দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী ভূমিকা আলোচনা কর Discuss role of pressure group.

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ‘উভয়েই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশবিশেষ। বিশেষত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে প্রতিপন্ন হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ পরিবেশের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া ও সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে উভয়েই যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এ দিক থেকে উভয়ের মধ্যে কতগুলো সাদৃশ্য এবং কতগুলো ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান ।

সাদৃশ্যসমূহ (Similarities) :

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে যে সকল সাদৃশ্য বিদ্যমান তার অন্যতম কয়েকটি হলো :

প্রথমত : রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ে একই রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল থাকতে পারে কিংবা জাতীয় পর্যায়েও বিস্তৃত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত : উভয়ের রাজনৈতিক পরিধি একইভাবে আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে কিংবা জাতীয় পর্যায়েও বিস্তৃত হতে পারে।

তৃতীয়ত : দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় । চতুর্থত : রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়েই বিভিন্ন স্বার্থের গ্রন্থিকরণ ও সংহতি সাধনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পঞ্চমত : উভয়েই বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় নিজেদের কাজ-কর্ম পরিচালনা করে এবং দাবি-দাওয়া ব্যক্ত করে।

বৈসাদৃশ্যসমূহ (Dissimilarities) :

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। অ্যালান বল ও অধ্যাপক নিউম্যান প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও আধুনিককালে উভয়ের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্যের কথা বলেছেন। উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি প্রভৃতির প্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় নিয়ে সেগুলো আলোচনা করা হলো :

১. লক্ষ্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য : সাধারণত বহুমুখি ও ব্যাপক সামাজিক বা জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকে। রাজনৈতিক দলের প্রধান বিবেচ্য বিষয় জাতীয় ও সামাজিক স্বার্থ সাধন। রাজনৈতিক দল সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করতে চায়।

অন্যদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সামনে বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণ সাধনের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকে না। সংকীর্ণ ও সমজাতীয় বিশেষ গোষ্ঠীগত স্বার্থকে কেন্দ্র করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়। যে কারণে জাতীয় ও সামাজিক স্বার্থের পরিবর্তে সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কাছে মুখ্য প্রতিপন্ন হয় ।

উৎপত্তিগত পার্থক্য : সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এই মতাদর্শের ভিত্তিতে দলীয় নীতি ও ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং তা বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করা হয়।

পক্ষান্তরে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উৎপত্তির ভিত্তিমূলে কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় না। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অঙ্গীকারও থাকে না। এসমস্ত গোষ্ঠীর অঙ্গীকার থাকে গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রতি ।

৩. সংহতির প্রশ্নে পার্থক্য : একই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর লোক থাকতে পারে। যে কারণে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে সংহতির প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংহতির সমস্যা বড় একটা দেখা যায় না। কারণ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা সাধারণত কম হয় এবং অভিন্ন স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে গোষ্ঠীর সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ থাকে ।

৪. সাংগঠনিক পার্থক্য : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর তুলনায় রাজনৈতিক দল অনেক বেশি সুসংগঠিত। অভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কঠোর দলীয় শৃঙ্খলার ভিত্তিতে দলীয় সংহতি বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সাংগঠনিক দিক থেকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দল অপেক্ষা দুর্বল।

৫. প্রকৃতিগত পার্থক্য : রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বশ্রেণির লোকের সমাবেশ ঘটে। ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির লোক রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ লাভ করে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একই জাতীয় এবং একই পেশার লোক সদস্যপদ লাভ করে। যেমন : ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য শুধুমাত্র ব্যবসায়িক শ্রেণি। আবার শিক্ষক সমিতির সদস্য শুধুমাত্র শিক্ষকবৃন্দ।

৬. আদর্শের ক্ষেত্রে পার্থক্য : রাজনৈতিক দল একটি বৃহৎ ও ব্যাপক সংগঠন। এর সদস্যভুক্তির পদ্ধতি জটিল। কেননা, কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলের আদর্শের প্রতি অনুগত লোকজনই এর সদস্য। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যগণ বিভিন্ন মতাবলম্বী হতে পারে ।

৭. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য : রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য বহুমুখি এবং ব্যাপক হলেও সরকারি ক্ষমতা দখল করে দলীয় নীতি ও কর্মসূচিকে বাস্তবে রূপায়িত করাই হলো রাজনৈতিক দলের মুখ্য লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিটি দলই তাদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করে, নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করে, দলীয় প্রার্থী মনোনীত করে, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সরকার গঠন ও পরিচালনা করে। অন্যদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সরকারি সিদ্ধান্তকে গোষ্ঠী স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করা ।

৮. কাজ-কর্মের ধরনগত পার্থক্য : রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ। জনসাধারণ রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবহিত থাকে। কারণ রাজনৈতিক দল জনসমর্থন পাওয়ার জন্য তার বক্তব্য ও কর্মসূচি সরাসরি জনগণের নিকট পেশ করে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ পরোক্ষভাবে ও গোপনে সম্পাদিত হয় । কারণ জনসাধারণের সমর্থন অর্জনের ব্যাপারে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর আগ্রহ বা উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তাই এদের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জনগণের অবহিত হওয়ার তেমন একটা সুযোগ থাকে না ।

৯. রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নে : প্রয়োজনবোধে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় সম মনোভাবাপন্ন দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মোর্চা নিতান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিভূ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের সমঝোতা খুব একটা দেখা যায় না ।

১০. নির্বাচনে যোগদানের ক্ষেত্রে পার্থক্য : প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দলীয় প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয় । কারণ রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সরকারি ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। তবে এই গোষ্ঠীগুলো গোষ্ঠীস্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে সমর্থন বা তার পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারে। আবার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কোনো সদস্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে বা নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে ।

১১. সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পার্থক্য : রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হলো নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করা, তাদের নির্বাচিত করার প্রচেষ্টা নেয়া, নির্বাচনের পর সরকার গঠন করা, এছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে কীভাবে সাফল্য অর্জন করা যায় তার চেষ্টা করা। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কর্তব্য হলো নিজেদের স্বার্থকে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা। তারা সরকারি ক্ষমতা দখল করতে চায় না। তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র নিজেদের কর্মসূচি বা স্বার্থকে সরকারি নীতির অন্তর্ভুক্ত করা।

১২. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে পার্থক্য : কর্মপদ্ধতির প্রকৃতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। অভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থের অস্তিত্ব হেতু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী অতি সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই রাজনৈতিক দলের পক্ষে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্বর ও সহজে সম্ভব হয় না।

১৩. জনকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্য : জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। ফলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ সাধন করাই হলো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য। যে কারণে রাজনৈতিক দল সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থকে গুরুত্ব প্রদান করে না। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সামনে বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণ সাধনের কোনো মহান উদ্দেশ্য থাকে না।

১৪. অপরিহার্যতার প্রশ্নে : উদারনৈতিক, সর্বাত্মক ও সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। কিন্তু সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী থাকে একথা বলা যায় না। যেমন— সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য বা শ্রেণি দ্বন্দ্ব থাকে না বিধায় এই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয়।

১৫. সদস্য সংখ্যার পার্থক্য : সাধারণত রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি হয়। তবে এ বক্তব্য সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে।

উপরের আলোচনায় রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য বিবৃত হলেও ক্ষেত্রবিশেষে এদের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এ পার্থক্য সর্বদা সুস্পষ্ট নয়। কোনো কোনো চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের মতোই তার কাজ-কর্ম পরিচালনা করে। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য লাভের জন্য চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ন্যায় কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উভয়ের অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয় ।

Leave a Reply