বিচার বিভাগের ক্ষমতা

বিচার বিভাগের ক্ষমতা Power and Functions of the Judiciary

বিচার বিভাগের প্রধান কাজ যদিও আইনকে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা, তথাপি আইনের প্রয়োগ ব্যতীতও বিচার বিভাগ অন্যান্য অনেক দায়িত্ব পালন করে থাকে। নিম্নে এসব কার্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. আইনের ব্যাখ্যা প্রয়োগ : বিচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘনকারীর আইনানুসারে বিচার করা এবং অপরাধীর যথাযথ শাস্তির বিধান করা। অর্থাৎ, আইনের ব্যাখ্যা ও সঠিক প্রয়োগই বিচার বিভাগের প্রধান কাজ। বিচার বিভাগ আইনের ভাষাগত দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতা দূর করে আইনের প্রয়োগকে সহজ করে। এক্ষেত্রে আইন বলতে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন ছাড়াও শাসনতান্ত্রিক আইন, প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতি, লোকাচার সকল কিছুকেই বুঝায় ।

২. বিচারকার্য সম্পাদন : বিচার বিভাগের প্রধান কাজ হলো বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যাবলি সম্পাদন করা। বিচার বিভাগ দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতে দায়েরকৃত বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করে। সাক্ষ্য প্রমাণাদি পরীক্ষা, ঘটনার সত্যতা নিরূপণ পূর্বক অপরাধীর শাস্তি বিধান এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে রক্ষার মাধ্যমে বিচার বিভাগ দেশের বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে ।

৩. আইন তৈরি : শুধুমাত্র আইনের ব্যাখ্যা বা প্রয়োগই নয়, বরং বিচার বিভাগ আইন তৈরির ক্ষমতাও সংরক্ষণ করে। অনেক সময় দেখা যায়, আদালতে যেসব মামলা দায়ের করা হয় সেগুলোর মীমাংসা সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে সম্ভব নয় কিংবা অনেক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে কোনো সূত্র বা স্পষ্ট নির্দেশ থাকে না। এরূপক্ষেত্রে বিচারকগণ ব্যক্তিগত বিবেকবুদ্ধি, স্বাভাবিক ন্যায়নীতি, সুবিচার প্রভৃতির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং বিচারকার্য সম্পাদন করেন। বিচারকগুণের এরূপ সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে অনুরূপ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এরূপ প্রক্রিয়ার বিচারকার্য সম্পাদনের সময় যে আইন তৈরি হয় তাকে Judge-made Law বলা হয়।

৪. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংবিধানের ব্যাখ্যা : বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বিচার বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব । এই ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগ সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো আইন বাতিল ঘোষণা করতে পারে। আইনসভা যদি এমন কোনো আইন পাস করে যা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কিংবা শাসন বিভাগ যদি এমন কোনো আদেশ জারি করে যা সংবিধান পরিপন্থী তাহলে বিচার বিভাগ উক্ত আইন বা আদেশের যে অংশটুকু সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেই অংশটুকু বাতিল করতে পারে। বিচার বিভাগের এই ক্ষমতাকে “বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা” বলে। এ ক্ষমতার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকারক হিসেবে কাজ করে।

৫. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ : মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবে বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আইন ও শাসন বিভাগের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সরকার নাগরিকদের জন্য সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে বিচার বিভাগ অপহৃত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে। ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতবর্ষের আদালত এ উদ্দেশ্যে রিট জারি করতে পারে।

 ৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা : যে কোনো ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার উপভোগের মাধ্যমেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং সে ব্যক্তি পূর্ণতা লাভ করে। আর এক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে বিচার বিভাগ গণতন্ত্রকে সুসংহত করে। কেননা, বিচার বিভাগ ব্যক্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকার উপভোগকে সহজ করে তুলে এবং ব্যক্তির এ ধরনের অধিকারের উপরে অন্যের হস্তক্ষেপকে বাধা প্রদান করে। এ উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে আদেশ-নির্দেশ জারি করতে পারে। অধ্যাপক লিকক (Leacock) বলেন, “The sole duty of government is to protect the individual from violence or fraud.” সকল সাংবিধানিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ বিভিন্ন প্রকার আইনগত আদেশ ও নির্দেশনামা জারি করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে Writ of Execution, Writ of Quowarranto, Writ of Habeas Corpus, Writ of Prohibition, Writ of Injunction প্রভৃতি।

৭. শাসন বিভাগকে পরামর্শ প্রদান : কোনো কোনো রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে পরামর্শ প্রদান করে থাকে । যেমন— ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে কোনো আইন বা তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন এবং সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মতামত রাষ্ট্রপতিকে জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত জটিল বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন।

৮. শাসন বিভাগীয় দায়িত্ব পালন : বিচার বিভাগ প্রত্যক্ষভাবে শাসন বিভাগীয় কতিপয় দায়িত্বও পালন করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে নাবালকদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়োগ, কোনো সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ, মৃত ব্যক্তির উইল অনুমোদন, দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের আদায়কারী নিয়োগ, লাইসেন্স প্রদান, বিয়ে বৈধকরণ ও বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমতি প্রদান ইত্যাদি ।

 

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান একারণে বলেছিলেন, বিচারকের সমালোচনা করার অধিকার আছে (দৈনিক সংবাদ, ৩ মে, ১৯৯৫)। বিচারপতি লতিফুর রহমানও স্বীকার করেছেন যে, জনমতের কাছে বিচারকদের জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন । সমালোচনা করা যাবে না তা নয়, তবে সেটা উদ্দেশ্যমূলক হবে না। যদি বলা হয় যে, বিচারক উদ্দেশ্যমূলক রায় দিয়েছেন বা রায়ের কারণে তিনি লাভবান হয়েছেন, তবে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে আসবে এবং সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিনা প্রমাণে বিচারক ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে কটূক্তি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে সেরকম যদি সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকে তবে তা বলা অপরাধ নয়। দোষ প্রমাণ হওয়ায় বহু বিচারক শাস্তি পেয়েছেন তার নজির যে নেই তা নয়। এ প্রসঙ্গে আইনজীবীদের ভূমিকা স্বচ্ছ হতে হবে। আইনজীবীগণ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবেন। জেনেশুনে তারা অপরাধীদের সহায়তা করবেন না। বিচার বিভাগকে সকল রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। নিরপেক্ষ অবস্থান ও সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকেও সে স্থান অর্জন করতে হবে।

Leave a Reply