Table of Contents
Toggleআইনের অনুশাসন Rule of Law
আইনের অনুশাসন Rule of Law
বর্তমানে আইন শাস্ত্রে এবং সাংবিধানিক আইনে “আইনের অনুশাসন” কথাটি সর্বজনস্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত নীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে আইনের অনুশাসনের ধারণা অত্যন্ত প্রাচীন। বিশিষ্ট রোমান দার্শনিক সিসেরো (Cicero) বলেছেন, আইনের অনুশাসনের নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্রিটেনের সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আইনের অনুশাসন। আইনের অনুশাসন ব্রিটেনের সাধারণ আইনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অধ্যাপক ডাইসি (Prof. A. V. Diecy)-র মতে, আইনের অনুশাসন হলো ব্রিটেনের সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূল সূত্র। আইনের অনুশাসনই হলো ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার মূলভিত্তি। অধ্যাপক জিংক (Prof. Harold Zink)-এর মতে, ব্রিটেনের সাংবিধানিক প্রথাগুলোর মধ্যে আইনের অনুশাসন হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ।
আইনের অনুশাসনের ঐতিহাসিক পটভূমি Historical Background of the Rule of Law
অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, অ্যারিস্টটলের লেখায় আইনের অনুশাসন কথাটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, কোনো একজন ব্যক্তির চেয়ে আইনের অনুশাসন অধিক কাম্য। অতি প্রাচীনকালে রোমান সাম্রাজ্যে এবং পরবর্তীকালে আইনের অনুশাসন বলতে জনশৃঙ্খলা (Public order) সংরক্ষণকে বোঝাত। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে এই জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা হতো। মধ্যযুগে আইনের অনুশাসন বলতে বোঝাত বিশ্ব দু’প্রকার আইনের দ্বারা শাসিত হয়, যথা— মানবিক ও ঐশ্বরিক আইন। ব্রিটেনের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, ১২১৫ সালের মহাসনদে (Magna Carta) বলা হয়েছে, যেকোনো স্বাধীন প্রজাকে বিনা-বিচারে বা দেশের আইন ছাড়া আটক করা যাবে না। তাই এই মহাসনদের মধ্যেও আইনের অনুশাসনের সন্ধান পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দিতে প্রথাগত আইনের (Common Law) প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে পার্লামেন্ট নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশেষে ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব এবং ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল এর মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারকদের দ্বারা প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে জনগণের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের সৃষ্টি হয়। এভাবে শাসন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং আইনের চোখে সমতার নীতি স্বীকৃত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দিতে আইনের অনুশাসনের ধারণা উদারপন্থী গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের বক্তব্যের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে অধ্যাপক ডাইসি ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর An Introduction to the Law of the Constitution শীর্ষক গ্রন্থে সর্বপ্রথম আইনের অনুশাসন’ (Rule of Law) কথাটি ব্যবহার করেন।
আইনের অনুশাসনের অর্থ ও সংজ্ঞা Meaning and Definition of Rule of Law
আইনের শাসনের মূল অর্থ আইনের সুস্পষ্ট প্রাধান্য। এ ধারণা অনুযায়ী আইনের স্থান সর্বোচ্চ । সকলেই আইনের অধীন এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্য একই আইন প্রযোজ্য। আইনের অনুশাসন বলতে আইন’ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বোঝায় ।
কার্টার, রেনি ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz ) বলেছেন, “The government and its agents, as well as individual citizens, are subject to laws which are definite and known in advance and which can be modified only by Act of Parliament.” ওয়েড এবং ফিলিপস (Wade and Phillips) আইনের অনুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “It means that the exercise of powers of government shall be conditioned by law and that the subject shall not be exposed to the arbitrary will of the ruler.”
লর্ড হিউয়ার্ট (Lord Hewaty তাঁর ‘New Despotism’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, “আইনের অনুশাসন বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্ধারণ বা সংরক্ষণের জন্য সাধারণ আইনের সার্বভৌমত্ব বা প্রাধান্যকে বোঝায়, যেখানে স্বেচ্ছাচারিতা বলে কিছু থাকবে না।”
আইভর জেনিংস (Isor Jennings) বিস্তারিতভাবে আইনের অনুশাসনের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে
প্রথমত : সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির সাধারণ নিয়মাবলির দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্ধারিত হবে।
দ্বিতীয়ত : এসব সাধারণ নিয়ম-বহির্ভূত অপরাধের জন্য ব্যক্তিকে কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না।
তৃতীয়ত : শাস্তিদান সংক্রান্ত বিধিগুলোকে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, যাতে এই বিধি বহির্ভূত কোনো কাজ অপরাধমূলক বলে বিবেচিত না হয় এবং
চতুর্থত : কোনো অপরাধমূলক কাজের বিচার সেই সময়ের আইন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।
আইনের অনুশাসন সম্পর্কে ডাইসির অভিমত Diecy’s Views on Rule of Law
অধ্যাপক ডাইসি ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর সাংবিধানিক আইনের ভূমিকা (An Introduction to the Law of the Constitution) শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন আইনের অনুশাসন তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ।
প্রথমত, সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য : ডাইসির মতে, স্বেচ্ছাধীন বা স্বৈরাচারী ক্ষমতার স্থলে দেশের মধ্যে প্রচলিত বা নিয়মিত আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ডাইসি (Diecy) বলেছেন, “সুস্পষ্ট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনগত পদ্ধতিতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না বা তাকে তার জীবন ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।” “No man is punishable or can be lawfully made to suffer in body or goods except for a distinct breach of law established in ordinary legal manner before the ordinary courts of law” এর দ্বারা সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্যের কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে আইন ভঙ্গ না করলে কোনো ব্যক্তিকে অথবা তার বিষয় আশয়কে আটক করা চলবে না। সুস্পষ্ট আইন ভঙ্গ হবে অপরাধের একমাত্র মাপকাঠি। আইন ভঙ্গ হয়েছে কি-না তা একমাত্র আইনই নির্ধারণ করবে, অপরাধ করা হয়েছে কি-না তা দেশের সাধারণ আদালত নির্ধারণ করে দেবে। সাধারণ আইন ও সাধারণ আদালতকে এড়িয়ে কোনো নাগরিককে শাস্তি দেওয়ার কোনো বিশেষ ক্ষমতা (Prerogative) বা স্বৈরাচারী ক্ষমতা (arbitrary power) কিংবা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (discretionary power) সরকারের নেই।
দ্বিতীয়ত, আইনের দৃষ্টিতে সমতা : আইনের অনুশাসনের দ্বিতীয় সংজ্ঞায় ডাইসি বলেছেন, “আইনের অনুশাসন বলতে বুঝায় আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ দেশের সাধারণ আইন মেনে চলতে বাধ্য এবং সাধারণ আদালতের নিকট দায়িত্বশীল।” ডাইসির ভাষায় “It means equality before law, or the equal subjection of all classes to the ordinary law of land administered by the ordinary law courts.” সব অপরাধের বিচার সাধারণ আদালতে হবে। আইনের অনুশাসন বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আইনের এখতিয়ার থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতি নয়। সকলেই সমানভাবে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। ডাইসি (A. V. Diecy) আরও বলেছেন, কোনো ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পদমর্যাদা অথবা অবস্থান যাই হোক না কেন, প্রত্যেকই দেশের সাধারণ আইনের অধীন এবং দেশের সাধারণ বিচারালয়ের অধীনস্থ । (No man is above the law, but here every man, whatever be his rank or condition, is subject to the ordinary law of the realm and amenable to the jurisdiction of the ordinary tribunals.) “
ডাইসির মতে, উপরিউক্ত অর্থে ফ্রান্সে আইনের অনুশাসন নেই। কেননা, ফ্রান্সে সাধারণ নাগরিকের বিচার সাধারণ আদালতে হয়। কিন্তু কোনো সাধারণ নাগরিকের সাথে সরকারি কর্মচারীদের বিরোধ বাধলে তার বিচার হয় স্বতন্ত্র শাসন বিভাগীয় আইন এবং স্বতন্ত্র শাসন বিভাগীয় আদালতে। ডাইসী এবং তাঁর সমর্থকগণ মনে করেন এই ব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার সহায়ক নয়। ডাইসী আরও বলেছেন, “দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ পুলিশ, কর্মচারী ও সরকারি কর আদায়কারীগণ অন্যান্য নাগরিকের মতোই আইন-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য সমভাবে দায়িত্বশীল।” (With us, every official, from the Prime Minister to a constable or a collector of taxes is under the same responsibility for act done without legal jurisdiction as any other citizen)
তৃতীয়ত, নাগরিক অধিকার সাধারণ আইনের দ্বারা সংরক্ষিত: ডাইসি (Diecy)-র মতে, ব্রিটেনে অন্যান্য দেশের মতো নাগরিক অধিকার কোনো সাংবিধানিক ঘোষণার ফলশ্রুতি নয় অথবা কোনো লিখিত আইনের দ্বারা নাগরিক অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করা হয়নি। অন্যান্য দেশে যেভাবে সংবিধানের বিধিবদ্ধ আইনের দ্বারা নাগরিক অধিকার স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত হয় ব্রিটেনে, সেসব বিধিবদ্ধ আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার উৎস নয়। উপরন্তু ঐসব অধিকার সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা আদালতের দ্বারা প্রযুক্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার ফলশ্রুতি। সুতরাং ব্রিটেনের সংবিধান হলো সাধারণ আইনের ফসল, ডাইসী (Diecy)-এর ভাষায় “The rule of law may be used as a formula for expressing the fact thats with us the law of the constitution, the rules which in foreign countries naturally form part of a constitutional code, are not the source but the consequence of the rights of individuals, as defined and enforced by the courts, …… thus the constitution is the result of the ordinary law of the land.” ব্রিটেনের নাগরিক অধিকারসমূহের উৎস সংবিধান নয়, বরং সংবিধানের উৎস হলো নাগরিক অধিকারসমূহ ।
ডাইসির আইনের অনুশাসনের সমালোচনা Criticism of Diecy’s Rule of Law
অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski), জেনিংস (Jennings), রবসন (Robson) প্রমুখ চিন্তাবিদ বিভিন্ন দিক থেকে ডাইসীর আইনের অনুশাসনের নীতির সমালোচনা করেছেন।
ক. বর্তমানে আইনের অনুশাসনের অর্থ সীমাবদ্ধ : আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বর্তমানে রাষ্ট্রের কর্ম পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য বহু রাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনেও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতায় কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে পারে। তার ফলে বর্তমানে আইনের অনুশাসনের অর্থ ও তাৎপর্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
খ. ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা : স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings)-এর মতে, “ডাইসির এ তত্ত্ব তাঁর একনিষ্ঠ উদ্যোগের পরিচায়ক হলেও এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যায় পরিণত হয়েছে।” ১৮৮৫ সালে যখন তাঁর An Introduction to the law of the constitution গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন ব্রিটেনের জীবনধারা ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত। ডাইসি নিজে ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন গোড়া সমর্থক। এজন্য তাঁর চিন্তাধারায় ব্যক্তির সর্বজনীন গুরুত্ব ফুটে উঠেছে ।
গ. শাসন বিভাগীয় আইনের অস্তিত্ব : ডাইসির আইনের অনুশাসনের প্রথম নীতিতে সরকারের বিশেষ ক্ষমতা বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রাধান্যের পরিবর্তে দেশের সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি পার্লামেন্ট কর্তক প্রণীত আইন বা প্রথাগত আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনের কল্পনা করতে পারেন নি। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের কার্যাবলি বৃদ্ধি পাওয়ায় আইন বিভাগ শাসন বিভাগের হাতে কিছু কিছু আইন প্রণয়নের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত এসব আইনকে হস্তান্তরিত আইন (Delegated legislation) বলে।
ঘ. স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা অস্বীকার : ডাইসির মতে, সরকারের কোনো প্রকার স্বৈরাচারী ক্ষমতা বিশেষ কিংবা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে সরকারকে বিভিন্ন প্রকার জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। তাই তার হাতে বিশেষ বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রভৃতি বহু
ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করে। জেনিংস ( Jennings)-এর মতে সরকারি কর্তৃপক্ষ ব্যাপক স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করে। তাঁর ভাষায় “If we look around us we can not fail to be aware that public authorities do in fact possess wide discretionary power.”
ঙ. স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার পার্থক করেন নি : ডাইসি (Diecy) স্বৈরাচারী ক্ষমতা (Arbitrary power) ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary power )-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি। বাস্তবে সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা এক নয়। স্বৈরাচারী ক্ষমতা দায়িত্বহীন ও অনিয়ন্ত্রিত হয় । এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ সচরাচর হয়ে থাকে ।
চ. সমতা সম্পর্কিত ধারণা ভ্রান্ত : ডাইসির আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এ কথাটি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকদের মতে, ধনী ও গরিব আর্থিক কারণেই আইনের সাহায্য সমানভাবে পায় না। জেনিংস বলেছেন, সমতা বা সাম্য বলতে অধিকার ও কর্তব্যের সাম্য বোঝায়। কিন্তু এই অর্থে কোথাও সমতা নেই। জমিদার, গাড়ির চালক, শিশু, বিবাহিতা নারী, সুদখোর অথবা যারা বন্ধকী কারবার করে এদের বিশেষ বিশেষ অধিকার ও কর্তব্য আছে। আইনের দৃষ্টিতে তারা সকলে সমান নয়। একজন পুলিশ কর্মচারী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। এই ক্ষমতা একজন সাধারণ নাগরিকের নেই ।
ছ. আদালতের সিদ্ধান্ত নাগরিক অধিকারের উৎস-এ ধারণা সত্য নয় : ডাইসির আইনের অনুশাসনের তৃতীয় নীতি হলো নাগরিক অধিকারসমূহ আদালতের সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছে সাংবিধানিক আইনের দ্বারা নয়। কিন্তু এই ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। ব্রিটেনের এমন কতকগুলো বিধিবদ্ধ আইন রয়েছে যেগুলো বিধিবদ্ধ আইন থেকে উৎপন্ন এবং সেসব আইনের দ্বারাই সংরক্ষিত । উদাহরণস্বরূপ মহাসনদ, অধিকারের বিল, অধিকারের আবেদন পত্র, হেবিয়াস কর্পাস আইন প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায় ।
জ. ব্রিটেনের আইন নয় পার্লামেন্টই সার্বভৌম : ডাইসির মতে, সরকারি কর্তৃপক্ষ যাতে আইন প্রদত্ত ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে না পারে আদালত তা নিশ্চিত করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় আইন সার্বভৌম নয়। পার্লামেন্ট হলো সার্বভৌম। কোনো আইনের শাসন ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে নিরন্ত্রণ করতে পারে না। জেনিংস (Jennings) বলেছেন, “No rule of law can restrain parliament.” পার্লামেন্ট আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের ক্ষমতাকে প্রসারিত করতে পারে।
আইনের অনুশাসন সম্পর্কে উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও ডাইসির আইনের অনুশাসনের নীতি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা যায় না। ওয়েড এবং ফিলিপস (Wade and Philips ) প্রমুখ সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের অনুশাসনকে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে এখনও স্বীকার করা হয়। ব্রিটেনের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই নীতির অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে আইনের অনুশাসনের ধারণা প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই একটি সর্বজনীন নীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
Rule of Law
বর্তমানে আইন শাস্ত্রে এবং সাংবিধানিক আইনে “আইনের অনুশাসন” কথাটি সর্বজনস্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত নীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে আইনের অনুশাসনের ধারণা অত্যন্ত প্রাচীন। বিশিষ্ট রোমান দার্শনিক সিসেরো (Cicero) বলেছেন, আইনের অনুশাসনের নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্রিটেনের সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আইনের অনুশাসন। আইনের অনুশাসন ব্রিটেনের সাধারণ আইনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অধ্যাপক ডাইসি (Prof. A. V. Diecy)-র মতে, আইনের অনুশাসন হলো ব্রিটেনের সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূল সূত্র। আইনের অনুশাসনই হলো ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার মূলভিত্তি। অধ্যাপক জিংক (Prof. Harold Zink)-এর মতে, ব্রিটেনের সাংবিধানিক প্রথাগুলোর মধ্যে আইনের অনুশাসন হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ।
আইনের অনুশাসনের ঐতিহাসিক পটভূমি Historical Background of the Rule of Law
অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, অ্যারিস্টটলের লেখায় আইনের অনুশাসন কথাটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, কোনো একজন ব্যক্তির চেয়ে আইনের অনুশাসন অধিক কাম্য। অতি প্রাচীনকালে রোমান সাম্রাজ্যে এবং পরবর্তীকালে আইনের অনুশাসন বলতে জনশৃঙ্খলা (Public order) সংরক্ষণকে বোঝাত। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে এই জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা হতো। মধ্যযুগে আইনের অনুশাসন বলতে বোঝাত বিশ্ব দু’প্রকার আইনের দ্বারা শাসিত হয়, যথা— মানবিক ও ঐশ্বরিক আইন। ব্রিটেনের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, ১২১৫ সালের মহাসনদে (Magna Carta) বলা হয়েছে, যেকোনো স্বাধীন প্রজাকে বিনা-বিচারে বা দেশের আইন ছাড়া আটক করা যাবে না। তাই এই মহাসনদের মধ্যেও আইনের অনুশাসনের সন্ধান পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দিতে প্রথাগত আইনের (Common Law) প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে পার্লামেন্ট নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশেষে ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব এবং ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল এর মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারকদের দ্বারা প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে জনগণের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের সৃষ্টি হয়। এভাবে শাসন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং আইনের চোখে সমতার নীতি স্বীকৃত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দিতে আইনের অনুশাসনের ধারণা উদারপন্থী গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের বক্তব্যের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে অধ্যাপক ডাইসি ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর An Introduction to the Law of the Constitution শীর্ষক গ্রন্থে সর্বপ্রথম আইনের অনুশাসন’ (Rule of Law) কথাটি ব্যবহার করেন।
আইনের অনুশাসনের অর্থ ও সংজ্ঞা Meaning and Definition of Rule of Law
আইনের শাসনের মূল অর্থ আইনের সুস্পষ্ট প্রাধান্য। এ ধারণা অনুযায়ী আইনের স্থান সর্বোচ্চ । সকলেই আইনের অধীন এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্য একই আইন প্রযোজ্য। আইনের অনুশাসন বলতে আইন’ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বোঝায় ।
কার্টার, রেনি ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz ) বলেছেন, “The government and its agents, as well as individual citizens, are subject to laws which are definite and known in advance and which can be modified only by Act of Parliament.” ওয়েড এবং ফিলিপস (Wade and Phillips) আইনের অনুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “It means that the exercise of powers of government shall be conditioned by law and that the subject shall not be exposed to the arbitrary will of the ruler.”
লর্ড হিউয়ার্ট (Lord Hewaty তাঁর ‘New Despotism’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, “আইনের অনুশাসন বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্ধারণ বা সংরক্ষণের জন্য সাধারণ আইনের সার্বভৌমত্ব বা প্রাধান্যকে বোঝায়, যেখানে স্বেচ্ছাচারিতা বলে কিছু থাকবে না।”
আইভর জেনিংস (Isor Jennings) বিস্তারিতভাবে আইনের অনুশাসনের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে
প্রথমত : সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির সাধারণ নিয়মাবলির দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্ধারিত হবে।
দ্বিতীয়ত : এসব সাধারণ নিয়ম-বহির্ভূত অপরাধের জন্য ব্যক্তিকে কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না।
তৃতীয়ত : শাস্তিদান সংক্রান্ত বিধিগুলোকে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, যাতে এই বিধি বহির্ভূত কোনো কাজ অপরাধমূলক বলে বিবেচিত না হয় এবং
চতুর্থত : কোনো অপরাধমূলক কাজের বিচার সেই সময়ের আইন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।
আইনের অনুশাসন সম্পর্কে ডাইসির অভিমত Diecy’s Views on Rule of Law
অধ্যাপক ডাইসি ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর সাংবিধানিক আইনের ভূমিকা (An Introduction to the Law of the Constitution) শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন আইনের অনুশাসন তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ।
প্রথমত, সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য : ডাইসির মতে, স্বেচ্ছাধীন বা স্বৈরাচারী ক্ষমতার স্থলে দেশের মধ্যে প্রচলিত বা নিয়মিত আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ডাইসি (Diecy) বলেছেন, “সুস্পষ্ট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনগত পদ্ধতিতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না বা তাকে তার জীবন ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।” “No man is punishable or can be lawfully made to suffer in body or goods except for a distinct breach of law established in ordinary legal manner before the ordinary courts of law” এর দ্বারা সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্যের কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে আইন ভঙ্গ না করলে কোনো ব্যক্তিকে অথবা তার বিষয় আশয়কে আটক করা চলবে না। সুস্পষ্ট আইন ভঙ্গ হবে অপরাধের একমাত্র মাপকাঠি। আইন ভঙ্গ হয়েছে কি-না তা একমাত্র আইনই নির্ধারণ করবে, অপরাধ করা হয়েছে কি-না তা দেশের সাধারণ আদালত নির্ধারণ করে দেবে। সাধারণ আইন ও সাধারণ আদালতকে এড়িয়ে কোনো নাগরিককে শাস্তি দেওয়ার কোনো বিশেষ ক্ষমতা (Prerogative) বা স্বৈরাচারী ক্ষমতা (arbitrary power) কিংবা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (discretionary power) সরকারের নেই।
দ্বিতীয়ত, আইনের দৃষ্টিতে সমতা : আইনের অনুশাসনের দ্বিতীয় সংজ্ঞায় ডাইসি বলেছেন, “আইনের অনুশাসন বলতে বুঝায় আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ দেশের সাধারণ আইন মেনে চলতে বাধ্য এবং সাধারণ আদালতের নিকট দায়িত্বশীল।” ডাইসির ভাষায় “It means equality before law, or the equal subjection of all classes to the ordinary law of land administered by the ordinary law courts.” সব অপরাধের বিচার সাধারণ আদালতে হবে। আইনের অনুশাসন বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আইনের এখতিয়ার থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতি নয়। সকলেই সমানভাবে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। ডাইসি (A. V. Diecy) আরও বলেছেন, কোনো ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পদমর্যাদা অথবা অবস্থান যাই হোক না কেন, প্রত্যেকই দেশের সাধারণ আইনের অধীন এবং দেশের সাধারণ বিচারালয়ের অধীনস্থ । (No man is above the law, but here every man, whatever be his rank or condition, is subject to the ordinary law of the realm and amenable to the jurisdiction of the ordinary tribunals.) “
ডাইসির মতে, উপরিউক্ত অর্থে ফ্রান্সে আইনের অনুশাসন নেই। কেননা, ফ্রান্সে সাধারণ নাগরিকের বিচার সাধারণ আদালতে হয়। কিন্তু কোনো সাধারণ নাগরিকের সাথে সরকারি কর্মচারীদের বিরোধ বাধলে তার বিচার হয় স্বতন্ত্র শাসন বিভাগীয় আইন এবং স্বতন্ত্র শাসন বিভাগীয় আদালতে। ডাইসী এবং তাঁর সমর্থকগণ মনে করেন এই ব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার সহায়ক নয়। ডাইসী আরও বলেছেন, “দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ পুলিশ, কর্মচারী ও সরকারি কর আদায়কারীগণ অন্যান্য নাগরিকের মতোই আইন-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য সমভাবে দায়িত্বশীল।” (With us, every official, from the Prime Minister to a constable or a collector of taxes is under the same responsibility for act done without legal jurisdiction as any other citizen)
তৃতীয়ত, নাগরিক অধিকার সাধারণ আইনের দ্বারা সংরক্ষিত: ডাইসি (Diecy)-র মতে, ব্রিটেনে অন্যান্য দেশের মতো নাগরিক অধিকার কোনো সাংবিধানিক ঘোষণার ফলশ্রুতি নয় অথবা কোনো লিখিত আইনের দ্বারা নাগরিক অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করা হয়নি। অন্যান্য দেশে যেভাবে সংবিধানের বিধিবদ্ধ আইনের দ্বারা নাগরিক অধিকার স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত হয় ব্রিটেনে, সেসব বিধিবদ্ধ আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার উৎস নয়। উপরন্তু ঐসব অধিকার সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা আদালতের দ্বারা প্রযুক্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার ফলশ্রুতি। সুতরাং ব্রিটেনের সংবিধান হলো সাধারণ আইনের ফসল, ডাইসী (Diecy)-এর ভাষায় “The rule of law may be used as a formula for expressing the fact thats with us the law of the constitution, the rules which in foreign countries naturally form part of a constitutional code, are not the source but the consequence of the rights of individuals, as defined and enforced by the courts, …… thus the constitution is the result of the ordinary law of the land.” ব্রিটেনের নাগরিক অধিকারসমূহের উৎস সংবিধান নয়, বরং সংবিধানের উৎস হলো নাগরিক অধিকারসমূহ ।
ডাইসির আইনের অনুশাসনের সমালোচনা Criticism of Diecy’s Rule of Law
অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski), জেনিংস (Jennings), রবসন (Robson) প্রমুখ চিন্তাবিদ বিভিন্ন দিক থেকে ডাইসীর আইনের অনুশাসনের নীতির সমালোচনা করেছেন।
ক. বর্তমানে আইনের অনুশাসনের অর্থ সীমাবদ্ধ : আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বর্তমানে রাষ্ট্রের কর্ম পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য বহু রাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনেও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতায় কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে পারে। তার ফলে বর্তমানে আইনের অনুশাসনের অর্থ ও তাৎপর্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
খ. ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা : স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings)-এর মতে, “ডাইসির এ তত্ত্ব তাঁর একনিষ্ঠ উদ্যোগের পরিচায়ক হলেও এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যায় পরিণত হয়েছে।” ১৮৮৫ সালে যখন তাঁর An Introduction to the law of the constitution গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন ব্রিটেনের জীবনধারা ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত। ডাইসি নিজে ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন গোড়া সমর্থক। এজন্য তাঁর চিন্তাধারায় ব্যক্তির সর্বজনীন গুরুত্ব ফুটে উঠেছে ।
গ. শাসন বিভাগীয় আইনের অস্তিত্ব : ডাইসির আইনের অনুশাসনের প্রথম নীতিতে সরকারের বিশেষ ক্ষমতা বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রাধান্যের পরিবর্তে দেশের সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি পার্লামেন্ট কর্তক প্রণীত আইন বা প্রথাগত আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনের কল্পনা করতে পারেন নি। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের কার্যাবলি বৃদ্ধি পাওয়ায় আইন বিভাগ শাসন বিভাগের হাতে কিছু কিছু আইন প্রণয়নের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত এসব আইনকে হস্তান্তরিত আইন (Delegated legislation) বলে।
ঘ. স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা অস্বীকার : ডাইসির মতে, সরকারের কোনো প্রকার স্বৈরাচারী ক্ষমতা বিশেষ কিংবা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে সরকারকে বিভিন্ন প্রকার জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। তাই তার হাতে বিশেষ বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রভৃতি বহু
ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করে। জেনিংস ( Jennings)-এর মতে সরকারি কর্তৃপক্ষ ব্যাপক স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করে। তাঁর ভাষায় “If we look around us we can not fail to be aware that public authorities do in fact possess wide discretionary power.”
ঙ. স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার পার্থক করেন নি : ডাইসি (Diecy) স্বৈরাচারী ক্ষমতা (Arbitrary power) ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary power )-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি। বাস্তবে সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা এক নয়। স্বৈরাচারী ক্ষমতা দায়িত্বহীন ও অনিয়ন্ত্রিত হয় । এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ সচরাচর হয়ে থাকে ।
চ. সমতা সম্পর্কিত ধারণা ভ্রান্ত : ডাইসির আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এ কথাটি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকদের মতে, ধনী ও গরিব আর্থিক কারণেই আইনের সাহায্য সমানভাবে পায় না। জেনিংস বলেছেন, সমতা বা সাম্য বলতে অধিকার ও কর্তব্যের সাম্য বোঝায়। কিন্তু এই অর্থে কোথাও সমতা নেই। জমিদার, গাড়ির চালক, শিশু, বিবাহিতা নারী, সুদখোর অথবা যারা বন্ধকী কারবার করে এদের বিশেষ বিশেষ অধিকার ও কর্তব্য আছে। আইনের দৃষ্টিতে তারা সকলে সমান নয়। একজন পুলিশ কর্মচারী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। এই ক্ষমতা একজন সাধারণ নাগরিকের নেই ।
ছ. আদালতের সিদ্ধান্ত নাগরিক অধিকারের উৎস-এ ধারণা সত্য নয় : ডাইসির আইনের অনুশাসনের তৃতীয় নীতি হলো নাগরিক অধিকারসমূহ আদালতের সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছে সাংবিধানিক আইনের দ্বারা নয়। কিন্তু এই ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। ব্রিটেনের এমন কতকগুলো বিধিবদ্ধ আইন রয়েছে যেগুলো বিধিবদ্ধ আইন থেকে উৎপন্ন এবং সেসব আইনের দ্বারাই সংরক্ষিত । উদাহরণস্বরূপ মহাসনদ, অধিকারের বিল, অধিকারের আবেদন পত্র, হেবিয়াস কর্পাস আইন প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায় ।
জ. ব্রিটেনের আইন নয় পার্লামেন্টই সার্বভৌম : ডাইসির মতে, সরকারি কর্তৃপক্ষ যাতে আইন প্রদত্ত ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে না পারে আদালত তা নিশ্চিত করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় আইন সার্বভৌম নয়। পার্লামেন্ট হলো সার্বভৌম। কোনো আইনের শাসন ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে নিরন্ত্রণ করতে পারে না। জেনিংস (Jennings) বলেছেন, “No rule of law can restrain parliament.” পার্লামেন্ট আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের ক্ষমতাকে প্রসারিত করতে পারে।
আইনের অনুশাসন সম্পর্কে উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও ডাইসির আইনের অনুশাসনের নীতি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা যায় না। ওয়েড এবং ফিলিপস (Wade and Philips ) প্রমুখ সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের অনুশাসনকে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে এখনও স্বীকার করা হয়। ব্রিটেনের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই নীতির অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে আইনের অনুশাসনের ধারণা প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই একটি সর্বজনীন নীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আইনের অনুশাসন