Site icon Honors Info

আইনসভার নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা

আইনসভার নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা Electoral Power of Lagislature

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা নির্বাচনি সংস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। নিম্নে এসম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলো 

১. রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইনসভা পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে নির্বাচিত করে থাকে। বিশেষ করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে থাকে। যেমন— বাংলাদেশ ও ভারতের আইনসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যদিও একটি নির্বাচনী সংস্থার দ্বারা নির্বাচিত হয় তথাপি কোনো প্রার্থী যদি নির্বাচনি সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় তবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে কংগ্রেসের

 নিম্নকক্ষ ‘প্রতনিধিসভা’ একজনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। আর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত প্রথম দুইজন উপ-রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর মধ্যে থেকে উচ্চ কক্ষ ‘সিনেট’ একজনকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করেন।

সরকার প্রধান নির্বাচন : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যে আস্থাভাজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে থাকেন।

৩. স্পীকার ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন : প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনসভা অধিবেশন পরিচালনার জন্য স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে থাকে ।

৪. কমিটি গঠন : আইনসভা বিভিন্ন স্থায়ী কমিটি ও বিশেষ কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন প্রদান করেন।

৫. সংরক্ষিত আসনের সদস্য নির্বাচন : কোনো কোনো দেশের আইনসভা সংরক্ষিত আসনের সদস্যদেরকে নির্বাচিত করে থাকে। যেমন— বাংলাদেশের আইনসভা নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনের সদস্যদেরকে নির্বাচিত করে থাকে।

আইনসভার অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা  Economic Power of Legislature

আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা জাতীয় অর্থের নিয়ন্ত্রক ও তদারকের ভূমিকা পালন করে থাকে। কর ধার্য, কর আদায় ও অর্থ ব্যয়ের জন্য আইনসভায় অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বলা হয়, ‘No taxation without representation’। ‘আইনসভায় অনুমোদন ব্যতীত সরকারি অর্থ আদায় বা ব্যয় করা সম্ভব হয় না। প্রত্যেক অর্থ বছরের শুরুতে আইনসভার সদস্যগণ খাতওয়ারী অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি বা কমানোর সুপারিশ করতে পারেন। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এবং ভারতে Public Accounts Committee, Comptroller and Auditor General, Estimates Committee-এর মাধ্যমে আইনসভা সরকারি আয়-ব্যয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে। এভাবে অর্থের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আইনসভা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।

আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণ  Causes of Decreasing the Power of Legislature

আইনসভা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা উদ্ভবের ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভার ক্ষমতা ও ভূমিকা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। গণতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক উভয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইসসহ অনেকে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের এই দিকটি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। নিয়ে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণ : সাম্প্রতিককালে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণের ফলে শাসন বিভাগের দায়িত্ব অনেক। বৃদ্ধি পেয়েছে। এরূপ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে আইনসভা ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারে না। যে কারণে শাসন বিভাগকেই এ সকল কাজের দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া সংসদীয় পদ্ধতিতে শাসন বিভাগই সরকারি নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এর ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন জীবনের গভীর সংযোগ সাধিত হয়। এভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডে আইনসভা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে শাসন বিভাগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে । ২. জরুরি অবস্থা ও সংকটকালীন প্রয়োজন : জরুরি বা সংকটকালীন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য আইনসভা শাসন বিভাগের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা অর্পণ করে। বিশ্বযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক ঠাণ্ডা লড়াই, নিত্যনতুন সংকট ও আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক ও বহিঃবাণিজ্যিক সমস্যা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলার দায়দায়িত্ব শাসন বিভাগকে গ্রহণ করতে হয়। কেননা, আইনসভায় বিভিন্ন আদর্শ ও চাপের প্রতিনিধিত্ব থাকায় ঐসব বিষয়ে আইনসভা খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ফলে এসব ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হয়, অনেকে শাসন বিভাগের এমনতর ক্ষমতা চর্চাকে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের সামিল বলে গণ্য করে ।

দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা : সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা মূলত সরকারে আজ্ঞাবহ সংস্থায় পরিণত হয়েছে। অনেকে সংসদকে “রাবার স্ট্যাম্প” (Rubber Stamp) বলে মন্তব্য করেছেন। সুগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা ইত্যাদির কারণে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। কেননা, আইনসভায় কোনো সদস্য দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিজ দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না বিধায় সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দলীয় সদস্যরা নিজ দলীয় মন্ত্রীদের মতামতকে সমর্থন করে থাকেন। তা না হলে দল থেকে বহিষ্কারের ভয় থাকে। তাছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার হুমকি দিয়ে সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এতে করে আইনসভা কার্যত নামসর্বস্ব সংস্থায় পরিণত হয়।

অর্ণিত আইন : অর্ণিত ক্ষমতা প্রসূত আইন আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ। আইনসভা সময়ের স্বল্পতা, জরুরি অবস্থাজনিত প্রয়োজন, আইনের নমনীয়তা, আইনসভার সদস্যদের বিশেষ জ্ঞানের অভাবজনিত কারণে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করে। শাসন বিভাগ এই ক্ষমতা বলে প্রয়োজনের সময় নতুন নতুন আইন জারি করে। এই ক্ষমতা বলে শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রণয়নকৃত আইনকে বলে অর্পিত ক্ষমতা প্রসুত আইন (Delegated Legislation)। এ ধরনের আইনের ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আইনবিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

৫. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা : আইনসভায় যে সকল আইন গৃহীত হয় সেগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার অধিকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা প্রণীত যে কোনো আইনকে সংবিধান বহির্ভূত বলে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। এতে আইনসভার মর্যাদা ও ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে।

৬. আইনসভার সদস্যদের অযোগ্যতা : আধুনিককালে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে আইনসভার সদস্যগণ জটিল কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে আইন প্রণয়নে অক্ষম। কিন্তু বর্তমানকালে আইন প্রণয়ন মূলত বিশেষজ্ঞদের কাজে পরিণত হয়েছে। এজন্য আইনসভার সদস্যগণ শুধুমাত্র আইনের মূলনীতি প্রণয়ন করে বিস্তৃত আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেন। এতে করে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পায়। তাছাড়া বর্তমানে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ নির্বাচনে যেতে চায় না বিধায় আইনসভায় সাধারণ ব্যক্তির সমাবেশ ঘটে। কিন্তু মন্ত্রীবর্গ তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও দক্ষ হওয়ায় শাসন বিভাগ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে।

৭. আইনসভার সদস্যদের মতদ্বৈততা/সংঘাত : বিভিন্ন মতদ্বৈততার কারণে আইন প্রণয়নের সময় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে ওঠে না বিধায় সমস্যার সমাধান করাও সম্ভব হয় না। তাদের মধ্যে বিভিন্ন অজুহাতে মতদ্বৈততা বা সংঘাত দেখা দেয়। ফলে ক্ষমতা আপনা আপনিই শাসন বিভাগের হাতে অর্পিত হয়। অনেক সময় আইনসভার সদস্যগণ নিজেদের দলীয় অবস্থান দৃঢ় করা, পরবর্তী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় মন্ত্রীদের কথামতো চলতে বাধ্য হন। এতে করে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ৷

 ৮. আইনসভার সদস্যদের স্বার্থপরতা : আইনসভার সদস্যগণ বর্তমান সময়ে শাসন বিভাগের কৃপায় বর্ধিত হারে বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ লাভ করেন। এজন্য তারা মন্ত্রিদের মন যুগিয়ে চলে। আইনসভার সদস্যগণ মনে করেন যে দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যারা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অবাধ্য হলে পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ সম্ভব নয়। ফলে আইনসভার সদস্যদের মধ্যে স্বার্থপরতা সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা মন্ত্রিদের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েন। এভাবে আইনসভার সদস্যদের উপর শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায় বিধায় আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পক্ষান্তরে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।

৯. শাসন বিভাগের নেতৃত্ব : শাসন বিভাগ আধুনিক সরকারের নেতৃত্ব প্রদান করে। শাসন বিভাগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রিগণ থাকেন, যারা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে থাকেন। আইন বিভাগ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই শাসন বিভাগের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলবৎ থাকায় কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণমুক্ত। তথাপি রাষ্ট্রপতিই সে দেশের জাতীয় সরকারের নেতৃত্ব প্রদান করে থাকে। এ সকল কারণ ও অবস্থা শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে।

১০. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে সমস্যা : আধুনিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে আর গতানুগতিক পদ্ধতিতে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। কারণ শাসন বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সাম্প্রতিক তথ্য আইনসভার নিকট নেই।

১১. আইনসভায় আলোচনার সুযোগের অভাব যদিও তত্ত্বগত বিচারে আইনসভায় সরকারের কর্মকাণ্ডের যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে সময় স্বল্পতার কারণে এ ধরনের আলোচনার সুযোগ খুবই কম। তাছাড়া দলীয় ব্যবস্থার ফলে সরকারি দলের সদস্যগণ আলোচনার এসব পন্থা ব্যবহার করতে পারেন না। আবার বিরোধীদলের সদস্যদেরকে বিভিন্ন কৌশলে আলোচনার সুযোগ হতে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি মার্কিন কংগ্রেসে পর্যন্ত আলোচনার অবাদ স্বাধীনতা নেই। এসব কারণে আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

১২. আইনসভার আলোচনার গুণগত মান হ্রাস। পূর্বে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি আইনসভার সদস্য হতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কিন্তু বর্তমানে দলীয় কঠোরতা ও অন্যান্য কারণে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ আইনসভার সদস্য হতে চান না। ফলে আইনসভার সদস্যদের গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। এডমন্ড বার্ক (Edmund Bark), মি. গ্রীন (Green), পর্ড হালডেন (Halden)-2 মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ নির্বাচনজনিত ঝামেলা, দলীয় নিয়ন্ত্রণ, একগুয়েমি ও অর্থহীন মানসিকতার জন্য আইনসভার সদস্য হতে চান না। এসব কারণে আইনসভার গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।

১৩. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অকার্যকারিতা : আইনসভার অনুমোদন ব্যতীত সরকার একটি পয়সাও আয়-ব্যয় করতে পারে না। কিন্তু এটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ সরকারি আয়-ব্যয়ের প্রস্তাব শাসন বিভাগের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়। সাধারণ সদস্যগণ অর্থ বিল ও বাজেট উত্থাপন করতে পারেন না। সংসদীয় সরকারের আইনসভা সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস করতে পারে কিছু বৃদ্ধি করতে পারে না। আবার বাজেট আলোচনায় যে সময় বরাদ্দ দেয়া হয় তা যথেষ্ট নয়। উপরভু আর্থিক বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারীও অনেক সদস্য নন। সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সকল বিশেষ কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে তাও যথেষ্ট নয়। তাছাড়া আইনসভার সদস্যগণ দলীয় নির্দেশ মেনে চলে বিধায় সরকার উত্থাপিত আর্থিক প্রস্তাব সহজেই পাস ও কার্যকর হয়।

১৪. অর্থনৈতিক সংকট বা দুরবস্থা : রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট বা দুরবস্থার কারণে শাসন বিভাগকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। এসব কর্মসূচি সম্পাদনের জন্য আইন বিভাগ শাসন বিভাগের হাতে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করে। এ ক্ষমতা শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করলেও আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে।

১৫. তথ্যের উৎসের পরিবর্তন : পূর্বে তথ্যের উৎস হিসেবে আইন বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকলেও বর্তমানে স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভবের ফলে তথ্যের উৎস হিসেবে আইনসভার তেমন আর গুরুত্ব নেই। আজকাল সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, উপগ্রহ তথ্যের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া, আধুনিক সরকারের জনসংযোগ দপ্তর নিয়মিত তথ্যাদি সরবরাহ করে থাকে। ফলে আইনসভার ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে।

১৬. গণসংযোগের অভাব : উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগই নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ সূত্রে শাসন বিভাগ নানাভাবে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অভাব-অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হয় । কিন্তু আইন বিভাগের এক্ষেত্রে করণীয় কিছুই নেই। এর ফলে শাসন বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পায়।

১৭. জনমত গঠনে ব্যর্থতা : জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানকালে আইনসভা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম তথা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি মাধ্যমগুলো জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যে কারণে আইনসভার মর্যাদাহানি ঘটে।

১৮. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব : রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজে অনেক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়,  যারা শ্রেণি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্য কথায় বলা যায়, সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করার এবং সরকারের সাথে জনসাধারণের সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে এ ধরনের গোষ্ঠীসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই সাথে আইনসভার মর্যাদাহানি ঘটেছে ।

 ১৯. সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে সামরিক বাহিনী  রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেণ করছে। ফলে নির্বাচিত আইনসভার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। কারণ সামরিক বাহিনী ইচ্ছেমতো দেশ পরিচালনা করে। সেখানে নির্বাচিত আইনসভার কোনো ভূমিকা থাকে না।

২০. জনগণের মনস্তত্ত্ব জনগণের মানসিকতা শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে। কেননা, আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি শাসন বিভাগই পরিচালনা করে। যে কারণে জনগণের দৃষ্টি শাসন বিভাগের

উপর পড়ে এবং জনগণ শাসন বিভাগকে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ বলে গণ্য করে। জনগণের এ ধরনের মানসিকতা আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে।

২১. মুগ্ধ বা যুদ্ধভীতি : যুদ্ধ বা যুদ্ধভীতি শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনা বা সেনা পরিচালনার জন্য শাসন বিভাগের হাতে প্রচুর ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এতে করে যুদ্ধকালীন সময়ে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। উপরভু রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। যে কারণে যুদ্ধকালীন সময়ে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ২২. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান পরিস্থিতি শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে। কেননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে মোকাবিলার জন্য শাসন বিভাগই নীতি নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আইনসভা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসন বিভাগের এ প্রাধান্যকে স্বীকার করে নেয়। যে কারণে ব্রিটিশ সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকে পরিণত হয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতিকরণ সাধিত হয়েছে বলে অনেকে

২৩. স্পিকারের ভূমিকা : আইনসভার সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি যদি নিরপেক্ষতার পরিচয় প্রদান না করেন তবে কখনো আইন পরিষদ সঠিক পথে চলবে না। তিনি নির্বাচিত হবার পরই নিরপেক্ষতার পরিচয় দান করবেন। স্পিকারের প্রতি সরকারি ও বিরোধীদলের সমান সমর্থন থাকতে হবে। স্পিকারও সরকারি ও বিরোধীদলকে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবেন। ড. হোরেস রিং কমন্সসভার স্পিকারের দায়িত্ব পালনকালে বলেন, “I now serve myself completely from all part politics. My own loyalty henceforth must be to no party, but to parliament itself.” জহুরলাল নেহেরুর কথায়, স্পিকার হাউজের প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু হাউজ জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। সেজন্য স্পিকার জাতির প্রতিনিধি ।

উপরিউক্ত আলোচনা পরবর্তীতে বলা যায় যে, কতগুলো কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। তবে একথাও সত্য যে, আইনসভার আস্থা হারালে শাসন বিভাগ তথা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। আইনসভার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন থাকলে সরকার বা শাসন বিভাগ আইনসভাকে উপেক্ষা করতে পারে না। যে কারণে সকল দেশের আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তা বলা যায় না। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভাসমূহ তাদের পূর্বের গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়েছে ।

Exit mobile version