আইনসভার ভূমিকা বা কার্যাবলি Role or Functions of Legislature
সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি যেমন ব্যাপক তেমনি এর মর্যাদা ও গুরুত্বও সর্বাধিক। তবে সকল দেশে এবং সব ধরনের সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা একরকম হয় না। আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি সরকারের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। একনায়কতন্ত্রে বা অসীম রাজতন্ত্রে আইনসভার ভূমিকা নেহায়েতই নগণ্য। আবার আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বিধায় আইনসভা মূলত শাসন বিভাগের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা অপর দুই বিভাগের তুলনায় অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। বিশেষ করে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকাই মুখ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিম্নে আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. আইন প্রণয়ন : রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা আইনসভার প্রধান কাজ। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা শাসনকার্য পরিচালিত হয়। আইন বিভাগ সমাজ পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে আইন প্রণয়ন করে। আইন প্রণয়নের সময় আইনসভা জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, দেশের সংবিধানের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এবং জনমতের গতি প্রকৃতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে। আইনসভা কর্তৃক আইনের প্রস্তাবাবলি গৃহীত হলে অর্থাৎ বিলটি পাস হলে তা রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মতি সাপেক্ষে তা আইনে পরিণত হয়। তবে আইনসভা কেবলমাত্র নতুন আইন প্রণয়নই করে না, বরং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন আইন সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনও করে থাকে ।
২. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : আইনসভার প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন হলেও এর অন্যতম কাজ হলো শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শাসন বিভাগের লম্বা হাতকে গুটিয়ে দেয়া। অর্থাৎ, শাসন বিভাগের অগণতান্ত্রিক কাজে বাধা প্রদান করা। আইনসভায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, শাসন বিভাগের কাজের যৌক্তিকতা যাচাই করা, সন্ধি-চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে আইন বিভাগ শাসন বিভাগকে সর্বদা জাগ্রত রাখে। বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এক্ষেত্রে শাসন বিভাগ তার যাবতীয় কার্যাবলির জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে। কারণ আইনসভা নিন্দা প্রস্তাব, মূলতবি প্রস্তাব, বাজেট আলোচনা প্রভৃতির মাধ্যমে মন্ত্রিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জ্ঞাপন ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যে কারণে শাসন বিভাগ স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায়ও আইনসভা বিভিন্ন পদ্ধতিতে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি যে সমস্ত নিয়োগ প্রদান করে থাকেন, সে সমস্ত নিয়োগ মার্কিন সিনেটে অনুমোদিত হতে হয়। আবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি সন্ধি স্থাপন বা যুদ্ধ ঘোষণা করলে তা মার্কিন সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হতে হয় ।
৩. আলোচনামূলক কাজ : আইনসভার আলোচনমূলক কার্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমগ্র দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ ও মতামতকে আইনে প্রতিফলিত করার জন্য জনপ্রতিনিধিদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা করতে হয়। আকস্মিক ও অবিবেচনাপ্রসূত আইন যাতে পাস না হতে পারে সেজন্যও আলোচনামূলক কাজের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে আইনের উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ আইনসভার সদস্যরা পান । তাছাড়া স্বল্প সদস্য বিশিষ্ট আইনসভার স্থায়ী কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে আনীত বিলের ধারা উপধারাগুলো সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে
আলোচনা করতে পারে।
সাংবিধানিক আইন প্রণয়ন ও সংশোধন সংক্রান্ত কাজ : কোনো কোনো দেশের আইন পরিষদ সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তা গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি দীর্ঘ পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যে সংবিধান প্রদান করে তা পরবর্তীতে গণপরিষদ কর্তৃক পাস ও গৃহীত হয়। ‘পাশাপাশি আইনসভা সংবিধানের কোনো ধারা উপধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারে। আমাদের দেশর আইনসভায় সংবিধানের ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে।
অর্থ সংক্রান্ত কাজ : আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা জাতীয় অর্থের নিয়ন্ত্রক ও তদারকের ভূমিকা পালন করে থাকে। কর ধার্য, কর আদায় ও অর্থ ব্যয়ের জন্য আইনসভায় অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বলা হয়, ‘No taxation without representation’। আইনসভায় অনুমোদন ব্যতীত সরকারি অর্থ আদায় বা ব্যয় করা সম্ভব হয় না। প্রত্যেক অর্থ বছরের শুরুতে আইনসভার সদস্যগণ খাতওয়ারী অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি বা কমানোর সুপারিশ করতে পারেন। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এবং ভারতে Public Accounts Committee, Controller and Auditor General, Estimates Committee-এর মাধ্যমে আইনসভা সরকারি আয়-ব্যয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে। এভাবে অর্থের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আইনসভা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।
৬. বিচার সংক্রান্ত কাজ : আইনসভা কিছু কিছু বিচার সংক্রান্ত কাজও করে থাকে। রাজদ্রোহ, উৎকোচ গ্রহণ বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধ বা বিধি বহির্ভূত কাজের জন্য সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনসভা অভিসংশন (Impeachment) উত্থাপন করে। মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট সেদেশের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির অপসারণের আদালত হিসেবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের আইনসভাও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে। তাছাড়া আইনসভার সদস্যদের আচরণের বিচার, নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা প্রভৃতি আইনসভা করে থাকে। বৃটেনের লর্ডসভা সে দেশের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে কাজ করে।
৭. সরকারি নীতি নির্ধারণ : সরকারের প্রধান প্রধান নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে মন্ত্রিসভা বা কেবিনেট সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক হলেও আইনসভার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কেননা, আইনসভা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈদেশিক নীতি ইত্যাদি ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এ সকল নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভা মন্ত্রিপরিষদ, রাজনৈতিক দল, স্বার্থ গোষ্ঠী, জাতীয় ঐতিহ্য, সংবাদ মাধ্যম, জনমত প্রভৃতি উপাদান দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
৮. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা নির্বাচনি সংস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে । বাংলাদেশ ও ভারতের আইনসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যদিও একটি নির্বাচনী সংস্থার দ্বারা নির্বাচিত হয় তথাপি কোনো প্রার্থী যদি নির্বাচনি সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় তবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্য থেকে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভা একজনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। আর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত প্রথম দুজন উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থীর মধ্যে থেকে উচ্চ কক্ষ সিনেট একজনকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করেন। তাছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনসভাই স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করে থাকেন ।
৯. অনুসন্ধানমূলক কাজ : আইনসভা বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে সরকারের অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, ভূমি, উপজাতি ইত্যাদি বিষয়ের অনুসন্ধান রিপোর্ট তৈরি করে থাকে : বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে এ সকল বিষয়ে পার্লামেন্টারী কমিটি গঠনের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও এ ধরনের কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হ্যারল্ড জে. লাস্কী (H. J. Laski), “It is real function is to watch to the process of administration to safeguard the liberties of private citizens.”
২০. অন্যান্য ভূমিকা : আইনসভা এছাড়াও যে সমস্ত কার্য সম্পাদন করে সেগুলো হলো :
ক. অনেক সময় সরকার প্রদত্ত আদেশ, বিধিমালার বৈধতা দিয়ে থাকে আইনসভা।
খ. আইনসভায় জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিরোধ দূর করে থাকে ।
গ. আইনসভা কার্যপ্রণালি জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিকীকরণে প্রভাব বিস্তার করে।
ঘ. জাতীয় মতানৈক্য ও বিরোধ মীমাংসায় আইনসভা ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে ভোটাভুটির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অধ্যাপক বল (A. R. Ball)-এর মতানুসারে সাংবিধানিক কাঠামো, দলব্যবস্থার প্রকৃতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পার্থক্য, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের স্তরভেদ অনুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনসভার প্রকৃতি ও ভূমিকা নির্ধারিত হয়। অধ্যাপক বল আইনসভার ভূমিকা বা কার্যাবলিকে নিম্নোক্ত ছক অনুযায়ী বিভক্ত করেন : ‘
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি বহুমেরুকরণের দিকে এগিয়ে চলেছে। ফলে এর পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসন বিভাগে। যে কারণে শাসন বিভাগ আইন বিভাগকে উপেক্ষা করার প্রয়াস পাচ্ছে। সে কারণে সমালোচকরা শাসন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তথাপি বলা যায় যে, আইন বিভাগই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যেখানে জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। ফলে আইন বিভাগের উল্লিখিত কার্যাবলি বা ভূমিকা একটি দেশের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই আইন বিভাগকে একটি প্রয়োজনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ বিভাগ বলতে পারি ।