ব্রিটিশ-সংবিধানের-উদ্ভব

ব্রিটিশ সংবিধানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ Origin and Evolution of Britsh Constitution

ব্রিটিশ সংবিধান হলো সুদীর্ঘকালের ক্রমবিবর্তনের ফল। যুগ যুগান্তর ধরে দেশ ও দেশবাসীর ঘটনা প্রবাহের সাথে সঙ্গতি বিধান করে ব্রিটিশ সংবিধান বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের প্রাচীন এই সংবিধানটির বিবর্তনের ধারা আজও অব্যাহত গতিতে চলছে । তাই অধ্যাপক মুনরো (Prof Munro) বলেছেন, “British Constitution is the mother of all constitution.” তবে ব্রিটিশ সংবিধান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবিধান হতে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠেছে। সমাজ ও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্রিটিশ সংবিধানেরও বিবর্তন ঘটেছে। এজন্য অধ্যাপক ফাইনার (Prof Finer) বলেছেন, ব্রিটিশ সংবিধান হলো বিরতিহীন ক্রমবিকাশমান সংবিধান (British constitution is a constitution of never ending evolution ) । অধ্যাপক মুনরো (Prof. Munro) বলেছেন, “এ সংবিধান কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংসদ কিংবা সংবিধান পরিষদ কর্তৃক রচিত হয়নি, অনেকটা জৈব প্রক্রিয়ার মতো ব্রিটিশ সংবিধান নিজে নিজেই বহু শতাব্দির বিবর্তনের ধারায় গড়ে উঠেছে।”

ব্রিটিশ সংবিধানের ধারাবাহিকতা ও গতিশীলতা একে অনন্য মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে। জে. এস. প্রাইস তাই বলেছেন, “Ideally the British constitution is always uptodate, responding quickly and sensitively to changing needs of changing times.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, বাংলাদেশ, ভারত প্রভৃতি দেশের মতো কোনো লিখিত সংবিধান ব্রিটেনে না থাকলেও লিখিত সংবিধান যে সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই সব প্রতিষ্ঠান এখানেও বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেছেন, যদি সংবিধান বলতে লিখিত দলিলকে না বুঝিয়ে কতকগুলো প্রতিষ্ঠান (Institutions) কে বোঝায়, তাহলে বলা যায়, ব্রিটিশ সংবিধান রচিত হয়নি, তা গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ সংবিধানের ক্রমবিকাশের পর্যায়গুলো নিচে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো :

ক. অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ (Anglo-saxon period) : খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দিতে মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ড থেকে অ্যাংলো- স্যাক্সন উপজাতিরা ইংল্যান্ডে এসে স্থানীয় সেল্টিক (Celtic) উপজাতিদের বিতাড়িত করে নিজেদের প্রধানের নেতৃত্বে সাতটি রাজ্য স্থাপন করে। এই সাতটি রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও যুদ্ধ প্রায়ই লেগে থাকত। এভাবে নবম শতাব্দিতে ওয়েসেক্স রাজ্য বাকি ছয়টি রাজ্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ।

১. রাজতন্ত্রের উদ্ভব (Origin of Monarchy) : এগবার্ট (Egbert) ছিলেন প্রথম রাজা যিনি সমগ্র অ্যাংলো স্যাক্সন ইংল্যান্ডের উপর একটি স্থিতিশীল এবং বৃহৎ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মূল ইউরোপীয় ভূ-খণ্ড থেকে এসে সর্বপ্রথম ৮০২ সালে ওয়েসেক্স রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি সাসেক্স, অ্যাসেক্স, পূর্ব অ্যাঙ্গোলিয়া ও কেন্ট রাজ্য দখল করেন। এরপর ৮২৭ সালে মদাম্বিয়া স্যাক্সন রাজা এগবার্ট এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। একই বছর মার্সিয়া বিজয়ের মাধ্যমে তিনি সমগ্র ইংল্যান্ডের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ৮২৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। তখন থেকে অদ্যাবধি ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তবে ১৬৪৯ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে রাজতন্ত্র ছিল না ।

২. উইটান (Witan) : অ্যাংলো স্যাকসন যুগে রাজাগণ উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনে আরোহণ করত। এ সময় রাজারা এককভাবে রাজ্য শাসন করতেন না। তাঁরা উইটান (Witan) বা বিজ্ঞজন সভার (Council of wise Men) মাধ্যমে রাজ্য শাসন করতেন। উইটান গঠিত হতো রাজপরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশপ, শায়ার এর অল্ডারম্যানগণ এবং প্রধান ভূস্বামীদের নিয়ে। উইটানের অধিবেশন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বসত এবং রাজা নিজে এতে সভাপতিত্ব করতেন। এর প্রধান কাজ ছিল নতুন কোনো কর ধার্য, সন্ধি চুক্তি সম্পাদন, নতুন কোনো নিয়ম প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে সম্মতি প্রদান। তবে উইটানে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় একে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা বলা যায় না ।

খ. নর্মান যুগ (Norman Age) : এরপর ১০৬৬ সালে নর্মান্ডির উইলিয়াম (William) ইংল্যান্ড জয় করেন এবং নিজেকে ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ যুগে পুরোপুরি সামন্ত ব্যবস্থা (Feudal System) প্রবর্তিত হয় এবং রাজার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার উপরও নর্মান রাজাগণ তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। উইলিয়াম নিজেকে গির্জা বা খ্রিস্টধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান হিসেবেও ঘোষণা করেন।  

৩. বৃহত্তর পরিষদ (Magnum Concillium) : নর্মান রাজাগণ উইটানের পরিবর্তে বৃহত্তর পরিষদ (Magnum

আর্ল, অ্যাবট এবং নাইটদের নিয়ে বৃহত্তর Concillium) গঠন করেন। রাজ পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি, আর্চ বিশপ, বিশপ, পরিষদ গঠিত হতো। এর অধিবেশন অধিকাংশ সময়ে ওয়েস্ট মিনস্টারে বসত। এই পরিষদের কাজ ছিল আইন প্রণয়ন, কর ধার্য ও বিচার কার্য সম্পাদন করা। অনেক দিন অন্তর এই পরিষদের অধিবেশন বসত ।

৪. ক্ষুদ্রতর পরিষদ (Curia Regis) : নর্মান যুগে রাজাকে সবসময় পরামর্শ ও সাহায্য দানের জন্য ক্ষুদ্রতর পরিষদ (Curia Regis) নামে আর একটি ক্ষুদ্র পরিষদ গড়ে ওঠে। Curia Regis বা রাজার কোর্টকে ক্ষুদ্রতর পরিষদ বলা হতো। কয়েকজন প্রধান রাজকর্মচারী ও ব্যারনদের নিয়ে এই ক্ষুদ্রতর পরিষদ গঠিত হতো। এই পরিষদ শাসন, বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে রাজাকে সাহায্য ও পরামর্শ প্রদান করত ।

৫. শাসন বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ (Separation of Administration and Judiciary) : দ্বাদশ শতাব্দিতে দ্বিতীয় হেনরির রাজত্বকালে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়।

৬. উচ্চতর আদালত প্রিভি কাউন্সিলের উদ্ভব (Rise of High court and Privy Council) : শাসন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ফলে ক্ষুদ্রতর পরিষদকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি বিভাগের উপর বিচার সংক্রান্ত কাজের ভার অর্পিত হয়, এর থেকেই উচ্চ আদালতের উদ্ভব ঘটে, অপর বিভাগটির উপর দৈনন্দিন শাসন সংক্রান্ত কাজের ভার অর্পণ করা হয়। এই দ্বিতীয় বিভাগটি রাজার স্থায়ী পরামর্শ পরিষদে পরিণত হয়। এই স্থায়ী পরিষদটি প্রিভি কাউন্সিল নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে এ প্রিভি কাউন্সিলের ভেতর থেকেই ক্যাবিনেট (Cabinet) আত্মপ্রকাশ করে। এরপর রাজকার্যে বাড়তি অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাজা জনকে পরামর্শ দানের জন্য তিনি প্রতিটি শায়ার (Shire) এর শেরিফকে অক্সফোর্ড মহাপরিষদে ৪ জন করে নাইট প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। ঐ সময় থেকে ইংল্যান্ডে প্রতিনিধিত্বমূলক পার্লামেন্টের সূত্রপাত হয়েছিল।

৭. মহাসনদ (Magna Carta) :- রাজা দ্বিতীয় হেনরির পুত্রদ্বয় রিচার্ড ও জন ছিলেন অযোগ্য, খামখেয়ালী এবং স্বৈরাচারী। বিশেষ করে রাজা জনের স্বৈরাচারী কার্যকলাপে ভূস্বামীগণ (Barons) অতিষ্ঠ হয়ে রাজার ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে উদ্যোগী হন। অতঃপর ১২১৫ সালের ১৫ জুন রুনিমিড প্রান্তরে রাজা জন ও বিক্ষুব্ধ ব্যারনদের মধ্যে ঐতিহাসিক মহাসনদ (Magna Carta) সম্পাদিত হয়। রাজা জন ব্যারনদের অনেক দাবি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন। রাজা অঙ্গীকার করতে বাধ্য হন যে, বৃহত্তর পরিষদের সম্মতি ব্যতীত তিনি কতকগুলো বিশেষ কর আদায় করতে পারবেন না। তাছাড়া প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, রাজা কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করতে, নির্বাসন দিতে বা সম্পত্তিচ্যুত করতে পারবেন না। মহাসনদকে ইংল্যান্ডের শাসনতন্ত্রের বাইবেল বলা হয়।

৮. পার্লামেন্টের উদ্ভব (Origin of Parliament) : ১২৫৪ সালে রাজা তৃতীয় হেনরির রাজত্বকালে করধার্যের ব্যাপারে ব্যারন বা জমিদারদের সাথে তাঁর তীব্র বিরোধ শুরু হয়। এ বিরোধ প্রায় দশ বছর যাবৎ চলে। এই বিরোধে ব্যারনদের নেতৃত্ব দেন সাইমন ডি. মন্টফোর্ট (Simon De Montfort)। তিনি ১২৬৫ সালে ব্যারনদের প্রতিনিধি হয়ে বৃহত্তর পরিষদের একটি সভা আহ্বান করেন। তিনি প্রতিটি শায়ার থেকে ব্যারন, অভিজাত পাদ্রি (Clergy) এবং ২ জন করে নাইট ছাড়াও ২১টি বরোর (Borough) প্রতিটি থেকে ২ জন করে বার্জেস (Burgess) বা নাগরিক প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানান। অনেকে সাইমন ডি. মন্টফোর্টকে আধুনিক পার্লামেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বলে থাকেন ।

৯. লর্ডসভা কমন্সসভার উদ্ভব (Origin of House of Lord & House of Commons ) : রাজা তৃতীয় হেনরির পুত্র প্রথম এডওয়ার্ড যুদ্ধের জন্য অর্থের প্রয়োজনে ১২৯৫ সালে বৃহত্তর পরিষদের এক সভা আহবান করেন। সমাজের সকল স্ত রের মানুষের প্রতিনিধির স্থান এই পার্লামেন্টে হয়েছিল। তাই ব্রিটিশ সাংবিধানিক ইতিহাসে একে আদর্শ পার্লামেন্ট (Model Parliament) বলা হয়। এই পার্লামেন্টে প্রধানত তিন শ্রেণির প্রতিনিধি ছিলেন, যথা-সামন্ত শ্রেণির প্রতিনিধি, যাজক শ্রেণির প্রতিনিধি এবং নাইট ও বার্জেস প্রতিনিধিগণ। শুরুতে এই তিন শ্রেণির প্রতিনিধি আলাদাভাবে বসতেন ও নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করতেন। ফলে এক সময় পার্লামেন্ট তিনটি কক্ষের দিকে ধাবিত হয়েছিল। কিন্তু অভিন্ন শ্রেণি স্বার্থের জন্য শেষ পর্যন্ত সামন্ত ও যাজক শ্রেণির প্রতিনিধিগণ একটি কক্ষে এবং অন্যান্যরা অপর একটি কক্ষে পার্লামেন্টে মিলিত হতেন। প্রথম কক্ষটি লর্ডসভা এবং দ্বিতীয় কক্ষটি কমন্সসভা নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রথমদিকে লর্ডসভাই ছিল প্রকৃত ক্ষমতাশালী। লর্ডসভার পরামর্শক্রমে রাজা আইন প্রণয়ন করতেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে কমন্সসভার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১০. গোলাপের যুদ্ধ (War of Roses) : ইংল্যান্ডের সামন্তবাদী সম্প্রদায়ের দুটি উপদলের মধ্যে সিংহাসন লাভের জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ ১৪৫৫-৮৫ সাল পর্যন্ত চলে। এদের এক পক্ষে ছিলেন ইয়কগণ এবং অপর পক্ষে ছিল ল্যাঙ্কাস্টারগণ। এ দুটি বংশের প্রতীক ছিল যথাক্রমে সাদা ও লাল গোলাপ। প্রথম পক্ষকে সমর্থন করে দক্ষিণের নাইট সম্প্রদায় নগরাঞ্চলের অধিবাসীরা এবং দক্ষিণের বৃহৎ সামন্তদের অংশবিশেষ। অপরপক্ষ ল্যাংকাস্টারদের সমর্থন করে উত্তরের কাউন্টিগুলোর সামস্ত অভিজাতগণ। যুদ্ধে প্রাচীন সামন্ত বংশগুলোর প্রায় সবই ধ্বংস হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডে স্বৈর শাসনের প্রতিষ্ঠাতা টিউডর বংশ ক্ষমতা দখল করে। সামন্ত শ্রেণির এই আত্মঘাতী যুদ্ধ ইতিহাসে “গোলাপের যদ্ধ” (War of Roses) নামে পরিচিত।

গ. টিউডর যুগ (Tudor Age) চরম রাজতন্ত্র : টিউডর বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা সপ্তম হেনরি ১৪৮৫ সালে ইংল্যান্ডের শাসন ক্ষমতায় আসীন হন। এ যুগে পার্লামেন্ট বিশেষভাবে রাজা বা রানীর অনুগত হয়ে পড়ে। রাজা অষ্টম হেনরি পার্লামেন্টের অনুমোদনের মাধ্যমে ১৫৩৪ সালে নিজেকে চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করেন। রাজা সপ্তম হেনরি, অষ্টম এডওয়ার্ড ও প্রথম এলিজাবেথ খুবই দক্ষ শাসক ছিলেন। তাঁরা পার্লামেন্টের সাথে সমঝোতা করে চলতেন। টিউডরদের শাসনামলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ নিজেদের দৈনন্দিন কাজের বিবরণী লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করে।

ঘ. স্টুয়ার্ট যুগ (Age of Stuart) : ১৬০৩ সালে স্টুয়ার্ট বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রথম জেমস সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রথম জেমস পার্লামেন্টের প্রাধান্যের বিরোধিতা করেন। তিনি রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতাতত্ত্ব (Theory of Divine Right ) তুলে ধরেন। ফলে রাজার সাথে পার্লামেন্টের দ্বন্দ্ব বাধে। এ সময় ইংল্যান্ডে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিদেশে নতুন নতুন উপনিবেশ গড়ে ওঠে। এ সময় ইংল্যান্ডের উদীয়মান ধনিক-বণিক শ্রেণি পার্লামেন্টের বিশেষ করে কমন্সসভার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয় ।

১১. অধিকারের আবেদনপত্র (Petition of Rights) : রাজা প্রথম চার্লসের সময় পার্লামেন্টের সাথে রাজার বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ১৬২৮ সালে প্রথম চার্লস পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেও শেষ পর্যন্ত বণিক শ্রেণির চাপে তিনি পুনরায় পার্লামেন্ট আহবান করেন। এ সময় লর্ডসভা ও কমন্সসভা একযোগে এক অধিকারের আবেদনপত্র (Petition of Rights) পেশ করে এবং রাজা প্রথম চার্লস অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি দিতে বাধ্য হন যে, পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতীত তিনি কোনো কর আদায় করবেন না। কিন্তু রাজা কিছুদিন পর এই শর্ত ভঙ্গ করতে শুরু করেন। তিনি দীর্ঘ এগারো বছর পার্লামেন্ট ছাড়াই দেশ শাসন করেন। ১৬৪০ সালে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটাবার জন্য তিনি পুনরায় পার্লামেন্টের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হন। কিন্তু রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে বিরোধে দেশব্যাপী বিরাট গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে রাজা প্রথম চার্লস পরাজিত হন।

১২. ক্রমওয়েল তার প্রজাতন্ত্র (Cromwell and his Republic) : ১৬৪৯ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে উদীয়মান ধনিক-বণিক শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং রাজা প্রথম চার্লসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। অলিভার ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডকে প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেন এবং তিনি রাজতন্ত্র ও লর্ডসভা বাতিল করে দেন। ক্রমওয়েলের ১১ বছরের শাসনকালে ব্রিটেনের জন্য একটি লিখিত সংবিধান চালু করা হয়েছিল। তিনি বিত্তবান ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সাহায্যে এককক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন করেন। কিন্তু তাঁর শাসনামল ছিল অগণতান্ত্রিক ও অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ।

১৩. গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution) : ১৬৫৮ সালে অলিভার ক্রমওয়েল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর দু’বছরের মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে এবং পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্টুয়ার্ট বংশের দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬০ সালে পার্লামেন্টের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়ে সিংহাসনে বসেন। ১৬৮৫ সালে তাঁর ভাই দ্বিতীয় জেমস রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় জেমসের রাজত্বকালে রাজার সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ বাধে। এই বিরোধের ফলে দ্বিতীয় জেমস ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত হন এবং একটি বিশেষ পার্লামেন্ট দ্বিতীয় জেমস এর কন্যা মেরী ও জামাতা উইলিয়ামকে সিংহাসনে আরোহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। এভাবে ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডে যে রক্তপাতহীন পরিবর্তন ঘটে, ইতিহাসে তাকে গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution) নামে অভিহিত করা হয়।

 ১৪. অধিকারের বিল (Bill of Rights) : ১৬৮৯ সালে দ্বিতীয় জেমসের কন্যা মেরী ও জামাতা উইলিয়াম সিংহাসনে বসেন। এ সময় পার্লামেন্ট ইতিহাস প্রসিদ্ধ অধিকারের বিল (Bill of Rights) পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইনের দ্বারা পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া রাজার কর ধার্য, রাজস্ব সংগ্রহ ও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়। তাছাড়া শাস্তির সময়ে সৈন্য সমাবেশ করার ক্ষমতা রাজার হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয় ।

১৫. কেবিনেট পদ্ধতির উদ্ভব (Rise of Cabinet System) : স্টুয়ার্ট রাজাদের শাসন আমলে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনকে রাজা পরামর্শ দানের জন্য আহ্বান করতেন। দ্বিতীয় চার্লস প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে তাঁর আস্থাভাজন পাঁচজনকে নিয়ে একটি পরামর্শ সভা গঠন করেন। এই পাঁচজন হলেন ক্লিফোর্ড (Cliford), অ্যাসলে (Ashley), বাকিংহাম (Buckingham), আরলিংটন (Arlington), এবং লডারডেল (Lauderdale)। এই পাঁচজন ব্যক্তির নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ক্যাবাল (CABAL) গঠিত হয়েছিল। এই CABAL থেকে পরবর্তীতে কেবিনেট শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।

ঙ. হ্যানোভার বংশ (Clan of Hanover) : হ্যানোভার বংশীয় রাজা প্রথম জর্জ (১৭২৭-১৭৬০), দ্বিতীয় জর্জ (১৭৬০- ১৮২০) এবং তৃতীয় জর্জ (১৭৬০-১৮২০) ছিলেন বিদেশি। তারা ইংরেজি জানতেন না। তারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত হতেন না এবং সভাপতিত্ব করতেন না। তারা রাজার বিশেষ অধিকার প্রয়োগে কোনো আগ্রহ দেখাতেন না ।

১৬. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ মন্ত্রিসভা গঠন ( Appointment of Prime minister & Formation of Cabinet) : হ্যানোভার বংশীয় রাজাদের আমলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেতন মন্ত্রিসভার সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য। এভাবে স্যার রবার্ট ওয়ালপোল (Sir Robert Walpole) ১৭২১ সালে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন সেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং তাঁকেই ইংল্যান্ডের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলা হয়ে থাকে। তিনিই মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতার নীতির প্রবর্তন করেন। ১৭৪২ সালে কমন্সসভা তাঁর মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলে তিনি পদত্যাগ করেন।

১৭. রাজনৈতিক দল, প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রভৃতির উৎপত্তি (Origin of Political Party, Election etc.) : রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আমলে দল ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়। এ সময় টোরি (Tory) এবং হুইগ (Whig) নামে দুটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়। রাজার সমর্থক হিসেবে টোরি দল এবং বিরোধী হিসেবে হুইগ দল পরিচিত। পরবর্তীকালে উভয় দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয় এবং দল ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন ঘটে। ১৮৩২ সালের আইনে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত করা হয়। কিন্তু তার পূর্বে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ ভোটাধিকার লাভ করত। ১৯১৮ সালে ব্রিটেনে ২১ বছর বয়সী বা তদূর্ধ্ব সকল পুরুষ ভোটাধিকার লাভ করেন এবং ৩০ বছর বয়সী বা তদূর্ধ্ব নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেন। ১৯২৮ সালে নারীদের ভোটাধিকারের বয়স পুরুষদের বয়সের সমান করা হয়। ১৯৬৯ সালে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভোটাধিকারের বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব করা হয়। ১৯৬৯ সালে ১৮ বছর বয়সী সকল নর-নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইনে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাস করা হয় ।

সুতরাং বলা যায় যে, ব্রিটিশ সংবিধান সুদীর্ঘ পনেরো শত বছরের ক্রমবিকাশের ফসল। এ সংবিধান কোনো গণপরিষদ কর্তৃক বা কোনো বিপ্লবী সংস্থা কর্তৃক নির্দিষ্ট দিনে রচিত হয় নি। দীর্ঘ ধারাবাহিক বিবর্তনের ধারায় ব্রিটিশ সংবিধান বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। তাই ড. জোহারী (Dr. Johari) যথার্থই বলেছেন, “Its evident that British constitution is a living organism which has been in a condition of perpetual growth and change.”

Leave a Reply