একনায়কতন্ত্রের ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ

একনায়কতন্ত্রের ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ Demerits or Disadvantages of Dictatorship

 

একনায়কতন্ত্রের কতিপয় সুবিধা পরিলক্ষিত হলেও সার্বিকভাবে একনায়কতন্ত্র একটি অকল্যাণকর শাসনব্যবস্থা। যে কারণে এটি সর্বত্র নন্দিত নয়। বিভিন্ন সমালোচকগণ একনায়কতন্ত্রের সমালোচনা করে কতিপয় ত্রুটি চিহ্নিত করেছেন। তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. স্বৈরতান্ত্রিকতা : একনায়কতন্ত্র মূলত একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কারণ একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চর্চার ক্ষেত্রে সেই শাসককে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট কোনো প্রকার জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে তিনি সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে ওঠে নিজের ইচ্ছেমতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। আর এতে করে সরকার সহজেই স্বৈরশাসন কায়েম করে। 

২. ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী: একনায়কতা ব্যক্তিস্বাধীনতার ঘোরী। সরকারে মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। বরং প্রয়োজনে রাষ্ট্রের জন্য হবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের মূল বুনিয়াদ যে জনগণ এবং প্রয়োन যে রাষ্ট্র সৃষ্টি এখানে তা এ ধরনের ব্যবস্থায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, সুপ্ত প্রতিভা ও জীবনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, বাকি আপেলব্ধি সাধিত হ ব্যক্তিসত্তার অপমৃত্যু ঘটে। হেগেলের মতে, রাষ্ট্র হলো পৃথিবীতে বিধাতার পদার্পণ। ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্যই জন্মলাভ করে এবং বেঁচে থাকে। হেগেলের এরকম মতামত প্রদানের জন্য জার্মান একনায়ক তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়াম ১৮১৮ হেগেলকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের প্রফেসর পদে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান ।

৩. রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব : রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিক চেতনা বৃদ্ধি করা একনায়কতন্ত্রে রাজনৈতিক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে । ान गाধারণত একটি মাত্র থাকে। উপরন্তু দলীয় সদস্যদের নিজস্ব ইচ্ছানুসারে মতামত প্রদানেরও সুযোগ নেই। তাঁরা শুধু একনায়কের ইচ্ছা প্রচার করে মাত্র। আবার বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না বিধায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষও ঘটে না।

৪. দায়িত্বহীনতা : দায়িত্বহীনতা একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ ত্রুটি। একনায়ক প্রায়ক্ষেত্রেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। বিধায় একনায়ক তাঁর নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। न একা কখনো কখনো সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে ওঠে ক্ষমতা চর্চা করেন। এরূপ অবস্থায় জনগণের কল্যাণ আশা করা যায় না। ৫. স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতি : একনায়কতন্ত্রে শাসন প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না বিদায়

ব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন খর্ব হয়। কোনো অঞ্চল, প্রদেশ বা স্থানীয় সংস্থায় স্বশাসন এখানে অস্বীকৃত। আর এভাবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষিত হওয়ায় এ ব্যবস্থায় জনসাধারণ সরকারের সাফল্য ব্যর্থতা সম্পর্কেও উদাসীন থাকেন। ব্যানারম্যান ( N. C. Bannerman)-এর ভাষায়, “Better bad government under self government than good government under dictatorship. “

৬. আইনের শাসন উপেক্ষা : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনের শাসন উপেক্ষিত হয়। অর্থাৎ, আইনের ভিত্তিতে শাসন কার্য পরিচালিত না হয়ে ব্যক্তির শাসনে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রের ন্যায় একনায়কতন্ত্রে ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী- গরিব নির্বিশেষে আইনের চোখে সকলে সমান নয়। ফলে এ ব্যবস্থায় আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জনমত উপেক্ষিত হয় ।

৭. প্রহসনমূলক আইনসভা : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা প্রহসনে পরিণত হয়। কারণ আইনসভা নিজের ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণয়ন করতে পারে না, বরং একনায়কের ইচ্ছা অনুসারে আইনসভাকে আইন প্রণয়ন করতে হয়। যে কারণে এ ব্যবস্থায় আইনসভাকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হি বে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

৮. বিপ্লবের আশঙ্কা : একনায়কতন্ত্রে শাসক জনগণের দুঃখ-দুর্দশার অভিযোগ শুনতে চায় না বিধায় এ ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তেমন একটা পূরণ না হওয়ায় বিপ্লবের আশঙ্খা প্রবলভাবে কাজ করে। কারণ মানব সন্তান সব সময়ের জন্য অত্যাচার সহ্য করতে পারে না। এক সময় অত্যাচারিত জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে এ নারকীয় শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। এরিস্টটলের মতে, “জনগণের মধ্যে বিদ্যমান অসমতাই বিপ্লবের মূল কারণ।” কিন্তু একনায়তন্ত্রে জনগণকে সমান অধিকার প্রদান করা হয় না, অতএব এ ব্যবস্থায় বিপ্লন হওয়া স্বাভাবিক।

৯. সাম্য বিরোধিতা : একনায়কতন্ত্রে সামাজিক সাম্য ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়। এতে মনে করা হয় যে, মানুষে মানুষে কোনো সমতা নেই । এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে উপেক্ষা করে শ্রেণিবিশেষের স্বার্থকে সংরক্ষণ করা হয়। একনায়ক সর্বদা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অভ্রান্ত বলে মনে করেন। তিনি নিজেকে সকলের ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। হিটলার ও মুসোলিনী এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লিপসন (Lipson) বলেছেন, “The classic voice of all dictatorial systems is their basic assumption of the superiority and infalibility of those in power.”

১০. বল প্রয়োগ : বলপ্রয়োগ একনায়কতন্ত্রের অন্যতম একটি ত্রুটি। এ শাসনব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকটা পেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল। কেননা, এ ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণি জনগণের ইচ্ছাকে কোনো প্রকার মূল্য প্রদান না করে বরং জনগণের উপর বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ করে থাকেন। ফলে এ ধরনের ব্যবস্থায় নির্বাসন, কারাদণ্ড, গোপন হত্যা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। ১১. যুদ্ধবাদী ব্যবস্থা : যুদ্ধের ফলে জীবনের সকল শান্তি বিনষ্ট হলেও একনায়কতন্ত্রে যুদ্ধকে গৌরবজনক মনে করা হয়। যদিও শান্তি বিনষ্ট হলে রাষ্ট্রে অস্থিরতা বিরাজ করে। একনায়কদের মতে, পৃথিবীতে বাঁচার জন্য যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। ফলে যুদ্ধ আতঙ্কে জনগণ যেমন স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে না, তেমনি এটি বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তারও পরিপন্থী। হিটলার ও মুসোলিনীর ন্যায় একনায়কদের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। তাদের ধ্বংসাত্মক ও যুদ্ধংদেহী কার্যকলাপ নিজ দেশসহ অপরাপর দেশের ধ্বংস ডেকে আনে ।

১২. সরকারি অর্থের অপচয় : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি অর্থের অপচয় হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় যুদ্ধ বিপ্লবের আশঙ্কা থাকে বিধায় একনায়কগণ যুদ্ধ ও বিপ্লব এড়ানোর জন্য সমগ্র দেশব্যাপী এক বিশাল গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলে। তাছাড়া নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে। ফলে এখানে সরকারের মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হয়। .

১৩. শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের অবনতি : একনায়কতন্ত্রে শাসক একক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর ইচ্ছা ও অনিচ্ছাই সর্বেসর্বা। জনগণের ইচ্ছা এখানে প্রাধান্য পায় না। তাছাড়া রাষ্ট্রনায়করা ব্যক্তির কল্যাণকে উপেক্ষা করে নিজেদের কল্যাণ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

১৪. অধিকার ও ন্যায় খর্ব : একনায়কতন্ত্রে জনগণের মৌল অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। এ ব্যবস্থায় শাসিতের সম্মতির উপর শাসকের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না, ন্যায়বিচারের বাণী এখানে ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’; মানুষের মনুষ্যত্ব এখানে পদদলিত। কিন্ত সুদীর্ঘকাল এরূপ শাসনব্যবস্থা মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না ।

১৫. অস্থিতিশীলতা : একনায়কতন্ত্রের অন্যতম দোষ হলো এ ব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। সরকারের প্রতি অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপ্লব ও যুদ্ধের আশংকা ইত্যাদি একে দুর্বল করে তোলে ।

১৬. উগ্র জাতীয়তাবাদ : একনায়কতান্ত্রিক শাসন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উগ্র বর্ণবাদে বিশ্বাসী। এরূপ উগ্রতার ফলেই বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। যে কারণে এ ধরনের ব্যবস্থা বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হিসেবে কাজ করে।

১৭. সাহিত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা : অনেক সময় একনায়কতন্ত্র শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির চরম শত্রু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কেননা, একনায়করা অনেক সময় শিল্পী, সাহিত্যিকদিগকে নিজেদের আজ্ঞাবহ ও অনুগত শক্তিতে পরিণত করতে চান। ফলে সমাজজীবন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া যেসব শিল্পী ও সাহিত্যিক ভিন্নধর্মী সৃজনশীল চিন্তায় বিশ্বাসী, শেষ পর্যন্ত তাদের উপর নেমে আসে একনায়কের দমন পীড়ন। এভাবে হিটলার, মুসোলিনী, ফ্রাঙ্কো প্রমুখের শাসনামলে বহু সৃজনশীল শিল্পী ও সাহিত্যিককে দেশ ত্যাগ করতে এবং অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

পরিশেষে বলা যায় যে, একনায়কতন্ত্রে শাসকগোষ্ঠী একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং কালক্রমে জনগণ থেকে নিজেদের আলাদা করে এক অভিজাত শ্রেণিতে উন্নীত করে। জনগণের প্রতি শাসকের কোনো প্রকার দায়িত্ব না থাকায় জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয় এবং শাসক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোনো স্বার্থ রক্ষা করে না। নিজেদের বিশেষ সুবিধা রক্ষা করার জন্য জনগণের ন্যূনতম সামাজিক ও অন্যান্য অধিকারকে তারা পদদলিত করতে দ্বিধা করে না। এসব কারণে গণতন্ত্র বিরোধী একনায়কতন্ত্রকে বর্তমান শতাব্দির সর্বাপেক্ষা বড় অভিশাপ বলেই গ্রহণ করা সমীচীন ।



Leave a Reply