Table of Contents
Toggleএককেন্দ্রিক সরকারের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ বা গুরুত্ব
Merits or Advantages or Importance of Unitary Government
এককেন্দ্রিক সরকার অন্যতম আলোচিত সরকারব্যবস্থা। অনেকের মতে, এটি এক ধরনের জনপ্রিয় সরকারব্যবস্থা এবং অপরাপর সরকারের চেয়ে এটি উত্তম সরকারও বটে। এককেন্দ্রিক সরকার যে সকল গুণের অধিকারী সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ : এ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিভক্তিকরণ না থাকায় ক্ষমতা বিভাজন সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। কিন্তু ক্ষমতার বিভক্তিকরণ থাকলে কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বিভক্তিকরণ না থাকলে একই রকম আইন বলবৎ থাকে যার জন্য শাসনকার্যে জটিলতা দেখা দিতে পারে না।
২. শক্তিশালী সরকারব্যবস্থা : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় শক্তিশালী সরকার কায়েম করা সম্ভব। কেননা, এতে কেন্দ্রিয় সরকারের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ এবং আঞ্চলিক বিরোধ না থাকায় শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, “A powerful government established at a centre in this form of government becuase the power of centralization.”
৩. নমনীয় শাসন : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সরকার অত্যন্ত নমনীয় প্রকৃতির হয়। যে কারণে সরকার পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারে। সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তেমন জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় না বিধায় যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়।
৪. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক সরকার দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে। এ ধরনের সরকারব্যবস্থায় শুধুমাত্র কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে সার্বিক ক্ষমতা অর্পিত থাকে। যে কারণে কেন্দ্রিয় সরকারকে ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে অন্য কারো সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হয় না। ফলে দেশের প্রয়োজনে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। সি.এফ. স্ট্রং (C. F. Strong )-এর ভাষায়, “In a unitary government prompt decisions are taken because of the lack of duplication of central and local authorities and services.”
৫. ঐক্যের প্রতীক : এককেন্দ্রিক সরকার ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ। এ ব্যবস্থায় সমগ্র দেশের জন্য একই প্রকার শাসন পদ্ধতি ও রীতি-নীতি কার্যকর থাকে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাপূর্ণ কোনো প্রকার মনোভাবের জন্য হয় না। কেন্দ্রের সাথে আঞ্চলিক সরকারের কোনো প্রকার মতদ্বৈততার অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তিও অক্ষুণ্ণ থাকে ।
৬. ব্যয়বহুল নয়: এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার খরচ কম হয়। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোতে দু’প্রকার সরকার না থাকায় জনসাধারণকে পরিচালনার ব্যয়ভার অনেক কম বহন করতে হয় এবং সরকার অত্যধিক জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে। ৭. রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষা : একমাত্র কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকলে আঞ্চলিক সরকারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কেননা, আঞ্চলিক সরকার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থেকে সহজে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। আনুগত্য এখানে বিভক্ত নয়। দেশের জনগণ এক অখণ্ড ও অবিভাজ্য দেশপ্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং দেশের সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট থাকে।
৮. নিপুণতা : এককেন্দ্রিক সরকার অতি সহজে ও তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সক্ষম হয়। বৈদেশিক নীতি বা নিজস্ব বিষয়ে কোনো সংকট দেখা দিলে নিপুণতা ও তৎপরতার সাথে মোকাবিলা করতে পারে। গেটেল বলেন, “এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দায়িত্ব পালনে দ্বিধা নেই, এক কাজ দু’বার করতে হয় না ।
৯. সুদৃঢ় শাসনব্যবস্থা : অভিন্ন আইন ও অখণ্ড নীতির ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় বিধায় এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় দৃঢ়তা প্রকাশ পায় ৷ এখানে কেন্দ্রিয় সরকারই সকল ক্ষমতার উৎস। এরূপ ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় কোনো অসুবিধা হয় না ।
১০. জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগি হয় না বিধায় কেন্দ্রিয় সরকার বৈদেশিক বিষয়াদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে। এতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ।
১১. প্রশাসনিক দায়িত্বশীলতা : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সমগ্র দেশের শাসন কর্তৃত্ব কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। যে কারণে কেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়। কেন্দ্র অন্যের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে না । ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১২. বিভাগীয় সহযোগিতা : এককেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সংহতি ও সহযোগিতা বর্তমান থাকে। বিভিন্ন বিভাগ তাদের প্রয়োজনে একে অপরের সাথে যোগসূত্র রচনা করতে পারে। এর মূল কারণ হলো ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি । বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতার ভিত্তিতে সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
১৩. ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপযোগী : ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের কেন্দ্রিয়ভাবে সহজে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। প্রশাসনকে সঠিক ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। যেসব দেশের সমাজে জাতিগত এবং ভাষা ও ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্য কম সেসব দেশে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সুশাসন অর্জন সম্ভব।
১৪. একক নাগরিকত্ব : এককেন্দ্রিক সরকারের অন্যতম সবিধা হলো এই সরকারব্যবস্থায় একক নাগরিকত্ব স্বীকৃত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সাধারণত একক নাগরিকত্বের বিধান রাখা হয়। সকল নাগরিক কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তাঁরা কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল। অধ্যাপক গার্নার ( Prof. Garner)-এর মতে, “ In unitary system there is a single citizenship in a unitary state and every citizen is the citizen of the entire country.”
১৫. কেন্দ্রীয় আইন : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সারাদেশে কেন্দ্রিয়ভাবে আইন প্রণীত হয়। এ ধরনের সরকারের প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, এ সরকারব্যবস্থায় নামমাত্র আঞ্চলিক সরকার থাকে, সব কিছুর মূলে থাকে কেন্দ্রিয় সরকার ।
১৬. জটিলতামুক্ত : এককেন্দ্রিক সরকার সরল প্রকৃতির সরকার। যে কারণে এ ব্যবস্থায় শাসন সংক্রান্ত কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। অধ্যাপক গার্নার ( Prof. Garner) তাই একে গুণগত দিক থেকে “সাদাসিধে” বা “সরল” শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাষায়, “Unitary government possesses the merit of being more simple in organization.”
১৭. পরিকল্পনা ও উন্নয়ন : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় দ্রুত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধন করা যায় । কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে সমগ্র দেশের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পররাষ্ট্র সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন : প্রতিটি রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা, দৃঢ়তা, জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তায় বিদেশ নীতি নির্ধারণ করতে হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তি, সন্ধি, কনভেনশন প্রভৃতি পালন করা এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে সহজ হয়। কারণ এক্ষেত্রে সরকার সর্বপ্রকার প্রভাবমুক্ত থেকে সুষ্ঠু ও উন্নত পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, এককেন্দ্রিক সরকারের এমন কতগুলো বিশেষ গুণ বিদ্যমান, যেগুলো এর উত্তম দিক বা সুবিধা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী এ সরকারের ব্যাপক সাফল্য থাকায় এ ধরনের সরকার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ও অভিনন্দিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত প্রভৃতি ঐক্য বিদ্যমান এমনতর ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা অধিক উপযোগী ।