ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বৈশিষ্ট্য Characteristics of Theory of Separation of Power

ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত না হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেমন ক্ষুণ্ণ হয়, তেমনি আবার ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত হলে অন্যান্য বিভাগের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে কারণে এরিস্টটল (Aristotle ), সিসেরো (Cicero), জ্যাঁ বদিন ( Jean Bodin), জন লক (John Locke) ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। তবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বিভক্তিকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কু (Montesquiu)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতাগণ মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঐ দেশের সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ Separation of Power

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে ক্ষমতা পৃথকীকরণকে বোঝায়। যেখানে সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ নিজ নিজ কাজে স্বাধীন থাকবে এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না ।

১. ফেডারলিস্ট ম্যাপিসন (Federalist Mapison)-এর মতে, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হলো এমন এক নীতি, যার অনুপস্থিতিতে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য।”

২. মনীষী লিপসন (Lipson)-এর ভাষায়, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হলো সংবিধান অনুসারে সরকারের ক্ষমতা পৃথকীকরণ যা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ম্যাডিসন ( Madison ) -এর মতে, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হচ্ছে সরকারের তিনটি বিভাগের উপর ন্যস্ত ক্ষমতার পৃথক পৃথক ব্যবহার ও নিশ্চিত প্রয়োগ যেখানে একে অপরের এখতিয়ারের হস্তক্ষেপমুক্ত।”

৪. মন্টেস্কু (Montesquieu) তাঁর “The Spirit of Laws” গ্রন্থে বলেন, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ বলতে বুঝায় এমন এক প্রক্রিয়াকে যেখানে সরকারের জিনিস বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণ পৃথক হবে এবং কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।” মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির তিনটি দিক রয়েছে ।

একই ব্যক্তি আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের একাধিক সংগঠনে থাকতে পারবে না।

উপরোক্ত তিন সংগঠনের এক সংগঠন অপর সংগঠনের কাজে বাধা দেবে না কিংবা অন্য সংগঠনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করবে না।

এক সংগঠন অন্য সংগঠনের কাজ করে ফেলবে না। তাঁর মতে, সব কিছুরই সীমা থাকা দরকার, গুণেরও (Virtue itself must have its limits ) ।

৫. আর. সি. আগারওয়াল ( R. C. Agarwall)-এর মতে, “Where all the power of the government are not be

concerned in the hands of one organ is called separation of power.”

৬. ইংল্যান্ডের আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ রাকস্টোন ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণকে আরও সুস্পষ্ট করে বলেন, “The accumulation of all powers in the same hands may justly be pronounced the vary definition of tyranny.” সুতরাং ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ বলতে আমরা বুঝি সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাকবে এবং প্রত্যেক বিভাগ একে অপরের হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে কাজ করবে।

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বৈশিষ্ট্য  Characteristics of Theory of Separation of Power

বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ আবশ্যক। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিম্নে এসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :

১. ক্ষমতার পৃথকীকরণ : ক্ষমতার পৃথকীকরণ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ নীতির মাধ্যমে সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতাকে পৃথক করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ, আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতাকে স্বতন্ত্রভাবে ন্যস্ত করা সম্ভব হয় ।

কার্য সম্পাদনের স্বাধীনতা : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যেক বিভাগের কার্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। কেননা, এই নীতির মাধ্যমে প্রত্যেক বিভাগের কাজের পরিধি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বিধায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাঁর নিজস্ব আওতাধীন দায়িত্ব বা কাজটি স্বাধীনভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারে।

৩. হস্তক্ষেপ মুক্ত : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের ফলে এক বিভাগ অপর বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কেননা, এক বিভাগ অপর বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করলে ঐ বিভাগের স্বাধীনতা থাকে না। ফলে সরকারের স্ব স্ব বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিভাগসমূহ পরস্পর পরস্পরের হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ, হস্তক্ষেপমুক্তভাবে দায়িত্ব সম্পাদন ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৪. কর্মপরিধি নির্ধারণ : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির দ্বারা সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগের কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে সরকারের বিভাগসমূহ স্ব স্ব গণ্ডিতে কাজ করার সুযোগ পায়। এক বিভাগ অপর বিভাগের কর্মে হস্তক্ষেপ করেন না। অর্থাৎ, সরকারের বিদ্যমান বিভাগসমূহের কর্মপরিধি নির্ধারণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

৫. স্বতন্ত্র ব্যক্তির পরিচালনা : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আওতায় সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি পৃথক পৃথক ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পরিচালিত হবার সুযোগ থাকে। প্রত্যেকটি বিভাগের প্রধান নেতৃত্ব দ্বারা সংশ্লিষ্ট বিভাগটি পরিচালিত হয়।

 ৬. একক দায়িত্ব : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে কোনো এক বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিকে অপর কোনো বিভাগের দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। অর্থাৎ, এক বিভাগের ক্ষমতাধরের হাতে অন্য বিভাগের ক্ষমতা বা প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ না দেয়া। কেননা, এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে যদি একাধিক বিভাগের ক্ষমতা প্রদান করা হয় তা হলে ব্যক্তি বা সমষ্টির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে।

৭. বিভাগীয় ক্ষমতার সীমিতকরণ : যেহেতু ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির আওতায় সরকারের সার্বিক ক্ষমতাকে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় সেহেতু প্রত্যেক বিভাগের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে কোনো একটি বিশেষ বিভাগের হাতে অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যাপক ক্ষমতা কেন্দ্রিকরণ সম্ভব নয়, ঐ বিভাগের ক্ষমতা নিজের বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ।

৮. নিয়ন্ত্রণ ভারসাম্য : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বিরাজমান। উপরে আলোচিত বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল পরিচয় বা সার নির্যাস নিহিত। মন্টেস্কুর মতে, ক্ষমতা অবশ্যই তিন বিভাগের মধ্যে পৃথক হবে, বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে এমনভাবে অনুশীলিত হবে যাতে একে অপরের বিরুদ্ধে ভারসাম্য বিধানে সক্ষম হয় ।

Leave a Reply