ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিকাশ

Background/ Development of the Theory of Separation of Power

রাষ্ট্রচিন্তার আদিযুগ থেকেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পর্কে চিন্তাধারা প্রবহমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল (Aristotle) এথেনীয় গণতন্ত্র চর্চাকে অবলোকন করে সর্বপ্রথম ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি উত্থাপন করেন এবং বলেন যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে আলোচনামূলক (Deliberative); শাসনসংক্রান্ত ( Magisterial) ও বিচার বিষয়ক (Judicial) এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক্ষেত্রে আলোচনামূলক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল আইন প্রণয়ন, যুদ্ধ ঘোষণা, সন্ধি, চুক্তি স্বাক্ষর এবং বিচার বিষয়ের সমাধান। শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য সম্পাদিত হয় শাসন বিভাগের মাধ্যমে এবং অপরাধীর দণ্ড বিধান করা ছিল বিচার বিভাগের কাজ। এরিস্টটল ( Aristotle ) ক্ষমতা বণ্টনের এই নীতির উপর জোর দিয়ে বলেন, সরকারের এই তিনটি বিভাগ যদি একই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির দ্বারা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন শাসনকার্যের নৈপুণ্যতা হ্রাস পাবে। তবে একথা সত্য তৎকালীন সময়ে এথেন্সেও এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়নি ।

যে, পরবর্তীতে রোমের সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে দুই স্মরণীয় দার্শনিক, আইনবিদ ও লেখক পলিবিয়াস (Polybius) ও সিসেরোর (Cicero) আলোচনায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি এসেছে। এক্ষেত্রে তাঁরা ক্ষমতার চর্চাকারী তিনটি বিভাগের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাতে ক্ষমতার বণ্টনে সামঞ্জস্য বিধানের উপর জোর প্রদান করেন।

মধ্যযুগেও রাষ্ট্রচিন্তায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। মধ্যযুগের কতিপয় রাষ্ট্রচিন্তাবিদের আলোচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এক উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু ছিল। তাঁরা এ নীতিকে জোরালোভাবে সমর্থন প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে পাদুয়ার বিখ্যাত মনীষী মার্সিলিও আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তিনি ক্ষমতা বিভাজনে মত দিয়ে বলেন, “শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের কার্যক্রম পৃথক হওয়া বাঞ্ছনীয়।” সরকারের দায়িত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এ পৃথকীকরণ একান্ত আবশ্যক ।

আধুনিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক জিন বডিন ( Jean Bodin) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আধুনিক প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। তাঁর মতে, “আইন প্রণয়ন ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা যদি ব্যবহৃত হয়, তবে তিনি বা তাঁরা নিষ্ঠুর আইন তৈরি করে নির্দয়ভাবে তা প্রয়োগ করতে পারেন।” তিনি আরও বলেন, “To be at once a legislator and a judge is to mingle together justice and the prerogative of mercy, adherence to law and arbitrary departure from it.”

১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডে রক্তপাতহীন বিপ্লবের পর জন লক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে মত দেন। তিনি ক্ষমতাকে আইন, শাসন ও কূটনীতি সম্পর্কিত— এই তিন ভাগে ভাগ করে এ সকল ক্ষমতা বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে বণ্টনের সুপারিশ করেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, ” The power of government naturally divided themselves into those which were

legislative in character. Those which were executive and those which were federative that is diplomatic.” জন লকের (John Locke) মতে, “আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাজা ও আইনসভার হাতে থাকা বাঞ্ছনীয় এবং অপর দুই বিভাগের ক্ষমতা রাজা ও তাঁর মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত করা উচিত।” তিনি বলেন, “যদি একই ব্যক্তি আইন রচনা ও তা প্রয়োগ করেন, তবে ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার ও নাগরিকদের জীবন বিপন্ন হবে।” জন লক জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং তাদের প্রাধান্য বজায় রক্ষার্থে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “আইন বিভাগের ক্ষমতা সর্বোচ্চ, তবে এর চেয়ে আরও কিছু উচ্চতর রয়েছে এবং তা হচ্ছে জনগণ।”

তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এবং বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাকারী ফরাসি দার্শনিক মহাপণ্ডিত মন্টেস্কু (Montesquieu)। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Spirit of Laws ‘ এ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বব্যাপী তিনি এ মতবাদের সফল ও ব্যাপক প্রসার ঘটান। তাঁর মতে, “When legislative and executive powers are united in the same person or in the governing body there can be no freedom. Nor is there freedom where the power to adjudicate is not separated from legislative power and the executive power.” মন্টেস্কু ন্যায়বিচার রক্ষার্থে বলেন, তিন প্রকার ক্ষমতাকে অবশ্যই পৃথক রাখতে হবে এবং এই ক্ষমতা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে এমনভাবে অনুশীলিত হবে যাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তিনটি একে অপরের বিরুদ্ধে ভারসাম্য বিধানে সক্ষম হয়।

পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞ ব্লাকস্টোন (Blackstone) মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে সমর্থন করেন। তিনি তাঁর “Commentaries on the Laws of England.” গ্রন্থে এ তত্ত্বকে আরও জোরদার করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, “The accumulation of all powers in the same hands may justly be pronounced the vary definition of tyranny.” ব্লাকস্টোন জনগণের অধিকার প্রসঙ্গে বলেন, “যেখানে আইন তৈরি ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির উপর ন্যস্ত থাকে, সেখানে জনসাধারণের অধিকার থাকতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, “বিচার করার ক্ষমতার সাথে আইন তৈরি করার ক্ষমতা যুক্ত হলে স্বেচ্ছাচারী বিচারকদের হাতে জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি বিনষ্ট হতে পারে। “

এভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উৎপত্তি ও বিকাশ সাধিত হয়েছে। তবে এ তত্ত্বের পূর্ণ প্রয়োগ আজ অবধি পৃথিবীর কোনো দেশে পরিদৃষ্ট না হলেও এই তত্ত্বের আংশিক প্রয়োগ ঘটেছে।

মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি Theory of Separation of Power of Montesquieu

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল ও শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু (Montesquieu) তাঁর খ্যাতনামা গ্রন্থ The Spirit of Laws-এ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে বলেন যে, যখন একই ব্যক্তি বা শাসকবর্গের হাতে আইন প্রণয়ন ও শাসন পরিচালনার ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়, তখন স্বাধীনতা থাকতে পারে না, অথবা আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও শাসন ক্ষমতা যদি বিচার বিভাগ হতে স্বতন্ত্র না হয়, তাহলেও স্বাধীনতা থাকতে পারে না। কেননা, তাতে করে স্বেচ্ছামূলক নিয়ন্ত্রণের কবলে পড়ে ব্যক্তিজীবন ছটফট করতে থাকবে। শাসন ক্ষমতার সাথে বিচারিক ক্ষমতা যুক্ত হলে ন্যায়বিচারের নামে প্রহসন হতে পারে এবং শাসকদের খেয়াল চরিতার্থ করার সুযোগ ঘটবে। সুতরাং এই তিন প্রকার ক্ষমতা অবশ্যই পৃথক হবে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা এমনভাবে ব্যবহৃত হতে হবে যেন একটি অপরটির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে ।

তিনি তাঁর তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেন, ক্ষমতা লব্ধ প্রতিটি মানুষের ঝোঁক থাকে ক্ষমতা অপব্যবহারের দিকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর কর্তৃত্বকে সীমিত করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে থাকবে। তাই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পৃথকভাবে বণ্টন করতে হবে।

তিনি মনে করেন যে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে একচেটিয়া সরকারি ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার অপরিহার্য শর্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। একই বিভাগের হাতে ক্ষমতা অর্পিত হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। কাজেই স্বাধীনতার স্বার্থেই সরকারের ক্ষমতা পৃথকীকরণ করা একান্ত প্রয়োজন ।

Leave a Reply