Site icon Honors Info

ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের গুরুত্ব

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Dictatorship

ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের গুরুত্ব ও উপযোগিতা

Importance and utility of the conventions

ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত। এই অলিখিত সংবিধানের বিধিগুলো অনেকাংশে প্রথাগত বিধানের উপর নির্ভরশীল। ব্রিটেনে সংবিধানের কার্যক্রম প্রথাগত বিধানকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। তাই ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় প্রথাগুলোর গুরুত্ব ও উপযোগিতা অপরিসীম। নিম্নে প্রথাগত বিধানের গুরুত্ব ও উপযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

ক. আইনের ফাঁক পূরণ : বাস্তব প্রয়োজন এবং সাংবিধানিক আইনের অপূর্ণতা পূরণে প্রথাগত বিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেন, “সাংবিধানিক প্রথাসমূহ আইনের শুষ্ক কাঠামোকে রক্ত মাংসের আবরণে আবৃত করে আইনগত সংবিধানকে কার্যকরী করে এবং পরিবর্তনশীল চিন্তাধারার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে।” (The short explanation of constitutional conventions is that they provide the flesh which clothes the dry bones of the law, make the legal constitution work, they keep in touch with the growth of ideas.)

খ. সংবিধানকে যুগোপযোগী করে : প্রথাগত বিধানগুলো ব্রিটেনের সংবিধানকে গতিশীল ও যুগোপযোগী করে তোলে। সাংবিধানিক বিধি-বিধানগুলো কার্যকর করতেও প্রথার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রথাগত বিধান না থাকলে কেবল আইনের দ্বারা একা সংবিধানকে কার্যকর রাখা সম্ভব হতো না। হার্ভে ও ব্যাথার ( Harvey and Bather) বলেছেন, “Conventions are the means by which the constitution is made adaptable. At new needs, so old conventions can be easily modified or fresh one developed, some may even be dropped.”

গ. বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি : সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। এই সহযোগিতার সম্পর্ক না থাকলে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে প্রথাগত বিধানগুলো সরকারি বিভাগসমূহের মধ্যে সহযোগিতা স্থাপনে সহায়তা করে। যেমন- রাজা বা রানীর স্বাক্ষর ছাড় কোনো বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। এই প্রথা না থাকলে রাজা বা রানীর স্বাক্ষর ছাড়াই পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত বিল আইনে পরিণত হতো ।

ঘ. রাজা বা রানীর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয় : প্রথাগত বিধান রাজা বা রানীর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়। ফলে রাজা প্রথাগত বিধানের বাইরে যেতে পারেন না। এর আওতার মধ্য থেকেই তিনি কাজ করেন। রাজা বা রানী কোনো বিলে ভেটো দিতে পারেন। কিন্তু তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত সকল বিলে সম্মতি দেন। কেননা ব্রিটেনের অন্যতম প্রথাগত বিধান হলো পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ কর্তৃক গৃহীত বিলে রাজা বা রানী সম্মতি দিতে বাধ্য।

  1. গণতন্ত্রের বিকাশ : ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ ধারায় প্রথাগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। প্রথাগত বিধানের কারণে রাজার হাত থেকে ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। ব্রিটেনে পার্লামেন্ট ও কেবিনেট গঠিত হয় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। অধ্যাপক ডাইসী (Diecy) বলেন, “Our code of constitutional morality secures, though in round about way, what is called abroad the sovereignty of parliament.”

চ. জনমতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : প্রথাগত বিধান জনমতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই ব্রিটেনের জনগণ প্রথাগত বিধানকে ভঙ্গ করতে চায় না। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমতের প্রাধান্য বিদ্যমান। আর এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় প্রথাগত বিধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কেবিনেট ও পার্লামেন্ট সংক্রান্ত প্রথাগত বিধানের ভিত্তিতে জনমতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের গুরুত্ব ও উপযোগিতা

 

ছ. শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় সাহায্য করে : প্রথাগত বিধান ব্রিটেনে শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় সাহায্য করে। ব্রিটেনের কেবিনেট শাসনব্যবস্থার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, তা সম্পূর্ণভাবে প্রথাগত বিধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সুতরাং প্রথাগত বিধান অনুযায়ী সব মন্ত্রী কমন্সসভার কাছে দায়ী থাকেন এবং কাথসভার আস্থা হারালে সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন।

জ. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেনের রাজা বা রানী চরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে রাজা বা রানীর পরিবর্তে পার্লমেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে প্রথাগত বিধানের সাহায্যে রাজশক্তির আইনগত ক্ষমতা খর্ব না করেও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।

ঝ. প্রথাগত বিধান আইনের সমতুল্য : ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রথাগত বিধানসমূহ আইনের মতোই মর্যাদা পেয়ে থাকে। আইন ভঙ্গ করলে প্রথাগত বিধানও ভঙ্গ করা হয়। এ কারণে ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের মর্যাদা বেশি। অধ্যাপক ডাইসী (Prof. Diecy)-র মতে, “Conventions are so intimately bound up with laws that former are violated it naturally leads to the violation of letter as well.”

ঞ. আইনে পরিণত হওয়ার প্রবণতা : প্রথাগত বিধান এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় যে, অনেক সময় সেগুলো বিধিবদ্ধ আইনে রূপান্তরিত হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ লর্ডসভা ও কমন্সসভার সম্পর্ক বিষয়ক প্রথাগত বিধানের ভিত্তিতে প্রণীত ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালের “পার্লামেন্ট আইন” (Parliamentary Acts) এর কথা বলা যেতে পারে।

ট. ব্রিটেনের মর্যাদা শক্তি বৃদ্ধি : প্রথাগত বিধানগুলোর জন্যই আজ কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ ব্রিটেনের মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়ে ব্রিটেনের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি স্বাধীন দেশ হলেও এগুলো ব্রিটিশ ডোমিনিয়নভুক্ত দেশ। এ সব দেশের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক প্রথাগত বিধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

ঠ. সংবিধানের চালিকা শক্তি : প্রথাগত বিধান সংবিধানের চালিকা শক্তি। প্রথাগত বিধান ঠিক করে দেয় কীভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। এডমান্ড বার্ক (Edmund Burke) বলেন, “আইনের বিধানসমূহ কীভাবে প্রয়োগ করা হবে তা সাংবিধানিক প্রথাসমূহের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এগুলো হলো সংবিধানের মূল চালিকা শক্তি।” (The conventions of the constitution determine the manner in which rules of law which they presuppose, are applied, so they are, in fact, the motive power of the constitution.)

ড. জনসমর্থন : প্রথাগত বিধানের পিছনে ব্রিটেনের জনগণের ব্যাপক জনসমর্থন বিদ্যমান। তাই এগুলো তাদের নিকট পবিত্র এবং অনুসরণীয়। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেন, মানুষ সাংবিধানিক প্রথাগুলোকে বাধ্যতামূলক এবং পবিত্ররূপে গণ্য করে । কারণ প্রথার অন্তর্নিহিত লক্ষ্যকে তারা স্বীকৃতি জানায়। (Men regard constitutional principles as binding and sacred, because they accept the ends they intended to secure).

 

সংবিধানের নমনীয়তা বজায় রাখে : সংবিধান একটি দেশের মৌলিক আইন। একটি বিশেষ সময়ে ও একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে রচিত সংবিধানের পক্ষে পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ অবস্থায় প্রথাগত বিধানের মাধ্যমে সংবিধানের প্রত্যাশিত নমনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব। প্রথাগত বিধানের কারণে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে ব্রিটিশ সংবিধান পরিবর্তন ও সংশোধন করা যায়।

ত. বিপ্লবের সম্ভাবনা দূরীকরণ : প্রথাগত বিধানসমূহ ব্রিটেনে একটি সুপরিবর্তনীয় শাসন-কাঠামো গড়ে তুলেছে। আইভর জেনিংস (Ivor Jennings)-এর মতে, পরিবর্তিত সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার সাথে সামস্য রক্ষা করে প্রথাগত বিধানসমূহ একটি সুপরিবর্তনীয় শাসন কাঠামো গড়ে তুলেছে। এর মানে ব্রিটেন রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

Exit mobile version