Table of Contents
Toggleবিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কী বুঝায়? মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কী বুঝায়? মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
What do you mean by judicial review? Discuss about the judicial review power of the supreme court of the USA.
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা
Judicial Review
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে আমরা সুপ্রিমকোর্টের সেই ক্ষমতাকে বুঝি, যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট সরাসরি যে কোনো কাজের ও পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত কোনো আইনের সাংবিধানিকতা পরীক্ষা করতে পারে।
অন্য কথায় কোনো দেশের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন ও শাসন বিভাগের আদেশ-নির্দেশ সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা বিচারকগণ পরীক্ষা করে দেখেন এবং উক্ত আইন বা নির্দেশ সংবিধানের পরিপন্থী হলে আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। আদালতের এই কার্যকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলে।
প্রখ্যাত সংবিধান বিশারদ ডিমক ও ডিমক (Dimock & Dimock) এর ভাষায়, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা এমন একটি ব্যবস্থা, যা দ্বারা আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কাজের মধ্যে বৈধতা নির্ধারণ করা যায়।
সুতরাং উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে বলা যায় যে, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা হলো সুপ্রিমকোর্টের সেই পর্যালোচনা যার মাধ্যমে আইনসভা কর্তৃক পাসকৃত আইন এবং শাসন বিভাগ কর্তৃক নির্বাহীকৃত কাজের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা
Judicial Review in U. S. A.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে এখানে সংবিধানের প্রাধান্য বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মার্কিন সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। যে কারণে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগকে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষমতার গণ্ডির মধ্যে থেকে কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংবিধান বিরোধী কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। সংবিধানের পবিত্রতা ও প্রাধান্য রক্ষার দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের হাতে অর্পিত হয়েছে। এই ক্ষমতা বলে সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেস ও রাজ্য আইনসভা প্রণীত আইন এবং শাসন বিভাগের যে কোনো আদেশ বা নির্দেশ সংবিধান পরিপন্থী কি-না সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এরূপ কোনো আইন, নির্দেশ ইত্যাদিকে সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করলে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করে দিতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতাকে ‘বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা’ (Power of Judicial Review) বলে অভিহিত করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার উৎপত্তি ও বিকাশ
Origin and Development of Judicial Review in U.S.A.
মর্কিন সংবিধানে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার যৌক্তিকতা সংবিধানের ৩নং এবং ৬নং ধারার সহায়তায় প্রমাণ করা যায়। মার্কিন সংবিধানের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন ও চুক্তি সংক্রান্ত যে কোনো বিবাদের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকবে (Art. 3 Sec. 2)। ৬নং ধারা অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং সেই সংবিধান অনুযায়ী যেসব যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন হবে কিংবা যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে বা হবে সেগুলো দেশের ‘সর্বোচ্চ আইন’ (The supreme law of the land) বলে বিবেচিত হবে (Art 6 Sec. 2)। অনেকের মতে, সংবিধানের এ দুটি ধারা সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। এ অংশের ব্যাখ্যায় মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্শাল (Marshal) মারবারী বনাম ম্যাডিসন (Marbery vs Madison, 1803 ) মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেন যে, “সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেই ক্ষমতা স্বীয় এখতিয়ারে নিয়েছে।” হ্যামিল্টন (Hamilton) এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষমতা হলো আদালতের যুক্তিযুক্ত (Proper) ও বিশেষ (Peculiar) ক্ষমতা। সুতরাং বলা যায়, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের স্ব-আরোপিত ক্ষমতা ।
তবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মার্শাল (Marshal) কর্তৃক মারবারী বনাম ম্যাডিসন (Marbery vs Madison, 1803 ) মামলার রায় প্রদানকালেই মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রতিভাত হয়ে ওঠে । বিচারপতি মার্শাল ১৮০৩ সালে এ মামলায় সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতার দাবি উত্থাপন করেন। এ সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ক্ষমতা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তার ফলস্বরূপ এক ধরনের বিচার বিভাগীয় প্রাধান্য (Judicial Supremacy)-এর সৃষ্টি হয়েছে। বিচারপতি মার্শাল বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার
স্বপক্ষে মত ব্যক্ত করে উল্লেখ করেছিলেন, “আইন বলতে কী বুঝায় তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার ও কর্তব্য বিচার বিভাগের যারা কোনো নির্দিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে বিধি প্রয়োগ করেন, তাদের বিধি ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। যদি দু’টি আইনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় তবে আদালত অবশ্যই প্রত্যেক আইনের বৈধতা বিচার করবে।”
কংগ্রেস প্রণীত আইনের সাথে সংবিধানের বিরোধ দেখা দিলে কোনটি প্রাধান্য লাভ করবে এ বিষয়ে সংবিধানে কোনো সুস্পষ্ট উত্তর নেই। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা প্রধানত অন্তর্নিহিত ক্ষমতা (Inherent Power) এর তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এ ক্ষমতাকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা হিসেবে গণ্য করে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। মার্শালের মতে, কোন মামলার সাথে কোন আইন জড়িত তা ঘোষণা করা আদালতের কর্তব্য। যখন দু’টি আইনের মধ্যে বিরোধ বাধে আদালত তখন উচ্চতর আইনকে মেনে নিবে। সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইনের সাথে সাংবিধানিক আইনের বিরোধ সৃষ্টি হলে আদালত সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকার করে নিবে। সংবিধানের সাথে বিরোধের অর্থ হলো কোনো কর্তৃত্ব সংবিধানের নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। মারবারী বনাম ম্যাডিসন মামলায় বিচার বিভাগীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রধান বিচারপতি মার্শাল অবশ্যই অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, কোনো আইনের সাথে সংবিধানের বিরোধ দেখা দিয়েছে কি না, আদালত এটা কংগ্রেস বা রাষ্ট্রপতির তুলনায় আরও ভালোভাবে বিচার করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি মার্শালকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার স্রষ্টা বলা হলেও পরবর্তীতে মার্কিন সংবিধানের পঞ্চম ও চতুর্দশ সংশোধনীতে উল্লিখিত ‘আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি’ (Due process of law) অংশের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট ‘আইনের যৌক্তিকতা’ বিচারেরও ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে একথা বলা হয়েছে যে, “আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি’ ব্যতীত কেন্দ্রিয় সরকার কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যসমূহের সরকারের উপর অনুরূপ বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ‘আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি’ অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট কেবলমাত্র আইনটি যথাযথ পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত হয়েছে কিনা তা-ই বিচার করে না, একই সাথে আইনটি ‘স্বাভাবিক ন্যায়নীতিবোধ’ (Principle of natural justice)-এর বিরোধী কিনা তাও বিচার করে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো আইন ন্যায়সঙ্গত কিংবা যুক্তিসঙ্গত কি-না তা বিচার করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের আছে। অর্থাৎ, মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার দুটি দিক আছে। প্রথমত: সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান বিরোধী বলে আইনসভা প্রণীত যে কোনো আইন এবং শাসন বিভাগের যে কোনো আদেশ, নির্দেশ ও কাজকে বাতিল করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ‘আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি’ (Due process of law) অনুসৃত হচ্ছে কি-না তা বিশেষভাবে লক্ষ রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সকল নীল চক্ষু বিশিষ্ট শিশুকে হত্যা করা হবে বলে কংগ্রেস যদি কোনো আইন প্রণয়ন করে তবে তা কেবলমাত্র সংবিধান বিরোধী বলে নয় ন্যায়নীতিবোধের বিরোধী বলেও সুপ্রিমকোর্ট সেই আইনকে বাতিল করে দিতে পারে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্য, ভারত প্রভৃতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত ন্যায়নীতিবোধের বিরোধী বলে কোনো আইনকে বাতিল করতে পারে না। কিন্তু মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট তা পারে ।
আইনের সাংবিধানিকতা এবং বৈধতা বিচারের দ্বারা মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট বহুবার কংগ্রেস প্রণীত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এভাবে কংগ্রেসের প্রণীত প্রায় ৮০টি আইনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, এদের মধ্যে এমন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সাথে সুপ্রিমকোর্টের বিরোধের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। ত্রিশের দশকের আর্থিক মন্দার কবল হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য রুজভেল্ট বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা ‘নিউ ডিল’ (New Deal) নামে পরিচিত। “নিউ ডিল”-কে কেন্দ্র করে ১৯৩৫- ‘৩৬ সালের মধ্যে কংগ্রেস প্রণীত গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি আইনকে সুপ্রিমকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। ১৯৩৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর রুজভেল্ট নিজের পছন্দমতো বিচারপতি নিয়োগ করে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য সিনেটে একটি বিল উত্থাপন করেন। এ বিল অনুসারে সত্তরের ঊর্ধ্ব বয়সী প্রত্যেক বিচারপতির জন্য একজন করে বিকল্প বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়। বিলটির লক্ষ্য ছিল সুপ্রিমকোর্টে নতুন পদ সৃষ্টি করা অথবা কোনো কোনো বিচারপতিকে পদত্যাগে প্ররোচিত করা এবং রাষ্ট্রপতির আস্থাভাজন প্রার্থীদেরকে সেই পদে নিয়োগ প্রদান করা। সিনেটের বিচার সংক্রান্ত কমিটির বিরোধিতার ফলে রুজভেল্টের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। কিন্তু অবসর গ্রহণ ও মৃত্যুর ফলে বিচারপতিদের যেসকল পদ শূন্য হয় সেখানে তিনি নিজ পছন্দ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগ করেন। এর ফলে সুপ্রিমকোর্ট ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়।
এভাবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কার্যক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধানের সর্বপ্রধান ব্যাখ্যাকর্তা ও রক্ষাকর্তা হিসেবে বিশ্বের সর্বাপেক্ষ শক্তিশালী বিচার বিভাগে পরিণত হয়েছে ।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কী বুঝায়? মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার প্রয়োগ
Application of the Judicial Review in U.S.A.
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার প্রয়োগ বিভিন্ন মামলার কার্যক্রম ও রায় উল্লেখ করে
নিম্নোক্তভাবে প্রমাণ করা যায় :
১. মারবারি বনাম ম্যাডিসন মামলা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মারবারী বনাম ম্যাডিসন (Marbery vs Madison, 1803 ) মামলার রায়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এ মামলার রায়দানকালে সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মার্শাল যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ।
মামলার ঘটনা (Facts) : ১৮০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন এডামস অপর প্রার্থী জেফারসনের নিকট হেরে যান। কিন্তু পূর্বে ক্ষমতায় থাকাকালীন এডামস বেশ কিছু বিচারকের পদ সৃষ্টি করেছিলেন। উইলিয়াম মারবারিকে ঐ ধরনের একটি পদে Justice of peace নিয়োগ দেন। এডামস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঐ নিয়োগপত্রে সই করেন এবং এতে তার সিলও দেওয়া হয়। শুধু বাকি রইল Secretary of State এর হাতে তুলে দেওয়া, যিনি রাষ্ট্রের পক্ষে মারবারির হাতে দিবেন। ঐ সময় Secretary of State ছিলেন জন মার্শাল। তিনি ছিলেন বিদায়ী। এডামস তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ঘোষণা করেন । অর্থাৎ, মারবারি নিয়োগপত্র পাওয়ার আগেই মার্শাল প্রধান বিচারপতি হিসেবে ঘোষিত হন। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন জেফারসন। তিনি জেমস মেডিসনকে Secretary of State হিসেবে ঘোষণা করেন। জেফারসন দেখেন মারবারিকে যে বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সেটা মূলত শেষ মুহূর্তের নিয়োগ। তিনি নতুন Secretary of State কে মারবারির নিয়োগ স্থগিত রাখতে বলেন। ফলে মারবারি প্রধান বিচারপতির আদালতে Write of mandamus চেয়ে Law suit করেন। . ফলে এই মামলার নাম দাঁড়ায় মারবারি বনাম ম্যাডিসন মামলা ।
মামলার রায় (Judgement) : প্রধান বিচারপতি মার্শাল তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন যে, মারবারির নিয়োগ স্থগিত ঘোষণা করা অবৈধ। কারণ বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হলেও প্রেসিডেন্ট এডামস যখন মারবারিকে বিচারক হিসেবে ঘোষণা করেন তখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর অবস্থান বৈধ ছিল। অর্থাৎ, উক্ত ঘোষণার সময় এডামসের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়নি। সুপ্রিমকোর্ট তাঁর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখেন যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এডামস এই নিয়োগ দিতে পারেন। বিচারপতি মার্শাল এই মামলায় রায় প্রদানের প্রারম্ভে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন বিধায় এর অবস্থান আইনসভা কর্তৃক রচিত আইনের ঊর্ধ্বে। আবার সংবিধানকে রক্ষা করার নিমিত্তে বিচারপতিগণ যেহেতু শপথ নেন সেহেতু স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত কারণেই আইনসভা কর্তৃক রচিত আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা বিচারপতিদের রয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে, ১৭৮৯ সালের ‘বিচার বিভাগীয় আইন’ সুপ্রিমকোর্টকে রীট ইস্যু করার যে ক্ষমতা প্রদান করে তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ৩নং ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই এ আইন (বিচার বিভাগীয় আইন) অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া হলো।
২. ম্যাকিউলাক বনাম মেরিল্যান্ড মামলা : মারবারী বনাম ম্যাডিসন মামলার রায় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের পর্যালোচনা ক্ষমতা ম্যাকিউলাক বনাম ম্যারিল্যান্ড (Mcculaoch vs Maryland, 1819) মামলার রায়েও পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
ঘটনা (Facts) : মার্কিন কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়। অনুমতি মোতাবেক সেখানে একটি ব্যাংক স্থাপন করা হয় এবং সেই ব্যাংক যথানিয়মে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। ১৮১৮ সালে ম্যারিল্যান্ড রাজ্যের গভর্নর একটি উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেয়। উক্ত উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনার জন্য বেশ কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। ফলে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের আইনসভা Stamp Tax নামে একটি আইন পাস করে। উক্ত আইনে বলা হয় যে, ব্যাংকে লেনদেনকারী ব্যক্তিরা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য Stamp Tax দিবে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ উক্ত Stamp Tax দিতে অস্বীকার করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার ম্যাকিউলাক বাদি হয়ে ম্যারিল্যান্ড সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে। ফলে মামলাটির নাম হয় ম্যাকিউলাক বনাম ম্যারিল্যান্ড মামলা। ম্যারিল্যান্ডের আদালত ব্যাংকের বিরুদ্ধে এবং রাজ্য সরকারের পক্ষে রায় প্রদান করে। ফলে বাধ্য হয়ে ম্যাকিউলাক সুপ্রিমকোর্টে রিট করেন।
মামলার রায় (Judgement) : মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের অত্যন্ত নামকরা প্রধান বিচারপতি মার্শাল এই মামলার রায় ঘোষণা করেন এবং ব্যাংকের পক্ষে সেই রায় হয়। বিচারপতি মার্শাল তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন, ‘আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যে কোনো স্থানে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা কংগ্রেসের আছে এবং ঐ কারণে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন এবং রাজ্য আদালত কর্তৃক প্রদেয় রায় সংবিধান বহির্ভূত।’
৩. ডারমাউথ কলেজ মামলা : অঙ্গরাজ্য সরকার কর্তৃক ডারমাউথ কলেজের চার্টার (Charter) সংশোধন এই মামলার সূচনা করে। মামলায় বিচারপতি মার্শাল রায় প্রদান করেন যে, অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনকে অঙ্গরাজ্য সরকার নাকচ করে দিতে পারেন না।
৪. গিবনস বনাম অগডেনস মামলা : গিবনস বনাম অগডেনস মামলার রায়ে বিচারপতি মার্শাল নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত একটি আইনকে অবৈধ ঘোষণা করে কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে নিউইয়র্কের জলপথে যান চলাচলের পূর্ণ অধিকার প্রদান করেন। এই মামলার রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। কেননা, এই রায় শুধু বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেনি, বরং তা দেশের অর্থনৈতিক সমঝোতাকে ত্বরান্বিত করেছিল।
৫. যুক্তরাষ্ট্র বনাম ডারবী মামলা : যুক্তরাষ্ট্র বনাম ডারবী মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় প্রদান করে যে, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ক্ষমতা কেবল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমবদ্ধ নয় বরং ঐ ক্ষমতা এইসকল কাজেরও অন্তর্ভুক্ত যার মাধ্যমে আন্ত:রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রভাবিত হয়ে থাকে।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার সমালোচনা
Criticism of the Power of Judicial Review
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা বিভিন্ন দিক থেকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। নিম্নে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার বিরুদ্ধে বহুবিধ সমালোচনা তুলে ধরা হলো :
ক. সমালোচকদের মতে, মার্কিন সংবিধান সুপ্রিমকোর্টের হাতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা তুলে দেয়নি। প্রধানত অন্তর্নিহিত ক্ষমতা (Inherent Power) তত্ত্বের ভিত্তিতে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট এ ক্ষমতা লাভ করেছে। তাই বলা যায়, মার্কিন সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত সুপ্রিমকোর্ট নিজেই সংবিধান উপেক্ষা করে বলপূর্বক ‘বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা’ ক্ষমতার অধিকারের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাসে এটিকে একটি ট্রাজেডি বলেই বর্ণনা করা যেতে পারে ।
খ. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ মার্কিন শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এই নীতি অনুসারে সরকারের তিনটি বিভাগ পৃথক পৃথকভাবে কাজ করবে এবং এক বিভাগ অপর বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কাজে অকারণে হস্তক্ষেপ করে বিভাগ দু’টির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে রাষ্ট্রপতি জেফাসরন সহ অনেকে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতাকে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অস্বীকৃতি হিসেবে আলোচনা করেছেন ।
গ. সমালোচকদের মতে, সুপ্রিমকোর্টের বিচার । ভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার পরিপন্থী। কেননা, সুপ্রিমকোর্ট এই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জনঃ তিনিধিদের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে গুরুত্বহীন করে নিজেকে একটি ‘সর্বোচ্চ আইনসভা’ (Super legislature) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ঘ. সুপ্রিমকোর্ট এর ‘বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা’র মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হলেও এ কথা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । বরং বলা যায়, বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা ব্যবহার করে এমন সব রায় দিয়েছে যা গণতন্ত্র এবং জনস্বার্থ বিরোধী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আলোচনা বনাম নিউইয়র্ক মামলার (১৯০৫) রায়ে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কাজের সময় নির্ধারণকারী একটি আইনকে কিংবা বিগত শতাব্দির ত্রিশের দশকে ‘নিউ ডিল পলিসি অনুযারী ১৯৩৫-৩৬ সালে প্রণীত ১৩টি আইন বাতিল করার কথা উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া, ১৯০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন, ১৯৫১ সালে ডেনিস মামলায় কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা অভিযোগকে সমর্থন প্রভৃতির মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের অগণতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঙ. সমালোচকদের মতে, আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা ও যৌক্তিকতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের হাতে ন্যস্ত করার ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। কারণ, কোনো আইন যতক্ষণ পর্যন্ত না সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বৈধ বলে ঘোষিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত প্রণীত আইন কতদিন বলবৎ থাকবে তা নিয়ে সকলের মনে প্রশ্ন থেকে যায়।
চ. সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন শাসনব্যবস্থায় অযথা অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে । কেননা, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচারকদের মানসিকতা ও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়। একই বিষয়ে কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে এরকম অনেক নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৮ সালে হ্যামার বনাম ডাজেনহার্ট মামলায় আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা কংগ্রেসের নেই বলে সুপ্রিমকোর্ট রায় প্রদান করলেও ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ডার্বি মামলায় সুপ্রিমকোর্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বের বিপরীত রায় প্রদান করে। অর্থাৎ, এই মামলার রায়ে আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কংগ্রেসের আছে বলে সুপ্রিমকোর্ট ঘোষণা করে। এভাবে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে কংগ্রেস জনস্বার্থ অপেক্ষা সুপ্রিমকোর্টের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রেখেই আইন প্রণয়ন করে। ফলে বিচার বিভাগ আইন বিভাগের ক্ষমতার গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করে কার্যত: ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন ।
ছ. সুপ্রিমকোর্ট তাঁর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে বলে অভিযেগ করা হয়। কারণ, সুপ্রিমকোর্ট যেসব আইনকে সংবিধান বিরোধী বলে বাতিল করেছে, সেগুলোর অধিকাংশই হলো রাজ্য আইন। ১৮০৩ সাল হতে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কংগ্রেস প্রায় ৭০,০০০ আইন প্ৰণয়ন করলেও সুপ্রিমকোর্ট এগুলোর মধ্যে মাত্র ১২০টি আইনকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। অপরদিকে, ঐ সময়ের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বাতিল বলে ঘোষিত রাজ্য আইন ও রাজ্য সংবিধানের বিভিন্ন অংশের মোট সংখ্যা হলো প্রায় ৯৫০। এসব কারণে অনেকে সুপ্রিমকোর্টকে কেন্দ্রীকরণের অন্যতম প্রধান ‘এজেন্সি’ বলে বর্ণনা করেন ।
জ. মার্কিন সংবিধান রচয়িতাগণ একটি সংক্ষিপ্ত অথচ পদ্ধতিগতভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান রচনা করে সুপ্রিমকোর্টের উপর তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মার্কিন সংবিধান প্রণয়নের পর বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য সংবিধানের প্রায় প্রতিটি ধারাকে সুপ্রিমকোর্টের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের বিভিন্ন ধারা-উপধারার ব্যাখ্যা প্রদান করে কার্যতঃ সংবিধানের পরিধিকে সম্প্রসারিত করেছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বিচারপতি হিউজেস বলেন, “আমরা একটি সংবিধানের অধীনে বাস করি; কিন্তু বিচারপতিগণ যা বলেন তা-ই হলো সংবিধান।” সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতাকে যেমন বৃদ্ধি করছে তেমিন দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয় করে তুলেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ বিশেষভাবে উপেক্ষিত হয়েছে বলে সমালোচকগণ অভিযোগ করেন।
ঝ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতিগণ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে সংবিধান প্রণেতাগণ আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সে আশা বাস্তবে সফল হয় নি বলে সমালোচকগণ মনে করেন। কারণ, বর্তমানে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দলীয় মনোভাবের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ফলে বিচারপতি নিয়োগের সময় তাঁদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা অপেক্ষা দলীয় আনুগত্যই বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করে। ফলে বিচারপতিদের রায় কখনো দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না ।
ঞ. মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট এর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা আইনগত এলাকাকে অতিক্রম করে। বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন ও সম্যসাদি নির্ধারণ ও মীমাংসার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। তাই অনেকে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতাকে বিচার বিভাগীয় স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর বলে মনে করেন ।
ট. মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রগতি-বিরোধী এবং রক্ষণশীলতার দোষে দুষ্ট। রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের সময়ে সুপ্রিমকোর্ট অনেক সংস্কারমূলক আইনকে অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছে।
ঠ. বাস্তব ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট অনেক সময় এই বিশেষ ক্ষমতার মাধ্যমে জনস্বার্থ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে । বহু ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট ধনিক ও মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রয়োগ করে কায়েমি স্বার্থের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মার্কিন সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট অভিপ্রেত ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে নি। রবার্ট ডাল (Robert A. Dahl) এর মতে, “The court used the protection of the 5th, 13th, 14th and 15th amendments to preserve the rights and liberties of a relatively privileged group at the expense of the rights and liberties of a submerged group.”
ড. মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বিচারকদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার সংযুক্ত হয়। বিচারকদের রাজনৈতিক ভূমিকা বা উদ্যোগ মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়নের বৈধ ক্ষমতায় অবৈধ হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ধারায় বিচার বিভাগীয় আইন প্রণীত হয়ে থাকে।
ঢ. বিচার বিভাগ যখন আইনসভা ও শাসন বিভাগের কার্যকলাপের সাংবিধানিক বৈধতা পরীক্ষা করে তা অবৈধ ও অকার্যকর বলে রায় দেয়, তখন বিচার বিভাগের সাথে অপর দু’টি বিভাগের শত্রুতামূলক বিরোধ দেখা দিতে পারে। এতে করে অনেক অবাঞ্ছনীয় পরিণতির সৃষ্টি হতে পারে।
ণ. সমালোচকগণ মত ব্যক্ত করেন যে, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অর্থ হলো আইনসভা যাতে সংবিধান লঙ্ঘন করে আইন তৈরি করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আইনসভা স্পষ্টত ও অবশ্যই বিচার বিভাগের চেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য হবে- এ কথা মেনে নেয়া যায় না ।
ত. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালত দ্ব্যর্থক ও অস্পষ্ট রায় প্রদান করে আইন ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করতে পারে।
থ. সমালোচকগণ যুক্তি দেখান যে, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ব্যতীতই কোনো কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ স্ব স্ব সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কাজ করছে এবং সেখানে গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতা সংরক্ষিত হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা গ্রেট ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে জনমত এবং প্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি জনগণের অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা সরকারের স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের উপর কার্যকর বাধা হিসেবে কাজ করছে।
প. সমালোচকগণ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অপরিহার্যতাকে অগ্রাহ্য করেন। সুইজারল্যান্ডের ন্যায় -কোনো কোনো দেশে জাতীয় আইনসভার আইনকে পর্যালোচনা করার ক্ষমতা আদালতের না থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ভালোভাবেই কাজ করছে বলে তাঁরা উল্লেখ করেন ।
ফ. সাম্প্রতিককালে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে অনেকে আদালতের ব্যাপক ক্ষমতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। বিচারপতি হারলান (Harlan)-এর মতানুসারে, “The constitution does not confer on the court blanket authority to step into every situation where the political branch may be throught train”. KE অনেকের মতে, “স্ব-আরোপিত সীমাবদ্ধতা’র মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের কাজ করা উচিত।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ইতিবাচক দিক
Postitive Aspects of the Judicial Review
রবার্ট কার, মারভার বার্নস্টেইন এবং ওয়াল্টার মার্ফি উল্লেখ করেছেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নেতিবাচক দিকই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। নিম্নে এসব ইতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন ও নীতিকে অবৈধ ঘোষণার দ্বারা বিচারপতিগণ অনেক সময়ে ইতিবাচক নীতির পথ প্রশস্ত করেন । দৃষ্টান্তস্বরূপ বিদ্যালয়ে বৈষম্যমূলক আলোচনা মামলায় সুপ্রিমকোর্টের রায় নিগ্রো সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকারের আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে ।
খ. মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কখনো তার পর্যালোচনা ক্ষমতাকে দায়িত্বহীনভাবে খেয়ালখুশিমতো প্রয়োগ করে নি। মার্কিন কংগ্রেস ১৮০৩ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে প্রায় ৭০,০০০ আইন তৈরি করেছে। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট বৈধতা বিচারের মাধ্যমে কেবল মাত্র ১২০টি যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনকে বাতিল করেছে। অঙ্গরাজ্যের আইন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ ধারাই বর্তমানে দেখা যায়।
গ. কংগ্রেস আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করতে পারে। কংগ্রেস ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের ২১টি সিদ্ধান্তকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ, কংগ্রেস যদি তার ইচ্ছার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় তবে সুপ্রিমকোর্ট তা আটকাতে পারে না।
ঘ. সংবিধানকে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও সময়োপযোগী করে ভুলতে সুপ্রিমকোর্ট যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সংবিধানের ক্রমবিকাশের পথে সুপ্রিমকোর্ট সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করেছে। তাই সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক মনে করা হয় এবং তাকে কেন্দ্র করেই সংবিধান আবর্তিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের জনৈক ব্যক্তি তাই যথার্থই বলেছেন যে, আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন পদ্ধতিতে কিছু সংখ্যক মোকদ্দমাই ক্ষমতার প্রধান অস্ত্র । ইউরোপে ক্ষমতার বিবাদ-মীমাংসার জন্য সৈন্য দল ডাকা হলেও আমেরিকায় এক্ষেত্রে উকিলদের ডাকা হয়ে থাকে । তাঁদের মতানুসারে, “These law suits are the chief instruments of power in our system. Struggles over power that in Europe call out regiments of troops, in America, calls out regiments of lawyers.”
ঙ. বিচার বিভাগীয় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রাধান্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে স্ব স্ব আওতায় সীমাবদ্ধ রাখতে সহায়তা করেছে। অর্থাৎ আইনসভা প্রণীত আইন এবং শাসন বিভাগীয় আদেশ, নির্দেশ বা কোনো কাজকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করে বাতিল করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের থাকায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি কিংবা কংগ্রেস স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না, বরং যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে তাদেরকে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এভাবে কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতি উভয়েই নিজস্ব ক্ষমতার গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করেছে।
চ. সুপ্রিমকোর্টের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্যই সংবিধানের পবিত্রতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি এবং নাগরিক অধিকারসমূহ রক্ষিত হয় ।
ছ. সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেস প্রণীত আইনকে বাতিল করে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পথকে উন্মুক্ত করে দেয় বলে কার, বার্নস্টেইন এবং মার্ফি মনে করেন । উদাহরণস্বরূপ সোয়েট বনাম পেইন্টার (১৯৫০), ব্রাউন বনাম টোপেকা শিক্ষা পর্ষদ (১৯৬২) প্রভৃতি মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করা যায়। ঐসব রায়ে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করে সুপ্রিমকোর্ট কার্যত: মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই সুদৃঢ় করেছে বলে দাবি করা হয়।
জ. কেন্দ্রিয় সরকার এবং অঙ্গরাজ্য সরকারের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সুপ্রিমকোর্ট এ বিরোধের নিষ্পত্তি করে থাকে এবং ভবিষ্যতে কোনো বিরোধের সূচনা যাতে না হয় তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। কেন্দ্রিয় ও অঙ্গরাজ্য সরকারের মধ্যে এভাবে সমন্বয় সাধন করে বলে সুপ্রিমকোর্টকে ‘সমন্বয় সাধনের চক্র’ (Balancing wheel) বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
ঝ. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা হয়ে থাকে। পূর্বে সুপ্রিমকোর্ট কেবলমাত্র জনগণের সম্পত্তির অধিকার ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা জনগণের ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে। সুতরাং বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট নাগরিক অধিকার রক্ষায় রক্ষক (Safeguard) হিসেবে কাজ করে।
.
ঞ. যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার সাহায্যে সংবিধানকে যুগোপযোগী করে তুলেছে। বিশেষ করে অর্জিত ক্ষমতার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে ও প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে সাহায্য করেছে। এভাবে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানকে অধিকতর কার্যকর করে তুলেছে।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জীবনে সুপ্রিমকোর্ট এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাংবিধানিক জটিলতা দূরীকরণ এবং গণঅধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সমগ্র সাংবিধানিক পদ্ধতিকে গতিশীল রাখতে সমর্থ হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট যে ক্ষমতা ভোগ করে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সুপ্রিমকোর্ট সেই ক্ষমতা ভোগ করে না। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত খোলাখুলিভাবে সুপ্রিমকোর্ট আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে বাতিল করতে পারে না। বিশেষ করে ব্রিটেনের কোনো কোর্ট কখনো পার্লামেন্টের আইনকে বাতিল করে নি এবং বাতিল করতেও পারে না। এটি মার্কিনিদের মানসিকতার সাথে খাপ খায়। মার্কিনিরা সরকারের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে পেশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায়।
সুতরাং বলা যায়, সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতার উৎস হলো জনগণের মানসিকতা। অধ্যাপক মুনরো (Munro) এর ভাষায়, “It seems to fit the American temperament” ( W. B. Munro, The Government of the United States, 5th ed. p-572) কেউ কেউ মনে করেন যে, সুপ্রিমকোর্টের এ বিশাল ক্ষমতা তা বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছে, কিন্তু একথা সত্য নয় । এ প্রসঙ্গে চার্লস বিয়ার্ড (Charles A. Beard) এর মতামত উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন যে, “ফিলাডেলফিয়া কনভেনশনের ২৫ সদস্য, যারা সংবিধান প্রণয়নে সবিশেষ সহায়তা করেছিলেন, তাদের মধ্যে ১৭ জন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের সমর্থক ছিলেন”। এ প্রসঙ্গে বিংকলি ও মস (Binkley and Moos ) বলেন, “Whether or not the Supreme Court usurped the practice of judicial review is now purely a academic question. So completely has the practice been woven into the wrap and woof of our constitutional fabric that the government could now scarcely endure its elemination.” (W. E. Binkley and M.C. Moos, A Grammar of American Politics, 1920, pp-519-520).
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার মূল্যায়ন
Evaluation of the Role of American Supreme Court
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি সংযোজন করা সত্ত্বেও বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সুপ্রিমকোর্ট নিজের প্রাধ্যান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে সংবিধানের প্রকৃত অভিভাবকে পরিণত হয়ে নিজের একটি অদ্বিতীয় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ম্যাসন ( A. T. Mason ) বলেছেন, “Under the guise of interpreting fundamental law, the court had in fact, made itself a super legislature.” বহু বিশিষ্ট বিচারপতি এক্ষেত্রে কার্যকরী ও সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তবে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মার্শাল এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিগণিত হন। কার, বার্নস্টেইন মার্ফি (Carr, Bernstain and Murphy)-এর মতে, প্রধান বিচারপতি মার্শালের সময় থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রভাব বিস্তার করছে। মার্কিন সংবিধান কার্যকরী হওয়ার সময় হে অদ্যাবধি সুপ্রিমকোর্ট শাসন ক্ষমতা প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে অংশগ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর জীবনধারাকে সুপ্রিমকোর্ট বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব : সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। এ সম্পর্কে কয়েকটি দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. জাতীয় সরকারের প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের অবদান অনস্বীকার্য। সুপ্রিমকোর্ট ম্যাকলুচ বনাম মেরিল্যান্ড, মুন বনাম ইলিনয় প্রভৃতি মামলার রায় দানের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় সরকারের কর্তৃত্বকে প্রসারিত করেছে।
২. সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজের ক্ষমতাকেও প্রসারিত ও সংহত করেছে। মারবারি বনাম ম্যাডিসন মামলায় নিজের সমীক্ষা ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। পরবর্তীকালে অঙ্গরাজ্যের আদালতের রায় বাতিলের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। আবার সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হয়েছে।
৩. সুপ্রিমকোর্ট ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং পরাস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতিকে শক্তিশালী করেছে। সোচেস্টার বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৯৩৫) মামলায় কোর্ট অঙ্গরাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের এখতিয়ার প্রত্যাখ্যান এবং কংগ্রেস কর্তৃক রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত অতিরিক্ত ক্ষমতার বিরোধিতা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম রিচার্ড নিক্সন (১৯৭৪) মামলায় রাষ্ট্রপতিকে ফৌজদারি মামলায় প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে বাধ্য করে। শাসন বিভাগের অব্যাহতির এলাকা সীমিত করা হয় ।
৪. মার্কিন নাগরিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে প্লেসি বনাম ফার্গুসন (১৮৬৯), ব্রাউন বনাম টোপেকা বোর্ড অব এডুকেশন (১৯৫৪), আলেকজান্ডার বনাম হোমস কাউন্ট্রি বোর্ড অব এডুকেশন (১৯৬৯), সোয়ান বনাম চারলোট্রি মেকলীনবার্গ বোর্ড অব এডুকেশন (১৯৭১), কিউজ বনাম স্কুল ডিস্ট্রিক্ট, কলোরাডো (১৯৭৩) এবং ক্যালিফোর্নিয়া বনাম রেকি (১৯৭৮) প্রভৃতি মামলার রায় উল্লেখযোগ্য।
খ. মার্কিন জীবনধারার উপর প্রভাব : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা, রাজনৈতক ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর জীবনধারাকে সুপ্রিমকোর্ট বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। এ বিষয়ে কার, বার্নস্টেইন ও মার্ফি (Carr, Bernstain and Murphy) তাঁদের ‘American Democracy’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁরা মার্কিন জীবনধারার উপর সুপ্রিমকোর্টের প্রভাবকে তিন দিক থেকে আলোচনা করেছেন। যথা:
১. মৌলিক সাংবিধানিক নীতিসমূহকে সজীব করে তুলে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান রূপরেখাকে সুনির্দিষ্ট রূপদানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট সাহায্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের যথার্থ অর্থ উপস্থাপন করেছে।
২. সুপ্রিমকোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন মানবিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক পরিচালনার জন্য একই ধরনের বিধি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। কংগ্রেস আধুনিক জটিল সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন করে। অইনের মাধ্যমে সরকারি নীতির মূল গতিধারাই অনুভব করা যায়। প্রশাসক ও বিচারকদের দায়িত্ব হলো এসকল নীতি সম্বলিত বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ অর্থ নির্ধারণ এবং প্রাত্যহিক প্রয়োজন অনুসারে তাদের নির্দিষ্ট রূপদান। সুপ্রিমকোর্ট প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস প্রণীত সকল গুরুত্বপূর্ণ আইন ব্যাখ্যা করেছে। এ ব্যাখ্যার মাধ্যমেই অধস্তন আদালত এবং প্রশাসনিক সংস্থাসমূহ অনুধাবন করতে পারবে কীভাবে | বিশেষ পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন ।
৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়বিচারের ধারণা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। সুপ্রিমকোর্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংবিধানের গতিশীলতা বজায় রেখেছে। সংবিধানের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টকে অপ্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করেছে। সংবিধান ব্যাখ্যা, শাসন ও আইন বিভাগের কার্যাবলির বৈধতা বিচারের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন সংবিধানকে ‘বিচারপতি দ্বারা প্রণীত সংবিধান’-এ রূপান্তরিত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিগ্রো সম্প্রদায়ের অনুকূলে ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এবং শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের অনবদ্য ভূমিকা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী সুধীজনের প্রশস্তি অর্জন করেছে। ওয়টারগেট কেলেঙ্কারী প্রসঙ্গে রায়দান কালে সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন রাষ্ট্রপতির অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরোধিতা করেছে। কোর্টের মতানুসারে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অজুহাতে জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা স্বীকার করা যায় না। যদি তা করা হয় এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী করা হয় তবে সংবিধানের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হবে।
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের সীমাবদ্ধতা
Limitation of the Supreme Court
মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের অভিভাবকে পরিণত হলেও তাঁর ক্ষমতা অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। ফলে বলা যায়, সুপ্রিমকোর্ট সর্বশক্তিমান নয়। সুপ্রিমকোর্টের উপর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ রয়েছে। নিম্নে এসকল বিধিনিষেধ
আলোচনা করা হলো :
ক. সাংবিধানিক বাধানিষেধ : মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের উপর যে সমস্ত সাংবিধানিক বাধানিষেধসমূহ রয়েছে নিম্নে তুলে ধরা হলো : ১. মার্কিন সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধান কর্তৃক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগ করতে হয়। তাছাড়া রায় দানের সময়ে তাকে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হয়।
২. মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কোনো আইনকে অবৈধ ঘোষণার পর কংগ্রেস সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদালতের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে ।
৩. সুপ্রিমকোর্ট নিজের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারে না। শাসন বিভাগ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করে। সরকারি কর্মচারীগণ সরাসরি সুপ্রিমকোর্টের রায় অমান্য করতে পারে না। সুপ্রিমকোর্টের কোনো রায়ের সাথে তাদের মতদ্বৈততা থাকলে ঐ রায় প্রয়োগ বিলম্বিত করতে পারে। এর ফলে রায়ের কার্যকারিতা বিলম্বিত হয়। বিদ্যালয়ে বর্ণবৈষম্যবিরোধী রায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ নীতি অবলম্বিত হয়েছে।
৪. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ কার্যকর করার জন্য সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন। তাছাড়া কংগ্রেস অসদাচরণের জন্য বিচারপতিদের পদচ্যুত করতে পারে।
৫. মার্কিন কংগ্রেস ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অসদাচরণের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারে ।
খ. রাজনৈতিক বাধানিষেধ : মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধানিষেধও রয়েছে । তাঁরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। বিচারপতিদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির নীতি এবং রাজনৈতিক মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হয় । বিগত শতাব্দির ত্রিশের দশকে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধির সমর্থক ব্যক্তিদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়োগ করেছিলেন। ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সংবিধানের ব্যাখ্যায় যারা অনমনীয় মনোভাব অবলম্বন করেন, এমন ব্যক্তিকেই নিক্সন বিচারপতি নিয়োগ করেছিলেন। বিচারপতিগণ নির্বাচনের ফলাফল দ্বারাও বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেন সুপ্রিমকোর্টের সক্রিয় ভূমিকার পক্ষে ছিলেন। বিপরীতে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন বার্জার এ সক্রিয়তার ঘোর বিরোধী ছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের কোনো গুরুত্বপূর্ণ রায়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও তাকে বাতিলের জন্য কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ সর্বদা ব্যগ্র থাকেন না। রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বাধানিষেধ দ্বারা আবদ্ধ গন্ডির বাইরে সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসন-এর মতে, “আদালত অভ্রান্ত বলেই তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়; আদালতের সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত বলেই সে চূড়ান্ত ।”
উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার গুরত্ব অনস্বীকার্য। দেশের নিগ্রো সম্পদায়ের অনুকূলে ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এবং শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের অনবদ্য ভূমিকা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী সুধীজনের প্রশস্তি অর্জন করেছে। নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি বজায় থাকলেও সুপ্রিমকোর্টের পদমর্যাদা সব বিভাগের ঊর্ধ্বে। প্রকৃত সাংবিধানিক দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টই পালন করে থাকে। সুতরাং বলা যায়, সুপ্রিমকোর্ট নিজের প্রাধান্য বজায় রেখেছে এবং মার্কিন সংবিধানের প্রকৃত অভিভাবকে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট
Supreme Court as the Regulator and Gurdian of the American Constitution
মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সেই দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করার জন্য সতত সতর্ক প্রহরীর মতো কাজ করছে বিধায় বলা হয়ে থাকে যে, মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক। নিম্নে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলো :
ক. সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী : সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট চরম ক্ষমতার অধিকারী। কোনো মামলার সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন জড়িত থাকলে সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশের ব্যাখ্যা করে। সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যানুসারে সংবিধানের অর্থ নির্দিষ্ট হয়। বিচারপতি ফ্রস্টফুটার বলেন, “সুপ্রিমকোর্টই সংবিধান”। সুতরাং বলা যায়, বিচারপতিদের ব্যাখ্যাই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। বিচারপতিগণ যেভাবে সংবিধানের অর্থ নির্ধারণ করেন, সংবিধানের ধারণাও সেভাবে নির্ধারিত হয়।
খ. সংবিধানের রক্ষক বা হেফাজতকারী : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের রক্ষাকর্তা বা হেফাজতকারী । সংবিধানের ভিত্তিতেই কেন্দ্রিয় ও অঙ্গরাজ্যের সরকারসমূহের মধ্যে এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দেয়া হয়। সুপ্রিমকোর্ট সর্বদাই সরকারের কার্যপ্রবাহকে যথোচিত খাতে প্রবাহিত করে। সকল সময়ে ও সকল পরিস্থিতিতে সুপ্রিমকোর্টের কর্তব্য হলো সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সমুন্নত রাখা।
গ. সংবিধানকে যুগোপযোগীকরণ : মার্কিন সংবিধানের বিকাশ সাধনে তথা পরিবর্তিত সময়ের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে সংবিধানকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট বিরাট ভূমিকা পালন করছে। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের বিধানাবলির নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করে একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারের নতুন নতুন প্রয়োজন মিটাতে সমর্থ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কংগ্রেসের উপর ন্যস্ত থাকবে— সুপ্রিমকোর্ট এমনভাবে এই বিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করেছে— যার ফলে কংগ্রেস রেলপথ, টেলিগ্রাম, বিমান বা রেডিও যোগে পরিচালিত বৈদেশিক ও আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
ঘ. আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান : আইনসভা কর্তৃক প্রণীত যে কোনো আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট তার সঠিক অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ঘোষণা করে এবং সেই ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়। কংগ্রেস প্রণীত যেকোনো আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে সুপ্রিমকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যা অনুসারেই মামলার মীমাংসার ক্ষেত্রে সেই আইন প্রয়োগ করা হয়।
ঙ. নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে নাগরিক অধিকারসমূহের সংরক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়। মার্কিন নাগরিকদের বাক স্বাধীনতার অধিকার, সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার, ধর্মের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ও সাম্যের অধিকারের দায়িত্ব মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশ বা আদেশ নাগরিক অধিকারসমূহের বিরোধী হলে সুপ্রিমকোর্ট সেগুলোকে অবৈধ হিসেবে বাতিল করে দিতে পারে। এর ফলে মার্কিন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে।
চ. বৈধতা বিচারের ক্ষমতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রাধান্য বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যেমন— আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে কাজ করে। সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেস ও রাজ্য আইনসভা কর্তৃক প্রণীত যেকোনো আইন এবং শাসন বিভাগের যেকোনো আদেশ সংবিধান বিরোধী কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এরূপ কোনো নির্দেশ সংবিধান বিরোধী বলে মনে হলে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করে দিতে পারে।
ছ. সংবিধানের মূলনীতিকে সঞ্জীবিত করা : মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের মূলনীতিকে সঞ্জীবিত করে। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের অর্থকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল নিয়মের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেমন: সুপ্রিমকোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মতো দ্ব্যর্থক নীতিকে সুনির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করেছে।
জ. অঙ্গরাজ্যগুলোর অধিকার সংরক্ষণ : কেন্দ্রিয় সরকার যাতে করে অঙ্গরাজ্যগুলোর শাসনব্যবস্থার কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে বিধানও সংবিধানে আছে। অঙ্গরাজ্যগুলোর এ অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
ছ. রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন : রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়নেও মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন— ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ও ভারসাম্য নীতির সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট এদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বহু বিরূপ সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনে ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সুপ্রিমকোর্টের ব্যাপক প্রভাব ও গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বজায় থাকলে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা সকল বিভাগের ঊর্ধ্বে। যদিও প্রথম পর্যায়ে সুপ্রিমকোর্টের এত ব্যাপক প্রভাব ও ভূমিকা ছিল না, কিন্তু বর্তমানে সুপ্রিমকোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের প্রধান ও সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে কারণে সুপ্রিমকোর্টকে মার্কিন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবকের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়ে থাকে ।