জনমত গঠনের বাহনসমূহ আলোচনা কর । Discuss the agencies of public opinion.
রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনমত গঠন আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতিপয় উপাদান বা বাহনের মাধ্যমে জনমত গঠন করা যায় :
১. পরিবার : পরিবার হলো জনমত গঠনের প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বা উপাদান। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। কেননা, পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। ফলে তাদের মধ্যে জনমত তৈরি সহজ হয়। অধিকন্তু পরিবারের অভিভাবক মহলের রাজনৈতিক মতামতের প্রতি অপরাপর সদস্যগণ অনুগত থাকে ।
২. সংবাদপত্র ও সাময়িকী : জনমত গঠনে সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র, পুস্তক-পুস্তিকার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এসব মাধ্যমে বহুকিছু জনসম্মুখে তুলে ধরা হয় বিধায় জনগণ দেশ-বিদেশের অনেক কিছু জানতে পারে। কেননা, গণমাধ্যমসমূহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক কিছু ব্যক্ত করে। ফলে জনগণের মধ্যে জনমত গঠন সহজ হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, Newspaper can be called the book of democracy ।
৩. সভা-সমিতি : পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্র শিক্ষিত লোকের জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করলেও অশিক্ষিত লোকের কাছে সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা কম। সভাসমিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ অনেক কিছু জানতে পারে। কেননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে রাষ্ট্রের অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও নবীন নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত এসব সভাসমিতিতে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেন। এসকল আলোচনার মাধ্যমে জনগণ তাদের মতামত যাচাই করতে পারে।
৪. রেডিও-চলচ্চিত্র : রেডিও ও চলচ্চিত্র জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবাদপত্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মনের খোরাক যোগালেও বেতার ও চলচ্চিত্র শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলের উপকারে আসে। বেতারের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিভিন্ন দিক জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। আবার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজ দেশ ও বহির্বিশ্বের সংস্কৃতির বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এগুলো সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলে বিধায় এর মাধ্যমে জনমত গঠিত হয়। মূলত নাটক, সিনেমা, খবরাখবর, প্রামাণ্যচিত্র, যাত্রা, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা, সরকার বিরোধী দলের বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রচারণা জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে ।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহ বিবিধ বিষয় স্থান পায় বিধায় শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পারে। ফলে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বহু বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে।
৬. পেশা : বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে পেশা জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত। স্ব স্ব পেশা তাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে বিধায় তারা নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তারা বহুমুখি দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, যেগুলো রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে। ফলে জনমত গঠন সহজ হয়।
৭. রাজনৈতিক দল : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল জনমত গঠনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে দেশে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। আর এসব রাজনৈতিক দল দেশের বহুবিধ সমস্যা জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং এসব সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের পথ নির্দেশ করে। যা জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করে জনমত গঠিত হয়। সরকারি দল তাদের দলীয় কর্মসূচিকে জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। বিপরীতে বিরোধী দলসমূহ সরকারি কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে নিজেদের কর্মসূচিকে উত্তম হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এরূপ নানামুখি চেষ্টায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে এবং সুস্থ ও সংহত জনমত গড়ে ওঠে।
৮. ধর্মীয় সংঘ : ধর্মীয় সংঘ জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করে। অনেক ধর্মীয় নেতা আছেন যারা ওতপ্রোতভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত হন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বক্তব্য রাখেন। নেতাদের বক্তব্য ও ধর্মীয় সংঘের ভূমিকা সমাজ জীবনে প্রভাব ফেলে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মহানবী (স) এর চিন্তাবোধ ও ক্যাথলিক গির্জার ধর্মীয় চেতনা। ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে ধর্মীয় বিষয়াদি প্রভাব বিস্তার করে।
৯. গুস্তক : পুস্তক জনমত গঠনে প্রভাব বিস্তার করে। কেননা, পুস্তক-পুস্তিকার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। এগুলোর মাধ্যমে পাঠক যেমন অনেক কিছু জানতে পারে, তেমনি এসব তথ্য ও তত্ত্ব এবং চিন্তা-চেতনা পাঠককে তার মতামত প্রকাশে সহায়তা করে।
১০. সাধারণ নির্বাচন : নির্বাচন হলো প্রতিনিধি নির্বাচনের একটি উত্তম পদ্ধতি। আর প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কেননা, নির্বাচ পচারণায় প্রতিটি দলের প্রার্থী নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি জনমতের সামনে তুলে ধরে। ফলে জনগণ দলীয় নীতি ও কর্মসূচি, শেখ সাথে প্রার্থীর গুণগত দিক বিচার-বিবেচনা করে সমর্থন ব্যক্ত করে।
১১. গণভোট বা রেফারেন্ডাম : গণভোট হলো জনমত গঠনের অন্যতম একটি মাধ্যম। সরকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে গণভোটের মাধ্যমে জনমত গঠন করে থাকে। এর মাধ্যমে জনমত গঠিত হলে সেই অনুযায়ী আইনী কার্যধারা বলবৎ হয় ।
১২. প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধব : প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধব জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে অনেক বিষয় আলোচনা করে এবং অনেক ইস্যুতে তর্কবিতর্ক হয়। আর এভাবে প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে খোলা মনে ও স্বাধীনভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হয় ।
১৩. আইনসভা : আইনসভা জনমত গঠনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আইনসভায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহুবিধ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। এছাড়া প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অনেক সত্য তথ্য উদঘাটিত হয়। এসব বিষয়ে জনগণ অনেক কিছু অবগত হতে পারে এবং তাদের মধ্যে জনমত গড়ে উঠতে পারে। ১৪. সরকার : সরকার নিজেই জনমত গঠনের অন্যতম অংশীদার। নিজ অস্তিত্ব রক্ষা ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনেই সরকার জনমত গঠনে উদ্যোগী হয়। সরকারি কার্যকলাপ প্রত্যক্ষভাবে দেশের মানুষকে প্রভাবিত করে। আর সরকারি কার্যকলাপের ফলেই জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটে।
১৫. জরিপ : অনেক সময় সমগ্র দেশব্যাপী কোনো বিশেষ অঞ্চলে জরিপের মাধ্যমে জনমত গঠন করা যায়। বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষণা বা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। তবে এ পদ্ধতি খুব সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
১৬. স্বাক্ষর সংগ্রহ : জনমত গঠনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হলো গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা। কোনো বিশেষ ইস্যুতে জনগণের কতটুকু বা কি পরিমাণ সমর্থন আছে তা যাচাইয়ের জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়।
১৭. মোবাইল : বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল কেবলমাত্র একটি যোগাযোগ মাধ্যমই নয়, বরং জনমত গঠনের একটি বাহনও বটে। কেননা, মোবাইলের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তার দ্বারা বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় । এমনকি নির্বাচনী প্রচারণাও চালানো হয়ে থাকে ।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনমতের উপর ভিত্তিশীল হলেও সুষ্ঠু ও সুসংহত গঠনে কোনো একক বাহন বা মাধ্যমের ভূমিকা যথেষ্ট নয়, বরং একাধিক মাধ্যমের সমন্বয়ে জনমত সুদৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে ।