অলিখিত সংবিধান : অর্থ, সংজ্ঞা, ধারণা Unwritten Constitution: Meaning,

সাধারণত কোনো দেশের শাসন পরিচালনার মৌল নীতিগুলো যখন প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে তখন তাকে অলিখিত সংবিধান বলে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম-নীতিসমূহ কোনো দলিলে লিপিবদ্ধ না থেকে বরং বিভিন্ন প্রথা, লোকাচার, রীতিনীতি ও আদালতের রায় বা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত থাকে তাই অলিখিত সংবিধান। কাগজে-কলমে লিখিত না থাকলেও লিখিত সংবিধানের মতোই সরকার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ।

অধ্যাপক ফাইনার-এর মতে, “যেখানে আইন প্রণেতারা সংবিধানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেননি এবং এর ফলে সাংবিধানিক আইনকে অন্য প্রকার আইন থেকে পৃথক করা যায় না, তাকে অলিখিত সংবিধান বলে।”

ড. গার্নার-এর ভাষায়, “An unwritten constitution is one where major portion is not written, mostly it includes customs and decisions of the courts, such types of the constitution are not framed by any constituted assembly, Thus the constitution is not enacted but it is evolved.”

ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ভিত্তিতে অলিখিত সংবিধান গড়ে ওঠে। এরূপ সংবিধানের একমাত্র প্রচলিত উদাহরণ হচ্ছে গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান। মনীষী-এর মতে, “সংবিধান বলতে যদি লিখিত দলিলকে না বুঝিয়ে কোনো সংস্থাকে বুঝানো হয়, তবে বলতেই হবে যে ব্রিটিশ সংবিধানের উদ্ভব আপোষে হয়েছে, এর কোনো দলিল নেই । ”

অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of unwritten constitution) : অলিখিত সংবিধানের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় :

১. অলিখিত সংবিধান দলিল আকারে প্রকাশ করা যায় না ৷

২. প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, নজীর, আচার-আচরণ, আদালতের রায় ও ব্যাখ্যা প্রভৃতি হচ্ছে অলিখিত সংবিধানের উৎস। ৩. অলিখিত সংবিধান সংকলিত হয় না ।

৪. অলিখিত সংবিধান নির্দিষ্ট কোনো সংস্থা কর্তৃক রচিত হয় না।

৫. ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় এই সংবিধান বিকাশ লাভ করে ।

৬. অলিখিত সংবিধানের রচনাকাল নির্দিষ্ট করা যায় না ।

অলিখিত সংবিধানের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ Qualites/ Merits of Unwritten Constitution

অন্যান্য সংবিধানের ন্যায় অলিখিত সংবিধানের কতিপয় গুণাগুণ ও ত্রুটি রয়েছে। নিম্নে অলিখিত সংবিধানের গুণাগুণসমূহ তুলে ধরা হলো :

১. নমনীয়তা : নমনীয়তা অলিখিত সংবিধানের প্রধান গুণ হিসেবে বিবেচিত হয় বিধায় এ সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হয়। যে কারণে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল রেখে চলতে পারে। জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সাড়া দিয়ে সরকার সহজেই সংবিধানের সংশোধন করতে পারে।

২. সহজ সংশোধন পদ্ধতি : অলিখিত সংবিধান সংশোধনে সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। লিখিত সংবিধানের ন্যায় এ সংবিধান সংশোধনে জটিল কোনো পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন পড়ে না। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সমঝোতার ভিত্তিতে অলিখিত সংবিধানকে সাধারণ আইন পাসের অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করে সহজেই পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়।

৩. জনমতের প্রতিফলন : অলিখিত সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কেননা, এ ধরনের সংবিধান আইনগত বিচার- বিবেচনার পরিবর্তে দেশ ও দেশবাসীর প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে।

৪. জরুরি অবস্থার উপযোগি : অলিখিত সংবিধান সহজে সঙ্কটকালীন অবস্থার মোকাবিলা করতে পারে। নমনীয় হওয়ার কারণে সঙ্কটকালীন অবস্থায় অলিখিত সংবিধানের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যে কারণে এধরনের সংবিধানকে জরুরি অবস্থার উপযোগী বলে মনে করা হয়।

৫. সংস্কারমুখি : রাষ্ট্রের চাহিদা ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার করা যায়। তাই এটি সুপরিবর্তনীয় ও ক্রিয়াশীল সংবিধান ৷

৬. জাতীয় ঐক্যের সহায়ক : অলিখিত সংবিধান জাতীয় ঐক্যের সহায়ক। এ সংবিধান জনগণের প্রয়োজন মোতাবেক সংশোধন করা যায় বিধায় দেশের অভ্যন্তরে কখনো জটিলতা দেখা দিলে তা সহজেই পরিবর্তন করা যায়। এতে করে জটিলতা নিরসন হয় এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে ।

৭. বিদ্রোহ-বিপ্লব রোধ : অলিখিত সংবিধান বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যে কারণে এতে বিদ্রোহ-বিপ্লবের আশঙ্কা কম থাকে। ৮. ব্যবহারিক মূল্য : অলিখিত সংবিধান দেশের সার্বিক স্বার্থ ও ব্যবহারিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এর তাত্ত্বিক দিক অপেক্ষা ব্যবহারিক দিকটি অধিকতর উপযোগী ও প্রয়োগযোগ্য। যে কারণে এটিকে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে যুগোপযোগী করা যায় ।

৯. ঐতিহ্য সংরক্ষণ : অলিখিত সংবিধানে দেশের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটে। কাজেই এর মাধ্যমে প্রচলিত প্রথা, দেশাচার, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আদর্শ, বিশ্বাস, আইনগত সিদ্ধান্ত প্রভৃতি সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। আর এতে করে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাগুলোকে ভিত্তি করে অলিখিত সংবিধান সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে, যা জাতীয় ঐতিহ্য সৃষ্টিতে

অবদান রাখে ৷

০. আন্তঃবিভাগীয় বিরোধ নিষ্পত্তি : সংবিধান অলিখিত হলে সরকারের আন্তঃবিভাগীয় বিরোধ সহজে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় ।


অলিখিত সংবিধানের দোষ বা অসুবিধাসমূহ Disqualities/ Demerits of Unwritten Constitution


অলিখিত সংবিধানের সুবিধার পাশাপাশি কতিপয় অসুবিধাও বিদ্যমান। সমালোচকগণ এর কিছু ত্রুটিও চিহ্নিত করেছেন। অলিখিত সংবিধানের দোষ বা ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাসমূহ নিম্নরূপ :

১. অস্থায়ী : অলিখিত সংবিধান লিখিত না হওয়ায় তা অস্থায়ী। এটি সহজে সংশোধন ও পরিবর্তনশীল। যে কারণে অলিখিত সংবিধানে স্থায়িত্বের সমস্যা প্রকট।

  1. অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও অবোধগম্য : প্রচলিত বিধি, প্রথা, রীতিনীতি, আদর্শ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে অলিখিত সংবিধান গড়ে ওঠে। যে কারণে এটি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট এবং সহজে বোধগম্য নয়। তাই অলিখিত সংবিধান অনেকের কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে।

৩. বিচার বিভাগের প্রাধান্য বা দুর্বলতা : অলিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগ প্রাধান্য পেতে পারে আবার দুর্বলও হতে পারে। একদিকে সাধারণ ও সাংবিধানিক আইন একীভূত হয়। ফলে বিচার বিভাগ শক্তিশালী হয় ও রীতিনীতি প্রাধান্য পায় । অন্যদিকে, অলিখিত থাকায় বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে ও এর স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে।

৪. মৌল অধিকারের অনুপস্থিতি : অলিখিত সংবিধানে জনগণের মৌল অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ থাকে না। ফলে নাগরিক

চেতনাবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া এতে করে জনগণের অধিকার উপেক্ষিত হয় ও সরকার অন্যায় হস্তক্ষেপ করে।

৫. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অচল : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় অলিখিত সংবিধান অনুপযোগী। এতে কেন্দ্র, প্রদেশ বা রাজ্য সরকারের মধ্যে স্ব স্ব ক্ষমতা বণ্টিত না হওয়ায় কেন্দ্র সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে ।

৬. স্বৈরতন্ত্রের সহায়ক : অলিখিত সংবিধান স্বৈরশাসনের পথকে সুগম করে। শাসনতন্ত্র অলিখিত হওয়ায় জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে কোনো প্রকার সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না। ফলে সরকার নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিতে পারে।

৭. বিভাগীয় হস্তক্ষেপ : অলিখিত সংবিধানে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট থাকে না। ফলে সামান্য অজুহাতে সরকারের এক বিভাগ অন্য বিভাগের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করে।

৮. রাজনৈতিক সংকট : অলিখিত সংবিধান মাঝে মাঝে রাজনৈতিক সংকট ও অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধন করতে পারে। ফলে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়।

৯. সংশোধন জটিলতা : অলিখিত সংবিধানে সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা থাকে না। আর এই সুযোগে সরকারি দল তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধন করতে পারে। ফলে বিরোধী দলের সাথে কলহ-বিরোধ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।

১০. অন্যান্য অসুবিধা : এছাড়াও অলিখিত সংবিধান আরো যে সকল দোষে দুষ্ট সেগুলো হলো :

জনগণের রাজনৈতিক চেতনার অভাব;

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:

  • জনগণের আস্থাহীনতা;
  • শাসক-শাসিতের সম্পর্ক অস্পষ্ট;

বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত;

সংবিধান লঙ্ঘন ও কার্যকর করার অসুবিধা প্রভৃতি ।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, অলিখিত সংবিধানে দোষ-গুণ উভয়ই বিদ্যমান। যদিও বিশ্বে অলিখিত সংবিধান তেমন গুরুত্ব পায়নি। একমাত্র যুক্তরাজ্যের সংবিধানই অলিখিত। তবে একে কেন্দ্র করে বহু রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়েছে ৷ তাই অলিখিত সংবিধানেরও ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।

Leave a Reply