জনমতের সংজ্ঞা দাও

প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে তৈরি হয় ১৬.৬ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব ১৬.৭ বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকা ১৬.৮ জনমতের সীমাবদ্ধতা

জনমত Public Opinion

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় জনমত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আবার বর্তমানে গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার বিকাশের সাথে সাথে জনমতের ধারণাটিও বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। যে কারণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে জনমতের অনুগামী শাসনব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। কোনো সরকার বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে না। জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কতগুলো মাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসকল মাধ্যম যদি শক্তিশালী হয় তবে সুস্থ জনমত গঠন করা সম্ভব হয়।

জনমতের সংজ্ঞা Definition of Public Opinion

সাধারণত জনমত বলতে জনগণের মতামতকে বুঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় জনমত হলো রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে এক বা একাধিক বিষয়ে জনগণের সুস্পষ্ট ও কল্যাণধর্মী অভিমতের সমন্বয় ।

১. লর্ড ব্রাইসের (Lord Bryce) মতে, “সমগ্র সমাজের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট বা স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন সব মতামতের সমষ্টিকেই সাধারণত জনমত বলা হয় ।”

২. কিম্বল ইয়ং (Kimbol Young) মনে করেন, “একটি নির্দিষ্ট সময়ে জনগণ যে মতামত পোষণ করেন তাকেই জনমত বলা হয়।”

৩. অস্টিন রেনি (Austin Renny)-এর মতে, “জনমত হলো সে সব ব্যক্তিগত মতামতের সমষ্টি যার প্রতি সরকারি কর্মচারীবৃন্দ কিছু পরিমাণে সজাগ থাকে এবং সরকারি কার্যক্রম নির্ধারণে তারা এর গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে।”

৪. সমাজবিজ্ঞানী জিন্সবার্গ (Ginsberg)-এর মতে, “জনমত হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফল।”

৫. জে. এস. মিল (John Stuart Mill)-এর মতে, “কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যার উপর জনগণের সংগঠিত অভিমতের নাম জনমত।”

৬. রবার্ট পিল (Robert Peel)-এর মতে, “সত্যিকার জনমত হতে হলে একে অবশ্যই জাতীয় কল্যাণ ও স্বার্থভিত্তিক সমস্যার প্রতিফলন সজ্ঞান, সচেতন ও যুক্তিভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত হতে হবে।”

৭. J. A. Corry-এর ভাষায়, “Public opinion is a view relating to government held strongly by a

considerable numbers of people dispose them to a put for action.”

সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, জনমত হলো দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহ জাতীয় কোনো বিষয়ে জনগণের যুক্তিভিত্তিক ও সুচিন্তিত মতামত ।

জনমত গঠনের শর্তাবলি Conditions to Organize the Public Opinion

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনমতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং জনমতের দ্বারা পরিচালিত। গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে সুস্থ, সুসংগঠিত এবং সদাজাগ্রত জনমত। যে কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের ভূমিকা অত্যধিক। নিম্নে জনমত গঠনের অপরিহার্য শর্তাবলি আলোচনা করা হলো :

১. গণতন্ত্র : গণতন্ত্র জনমত গঠনের অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে বিধায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকলে সুষ্ঠু সুসংগঠিত জনমত গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও জনমত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

ঐক্যবোধ : জনমত গঠনের জন্য জনগণের মধ্যে ঐক্যবোধ থাকা প্রয়োজন। ঐক্যবোধ না থাকলে স্বাধীন ও সুষ্ঠু জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকা আবশ্যক। কারণ জনগণের মধ্যে যে কোনো ধরনের অনৈক্য, দ্বন্দ্ব-কলহ জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঐক্যবোধ সুষ্ঠু ও সফল জনমতের জন্য অপরিহার্য।

৩. সুশীল সমাজ : সুশীল সমাজ জনমত গঠনের অপরিহার্য উপাদান। সার্থক জনমত গঠনের জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও প্রগতিশীল লেখকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ তাদের বক্তব্য ও মতামত পত্র-পত্রিকা, প্রচারপত্র, পুস্তিকা ও সভা-সমিতির মাধ্যমে জনগণের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর প্রেক্ষিতে জনমত গঠন সহজ হয়ে ওঠে।

৪. সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা : রাষ্ট্রের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জনমত গঠনে ব্যাপক অবদান রাখে। অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনগণের মধ্যে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে, যার বিকাশ শিক্ষিত জনগণের মধ্যে খুব সহজেই ঘটে থাকে । এভাবে শিক্ষা জনমত গঠনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে ।

৫. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা : স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ না থাকলে প্রকৃত জনমত গঠিত হতে পারে না। অর্থাৎ, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাও জনমত গঠনের ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। যে কারণে গণসংযোগ মাধ্যমসমূহের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অপরিহার্য ।

৬. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল : জনমত গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল প্রকৃত মাধ্যম হিসেবে কাজ করলেও দেশে যদি সুসংগঠিত আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল না থাকে তবে তা কোনো সময় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না। জনমত গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলকে হতে হবে আদর্শভিত্তিক, সুসংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক।

৭. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : জনমত গঠনের জন্য জনমত গঠনের প্রয়োজনীয় মাধ্যমসমূহের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। পরিবার, সংবাদপত্র, বেতার ও চলচ্চিত্রসহ প্রচার মাধ্যমসমূহের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে।

৮. বৈধ সরকার : বৈধ সরকারের উপস্থিতি জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা গঠিত ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বৈধ না হলে সে সরকার জনমতের তোয়াক্কাই করবে না। কারণ অবৈধ সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে জনমত নয়, বরং শক্তি কাজ করে থাকে। একমাত্র বৈধ সরকারই জনমতের প্রকৃত ধারক-বাহকে পরিণত হতে পারে।

৯. জনসভা : যেকোনো ধরনের সভা-সমিতিতে জনমতের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। যদিও অধিকাংশ জনসভা অনুষ্ঠিত হয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য। যদি সুষ্ঠু জনমত গঠনের জন্য যে কোনো সভা-সমিতিতে আদর্শগত বক্তব্য প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। আদর্শগত ও লক্ষ্যভিত্তিক বক্তব্য জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে।

১০. সহনশীলতা : সহনশীলতা না থাকলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জনমত কখনোই গঠিত হতে পারে না। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন না করলে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব নয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সুষ্ঠু, সফল ও অবাধ জনমত গঠন এবং তা দ্বারা সরকারি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যে দেশের জনমত যত সুসংবদ্ধ সে দেশের শাসন ব্যবস্থাও তত উন্নত। তবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের কোনো বিকল্প নেই ।

Leave a Reply