বিচার বিভাগের স্বাধীনতা Independence of the Judiciary
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বুঝায় অন্য বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে বিচার বিভাগ দেশে প্রচলিত আইন ও সংবিধান মোতাবেক তাদের কার্যাবলি সম্পাদন করবে। অর্থাৎ, বিচার বিভাগের উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব তারা যে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে পালন করবে।
১. মনীষী জেমস্ (James) বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থ বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও আপসহীনতা।”
২. হ্যামিল্টন (Hamilton)-এর মতে, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হলো অপরাপর বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারের রায় ঘোষণা করা। “
৩. মনীষী ক্যান্ট (Kant)-এর মতে, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে, বিচার বিভাগের প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতাকে বুঝায়।”
৪. অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেন, “The independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense, the doctrine of separation of powers enshrines a permanent truth.”
৫. অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner)-এর মতে, “Independence of judiciary refers the fundamental rights
and the constitutions as neutral.”
৬. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতে, “There is no better test of the excellence of government than
the efficiency of its judicial system.”
সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝি আইন বিভাগ; শাসন বিভাগ বা অন্য কোনো বহিঃশক্তি বা তৃতীয় কোনো শক্তির অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বিচার কাজ সম্পাদন করা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়
Methods for Securing the Independence of the Judiciary
বিচার বিভাগের সুনাম ও পারদর্শিতার উপর একটি সরকারের অবস্থান ও স্থায়িত্ব অনেকটা নির্ভর করে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি জরুরি হয়ে ওঠে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে। একই সাথে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। যে কোনো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন, শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে সকল উপায় অবলম্বন করতে হয় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. বিচারকদের যোগ্যতা : বিচারকার্য সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। তা না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। দলীয় রাজনীতির অতি ঊর্ধ্বে অবস্থান করে অত্যন্ত সৎ, সাহসী ও অভিজ্ঞ আইনবিদদেরকে বিচারক পদে নিয়োগ প্রদান করলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা জোরালো হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের গুণগত দিক এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তিদের বিচারক পদে নিয়োগ প্রদান করলে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা থেকে যায় বিধায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা-করা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেন, “If the Judges lack wisdom probity and freedom of decision, the high purpose for which the judiciary is established can not be secured.”
২ : বিচারকদের নিয়োগ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা বিচারকদের যোগ্যতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই তারা কীভাবে নিয়োগলাভ করবেন সে ব্যাপারে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো : আইনসভা কর্তৃক নির্বাচন, জনগণ কর্তৃক নির্বাচন এবং প্রধান নির্বাহী কর্তৃক নির্বাচন ।
আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত বিচারকগণ আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে দলীয় লোকজন নির্বাচিত হওয়ারও সুযোগ থাকে। ফলে মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। জনগণ কর্তৃক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ভাবাবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কিংবা প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে অযোগ্য ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এ সকল অসুবিধা দূর করার জন্য বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রেই প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। তবে এতেও রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় প্রধান নির্বাহী বিচারকমণ্ডলী ও বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে বিচারকদের নিয়োগদান করেন। বর্তমানে এটি সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য নিয়োগ পদ্ধতি বিধায় এ পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ করা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রা ৩ হবে ।
৩. বিচারকদের কার্যকাল : বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্বের উপরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কেননা, কার্যকালের স্থায়িত্ব না থাকলে নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারকার্য সম্পাদন করা বিচারপতিদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিচারকগণ স্বল্প সময়ের জন্য নিযুক্ত হলে তাদের পক্ষে মুক্ত মন নিয়ে বিচারকার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিচারকদের কার্যকাল স্থায়ী হলে তাদের পক্ষে নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করা সম্ভব। ফলে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বিচারক পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হওয়া উচিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বল (Allan Ball)-এর মতে, “বিচারপতিদের কার্যকালের নিরাপত্তা তাদের স্বাধীনতা সংরক্ষণের হাতিয়ার। কার্যকালের স্থায়িত্ব থাকলে বিচারকগণ নির্ভীক ও নিঃসংশয় চিত্তে সততার সাথে বিচারকার্য সম্পাদন করতে উৎসাহী ও তৎপর থাকবেন।” এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবীর (Willoughby) বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “তাঁরা একবার নির্বাচিত হলে আজীবন বা দীর্ঘকাল পর্যন্ত উত্তম আচরণের নিশ্চয়তায় যেন ক্ষমতাসীন থাকতে পারে। তাঁরা যেন শাসন বিভাগ কর্তৃক পদচ্যুত না হন এবং গর্হিত আচরণের জন্য আইনানুগ পন্থায় যথার্থ বিচারের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।”
৪. বিচারপতিদের পদোন্নতি : বিচারকদের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে তাদের কার্য সম্পাদনের উপর। এ কর্ম সম্পাদনের উ আবার অনেকাংশে নির্ভর করে পদোন্নতির আশার উপর। সাধারণত জ্যেষ্ঠত্ব নীতি অনুসারেই পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয় । তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা ও মেধা পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিচারপতি দীর্ঘদিন যাবৎ পদোন্নতি হতে বঞ্চিত হওয়ায় বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, যা পদোন্নতি নিয়ে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে সচেতন মহলকে হতাশ করেছে। কাজেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পাে বিচারপতিদের পদোন্নতির বিষয়টি অতি যত্নের সাথে নিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা উচিত।
৫. বিচারপতিদের অপসারণ : বিচারপতিদের অপসারণ পদ্ধতির উপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভরশীল। অকারণে বা সামান্য কারণে অপসারণের ভয় বা আশঙ্কা থাকলে বিচারকদের পক্ষে ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয় না। তাই কোনো বিচারককে যেন সামান্য কারণে অপসারিত হতে না হয় তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রমাণিত দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার পূর্বেই বিচারপতিগণ পদচ্যুত হতে পারেন। তবে সহজে তাদের পদচ্যুত করা যায় না। কারণ এক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো যাতে অন্য কোনো চাপ এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিসংশনের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদচ্যুত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধিসভা অভিযোগ উত্থাপন করে এবং সিনেট অভিযোগের বিচার করে। ভারতে রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের মোট সদস্যের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে অভিযুক্ত কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে পারে। ব্রিটেনে রাজা বা রানী পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে বিচারকদের পদচ্যুত করতে পারেন।
৬. বিচারকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতাদি : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার্থে বিচারপতিদেরকে আকর্ষণীয় বেতন ও ভাতা দিতে হবে। কারণ স্বল্প বেতনভোগী বিচারকদের দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাদের জন্য উত্তম বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা প্রদান করতে হবে। দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারক পদে উৎসাহিত করার জন্য আকর্ষণীয় বেতন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে বিচারকগণ সৎ ও নির্লোভ থাকবেন এবং ভবিষ্যতে সৎ ও মেধাবী আইনজ্ঞগণ বিচারক পদে প্রবেশ করতে আগ্রহী হবেন।
৭. বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য শাসন ও আইন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে হবে। এক্ষেত্রে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কার্যের পরিধি পৃথক করে দিতে হবে। অন্যথায় বিচার বিভাগ কোনোক্রমেই ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে স্বাধীনভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারবে না। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেন, “The independence of the judiciary is essentcial to freedom. In that sense, the doctrine of separation of powers enshrines a permanent truth.”
৮. বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিচারকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। এতে একদিকে তাঁরা যোগ্যতা ও দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারবেন; তেমনি অন্যদিকে আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন। ফলে সহজেই তাঁরা বিচারকাজে মনোনিবেশ করবেন এবং নিরপেক্ষতার পরিচয় প্রদান করবেন।
৯. বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি : অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণিচেতনার উপর বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নির্ভরশীল। অর্থাৎ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদেরকে শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে । কেননা, বিচারকদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চেতনা ইত্যাদির ছাপ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর পড়ে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কির (Prof. Laski) অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “বিচারকেরা সমাজের উচ্চ শ্রেণি থেকে আবির্ভূত হয়। সেজন্য যখন শ্রমিকদের সঙ্গে ধনীদের সংঘর্ষ বাঁধে, তখন বিচারকদের সহানুভূতি নিজেদের শ্রেণির উপর থাকা বিচিত্র নয়।” কিন্তু এটি পরিহার করা উচিত।
১০. বিচারকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করে হবে। কারণ নিরাপত্তার অভাবে বিচারকগণ অনেক সময় ন্যায্য রায় প্রদান করতে ব্যর্থ হন। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার বিচারকদের বহুমুখি সমস্যা অর্থাৎ, জীবনের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। ।
১১. বিচারকদের সামাজিক পদমর্যাদা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে বিচারপতিদের সামাজিক পদমর্যাদার বিষয়টি জড়িত তাই সামাজিকভাবে বিচারপতিদের অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১২. লিখিত সংবিধান : লিখিত সংবিধানের উপস্থিতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য। কেননা, বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের পরিধি বিশেষ করে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা সংবিধানে স্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ থাক উচিত। একই সাথে বিচার বিভাগের প্রাধান্য সম্পর্কেও সংবিধানে সুষ্পষ্ট বিধান সংযোজন করা প্রয়োজন। বিচারকগণ লিখিত সংবিধানের সুস্পষ্ট ধারা অনুযায়ী রায় প্রদান করলে রায় সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি থাকবে না ।
১৩. সুশিক্ষিত ও দক্ষ আইনজীবী : আইনজীবীগণ বাদী-বিবাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। এসব আইনজীবী যদি আইনা বিষয়ে সুশিক্ষিত ও দক্ষ হন, তবে বিচারকদের সাথে ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ থাকে না। ফলে বিচারকগণ আদালত ভবনে নিজেদের মর্যাদাবান ও স্বাধীন মনে করেন।
১৪. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যার ব্যাপারে বিচার বিভাগের প্রাধান্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে । যাতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ বা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে না পারে।
১৫. রায় কার্যকর : আদালত প্রদত্ত রায় যথাসময়ে কার্যকর না হলে এর ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে এবং জনগণের আস্থা ও ভরসা হারাবে। তাই আদালতের রায় যাতে বিচার বিভাগ কার্যকর করতে পারে সেই ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। আদালতের রায় কার্যকর করা না গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়।
১৬. শাসন বিভাগের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কেননা, বিচার বিভাগের সমস্ত সিদ্ধান্ত বলবৎকরণে শাসন বিভাগের সাহায্য প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ, দণ্ডাদেশ নিয়ন্ত্রণ, নতুন আইন প্রণয়ন, পুরাতন আইন সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগীয় নজির প্রভৃতি ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের সাহায্য দরকার। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনে শাসন বিভাগের উপর এ সকল বহুমুখি নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হবে।
১৭. অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগ রোধ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অন্যত্র নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। নতুবা তাঁরা অতীতের কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হারাবে এবং বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করবে। ডাইসি (Diecy) বলেন, “The judges should not be allowed practice after retirement because his previous collegues would favour him in the case in which he appears as a lawyer.”
১৮. জনগণ ও রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা : জনগণ ও রাজনীতিবিদদের আগ্রহ ও সদিচ্ছা থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষিত হবে। কারণ জনগণই আইন ও বিচারের সুফল ভোগ করে। প্রয়োজনবোধে সাংবিধানিক চাপ প্রয়োগে আন্দোলন করতে হবে।
১৯. দুর্নীতিবাজদের শাস্তি : মনীষী গোখেল-এর মতে, “বিচারকরা দুর্নীতিপরায়ণ ও বিকৃত মনোভাবাপন্ন হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে বাধ্য।” কাজেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, বিশেষ সুবিধাভোগী প্রমুখদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
২০. সুরক্ষিত আদালত ভবন : সুরক্ষিত আদালত ভবন ও নিরাপত্তার সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারটি জড়িত। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আদালত ভবনটি হবে সুপ্রশস্ত ও সুরক্ষিত, যেখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিরাজ করবে। ফলে বিচারকগণও তাদের কাজে স্বস্তি বোধ করতে পারেন।
২১. ডব্লিউ.এফ. উইলোবীর অভিমত : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা অর্জনের জন্য প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ. এফ. উইলোবী তিনটি প্রধান শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা :
ক. বিচারের জন্য অপরাধীদের তাদের সম্মুখে আনয়ন করার অধিকার বিচারপতিদের থাকতে হবে;
খ. আদালতের যাবতীয় বিষয়াদির গুরুত্ব যাতে বিচারকগণ জনসাধারণকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন, তার সুযোগ থাকতে হবে; এবং
গ. বিচারপতিদের আদেশ ও রায়কে কার্যকর করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করা আবশ্যক ।
পরিশেষে বলা যায়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সফলতার গুরুত্বপূর্ণ বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কেবলমাত্র সাংবিধানিক কতগুলো যান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না । বরং বলা হয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারের অন্য বিভাগদ্বয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকলে কেবল প্রকৃত স্বাধীনতা রক্ষিত হতে পারে। সেই সঙ্গে বিচারকদের মানসিক শক্তি, চারিত্রিক মনোবল ও নিরপেক্ষতাও এর জন্য অত্যাবশ্যক । বিচারকগণের দৃষ্টিভঙ্গি, দৃঢ়তা ও সততার উপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে সরকার, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের সদিচ্ছা এবং সচেতনতাও অপরিহার্য। অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner)-এর মতে, “If the Judges lack wisdom, probity and freedom of decision, the high purposes for which the judiciary is established cannot be secured.”