একনায়কতন্ত্রের অর্থ ও সংজ্ঞা

একনায়কতন্ত্র একটি প্রচলিত প্রাচীন মতবাদ। প্রাচীনকালে যতগুলো মতবাদ প্রচলিত ছিল তন্মধ্যে একনায়কতন্ত্র অন্যতম । তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের ন্যায় একনায়কতন্ত্রের উৎপত্তিও প্রাচীন গ্রিস ও রোমে। তৎকালীন গ্রিসে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা প্রায়ই একজনের কর্তৃত্বে ব্যবহৃত হতো, যাতে একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় ।

কিন্তু আধুনিক একনায়কতন্ত্রের বিকাশ ঘটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ গড়ে ওঠে। ফলে এসময় জার্মানি ও ইতালিসহ কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে। বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালির একনায়করা যুদ্ধপরবর্তী দুর্দশা কাটিয়ে উঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি একনায়কতন্ত্রকে স্বাগত জানায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ১৯২২ সালে ইতালির বলিষ্ঠ নেতা মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী (Facism) নামে একটি দলের উত্থান ঘটে। ১৯৩৩ সালে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের নেতৃত্বে জনা নেয় নাৎসিবাদ (Nazism) নামে আর একটি দল বা মতবাদ। এ দুই মতবাদই একনায়কতন্ত্রকে তত্ত্বগতভাবে সমর্থন করে। একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সামরিক শক্তি, যে কারণে একনায়কতন্ত্র যুদ্ধকে প্রশ্রয় দেয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক বিশ্বেও বিভিন্ন নামে ও ছদ্মবেশে অনেক রাষ্ট্রে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে।

ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, বিরোধী মত ও পথকে রুদ্ধকরণ, সামরিকীকরণ প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি। একনায়কতন্ত্রে সামরিক শক্তির উপস্থিতি লক্ষ করে মনীষী নিৎসে ( Nietzsche ) বলেন, “Live dangerously, effect your cities beside Visuvius send out your ships to unexpected seas, live in a state of war.”

একনায়কতন্ত্রের অর্থ ও সংজ্ঞা Meaning & Definition of Dictatorship

প্রাচীন রোমে ‘একনায়ক’ (Dictator) শব্দটির প্রচলন লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংকটজনক অবস্থার মোকাবিলার জন্যই রোমানগণ কোনো ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করত। এ ব্যবস্থা রোমে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার প্রাচীনকালে কোনো কোনো দেশে স্বৈরাচারি রাজতন্ত্রকেও একনায়কতন্ত্র বলে মনে করা হতো। তবে একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে বর্তমানের ধারণা ভিন্ন প্রকৃতির।


সাধারণত যে শাসনব্যবস্থায় একজন রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করে তাকেই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। একনায়কের নির্দেশেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা

১. আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতে, “যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমটি হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।”

২. গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল ( Aristotle)-এর মতে, “যখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা একজনের হতে ন্যস্ত থাকে এবং সে যদি নিজের স্বার্থের জন্য শাসন করে তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।”

৩. রজার ইসক্রুটন (Roser Escruton) তাঁর A Dictionary of Political Thought গ্রন্থে বলেন, “একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী বা দল সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সকল জনসাধারণের নিকট থেকে আনুগত্য আদায় করে।”

৪. অস্টিন রেনি (Austin Ranney)-এর ভাষায়, “একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে প্রশাসনিক চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয় একজন ব্যক্তি বা বাছাই করা কয়েকজনের হাতে।”

৫. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিউম্যান (Newman)-এর মতে, “By dictatorship we understand the rule of a person or group of persons who arrogate of themselves and monopolize power of the state, exercising it without restraint. “

৬. বিশিষ্ট দার্শনিক ফোর্ড (Ford) বলেন, “Dictatorship is the assumptions of extra legal authority by the head of the state.”

৭. Alfred-এর ভাষায়, “Dictatorship is the government of one man who has not obtained his position by inheritance but either by force or by consent and normally by a combination of both, he must posses absolute sovereignty. Finally it must not be incompatible with absolute rule.”

৮. ইটালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনি (Mussolini) -এর মতে, “একনায়কতন্ত্র হচ্ছে ঐ শাসনব্যবস্থা যেখানে সকল কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থে করা হয়। কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, আর রাষ্ট্রের বাইরেও কোনো কিছু নয়।”

সুতরাং বলা যায়, একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যাতে সরকার গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে একজন বিশেষ ব্যক্তি, একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণির ব্যাপক ক্ষমতা বিদ্যমান। ঐ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, ভোগ ও প্রয়োগ করে ।


একনায়কতন্ত্রের প্রকারভেদ Classification of Dictatorship

একনায়কতন্ত্র এমন বিশেষ এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যাতে একক ব্যক্তির ও ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসনব্যবস্থার মূল মন্ত্র হলো One man, one state and to believe, to obey and to fight. একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক ফোর্ড (Prof. Ford ) বলেন, “Though there is sometime similiarity among the mlilitary, the facist and the communist dictatorship, yet they are different in certain ways.” প্রকৃত বিচারে একনায়কতন্ত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

১. ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র (Individual Dictatorship) : ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে দেশের যাবতীয় ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা সামরিক নেতার হাতে ন্যস্ত থাকে। সাধারণত সংবিধান বহির্ভূতভাবে ও সম্পূর্ণ অতর্কিতে আইনানুমোদিত সরকারকে উচ্ছেদ করে বা হটিয়ে ক্ষমতা দখল করা হয় এবং একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় কখনো কখনো সামরিক বাহিনীর সমর্থনে সামরিক প্রধান শাসন ক্ষমতা দখল করেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় শাসন ক্ষমতা দখল করলে তাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র (Military Dictatorship) বলা হয়। একনায়কের ক্ষমতাকে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। স্পেনের সেনানায়ক ফ্রাঙ্কো, পাকিস্তানের আইয়ুব খান এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ।

২. দলগত একনায়কতন্ত্র (Party Dictatorship) : যে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করে তাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলে। এই বিশিষ্ট দল ব্যতীত অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব এ ব্যবস্থায় স্বীকৃত নয় । তবে দলনেতার প্রভাব ও প্রাধান্য এখানে মুখ্য। যেমন : জার্মানির হিটলারের নাৎসি দল এবং ইতালির মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের কথা বলা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এরূপ দল গঠিত হয়। এরা প্রথমে আইনানুমোদিতভাবে ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারি শাসন প্রবর্তন করে। সি.ডি. বার্নস (C. D. Burns)- এর ভাষায়, “In 1933 Hitler established the Nazi party on his dictatorship in Germany and he remained in power till 1944. “

৩. শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র (Class Dictatorship) : একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করলে আর এক ধরনের একনায়কতন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র। শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে একটি বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ ধরনের একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ফলে এধরনের ব্যবস্থায় শ্রেণি শোষণ ও শাসন স্বীকৃত হয়। বিশেষ করে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় ধনিক-বণিক শ্রেণির নেতৃত্বে এবং সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে এধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চীনের সমাজতান্ত্রিক দ

Leave a Reply