Table of Contents
Toggleগণতন্ত্রের সফলতার পথে অন্তরায়/সংকটসমূহ Hindrances/Crisis to the Success of Democracy
গণতন্ত্রের সফলতার পথে যে সমস্ত অন্তরায় বিদ্যমান তা আলোচনা করা হলো :
প্রথমত : রাজনৈতিক উদাসীনতা হলো গণতন্ত্রের পথে প্রথম বাধা। কারণ কোনো সমাজের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক উদাসীনতা দেখা দিলে সেই সমাজে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
দ্বিতীয়ত : শিক্ষার অভাবে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোদ যথার্থভাবে কাজ না করতে পারার দরুন গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। তৃতীয়ত : জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব গণতন্ত্রের ব্যাহতের অন্যতম কারণ ।
চতুর্থত : স্বার্থপরতা গণতন্ত্রের পথে বাধা।
পঞ্চমত : বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের দুর্দশার একটি বিশেষ কারণ হলো অর্থনৈতিক সংকট।
ষষ্ঠত : বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের প্রসার গণতন্ত্রের সফলতার পথে বাধা হিসেবে কাজ করে। কারণ পুঁজিবাদে বণিক শ্রেণি রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত করার দরুন গণতন্ত্র ব্যাহত হয়।
সপ্তমত: সামরিক হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রের সফলতার পথে বাধা হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান বিশ্বে শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ। যা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহকে নিশ্চিত করে ও সমগ্র জনগণের যৌণ কল্যাণ সাধন করে। কিন্তু যে কোনো দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা, সংহত ও সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে অবশ্যই আলোচিত শর্তাবলি অনুসরণ করতে হবে। কেননা, গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে অনেক বাধা বা অন্তরায় বিদ্যমান। এ সমস্ত বাধা বা অন্তরায় পূরণ করতে হলে অবশ্যই গণতন্ত্রের পূর্বশর্তসমূহ পূরণ করতে হবে।
গণতন্ত্রের ধরন বা প্রকারভেদ
Types/Classification of Democracy
গণতন্ত্র যদিও জনগণের শাসন তথাপি জনগণ সর্বদা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না। যে কারণে গণতন্ত্রের প্রকৃতি বা জনগণের শাসন কাজে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Direct Democracy) : প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণ সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে শাসনকাজে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র (Pure Democracy) নামেও পরিচিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রাচীন গ্রিসে ও রোমে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নাগরিকগণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ কোনো স্থানে সমবেত হয়ে আইন প্রণয়ন, রাজস্ব ও ব্যয় নির্ধারণ, সরকারি কর্মচারী নিয়োগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করত। মাঝে মাঝে তারা বিচার কার্যও সম্পাদন করত। কারণ ঐসব রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল নগররাষ্ট্র ভিত্তিক, যেগুলো ছিল আয়তনে ক্ষুদ্র ও স্বল্প জনসংখ্যা অধ্যুষিত। ঐসময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানেও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল।
মনীষী হার্নশ (Hearnshaw) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেন, ” Direct democracy is a democratic form of government……………….. is one in which the community as a whole, directly or immediately without agents or representatives perform the function of soveriegnty.”
কিন্তু আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের বিশালায়তন, বিপুল জনসংখ্যা ও জটিল প্রকৃতির নানাবিধ সমস্যার কারণে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. পরোক্ষ গণতন্ত্র (Indirect Democracy) : পরোক্ষ গণতন্ত্র গণতন্ত্রের আধুনিক রূপ তথা বর্তমানে প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে শাসনকাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না; বরং তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলে। সহজ ভাষায় বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ নিজেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করে না, বরং তাদের প্রতিনিধিদেরকে প্রেরণ করে তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলে। জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেয় বলে একে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রও বলা হয়।
জন স্টুয়ার্ট মিল (JS. Mill)-এর মতে, “পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে এমন এক শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়, যেখানে সমগ্র জনসাধারণ বা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা ব্যবহার করে। “
বৃহৎ ও ব্যাপক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্রে পরোক্ষ গণতন্ত্র অপরিহার্য। এক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনগণের পক্ষে ক্ষমতা চর্চা করে থাকে এবং জনগণের নিকট দায়ী থাকে। যে কারণে আইন ও শাসন বিভাগ জনমতের অনুকূলেই পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পরোক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত।
পরোক্ষ গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ
Application of Direct Democratic Methods in Indirect Democracy
গণতন্ত্র জনগণের শাসন। কিন্তু জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে যায় এবং জনমতের প্রতি তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করে। ফলে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে শাসকের অনেক হঠকারিতা সহ্য করতে হয়। কিন্তু এরূপ অবস্থা যাতে ঘটতে না পারে এবং পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদেরকে যাতে করে জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায় সেজন্য কতগুলো পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিগুলোকে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলে। নিম্নে এসব পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
- গণভোট (Referendum) : গণভোট বলতে আইন প্রণয়ন কিংবা সংবিধানের সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণ করাকে বুঝায়। সুইজারল্যান্ডের সংবিধানের কোনো অংশ পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট অবশ্যই গ্রহণ করতে হয়। সুইডেন, ইতালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশেও গণভোট প্রচলিত আছে। বাংলাদেশেও গণভোটের বিধান আছে। বাংলাদেশ সংবিধানে উল্লেখ আছে, সংবিধানের কোনো মৌলিক ধারা সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পেশ করলে তিনি সাত দিনের মধ্যে উক্ত প্রস্তাব গণভোটে দিবেন।
২. গণউদ্যোগ (Public Initiative) : গণউদ্যোগ বলতে জনসাধারণ কর্তৃক আইন প্রণয়ন করাকে বুঝায়। গণউদ্যোগ জনসাধারণের ক্ষমতাকে সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে একটি অমোঘ অস্ত্র। এ পদ্ধতি অনুযায়ী যখন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটার কোনো আইন প্রণয়ন বা পুরনো আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করে তখনই এসব প্রস্তাবকে কার্যকরী করা আইন পরিষদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় । এমনকি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত নতুন কোনো আইন তৈরির প্রস্তাব আইন পরিষদের সম্মতি ব্যতীতই আইন হিসেবে গণ্য হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের ঊনিশটি অঙ্গরাজ্যে এবং সুইজারল্যান্ডে গণউদ্যোগ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
৩. পদচ্যুতি (Recall) : কোনো জনপ্রতিনিধিকে তার নিজস্ব মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে জনসাধারণের আস্থা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করার মাধ্যমে অপসারণ করার প্রক্রিয়াকে পদচ্যুতি বলে। এ পদ্ধতিতে কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটার যদি অভিযোগ উত্থাপন করে এবং সেই অভিযোগ যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটারের দ্বারা সমর্থিত হয়, তবে আইন পরিষদের বা শাসন পরিষদের অভিযুক্ত প্রতিনিধির সদস্য পদ বাতিল বলে গণ্য হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় এরূপ পদচ্যুতির ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
৪. জনমত নির্ধারণ (Plebiscite) : যখন কোনো রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয় তখন এরূপ গণভোটকে জনমত নির্ধারণ বলে । একে গণভোটও বলা যেতে পারে । গণভোট এবং জনমত নির্ধারণের মধ্যে পার্থক্যের মূল বিষয় হচ্ছে, আইন ও সংবিধান সংক্রান্ত ভোট গ্রহণ করাকে গণভোট বলে। আর রাজনৈতিক সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে ভোট গ্রহণ করাকে জনমত নির্ধারণ বলে। বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৮৫ সালের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকার নির্বাচন এবং ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর উপর নির্বাচন মূলত জনমত নির্ধারণ বা গণভোট ছিল।
উপরিউক্ত পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার যেমন ঘটানো যায়, নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই জনগণের শাসন প্রকৃতপক্ষে জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনে পরিণত হতে পারে। তবে উক্ত পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। এটি সর্বদা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণধর্মী হয়ে ওঠে না।