপ করে বিদেশাগতদেরকে দেশীয়করণে বাধা প্রদান করেছেন।
তিনি বিচার বিভাগের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়নে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনায় বাধা দিয়েছেন।
তিনি বিচারকদের কার্যকাল, বেতন নির্ধারণ এবং বেতন প্রদানের নিয়মাবলি কেবল নিজের কাছে কুক্ষিগত করে বিচারকদের সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভরশীল করে রেখেছেন।
তিনি বিপুলসংখ্যক নতুন অফিস নির্মাণ করেছেন
জন্য দলে দলে সেখানে অফিসার পাঠিয়েছেন।
সামাদের জনগণকে উত্যক্ত করা ও তাদের খাদ্য সাবার করার
তিনি আমাদের আইনসভার সম্মতি না নিয়ে শান্তির সময়েও আমাদের মধ্যে স্থায়ী সৈন্যবাহিনী রেখেছেন । তিনি সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত রেখেছেন এবং উচ্চতর মর্যাদা প্রদান করেছেন।
তিনি আমাদেরকে আমাদের সংবিধান বহির্ভূত এবং আমাদের আইনে অস্বীকৃত অধিক্ষেত্রের অধীন করার জন্য অন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যসমূহ চরিতার্থ করার জন্য তাদের স্বকল্পিত আইন প্রণয়নে তিনি সম্মতি দিয়েছেন।
আমাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন করে যুদ্ধকালীন সেনানিবাস স্থাপন করা ।
সেনাবাহিনী এসব অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দাদের হত্যা করলে বিচার প্রহসনের নামে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করা।
oবিশ্বের সকল অংশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করা ।
আমাদের সম্মতি ছাড়াই আমাদের উপর কর আরোপ করা।
ঐতিহাসিক পরিক্রমা : মার্কিন সংবিধানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
এ বহু মামলায় জুরির মাধ্যমে বিচারের সুবিধা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা।
কল্পিত অপরাধের বিচারের জন্য আমাদেরকে সাগরপারের দেশে প্রেরণ করা।
ইংল্যান্ডের মুক্ত আইনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এসব কলোনিতে স্বৈরশাসন কায়েম করার জন্য পার্শ্ববর্তী কোনো প্রদেশ দৃষ্টান্তমূলকভাবে স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করে ক্রমে সে সরকারের আওতা সম্প্রসারিত করা।
ও আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান আইনগুলো বিলুপ্ত করে আমাদের সরকার পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা এবং এভাবে আমাদের সনদগুলো রহিত করা ।
আমাদের নিজেদের আইনসভাকে স্থগিত করা এবং তাদের নিজেদেরকেই যেকোনো ব্যাপারে আমাদের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘোষণা করা ।
তিনি আমাদের তাঁর আশ্রয় বহির্ভূত বলে ঘোষণা করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আমাদের সরকারকে প্রত্যাখ্যান
তিনি আমাদের সমুদ্রগুলো আত্মসাৎ করেছেন, আমাদের উপকূলগুলো বিধ্বস্ত করেছেন, আমাদের শহরগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের জনগণের জীবন ধ্বংস করেছেন।
এখন তিনি হত্যা, উচ্ছেদ ও উৎপীড়নের কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য বিপুল সংখ্যক ভাড়াটিয়া বিদেশি বাহিনী আমদানি করেছেন, এসব কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং কখনো কখনো এমন নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে এসব কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে, যার তুলনা সবচেয়ে বর্বর যুগেও বিরল ছিল এবং একটি সভ্য জাতির নায়কের কাছ থেকে যা কিছুতেই আশা করা যায় না ।
তিনি বহিঃসমুদ্রে বন্দি আমাদের নাগরিকদের তাদের দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র বহন করতে, তাদের বন্ধু ও ভাইয়ের ঘাতক হতে অথবা নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধরাশায়ী করতে বাধ্য করেছেন ।
তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্রোহের উস্কানি দিয়েছেন এবং আমাদের সীমান্তের অধিবাসীদের উপর সেসব নির্দয় রেড ইন্ডিয়ান বর্বরদের লেলিয়ে দিতে প্রয়াসী হয়েছেন, যাদের পরিচিত যুদ্ধনীতি হচ্ছে নারী-পুরুষ, ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষকে নির্বিচারে নিধন করা ।
এসব অত্যাচার-নিপীড়নের প্রত্যেক পর্যায়ে আমরা অত্যন্ত বিনীতভাবে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু আমাদের বারবার আবেদনের জবাব দেয়া হয়েছে বারবার আমাদের ক্ষতি সাধন করেই। একজন যুবরাজ, যাঁর চরিত্র একজন অত্যাচারীর কার্য দ্বারা চিহ্নিত, তিনি একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠীর শাসক হবার যোগ্য নন ।
আমাদের ব্রিটিশ ভাইদের প্রতিও আমরা কখনো কম মনোযোগী ছিলাম না। তাদের আইনসভা আমাদের উপর অবাঞ্ছিত এখতিয়ার বিস্তার করছে বলে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি। দেশত্যাগ করে আমাদের এখানে আগমন এবং বসতি স্থাপনের বিষয়টি আমরা তাদেরকে মনে করে দিয়েছি। আমাদের প্রতি তাদের দেশীয় ন্যায়পরায়ণতা ও ঔদার্য প্রদর্শনের জন্য আমরা তাদের নিকট আবেদন জানিয়েছি এবং আমাদের মধ্যে বিরাজমান সাধারণ আত্মীয়তার বন্ধনের দোহাই দিয়ে তাদেরকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছি এভাবে আমাদের অধিকার হরণ পরিহার করার জন্য। কেননা, তাঁদের এসব কাজের ফলে অনিবার্যভাবে আমাদের আত্মীয়তা ও ঐক্য বিঘ্নিত হবে। অথচ ন্যায়পরায়ণতা ও রক্ত সম্পর্কের এই বাণী তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। অতএব, যারা আমাদের পৃথকীকরণের দাবি অস্বীকার করে আসছে, তাদেরকে প্রয়োজনবোধে মানবজাতির বাকি অংশের মতো যুদ্ধকালে আমাদের শত্রু এবং শান্তির সময়ে আমাদের মিত্র হিসেবে গণ্য করতে হবে।
সুতরাং আমরা এখানে সমবেত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ তথা কংগ্রেস বিশ্বের সর্বোচ্চ বিচারকদের নিকট আমাদের অভিপ্রায়ের ন্যায্যতা বিচারের আবেদন জানিয়ে এ কলোনিগুলোর সৎ জনগণের নামে তাদেরই প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রকাশ ও ঘোষণা করছি যে, এই সংযুক্ত কলোনিগুলো বস্তুত ও অধিকারগতভাবে মুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্র; তারা ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতি সর্বপ্রকার আনুগত্য থেকে অব্যাহতি লাভ করল এবং তাদের সঙ্গে ছোট ব্রিটেনের সকল রাজনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হলো; মুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যুদ্ধের জন্য সৈন্য ও অর্থ সংগ্রহ করার শাস্তি ও মৈত্রী সম্পাদনের, বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের এবং অন্য যেসব কাজ কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র স্বীয় অধিকার বলে করতে পারে সেসব কাজ করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের থাকবে এবং এই ঘোষণা সমর্থনের জন্য আমরা সৃষ্টিকর্তার উপর অবিচল নির্ভরতার সাথে পরস্পরের নিকট আমাদের জীবন, ভাগ্য ও পবিত্র সম্মান সমুন্নত রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভ
Independence of U.S.A
১৭৭৬ সালে উপনিবেশিক নেতৃবৃন্দ ব্রিটেনের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসে ১৭৭৬ সালের ৭ জুন ভার্জিনিয়ার রিচার্ড হেনরি তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি। ম্যাসাচুসেটস-এর প্রতিনিধি জন অ্যাডামস সে প্রস্তাব সমর্থন করেন। ১৭৭৬ সালের ১০ জুন মহাদেশীয় কংগ্রেসের এক প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, রোগার শেরম্যান এবং রবার্ট লিভিংস্টোনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় টমাস জেফারসনকে। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র সম্পর্কিত কমিটি ১৭৭৬ সালের ২৮ জুন তারিখে এর রিপোর্ট পেশ করে। আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের ৫৫ জন প্রতিনিধি ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্তভাবে গ্রহণ ও প্রকাশ করেন। আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের প্রতিনিধিগণ সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। যে কারণে ৪ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু ব্রিটেন স্বাধীনতার এ ঘোষণাকে সহজভাবে গ্রহণ করে নি। ব্রিটেন সর্বশক্তি দিয়ে স্বাধীনতার এ ঘোষণাকে বাতিল করার চেষ্টা করে। ঘোষিত স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য উপনিবেশের সৈন্যবাহিনীও সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
যুদ্ধের শুরুতে উপনিবেশের গভর্নরগণ পদত্যাগ করে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করলে প্রশাসনে এক অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। মহাদেশীয় কংগ্রেস থেকে তখন প্রত্যেক বিদ্রোহী উপনিবেশের নিকট নির্দেশ পাঠানো হয় যে, নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারকে পুনর্গঠন করতে হবে। কংগ্রেসের নির্দেশে উপনিবেশগুলো ‘উপনিবেশ’ (Colony State) এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহার করে জনসাধারণের সম্মেলন ডেকে নিজ নিজ সরকার গঠনের পাশাপাশি নিজেদের সংবিধান রচনা করে। দ্বিতীয় কংগ্রেস আমেরিকার বিদ্রোহী উপনিবেশগুলোর সরকার হিসেবে কাজ করলেও প্রথমে এর কোনো সংবিধান ছিল না। জরুরি অবস্থার প্রয়োজনে একে অস্থায়ীভাবে গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে সংবিধানসিদ্ধ এক স্থায়ী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হতে থাকে। তখন কংগ্রেসের উপর সংবিধান প্রণয়নের ভার অর্পিত হয়। ১৭৭৭ সালের ১৭ নভেম্বর আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ ‘রাষ্ট্র সমবায়ের শাসনতন্ত্র’ (The Articles of Confederation) নামক চুক্তিপত্রের দ্বারা সংগঠিত হয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গঠন করে। ১৭৮১ সালে আমেরিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র এ চুক্তি অনুমোদন করে। রাষ্ট্র সমবায়ের পরিচালনার উদ্দেশ্যে চুক্তিপত্রের ভিত্তিতে ‘মহাদেশীয় কংগ্রেস’ (Continental Congress) গঠিত হয়। এ কংগ্রেসের উপর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। জর্জ ওয়াশিংটনের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও অন্যদের আত্মত্যাগে ১৩টি উপনিবেশের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৭৮৩ সালে চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি লাভ করে ।