আইন বিভাগ

আইন বিভাগের সংজ্ঞা Definition of Legislature

আধুনিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান হলো সরকার। সরকার এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা যন্ত্রবিশেষ যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। সরকার তাঁর যাবতীয় কার্যাবলি তিনটি বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে। বিভাগ তিনটি হলো— আইন বিভাগ (Legislature), শাসন বিভাগ (Executive) ও বিচার বিভাগ (Judiciary)। আইন বিভাগের কাজ হলে৷ আইন প্রণয়ন করা, শাসন বিভাগের কাজ হলো আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা এবং বিচার বিভাগের কাজ হলো আইনের ব্যাখ্যাদান ও এর কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।

আইন বিভাগ The Legislature

সরকারের যে বিভাগ আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন ও প্রয়োজনে সংশোধন করে সেই বিভাগকে আইন বিভাগ বলা হয়। আইন বিভাগ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। আইন বিভাগকে আইনসভা (Parliament) নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। আইন বিভাগের প্রণীত আইনের মাধ্যমেই অপর দুটি বিভাগের ভূমিকা পালিত হয়। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে শাসন বিভাগ বাস্তবায়ন করে এবং বিচার বিভাগ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে। যে কারণে বলা হয়ে থাকে যে আইন বিভাগের কাজ শাসন ও বিচার বিভাগের কাজের পূর্ববর্তী পর্যায়ের কাজ। সাবেকি রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ব্যতীত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই আইনসভা রয়েছে। যদিও বিভিন্ন দেশের আইনসভার নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । যেমন— বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ইরাক, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে পার্লামেন্ট, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও নেপালে কংগ্রেস, ফ্রান্সে চেম্বার, সুইজারল্যান্ডে ফেডারেল এ্যাসেম্বলী, জাপানে ডায়েট, ইরান, মালদ্বীপ ও মালয়েশিয়ায় মজলিশ, রাশিয়ায় ডুমার, মিসরে দারুল আওয়াম ও যুগোশ্লাভিয়ায় কপচিনা প্রভৃতি ।

আইন বিভাগের সংজ্ঞা Definition of Legislature

সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। আইন বিভাগ সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কতিপয় প্রামাণ্য সংজ্ঞা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

এ্যালান আর. বল (A.R. Ball)-এর মতে, “বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে আইন প্রণয়নকারীদের ভূমিকা সুপরিচিত।” অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner)-এর মতে, “Of all the organs of government the legislature occupies the paramount place.”

অধ্যাপক উইলোবী (Willoughby)-এর মতে, “Government is the organization or machinary through which the state formulates and executes it’s will is termed as government.”

গিলক্রাইস্ট (Gilchrist)-এর মতে, “The legislative is the most important, indeed the fundamental function of the government without it the executive and the judiciary cannot exist.”

সুতরাং বলা যায় সরকারের যে বিভাগ আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করে তাকে আইনসভা বা আইন বিভাগ বলে। আইনসভা দেশের সংবিধান প্রণয়ন, সংশোধন কিংবা বাতিল করতে পারে। ফলে আইনসভার গুরুত্ব ও মর্যাদা সর্বাধিক ৷

আইন বিভাগের গঠন কাঠামো  Composition of Legislature

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইনসভার গঠন-প্রকৃতি, উপাদান, সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন প্রকার। কারণ আইনসভার গঠন বেশ জটিল ও বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভরশীল। গঠনকাঠামো অনুসারে আইনসভাকে দু’ভাগে করা যায়। যথা— এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা। নিম্নে আইনসভার এই গঠন কাঠামো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

১. এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা (Uni-cameral Lagislature ) : যে রাষ্ট্রের আইনসভায় একটি কক্ষ বা পরিষদ থাকে, তাকে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বলে। সাধারণ নির্বাচন বা সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এতে সরকারি ও বিরোধীদলের সদস্য থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা । এতে ৩০০ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং ৪৫ জন পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধি রয়েছে।

২. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা (Bi-cameral Lagislature ) : যে রাষ্ট্রের আইনসভায় দুটি কক্ষ বা পরিষদ থাকে, তাকে দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বলে। এটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপরীত। বর্তমান বিশ্বে এরূপ আইনসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত, কানাডা প্রভৃতি দেশের কথা বলা যায় যেখানে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাগঠনের উপায়গুলো নিম্নরূপ :

ক. সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা;

খ. আংশিক মনোনয়ন প্রদানের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা;

গ. উত্তরাধিকার সূত্রে বা বংশানুক্রমিকভাবে।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষ হলো নিম্ন কক্ষ ও উচ্চ কক্ষ। নিম্নে এ দুটি কক্ষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

 ক. নিম্ন কক্ষ (Lower House) : দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সর্বাধিক জনপ্রিয় কক্ষ হলো নিম্ন কক্ষ। এটি প্রাপ্তবয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি কক্ষ। যে কারণে এটি উচ্চ কক্ষের চেয়ে অধিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ায় সরকারের উপরও এ কক্ষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অত্যধিক। যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন কক্ষের নাম “হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ”, (House of Representative) যুক্তরাজ্যে “হাউজ অব কমন্স’ (House of Commons) ও ভারতে রাজ্যসভা ।

খ. উচ্চ কক্ষ (Upper House ) : দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চ কক্ষের সদস্যগণ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ কক্ষের নাম “সিনেট” (Senate) যুক্তরাজ্যে “হাউজ অব লর্ডস” (House of Lords) এবং ভারতে “লোকসভা”।

উচ্চ কক্ষের সদস্য নির্বাচনে যে সকল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে সেগুলো হলো :

ক. উত্তরাধিকার : যুক্তরাজ্যের আইনসভার উচ্চ কক্ষ লর্ডসভা উত্তরাধিকার সূত্রে গঠিত হয়।

খ. মনোনয়ন: মনোনীত সদস্যদের নিয়ে কানাডার আইনসভার উচ্চ কক্ষ গঠিত হয়।

গ. প্রত্যক্ষ নির্বাচন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার উচ্চ কক্ষ “সিনেট” প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন করে সদস্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে মোট ১০০ জন সদস্য নিয়ে সিনেট গঠিত হয় ।

ঘ. পরোক্ষ নির্বাচন : ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের আইনসভার উচ্চ কক্ষ পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়। আইনসভার গঠন কাঠামোকে নিম্নের ছকে উপস্থাপন করা হলো :

আইনসভা

এক-কক্ষ বিশিষ্ট

(বাংলাদেশের আইনসভা জাতীয় সংসদ)

দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট

(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস)

উচ্চকক্ষ (মার্কিন সিনেট)

নিম্নকক্ষ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ)

আইনসভার অন্যান্য সংগঠন Other Organization of Legislation

মেয়াদ (Period) : আইনসভার একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা আবশ্যক, যা সংবিধানে উল্লেখ থাকবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর মেয়াদ সীমিত। যেমন— বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ৫ বছর মেয়াদি। তবে জরুরি অবস্থায় আইনসভা ভেঙে দেয়া যেতে পারে বা স্থগিত করা যেতে পারে। সাধারণত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ক্ষেত্রে উচ্চ কক্ষের সদস্যগণ বেশি মেয়াদ ভোগ করে থাকেন ।

১. অধিবেশন (Assembly) : আইনসভা নিয়মিত ও বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়। আইনসভার অধিবেশন আহ্বানের সময়কাল বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এর দুটি অধিবেশনের মধ্যকার বিরতি সর্বোচ্চ ৬০ দিনের বেশি হবে না ।

২. বিধিমালা (Rules) : আইনসভা বিধি মোতাবেক এর কার্যপদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আইনসভার স্থায়ী নিয়মকে কার্যপ্রণালি বিধিমালা বলে। যার মাধ্যমে আইনসভার সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, বিভিন্ন বিষয় বিবেচিত হয় ও সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষিত হয়। তাছাড়া রেওয়াজ বা পূর্ব নজির অনুসরণের মাধ্যমেও আইনসভা বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে ।

৩. স্পিকার (Speaker) : আইনসভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়ে থাকে। তিনি আইনসভার কার্যপ্রণালি বাস্তবায়ন, পরিচালনা, শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচার বজায় রাখা, কমিটি নিয়োগ, বিল ও প্রস্তাব পেশ প্রভৃতি কার্যসম্পাদন করে থাকেন।

৪ . কমিটি (Committee) : আইনসভার সার্বিক কাজকে বিভিন্ন কমিটিতে ভাগ করা হয়। কমিটি সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। প্রত্যেক কমিটিকে এক শ্রেণির বিল সম্পর্কে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কমিটি তদন্ত পরিচালনা, সাক্ষীর শুনানী গ্রহণ, বিলসমূহ উত্থাপন বা সংশোধন, বিল পাস করা বা প্রত্যাখ্যানের সুপারিশ অথবা উত্থাপিত বিলের ব্যাপারে আইনসভায় বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করতে পারে। .

৫. হুইপ (Whip) : আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে হুইপ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। যারা আইনসভার অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অধিবেশনের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে স্পিকারকেসহায়তা করে থাকেন ।

৬. সচিবালয় (Secretariat) : আইনসভার সামগ্রিক বিষয়ে সার্বিক সহায়তা দানের লক্ষ্যে একটি সচিবালয় কাজ করে থাকে

Leave a Reply