প্রিভি কাউন্সিলের বিবর্তন, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রিভি কাউন্সিলের বিবর্তন, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রিভি কাউন্সিলের বিবর্তন, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রিভি কাউন্সিল / Privy Council

ব্রিটেনের শাসন বিভাগের অন্যতম অংশ হলো প্রিভি কাউন্সিল (Privy council)। এক সময় প্রিভি কাউন্সিল যথেষ্ট ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। কিন্তু কেবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে প্রিভি কাউন্সিলের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে প্রিভি কাউন্সিল একটি নামমাত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবুও ব্রিটেনে শাসনব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাসে প্রিভি কাউন্সিলের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

 

উৎপত্তি ক্রমবিকাশ Origin and Evolution

ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এ্যাংলো-স্যাকসন যুগে রাজাকে শাসন কাজে সহায়তা করার জন্য একটি প্রধান পরিষদ ছিল। এ পরিষদ উইটেনাগেমোট (Witenagemot) নামে পরিচিত ছিল। নর্মান যুগে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। নর্মান রাজাদের আমলে (১০৬৬-১১৫৪) রাজাকে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য ক্ষুদ্রতর পরিষদ (Curia Regis) নামে স্থায়ী পরিষদের সৃষ্টি হয়। এই ‘কিউরিয়া রেজিস’ (Curia Regis) থেকেই পরবর্তীকালে প্রিভি কাউন্সিলের উৎপত্তি হয়েছে। বৃহত্তর

 

পরিষদের (Megmum councilium) অধিবেশন দীর্ঘদিন অন্তর কাত। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কিউরিয়া রেজিস (Curia Regis) রাজাকে শাসনকার্যে সবসময় সাহায্য করত। রাজা ইচ্ছেমতো অভিজাত শ্রেণি এবং রাজপরিবারের পদস্থ ব্যক্তিদের ক্ষুদ্র পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করতেন। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষুদ্রতর পরিষদ (Curia Regis) রাজাকে শাসন, বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে সাহায্য ও পরামর্শ দিত। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দিতে দ্বিতীয় হেনরির রাজত্বকালে শাসন ও বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। ফলে ক্ষুদ্রতর পরিষদ এই দুই ধরনের কাজ সম্পাদনের জন্য দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যে বিভাগের উপর বিচার সংক্রান্ত কাজের ভার ন্যস্ত করা হয় তা থেকে উচ্চ আদালতের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে, যে বিভাগটি শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিত, তা প্রিভি কাউন্সিল নামে পরিচিত হয়।

প্রিভি কাউন্সিল প্রথমে আয়তনে ক্ষুদ্রাকৃতির ছিল। ১৪০৪ সালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৯ জন। ১৬৪১ সালে বিভি কাউন্সিলের কোর্ট অব স্টার চেম্বারকে বিলুপ্ত করা হয়। গৃহযুদ্ধ ও ক্রমওয়েলের শাসনামলে প্রিভি কাউন্সিলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৬৬০ সালে প্রিভি কাউন্সিলের পুনরুত্থান ঘটলেও এর ক্ষমতা হ্রাস করা হয়।

স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে প্রিভি কাউন্সিল আয়তনে বড় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় চার্লস প্রিভি কাউন্সিলের বিশাল আয়তনে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রীতিভাজন পাঁচজনকে নিয়ে যে পরামর্শ সভা গঠন করেছিলেন, তাকে ক্যাবাল (CABAL) বলা হত। পরবর্তীকালে ক্যাবাল কথাটি থেকে কেবিনেট শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।

প্রিভি কাউন্সিলের গঠন : বর্তমানে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ৬৫০ এর বেশি (২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত) জনের মতো। সকল সদস্য রাজা বা রানী কর্তৃক মনোনীত হন এবং আজীবন সদস্য থাকেন। এখন অতীত ও বর্তমানের সকল কেবিনেট সদস্যকেই প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য করা হয়। তাছাড়া কমন্সসভার স্পিকার, কেন্টারবেরি ও ইয়র্কের প্রধান যাজক (Archbishops)। আপীল লর্ড, প্রধান বিচারপতি, হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণ, বিদেশে নিযুক্ত রাজপ্রতিনিধিগণ, রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ এবং রাজপুত্রদেরও প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত করা হয়। তাছাড়া ডোমিনিয়নের প্রধানমন্ত্রীগণ এবং বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা, আইন, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য মনোনয়ন করেন। মর্যাদার প্রশ্নে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের স্থান লর্ডসভার সদস্যদের পরেই। প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যগণ নামের আগে ‘Right Honourable’ এবং নামের শেষে PC বা ‘Privy Councillor’ সম্মানসূচক শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারেন।

অধিবেশন, কোরাম ইত্যাদি : প্রিভি কাউন্সিলের সকল সদস্যের মিলিত অধিবেশন কখনই ডাকা হয় না। কারণ কাউন্সিলের বর্তমান আয়তন অনেক বড়। প্রিভি কাউন্সিলের অধিবেশনের জন্য কোরাম (Quorum) হলো ৩ জন সদস্য; তবে ৪ জনের কম সদস্য উপস্থিত হতে আহ্বান করা হয় না তবে রাজা বা রানীর অভিষেকের সময় অথবা রাজা বা রানীর মৃত্যু ঘটলে সাধারণত প্রিভি কাউন্সিলের সকল সদস্যকে মিলিত হতে আহ্বান করা হয়। সাধারণত কাউন্সিলের সভায় ৪-৫ জন সদস্য মিলিত হয়ে কার্য সম্পাদন করেন। এদের মধ্যে থাকেন কাউন্সিলের লর্ড প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিলের কর্মসচিব (The Lord’ President of the council and the clerk of the council)। প্রিভি কাউন্সিলের অধিবেশন আহ্বান করেন এর কর্মসচিব। রাজা বা রানী এতে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর অবর্তমানে কাউন্সিলর অব দি স্টেট (Councillor of the state) সভাপতিত্ব করেন।

 

প্রিভি কাউন্সিলের ক্ষমতা কার্যাবলি

Powers and Functions of Privy Council

প্রিভি কাউন্সিল বর্তমানে নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে :

ক. ব্রিটেনের মন্ত্রিসভা যে সব নীতি নির্ধারণ করে, প্রিভি কাউন্সিল তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে। প্রিভি কাউন্সিল সপরিষদ রাজাদেশ (Orders-in-council) বা রাজকীয় ঘোষণা (Royal Proclamation)-র মাধ্যমে কেবিনেটের সিদ্ধান্তকে কার্যকর করে। সপরিষদ রাজাদেশ বা রাজকীয় ঘোষণা প্রিভি কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়।

গ. প্রিভি কাউন্সিল রাজা বা রানীকে পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান বা স্থগিতকরণের জন্য রাজকীয় ঘোষণা জারীর জন্য পরামর্শ দেয়। এগুলো রাজার বিশেষাধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

গ. রাজা বা রানীর নামে যেসব পদাধিকারীদের নিয়োগ করা হয় প্রিভি কাউন্সিল তাদের নিয়োগ ও অপসারণের দায়িত্ব পালন করে । প্রিভি কাউন্সিল মন্ত্রীদের ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে।

৪. প্রিভি কাউন্সিল বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে কার্যাবলি সম্পাদন করে। এই কমিটিগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগীয় কমিটির (Judicial Committee) ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩৩ সালে পার্লামেন্টের আইন অনুযায়ী এই কমিটি গঠিত হয়। প চ্যান্সেলর প্রাক্তন লর্ড চ্যান্সেলর এবং আপিল লর্ডদের মধ্য থেকে মনোনীত কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড বিচারকার্য সম্পাদন করে। তবে বিচার বিভাগীয় কমিটির কোনো রায় দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এটি রাজাকে পরামর্শ দিয়ে রিপোর্ট পেশ করে।

৫. প্রিভি কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় কমিটি ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি কমিটি রয়েছে। চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের তত্ত্বাবধানের জন্য কাউন্সিলের একটি কমিটি আছে। তাছাড়া কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য কয়েকটি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটিগুলোর মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি, স্কটল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কমিটি প্রভৃতি কমিটির নাম উল্লেখযোগ্য ।

৬. প্রিভি কাউন্সিল বিশেষ কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য তিন থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ‘বিশেষ কমিটি’ (Special Committee) গঠন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৭ সালে টেলিফোনে আড়িপাতাজনিত অপরাধ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটির কথা বলা যায় ।

পরিশেষে বলা যায়, প্রিভি কাউন্সিলের পূর্বের সেই ক্ষমতা আর নেই। বর্তমানে এটি একটি নামমাত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রিভি কাউন্সিলের অধিকাংশ ক্ষমতা কেবিনেটের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওয়েড এবং ফিলিপস (Wade and Philips), “Today the act of privy council are purely formal and give effect of orders, the contents of which are the responsibility of government department.”

প্রিভি কাউন্সিলের বিবর্তন, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

Leave a Reply